প্রেয়সী পর্ব ৪৮ (১)

প্রেয়সী পর্ব ৪৮ (১)
নন্দিনী নীলা

থানায় যাওয়ার বদলে হসপিটালে আসতে হলো মধু ও সমুদ্র কে। সমুদ্র একটা রিকশার সাথে গাড়ি বাজিয়ে দিয়েছিল। নিজেরাও ব্যথা পেয়েছে আর রিকশা ওয়ালা ও গাড়ি থেকে পড়ে আহত হয়েছে। তাকে সমেত হসপিটালে আসতে হয়েছে। রিকশা চালক বেশি ব্যথা পেয়েছে ওরা দুজন তেমন আঘাত পায়নি। অল্প আঘাত পেয়েছে।

এক্সিডেন্ট এর পর থেকে সমুদ্র মধু কে সরি বলছে ওর কারণে কম হলেও ব্যথা তো পেয়েছে। মধু কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওর থানায় যাওয়া হলো না ও সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। সমুদ্র সরি বলছে বারবার মধু ইটস ওকে বলে মনে খারাপ করে আছে। দুই ঘন্টা হসপিটালে থাকতে হলো। ওদের বড়ো কোন সমস্যা না হলেও রিকশা চালক এর পায়ে গুরুতর জখম হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের খবর দেওয়া হয়েছে তারপর হসপিটালের বিল পরিশোধ করে ওরা বেরিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মধু মুখটা মলিন করে রাখছে দেখে সমুদ্র বলে,,” সরি মধু আমার জন্য তোমাকে ব্যথা পেতে হলো। কিন্তু বিলিভ মি আমি কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করি নি।”
মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” বাদ দেন। আমি যাই করতে চাই এভাবে গন্ডগোল হবেই।”
” তুমি কি এইভাবেই যেতে চাও থানায়? তাহলে বলো যাই‌। তোমার মলিন মুখ দেখতে একদম ভালো লাগছে না।”
মধু বলল,,” না অন্যদিন যাব। এখন ভালো লাগছে না!”

” সরি,কোথায় কোথায় আঘাত পেয়েছ ডক্টর কে ভালো করে দেখিয়েছ?”
মধু বলল,,” হুম। আর তেমন কিছু হয়নি আমার। এতো বার সরি বলার প্রয়োজন নাই।”
বাকি রাস্তা আর দুজনের কেউ কথা বলল না। বাসার সামনে এসে নেমে দাঁড়াল দুজনেই। মধু আর সমুদ্র বাসায় ভেতরে ঢুকল লক খুলে। ভেতরে ঢুকে দুজনেই চমকে উঠল। মধু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে সামনে বসে থাকা মানুষদের দিকে।

সমুদ্র নিজেও চমকে গেছে‌। বিস্মিত গলায় বলল,,” তোমরা এখানে কি করছো?”
সোফায় বসে আছেন সমুদ্রের বাবা, মা। তাদের দেখে মধু আর সমুদ্র দুজনেই ভয় আঁতকে গেছে। এখানে তাদের আশা করেনি ওরা। মধু সন্দেহ চোখে তাকাল সমুদ্রের দিকে। গতকাল যখন তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিল মধু তখন তো সমুদ্র খুব বলেছিল জানানো যাবে না। এখানে থাকলে সেভ ওরা। এখন কি হলো? উনারা এখানে কিভাবে এল।
সমুদ্র মধুর রাগী চোখে প্রশ্ন যেন সেকেন্ড এই ধরে ফেলল। মধুর দিকে চেয়ে নিচু স্বরে বলল,,” তুমি কি ভাবছ আমি উনাদের কল করে বাসায় এনেছি?”

মধু বলল,” হ্যা আমার এটাই মনে হচ্ছে। হ‌ওয়া টা কি স্বাভাবিক না? গতকাল এতো কথা বললেন আর আজকেই তারা চলে এল। এতোটা মিরাকেল হয় বুঝি। আপনি আমাকে কিছুই বুঝাতে পারবেন না।”
সমুদ্র কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। এদিকে মধু ওর উপর রাগ ঝাড়ছে ওদিকে মা বাবা এমন ভাবে ওর দিকে চেয়ে আছে কি করবে আল্লাহ তাআলা জানেন।

সমুদ্র মধু কে বলল,,” তুমি রুমে যাও আমি কথা বলছি।”
” আমি রুমে কেন যাব! আমি এখানেই থাকব।”
” আচ্ছা থাকো। তোমাকে বাজে কথা বলতে পারে তাই রুমে যেতে বলেছিলাম। সেসব শুনলে শুধু কষ্ট‌ই পাবে।”
মধু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইল। সমুদ্র বাবা মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই ওর মা নাফিসা বেগম উঠে ঠাস করেই সমুদ্রের গালে থাপ্পড় মেরে দিল। সমুদ্র হতবুদ্ধি চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাকে কখনো এতোটা রাগতে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তাও ওর উপর।

নাফিসা বেগম চিৎকার করতে বললেন,,” এতো দিন ফুয়াদ এই মেয়ের পেছনে ঘুরে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আর আজ আমার ছেলেটা নিখোঁজ যেই মেয়ের জন্য। আর এখন তুমি সেই মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছ? বুঝতে পারছ না এই মেয়ে একটা অলক্ষি ওর জন্য আমার ছেলে নাই। আর তুমিও ওই মেয়ের ফাঁদে পড়েছ?

সবসময় তুমি নিজের মতো চলেছ কেউ তোমার স্বাধীনতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আমি দাঁড়াতে দেই নি। আর আজ সেই তুমি আমাকে এই কষ্ট দিলে? কি দেখছ তোমার দুই ভাই ওর মেয়ের মধ্যে যে আমার দুই ছেলেই এক মেয়েতে পাগল হয়ে উঠেছে। একজন তো তার জন্য আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আরেক তুমি তাকে বিয়ে করে নিলে?”

সমুদ্র কথা বলার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না মা যে খুব রেগে আছে। আর কষ্ট ও কম পায়নি। মধু জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উনারা কিভাবে জানল ওদের বিয়ে হয়েছে? সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মধুর দিকে তাকালেন অবশেষে নাফিসা বেগম।
” এদিকে আসো”

মধু ভয়ে আতকে উঠল। কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে আবার থাপ্পড় দিয়ে না বসে।
ঢোক গিলে মুখটা ফ্যাকাসে করে তাকিয়ে আছে মধু। সমুদ্র মায়ের দিকে চেয়ে বলল,,” আম্মু ওকে কিছু বলো না। এখানে ওর কোন দোষ নেই। বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি একাই নিয়েছিলাম। আর আমাদের বিয়েটা শুধু মাত্র মধু কে ওই বাসায় থেকে বের করে আনার জন্য হয়েছে। আমরা দুজনের কেউ ই এই বিয়ে মানি না।”
নাফিসা বেগম বললেন,,” বিয়ে নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে?”

” না আম্মু তুমি বুঝতে পারছ না।”
” আমি কিছুই বুঝতে চাইছি না। এখনি আমাদের সাথে তোমরা বাসায় ফিরে যাবে।”
সমুদ্র অনেক বলেও তাদের মানাতে পারল না। আর মানিয়ে কি হবে তাদের অজানা রাখার জন্য এখানে থাকার কথা বলেছিল কিন্তু তারাই যেহেতু জেনে গেছে আর এখানে থেকে কি হবে? মধু হতবিহ্বল হতে শুধু কর্মকাণ্ড গুলো দেখল। সমুদ্রের সামনে নাফিসা আন্টি ওকে কিছু বলতে না পারলেও তার চোখে মুখে ওর জন্য ঘৃণা দেখেছে মধু।

যেটা ওর জন্য খুব যন্ত্রণাদায়ক।
এ বাসায় ফিরে এসে মধু মুখোমুখি হলো তিন্নির। তিন্নি কে পেয়েই ওকে জড়িয়ে ধরল। বাসায় মিতুল ও ছিল। ও তিন্নি কে জড়িয়ে ধরেই ছিল। দু’জনে অনেক কথাই বলছিল। সেখানে উপস্থিত হয় মিতুল। তার চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে যেন। মধু জানে সেই খুশির কারণ।

” হাই মধু! অভিনন্দন তোমার নতুন জীবন ও সংসার এর জন্য।”
মধু দাঁতে দাঁত চেপে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতুল আবার বলে,,” আমি তো প্রথম থেকেই তোমাকে আর সমুদ্র কে কল্পনা করতাম। দুজন কে দারুন মানিয়েছিল। তোমরা একদম পারফেক্ট জুটি যাকে বলে। মাঝে তুমি ভুল ঠিকানায় চলে গিয়েছিলে। তোমার সাথে ফুয়াদের না মানিয়ে ছিল আর না থাক সেসব কথা। আমি জানি আমার ফুয়াদ বেঁচে আছে। এবার রাস্তা ও ক্লিয়ার। আলহামদুলিল্লাহ।”

মধু গমগমে গলায় বলল,,” এতো খুশি হবেন না আপু। পরে আবার দুঃখ টা সহ্য করতে পারবেন না।”
মিতুল বলল,,” মানে কি বলতে চাইছ তুমি? ফুয়াদ ফিরে এসে ভাইয়ের বউ এর দিকে হাত বাড়াবে নাকি?”
” দেখুন এক কথা বারবার বলবেন না। আমি কারো ভাইয়ের ব‌উ না। আমি ফুয়াদের ফিয়ান্সে এটাই সত্যি। বাকি সব মিথ্যে।”

মিতুল ওর কথা শুনে ব্যঙ্গ করে হেসে বলল,,” হাসালে মধু। তুমি তোমার চিন্তা নিয়ে থাকো। কিন্তু মনে রেখো ফুয়াদ কে তুমি হারিয়েছ। ফুয়াদ এখন শুধুই আমার।”
এই মুহূর্তে মধু একটা সাহসী কাজ করে বসল। পাশের ফুলদানি ছিল সেটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে চিৎকার করে উঠল।
ওর এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে মিতুল সহ তিন্নি ও চমকে উঠল। তিন্নি তারাতাড়ি মধুর হাত ধরে ওকে বলল,,” কি করছিস থাম।”

তিন্নি অবাক হয়ে মধুর রাগ দেখল কখনো মধু কে এমন রাগতে দেখে নি। তিন্নি মধু কে টেনে নিজের রুমে এনে দরজা আটকে দিল। মধুকে শান্ত হতে বলে জোর করে বিছানায় বসিয়ে পানি দিল।
” তুই এতো রাগতে পারিস জানতাম না তো। পানি না ঠান্ডা হ। ওর কথা শুনে এতো রাগার কি আছে?”
মধু পানি খেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল।

” কি হলো কাঁদছিস কেন?”
” সত্যি ফুয়াদ আমাকে দূরে সরিয়ে দিবে?”
” ভাইয়া কে পাওয়া যাচ্ছে না অনেকে বলাবলি করতে ভাইয়া আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমরা পরিবারের মানুষেরা আশায় আছি ভাইয়া বেঁচে আছে। আর ঠিক ফিরে আসবে। ভাইয়া যাতে সুস্থ থাকে আর আমাদের কাছে ফিরে আসে সেই প্রার্থনা কর না মধু। এসব নিয়ে মাথা গরম না করে।”
মধু নিশ্চুপ চোখের পানি ফেলতে লাগল।

তিন্নি আবার বলল,,” সমুদ্র ভাইয়া এমন একটা কাজ করবে আমরা কেউ জানতাম না। ফুয়াদ ভাইয়া তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে সেখানে ভাইয়া এসব জানলে কি হবে আমি জানি না।”
মধু বলল,,”বিশ্বাস কর আমি বিয়ে করতে চাইনি। এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলাম না করেও উপায় ছিল না। আমি নিজেও কল্পনা করিনি সমুদ্র ভাইয়া এই পন্থা কাজে লাগিয়ে আমাকে উদ্ধার করার কথা ভেবেছেন।”

প্রেয়সী পর্ব ৪৭

” থাক বাদ দে। চোখের পাড় তো কালো করে ফেলছিস‌। ঘুমাস না রাতে। এখন একটু ঘুমা এসব না ভেবে।”
তিন্নি মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

প্রেয়সী পর্ব ৪৮(২)