প্রেয়সী পর্ব ৪৮ (২)

প্রেয়সী পর্ব ৪৮ (২)
নন্দিনী নীলা

চিত্রা ভাবি এসে বসে আছে মধুর পাশে। মধু আগেও অনেকদিন ছিল বাসায় থেকেছে চিত্রা ভাবি কখনো ওর সাথে তেমন আলাপ করতে আসেনি। তাই তাকে এমন আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতে দেখে ওর কপাল কুঁচকে এল। তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ায় ওর চোখে ঘুম নেমে এসেছিল। উঠে ফ্রেশ হয়ে বসতেই চিত্রা ভাবি এসে বসেছে বিছানায়। তিন্নি রুমে নাই। বাইরে কোথাও হতে পারে।‌ মধু প্রশ্নবিন্দু চোখে চেয়ে আছে চিত্রা ভাবির দিকে।

তিনি মিষ্টি করে হেসে বলল,,” কেমন আছো তুমি?’
মধু বলল,,” ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাবি?”
” এইতো ভালোই। তুমি তো আমার জা হয়ে গেলে। কিন্তু ভেবেছিলাম হলে তুমি ফুয়াদ দেবর এর ব‌উ হবে। সমুদ্র দেবর এর ব‌উ হবে অপ্রত্যাশিত ছিল।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধু দুই হাত শক্ত করে মুঠো করে মাথা নিচু করে আছে। সবার এক কথা শুনে ওর কান জ্বালা পালা হয়ে যাচ্ছে। ও যেই বিয়েটা গোপন রাখতে চেয়েছিল‌ আজ সবটাই সবাই জানে। ওর চোখ টলমল করে উঠল। বারবার সমুদ্রের ব‌উ কথাটা শুনতেও ওর বুকে তীরের মতো বিঁধছে। শব্দ করে না কাঁদলে ও ওর চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যেকোনো সময় কেঁদে উঠবে। কান্না আটকাতে মধু ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। চিত্রা ওর মুখে দিকে চেয়েই তা উপলব্ধি করতে পারল যেন।
চিত্রা মধুর হাত ধরে বলল,,” একটা কথা বলবে মধু?”

মধু চিত্রার দিকে তাকাতে পারছে না। উপরে তাকালেই যেন ওর চোখ এলিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে। ও চাইছে না চোখের নোনা জল আর কাউকে দেখাতে। ও চিত্রার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। তারপর চোখ মুখ ঠলে লাল করে ফেলল। পাঁচ মিনিট পর চোখ মেলে তাকাল চিত্রার দিকে।
চিত্রা ওর অবস্থা দেখে বলল,,” আমি কি পরে আসব? তোমাকে অস্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে এখন একা থাকা প্রয়োজন।”

মধু বলল,,” না বলুন।”
চিত্রা বলল,,” আর ইউ শিউর?”
” হুম। আমি ঠিক আছি।”
চিত্রা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,,” সমুদ্র কি তোমায় ভালোবাসে?”
মধু থমকে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর এ ও কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। ওর ভেতরটা ভীতু হয়ে উঠল সেকেন্ড এ।
” কি হলো মধু কিছু বলছো না যে?”
মধু থতমত খেয়ে বলল,,” আপনি এমন প্রশ্ন করছেন কেন?”

চিত্রা বলল,,” বলছি কারণ যে ছেলে এতো কাল এতো কিছুর পর ও বিয়েতে রাজি হয় নি। তাকে শত চেষ্টা করেও বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি কেউ। আজ সেই ছেলে নিজে থেকে তোমাকে বিয়ে করেছে। এটা কি আদো পসিবল তুমি বলো।”
” এই বিয়েটা শুধু মাত্র আমাকে সেভ করার জন্য করেছে। আমাদের মধ্যে কোন ভালোবাসা বাসির সম্পর্ক নাই। আমি শুধুই ফুয়াদ কে ভালোবাসি‌‌ আর এটা সমুদ্র ভাইয়া ও জানে। তিনি আমাকে শুধু বাঁচিয়েছেন। আর কিছুই না।”

এক দমে কথাটা বলেই থামল। চিত্রা আরো কিছুক্ষণ অন্য কথা বলে চলে যান।
মধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবল উনি হঠাৎ এক্সটা ভাবে এসব জিজ্ঞেস করল কেন? কথা বলার সময় ওনার চোখ মুখ কেমন জানি একটা লেগেছে মধু কাছে যার ব্যাখ্যা ওর জানা নাই।

মধু রুমে থেকে বেরিয়ে ফুয়াদের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। বুক কাঁপছে ওর ও এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দরজা খুলতে হাত বাড়িয়েছে তখনি একটা হাত ওর হাত চেপে ধরে। ও চমকে উঠে তাকায় হাতের মালিকের দিকে। দেখে নাফিসা আন্টি দাঁড়িয়ে আছে ওর হাত ধরে। ভয়ে মধুর মুখ সাদা হয়ে উঠে। ও মাথা নিচু করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে।
নাফিসা বেগম বলেন,” তুমি এখানে কি করছো?”

মধু কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে কাঁপতে থাকে। নাফিসা বেগম মধুকে অভদ্রের মতো কথার উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে তার কপাল কুঁচকে আসে।
” কি হলো বেয়াদব এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথার উত্তর না দিয়ে?”
মধু বলে,,” সরি আন্টি।”

” কিসের সরি, বলো ফুয়াদের রুমের সামনে তুমি কী করছিলে?”
রাগে নাফিসা বেগম এর কন্ঠ উচ্চ হয়ে উঠল। মধু ভয়ে কান্না করে দিল। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগল। সমুদ্র নিচে যাচ্ছিল। তখনি এই দিকটা নজরে আসে। মায়ের হাতে মধুর এক হাত। মধু কাঁদছে চোখের জল ফেলছে আর মা কিছু বলছে রাগী মুখ করে।
সমুদ্র তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দাঁড়ায় দুজনের কাছে।

” আম্মু কি হয়েছে? মধু কাঁদছে কেন?” উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে সমুদ্র।
নাফিসা বেগম রাগে ফেটে পরেন ছেলের উপস্থিতি পেয়ে। রাগে গমগমে গলায় বলতে লাগলেন,,” দুই দিন ও হয় নাই ব‌উ এনেই মায়ের কাছে কৈফিয়ত চাইছিস? তোর ব‌উ কে কি আমি কষ মেরেছি যে এমন রাগে চিৎকার করে কথা বলেছিস আমার সাথে।”

বলতে বলতে তিনি মধুর হাত ছেড়ে দিলেন। মধুর হাত ঝিম ধরে আছে। এতো শক্ত করে ধরেছিল যে হাত লাল হয়ে গেছে। মধু হাত ঠলে মা ছেলের মাঝখানে থেকে কেটে পরে।

সমুদ্র বলে,,” এসব কি বলছো আম্মু। আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছি। তাও মধু কে কাঁদতে দেখে। আমি কখন বললাম তুমি মধুকে মেরেছ?”
” সরাসরি মুখে না বললেও তোর বলার ধরনে তাই প্রকাশ পেয়েছে।” নাফিসা বেগম এর কন্ঠ নরম হয়ে এল।
সমুদ্র মায়ের নরম কন্ঠ শুনে গলে বলল,,” সরি আম্মু আমি আসলে মধুকে কাঁদতে দেখে উত্তেজিত হয়ে পরেছিলাম। তোমাকে কষ্ট দিলে ক্ষমা করে দাও।”

নাফিসা বেগম ন্যাকা কান্না করে বলল,,” তোর ব‌উ আমার ফুয়াদের রুমের সামনে এসে দাড়িয়ে ছিল কেন? তাই আমি ধমক দিয়েছি। ওকে আমার ফুয়াদের রুমের কাছে ঘষতে মানা করবি। অলক্ষি একটা ওর জন্য আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি। তুই ও ওর থেকে দূরে থাকবি। নাহলে ও তোকে ও আমার কোল ছাড়া করবে।”
” উফফ আম্মু এখানে মধুর কি দোষ বলোতো। তুমি অযথাই ওকে ভুল বুঝে আছো।”
“না আমি ঠিকিই বুঝেছি তোরা দুই ভাই বুঝলি না।”

সমুদ্র হতাশ হয়ে মাকে বুঝানোর বৃথা চেষ্টা বাদ দিল।‌ তাকে সান্ত্বনা দিতে তার সাথেই তার রুমে গেল।
মিতুল মধুর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। মধু নিচে নেমে ফাহাদের মুখোমুখি হলো। ফাহাদ ওকে দেখেই এক চিৎকার দিল। সকালে যখন এসেছে ফাহাদ ছিল না। এখন ফাহাদ ওকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছে। ফাহাদের চেঁচানো শুনে আনিতা বেগম এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে আবার চলে যায়।
মধুর দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বলে,,” মৌমাছি তুমি? আমার তো বিলিভ হচ্ছে। তুমি কীভাবে?”

” কেমন আছো ফাহাদ?”
” ভালো না। ভাইয়া কে পাওয়া যাচ্ছে না।”
মন খারাপ করে বলল ফাহাদ।
” তুমি কেমন আছো?” বলল ফাহাদ। মধু উত্তর না দিয়ে সোফায় বসল। মিতুল ও সোফায় বসে ছিল। ফাহাদ কে ডেকে বলল,,” ফাহাদ মধু তোমার ভাবি হয়ে গেছে জানো?”

ফাহাদ বলল,,” জানি, মৌমাছি আমার ভাবি। তোমার বলতে হবে না।”
মিতুল ব্যঙ্গ করে হেসে বলল,” তোমার জানায় ভুল আছে ফাহাদ।”
ফাহাদ কপাল কুঁচকে বলল,,” কি ভুল আছে?”

” তুমি তো মধুকে ফুয়াদের ব‌উ ভাবছিলে। কিন্তু মধু তো সমুদ্র কে বিয়ে করে আসছে। এখন তোমার সমুদ্র ভাইয়ের ব‌উ মধু।”
” মজা করবে না আমার সাথে।” কপট রাগ দেখিয়ে বলল ফাহাদ।
মিতুল বলল,,” আমার কথা তোমার বিলিভ হচ্ছে না ফাহাদ?”
” না সমুদ্র ভাইয়া কেন মৌমাছি কে বিয়ে করতে যাবে। তুমি বললেই আমার বিশ্বাস করতে হবে নাকি!”

মধু নিরব হয়ে দুজনের তর্ক শুনছে। মিতুল ঠাস করেই মধুর দিকে তাকিয়ে ওকে ডেকে বলল,,” মধু তুমি কিছু বলো। ফাহাদ তো আমার কথা বিলিভ ই করছে না। ওরা সবাই ভাবে আমি মিথ্যাবাদী।”
মধু অবাক স্বরে বলল,,” আমি কি বলব? ফাহাদ তো ঠিকি বলেছে আমার সাথে সমুদ্র ভাইয়ার বিয়ে কেন হবে?”
মিতুল বলল,,” মধু মিথ্যা বলছো কেন?”

” আমি কি মিথ্যা বললাম। যেই বিয়ে আমি মানিই না সেটা কেন সারাদিন জাহির করে সবাইকে বলত হবে। তার জন্য তো আপনি আছেন আপু।”
মিতুল রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছে মধুর খোঁচা দেওয়া কথা শুনে। ফাহাদ কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে না পেরে মধুকে জিজ্ঞেস করল।
মধু বলল,,” তুমি রুমে যাও ফ্রেশ হ‌ও ফাহাদ‌। একাই জানতে পারবে।”
ফাহাদ নিজের রুমে চলে গেল। তিন্নি মধু কে প্লেট এ করে খাবার এনে দিল। মিতুল ভেংচি কেটে চলে গেল।

” খেয়ে নে।”
” আমার খিদে নেই।”
” দেখ লাঞ্চের টাইম অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। তুই ক্লান্ত তাই ডাকি নি। এখন অন্তত মানা করিস না। খেয়ে নে।”
” আমার খেতে ইচ্ছে করে না।”
” না খেয়ে অসুস্থ হলে কি ভাইয়া চলে আসবে?”
” জানি না।”
” তাহলে কেন না খেয়ে থাকবি? খেয়ে নে।”

জোর করেই মধু কে খেতে বসালো তিন্নি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশি খাওয়া যায় না। মধু ও বেশি খেতে পারল না।
কারো ফিসফিস আওয়াজ কানে আসতেই মধ্য রাতে মধুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে ও ড্রিম লাইটের আলোয় কারো ফিসফিস আওয়াজ আসছে শোনার চেষ্টা করল। ও হাত বারিয়ে দেখল পাশে তিন্নি নাই। ও বিছানায় একা শুয়ে আছে। মধু ধরফরিয়ে উঠে বসল। তিন্নি কোথায় গেল? ফোনে চেক করল দুইটা বাজে এই সময় তিন্নি কোথায়? ওয়াশরুমের লাইট ও অফ তাহলে ও এখনো ফিসফিস আওয়াজ পাচ্ছে। ফ্লোরে পা রেখে মধু উঠে দাঁড়াল। ফিসফিসানি আওয়াজ আসছে বেলকনিতে থেকে অবশেষে ধরতে পারল। তিন্নি কি বেলকনিতে থেকে কারো সাথে কথা বলছে? কিন্তু কার সাথে এতো রাতে কথা বলছে?

মধুর মনে অজানা উঁকি দিল প্রশ্নটা ও পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বেলকনিতে। বাইরের জোছনার আলোয় বেলকনি দিনের মতোই আলোকিত আর রোমাঞ্চিত হয়ে আছে। তিন্নি খুব সাবধানে ফিসফিস করে কথা বলছে কারো সাথে। কি কথা‌ বলছে বুঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা এতো আস্তে কথা শিখল কবে? ভাবছে মধু।
“তিন্নি এতো রাতে কার সাথে কথা বলছিস?”

তিন্নি ফোন ফেলে মৃদু চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে ওর চোখ মুখ আতংকিত হয়ে উঠেছে। যা লক্ষ্য করল মধু।
মধু ওর মুখেও ফ্লোরে পরে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিচু হয়ে ফোন ধরতে যাবে। তিন্নি ছো মেরে ফোন নিয়ে নেয়। তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,,” তুই ঘুমাস নি?”

” ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু তোর কথায় উঠে গেছি! বললি না কার সাথে কথা‌ বলছিলি লুকিয়ে?”
” ওই আসলে একটা রং নাম্বারে থেকে কল আসছিল। তাই কে হ্যান ত্যান জিজ্ঞেস করছিলাম!”
মধু কথাটা বিলিভ করতে পারল না। রং নাম্বার থেকে কল আসলে কেউ এমন মনের সুখে বেলকনিতে বসে রষের আলাপ করে?

” তুই আমাকে মিথ্যা বলছিস তিন্নি। আমার থেকে ও কথা লুকিয়ে রাখিস?”
তিন্নি মধুর কথা শুনে বলল,,” বিশ্বাস কর আমি সত্যি বলছি। আমি চিনি না কে ছেলেটা কয়েকদিন ধরেই কল দিচ্ছে। পরিচয় দিচ্ছে না।”

প্রেয়সী পর্ব ৪৮(১)

” অপরিচিত একজন কল দিচ্ছে তোকে পরিচয় ও দিচ্ছে না তাহলে কয়েকদিন ধরে তাকে সহ্য করছিস কেন তুই? ব্লক না করে কথা বলছিস রাত জেগে?”
তিন্নি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মধু নিজেও বুঝতে পারছে না তিন্নি কি লুকাচ্ছে ওর থেকে।

প্রেয়সী পর্ব ৪৯