প্রেয়সী পর্ব ৪৭

প্রেয়সী পর্ব ৪৭
নন্দিনী নীলা

মধু সমুদ্র কে দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে ছিল। ও স্বপ্নেও ভাবেনি নিচে এই অবস্থায় সমুদ্র কে দেখবে। তাদের আড্ডা হাসি দেখে মধুর কপাল বারবার কুঁচকে আসছিল। তাদের দূরে থেকে মনে হচ্ছে বন্ধু এটা কীভাবে সম্ভব। মধুর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল চরম বিষ্ময়। কি করবে ও বুঝে উঠতে পারছিল না।

ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে ছিল তিনজন মানুষের দিকে। মধুর মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। না এগিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে আর না এভাবে বসে থাকতে পারছে। ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছে সবাই ঘুরে ঘুরে ওর দিকে তাকাচ্ছে। অবশেষে সমুদ্র কে দেখল ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। মধু তখনো ওর দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। মধুর দৃষ্টি ভরা হাজার শো প্রশ্ন কিলবিল করছে। ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে ধরে ও উঠে দাঁড়াল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মধু কিছু বলার আগেই সমুদ্র বলে উঠল,,” জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর একটু পর পাবে।”
মধু চোখ ছোটো ছোটো করে সমুদ্র কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,,” আপনি এমন শেরোয়ানি পরে জামাই সাজে কেন?”

সমুদ্র উত্তর না দিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। মধুর হাসিটা কেন জানি একটুও পছন্দ হলো না। ও বাজখাঁই গলায় বলল,” আপনার আমাকে এখানে থেকে উদ্ধার করার কথা ছিল। আপনি কথা দিয়েছিলেন যেভাবেই হোক আমাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু আপনি সেসব কিছুই করছেন না উল্টো সেজে গুজে এসে বাপি আর ভাইয়ার সাথে আলাপ করছেন! এখন আবার হাসছেন?”

সমুদ্র মধুর মুখের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে মধু আবার বলল,,” হ্যাবলার মতো চেয়ে আছেন কেন? উত্তর দিন। আপনি কথা কেন রাখলেন না? আর বাপির সাথে কি কথা বললেন? উনারা তো আপনাদের উপর রেগে ছিলেন আপনিও। তাহলে কি এমন কথা বললেন। কারো মুখশ্রী দেখে তো রাগের ছিটেফোঁটা ও পেলাম না।”
সমুদ্র ওর কথা শুনে হাসছে। মধুর রাগে শরীর কেঁপে উঠল। সমুদ্র ওর কথাগুলো শুনছে না। বেয়াদব এর মতো হাসছে। মধু নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না দেখাতেও পারছে না। সমুদ্র এমন পাগলের মতো হাসছে কেন ও কি কৌতুক বলছে যে শুনে হাসবে?

লজ্জায় অপমানে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ‌র‌ইল মধু। ফুয়াদের কথা মনে করতে লাগল শুধু। ফুয়াদ ছাড়া কেউ ওকে বুঝে না। কোথায় আপনি ফুয়াদ এভাবে একা ফেলে কোথায় হারিয়ে গেলেন? মধুর গাল গড়িয়ে জল পরতে লাগল।
” আরে বোকা কাঁদছ কেন?” এতোক্ষণে কথা বলল সমুদ্র।
মধু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদছে।
সমুদ্র বলল,,” বিয়ের কনেকে কাঁদতে নেই। কেঁদো না প্লিজ।”
মধু বলল,,” মশকরা করছেন? আপনি কথা কেন রাখলেন না।”

” তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই তো এসেছি। আমি কথা রাখব টেনশন করো না।”
” কীভাবে নিয়ে যাবেন? বাপি ভাইয়া বুঝি নিজেই আপনার হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বলবেন ধরো নিয়ে যাও? আমি আপনাকে অনেক বার বলেছিলাম সাবধানে লুকিয়ে আসতে কিন্তু আপনি সবার সামনে এসে হাজির হয়েছেন।”
সমুদ্র ওর ভয় কাটাতে বলল,” তোমার বাপ ভাই নিজেই তোমাকে আমার হাতে তুলে দেবে। টেনশন নিও না।”

মধু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,” আপনি আমার সাথে কি মশকরা করছেন? একটু পর আমার বিয়ে আর এখন তারা আমাকে আপনার হাতে তুলে দেবে হাস্যকর থাক বলছেন?”
সমুদ্র বলল,,” হ্যা দেবে। তুমি নিশ্চিন্তে বসতে পারো।”
বলেই মধু কে রেখে সমুদ্র চলে গেল। মধু বসতে পারলে না। হাঁসফাঁস করতে লাগল। বর ক‌ই সাফিন কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন? এখনো এসে পৌঁছায় নি নাকি কিন্তু সবাই যে বলাবলি করছিল ব‌র চলে এসেছে। মধু উন্মাদের মতো দৃষ্টি এদিকে ওদিকে ঘুরাতে লাগল। আর সমুদ্র ওমন রহস্যময় কথা বলল কেন?

মধু হঠাৎ দূরে থেকে এগিয়ে আসতে দেখল খালামনি কে। খালামনিকে দেখতেই মধুর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। একটা আশার আলো জ্বলে উঠল দপ করেই যেন। মধুর খালামনি কাছে আসতেই মধু তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মধুর কাছে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সাবরিনা বেগমের সাথে কথা বলে। থপ করেই বসে পড়ল মধু।‌ সাবরিনা ওর কাঁধ ধরে বলল,,” সমুদ্র কে বিয়ে করে চলে যা এই নরক থেকে। এছাড়া আর কোন উপায় নাই। অনেক কষ্টে সমুদ্র তোর বাপ কে রাজি করিয়েছে।”

” আমি ফুয়াদ কে ভালোবাসি খালামনি। ফুয়াদ ছাড়া আমি অন্য কাউকে কীভাবে বিয়ে করতে পারি তাও ফুয়াদের‌ই বড় ভাইকে? তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো? আর সমুদ্র কীভাবে এটা করতে পারল। সে তো জানে ফুয়াদ আমাকে কতটা ভালোবাসে সব জেনেশুনে এমন একটা কাজ করতে পারল?”
অবিশ্বাস্য গলায় বলল মধু।
হঠাৎ মধুর চোখের সামনে সমুদ্রের ফোনের ওয়ালপেপার টা ভেসে উঠল। ও ঢোক গিলল। মনে মনে সমুদ্র এমনটাই চাইছিল না তো?

রাহী আপুর বিয়েতে সমুদ্রের ফোনের ওয়ালপেপার এ নিজের ছবি দেখার পর থেকে মধু সমুদ্রের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সমুদ্রের মনে যাই থাক সামনে কখনো প্রকাশ করেনি তাই মধু স্বস্তিতে ছিল। যে ফুয়াদের ব্যাপারটা সমুদ্র জানে তাই ও নিশ্চিন্তে ছিল ভাইয়ের ভালোবাসার দিকে উনি নজর দেবেন না। কিন্তু তবুও তার কাছাকাছি আসলে মধু অস্বস্তিতে পরত। কিছু সত্যি সামনে না আসায় ভালো। তা অজানা থাকাই শ্রেয়।

মধু এমন বাজে সত্যি জানার পর কখনো মুখে আনেনি আর না জেনেছে এমন ভাব করেছে। জানে না এমন ভাবেই ছিল। মধু সমুদ্রের বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারছে না। সমুদ্রের অনুভূতি আর এই বিয়ে সবটাই ওর কাছে নাটকীয় লাগছে। ফুয়াদ এই জটিল সময় ওর কাছে নেই। ও একা কীভাবে এসব সামলাবে? দুহাতে মাথা ধরে বসে র‌ইল। ওর মাথা ঘুরছে টেনশনে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে ওর কাছে।

সমুদ্রের ব্যাপার স্যাপার কিছুই মধুর ভালো লাগছেনা। প্রচন্ড সন্দেহজনক লাগছে। বিয়ে সময় ঘনিয়ে এল সমুদ্র আর মধু কে পাশাপাশি বসানো হলো। মধু গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে আছে। একবার ও সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছে না আর না কথা বলছে। সমুদ্র ওর পাশে বসে একটা দুইটা কথা বলেছে কি মধু উত্তর দেয়নি আর না তাকিয়েছে।

কাজী ওদের সামনে একটা কাগজ রাখল। তারপর দুজনকে সাইন করতে দিল। মধু আগুন গরম চোখে তাকাল কাগজের দিকে মন চাইছে চোখ দিয়ে আগুন বের করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে কাগজ টা। কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে দিল খুব তাড়াতাড়িই সমুদ্র। মধু সাইন করছে না হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে বসে আছে। মাহতিম হোসেন মেয়ের জেদ দেখে টেনে মেয়েকে নিয়ে দূরে সরে এল।

মধু নিজের বাবার দিকে চেয়ে কান্না গলায় বলল,,” সেই তো সমুদ্রের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছ তাহলে ফুয়াদ কে কেন মানতে চাও নি। আমি ফুয়াদ কে ভালোবাসি।”
” যে নাই তার কথা বলে লাভ কি বলো? ফুয়াদ আর বেঁচে নাই মরীচিকার পেছনে আমি তোমায় ছুটতে দেব না।”
” বাপি ফুয়াদের লাশ পাওয়া যায়নি। ওর কিচ্ছু হয়নি আমার বিশ্বাস। আমি তো তোমার সন্তান বাপি আমার প্রতি কি তোমার কোন ভালোবাসা নাই এইভাবে জোর করে আমাকে বিয়ে দিচ্ছ? আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো না। আমি আর এসব নিতে পারছি না হাঁপিয়ে গেছি।”

ঝরঝর করে কেঁদে উঠল। ওদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে সমুদ্র উঠে দাঁড়াল। ওদের অনুসরণ করে কাছে এসে দাঁড়াল দেখল মধু কাঁদছে।
মাহতিম হোসেন কে বলল মধুর সাথে ওর জরুরি কথা আছে। মাহতিম হোসেন চলে গেল। সমুদ্র মধু হাত ধরল। মধু কান্না থামিয়ে বিস্মিত নয়নে তাকাল সমুদ্রের দিকে তারপর চোখ মুখ লাল করে তাকাল হাতের দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,” হাত ছাড়ুন।”

সমুদ্র হাত না ছেড়ে ওকে টেনে হেঁচড়ে দূরত্বে নিয়ে হাত ছেড়ে দিল। মধু হাত ধরে বলল,,” কি হচ্ছে এসব?”
সমুদ্র ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকাল শান্ত চোখে মধুর মুখের দিকে। মধু চোখ মুখ শক্ত করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” প্লিজ মধু সিনক্রিয়েট না করে বিয়েটা করে নাও। তুমি তো বলেছিলে এই নরক যন্ত্রণা থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে।আমি তোমাকে সেটাই দেব। বিয়েটা শুধু নামেই হবে। বিয়ের পর তুমি মুক্ত পাখি হয়ে যাবে। তোমার বাবা ভাই কেউ আর তোমার উপর জোর জবরদস্তি করতে পারবে না।”

” আপনি কীভাবে বিয়ের কথা বলছেন লজ্জা করছে না ছিহ? আপনি জানেন আমি ফুয়াদ কে ভালোবাসি। ফুয়াদ আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সব জানার পর ও এই কথা বলতে লজ্জা করছে না। ছোটো ভাইয়ের ভালোবাসা কে নিজের ব‌উ করতে অনুরোধ করছেন।” ঘৃণায় মুখটা সরিয়ে নিল মধু।

সমুদ্র বলল,,,” না লজ্জা করছে না। লজ্জা তখন করত যখন আমি ফুয়াদের সামনে তোমাকে বিয়ে করতাম। কিন্তু আমি কি সেটা করতেছি? ফুয়াদ নাই। সবাই ধারণা করছে ও মারা গেছে। ফুয়াদ নাই আমি ওর ভালোবাসাকে রক্ষা করতে চাইছি তার জন্য যদি বিয়ে প্রয়োজন হয় তাই করব। তুমি হয়ত ভাবছ বিয়ে করলেই আমি তোমার উপর অধিকার ফলাতে আসব তাহলে ভুল ভাবছ আমি শুধু তোমাকে একটা সুন্দর লাইফ ও এখানে থেকে উদ্ধার করতেই এসব করছি। বিলিভ মি।”

মধু বলল,,” আপনাকে আমার খুব অপরিচিত লাগছে। যে আপনি ফুয়াদ বলতে পাগল ছিলেন আজ সেই আপনার চোখে আমি ফুয়াদের জন্য বিন্দু মাত্র ভালোবাসা দেখতেছি না। ও মারা গেছে কত নির্দ্বিধায় বলে দিলেন একটুও আপনার ঠোঁট কাঁপলো না। কতটা পাষাণ লাগছে আপনাকে। মনে হচ্ছে ফুয়াদ নাই তাতে আপনিই বেশি খুশি হয়েছেন।”

” লিমিট ক্রস করো না মধু। ফুয়াদ আমার আদরের ছোটো ভাই। ওকে আমি খুব ভালোবাসি ওর এই পরিণতির জন্য যথেষ্ঠ পরিমান কষ্ট পেয়েছি। ওকে খোঁজার সব রকম চেষ্টা করেছি কিন্তু পাই নি। বারংবার নিরাশ‌ হয়ে আমি এই কথা মানতে রাজি হয়েছি। ও আর বেঁচে নেই থাকলে ঠিক ফিরে আসত।”
মধু এই সমুদ্র কে চিনতে পারছে না। সমুদ্র তো ফুয়াদ কে কখনো নাম ধরে বলতো না সবসময় ছোটো বলতো আজ কেন নাম বলছে।

ওর সব কিছুই তালগোল পাকিয়ে গেছে।
সমুদ্র আবার বলল,” বিয়েটা না করলে কিন্তু এই বাসা থেকে বের হতে পারবে না তুমি। আমাকে বিয়ে না করলে হয়তো কালকেই আরেকজন ঠিক ধরে নিয়ে আসবে তোমার বাবা তাকে বিয়ে করতে হবে তার চেয়ে আমাকে বিয়ে করো।”
মধু চুপ করে সমুদ্রের কথা শুনছে। ও চোখ নামিয়ে ফুয়াদের দেওয়া আংটিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র ওর উত্তরের আসায় চেয়ে আছে ওর দিকে।

” মধু..!”
মধু দশমিনিট কোন কথা বলল না। তারপর মাথা তুলল ধীরে সুস্থে। তারপর বলল,,” ওকে আমি রাজি। কিন্তু এটা শুধু নামের বিয়েই হবে। আদতে আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি না। আর না আপনি আমাকে স্ত্রী রুপে চাইবেন না। কোন আশা রাখবেন না। বিয়েটা শুধু কাগজ কলমের হবে। ধর্মীয় ভাবে নয়। এই বাসা থেকে বের হ‌ওয়ার পর ই ভুলে যাবেন আমার বিয়ে হয়েছে আমিও ভুলে যাব। রাজি?”

প্রেয়সী পর্ব ৪৬

সমুদ্র বলল,,” হুম রাজি।”
মধু বলল,,” এবার বলেন বাবা ভাইয়ের সাথে আপনার এতো সক্ষতা হলো কি করে?”
” পরে বলি এখন চলো বিয়ের কার্যক্রম শেষ করি।”

মধু ব্যথিত শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল আর দুর্বল হাতেই সাইন করল। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন ফুয়াদ। আমি শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য আর এই বাসা থেকে বের হতেই এই সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছি আপনি আমাকে ভুলে বুঝেন না আশা রাখছি।

প্রেয়সী পর্ব ৪৮