বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৯

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৯
জাওয়াদ জামী

কায়েসরা ফ্রেশ হয়ে আসলে সবাই মিলে খেতে বসল। আজ ‘ কুঞ্জছায়া ‘ লোকে লোকারণ্য। আফরোজা নাজনীনের মুখ থেকে হাসি সরছেনা। কুহুও থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে।

” বুঝলে সিনিয়র, তোমার কপাল আর আমার কপাল এক সুতোয় গাঁথা। দু’জনের দাদার বাড়িও একটা। আবার দু’জনের শ্বশুর বাড়িও একটা। অবশ্য পার্থক্য একটু আছে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাদের মেয়ের বাড়িতে এসেছে কতকিছু নিয়ে, নতুন জামাইকে দেখতে তার শ্যালক-শালিকা এসেছে । কিন্তু তোমার বাড়িতে, তোমাকে দেখতে কেউই আসেনি। দুঃখ করোনা সিনিয়র, দিনতো সবার সব সময় সমান যায়না। আমাদের ভাগ থেকে সবকিছুই তোমাকে একটু একটু করে দেয়া হবে। ” তাহমিদের কথা শুনে দৃষ্টি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আফরোজা, ঐ বেয়াদবকে বলে দাও, শুধু ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আসেনি। আমার শ্যালক ও তার পরিবারও এসেছে। ওর ভাগের কোন কিছু আমাকে খেতে হবেনা। আমার ভাগেরটাই আমি খাব। আমাকে নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবেনা।”
” এই যে শ্বশুরমশাই? সত্যি করে বল, তুমি কি এসব আমার জন্য এনেছ নাকি সিনিয়র ভদ্রলোকের জন্য এনেছ? ”

কায়েস পরল মহাবিপদে। সে যদি তাহমিদের পক্ষ নেয়, তবে তার দুলাভাইকে অপমান করা হবে। আবার যদি দুলাভাইয়ের পক্ষ নেয়, তবে মেয়ে-জামাইকে ছোট করা হবে। আবার যদি একসাথে দুজনেরই পক্ষ নেয়, তবে তাহমিদ নিশ্চয়ই বলবে পিঠ বাঁচাতে সে এরূপ করছে। মাঝেমাঝে কায়েস ভেবে পায়না এই ছেলেটাই কেন ওর মেয়েকে পছন্দ করল। নির্ঘাত এই ছেলের মাথায় প্রবলেম আছে। হয়তো ডাক্তারি পড়তে যেয়ে এমনটা হয়েছে।

” কি ব্যাপার শ্বশুরমশাই, তুমি এমন সাইলেন্ট মোডে চলে গেলে কেন! তোমার রিয়্যাক্ট বাটন কি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে? নাকি ব্যাটারি ডাউন? ”
এবার দৃষ্টি হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে ওর চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছে। সেই সাথে প্রচন্ড বিষম লেগেছে।
কুহু কটমটিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকটার জন্য বারবার ওকে লজ্জায় পরতে হয়।
খাবার টেবিলে বসা বাকি সবার নজর দৃষ্টির দিকে। মেয়েটার ভালোই সমস্যা হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে কথা বলল,

” এই যে দুলাভাই রূপি ভাইয়া, এগুলোর কিছু তোমার জন্য, আবার কিছু ফুপার জন্যও নিয়ে আসা হয়েছে। তোমার পছন্দ আর ফুপার পছন্দ তো এক নয়। তাই তোমাদের দুজনের খাবারও আলাদাভাবেই নিয়ে আসা হয়েছে। তাই কোন তর্কে না জড়িয়ে চিল করে খাও। ”

আনান এতক্ষণ তামাশা দেখছিল। ও যতই তাহমিদকে দেখে, ততই শিওর হয়ে যায়, এই ডক্টর পা’গ’ল। তা নাহলে একটা সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ এসব কথা বলতে পারে!
খাওয়া শেষ করে আনান শিহাবকে নিয়ে ওদের বাসায় যায়। ওদের জন্য নিয়ে আসা জিনিসপত্র আনানকে দিয়েই পাঠিয়ে দেয় আফরোজা নাজনীন। সেই সাথে শাহনাজ পারভীনকে পরিবারসহ ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য় আসার কথা বলে দেন।
তাহমিদ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। দৃষ্টির জোড়াজুড়িতে ও তারাতারি বাসায় আসতে রাজি হয়।

শিউলি একে একে সবাইকে তাদের জন্য নিয়ে আসা পোশাকগুলো দেয়। শিউলি নীরা ও তার মেয়ের জন্যও পোশাক কিনেছে। ও কুহুর কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল নীরা ঢাকাতেই আছে।
শিউলির এরূপ পরিবর্তন দেখে আফরোজা নাজনীন বেশ খুশি হলেন। তিনি তো এমনটাই চেয়েছিলেন। তার ভাই পরিবার নিয়ে সুখে থাকবে। শিউলি কুহুকে মেয়ের আসনে বসাবে। আজ আফরোজা নাজনীন তার আব্বা-আম্মাকে ভিষন মিস করছেন। তাদের সুখি পরিবার তার আব্বা-আম্মা দেখে যেতে পারলনা। আঁচলের কোনে চোখের পানি মুছলেন আফরোজা নাজনীন।

সারাদিন কুহু, দৃষ্টি, সিক্তা, নীরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করে কাটায়।
বিকেলে শাহনাজ সুলতানা আরোশীকে নিয়ে ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য় এসেছেন।
আফরোজা নাজনীন তার মেজো বোনকে ফোন দিয়েছেন। তিনি চাচ্ছেন নাজমা পারভিনও ঢাকায় এসে সবার সাথে আনন্দ করুক।

নাজমা পারভিন জানিয়েছেন, তিনি দুই-একদিনেই ঢাকা আসবেন।
আফরোজা নাজনীন এরপর নীরার বাবা-মা, ভাই-বোনের কাছে ফোন দিয়ে তাদের সবাইকে আসতে বললেন। তারা জানিয়েছেন সুযোগ পেলে তারা অবশ্যই আসবেন।

নীরা বড়মার কাজে খুব খুশি হয়। ও ভাবতেও পারেনি, বড়মা তাদের বোনদের আনন্দের মধ্যে ওর বাবা-মা, ভাই-বোনদেরও সামিল করবে। এজন্যই তাওহীদ সব সময় বলে, তার বড়মা ম্যাজিশিয়ান। তিনি যাদু জানেন। নিমেষেই কারও মন ভালো করে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে।

দুইদিন সবাই আনন্দ-হৈহুল্লোড় করে কাটায়। তৃতীয় দিন নাজমা পারভিন তার পরিবারসহ ঢাকায় আসলেন। তাহমিদও তিনদিন ছুটি নিয়েছে। এই তিনদিন ও পরিবারকে সময় দেবে। কুহুর ভাই-বোনদের নিয়ে এদিকসেদিক ঘুরাঘুরি করবে।
” কি রে পেঁচী, তুই একা একা ছাদে কি করছিস? সবাই নিচে আড্ডা দিচ্ছে, কিন্তু তুই ছাদে কেন। তা-ও এই সন্ধ্যায়। ”
দৃষ্টি সন্ধ্যার আকাশের লালিমা দেখে চোখ জুড়াচ্ছিল। এমন সময় সেখানে নিহানের আগমন। নিহানের গলায় এমন কিছু ছিল যা দৃষ্টির বুকের ভিতর কাঁপন ধরায়।

” আকাশ দেখছিলাম। সন্ধ্যায় আকাশের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেরে যায়। আজকের আকাশটা যেন আরও সুন্দর। যেন টুকটুকে বধূ। ” দৃষ্টি এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
” আমিতো আকাশে কোন বধূ দেখছিনা। শুধু দেখছি টুকটুকে এক বধূ ধরনীর বুকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে আকাশ দেখছে। তবে বলি কি, এভাবে মুগ্ধ নয়নে আকাশ না দেখে, সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকেও তো দেখা যেতে পারে? সে তোর কাছে অনেক কিছু আশা করে। ”

” সামনে মানুষটিকে দেখার কি আছে! হ্যাংলা-পাতলা, শ্যামবর্নের মানুষটার মধ্যে নতুন কিছু খুঁজে পাইনা তো। যে শুধু আমাকে বকাঝকা করার সুযোগ খোঁজে। ”
” আচ্ছা! তুই শুধু বকা খাওয়ার কাজ করিস, তাই আমি বকা দেই। ভালোবাসা পাওয়ার কোন কাজ কখনো করেছিস, যে তোকে ভালোবাসব? ভালোবাসা পেতে হলে আগে ভালোবাসতে হয়। তুই আমাকে ভালোবেসে দেখ, আমিও তোকে ভালোবাসা রিটার্ন দেব। চাই নাকি তোর আমার ভালোবাসা? ” নিহান ঠোঁট কা’ম’ড়ে, বাম ভ্রু উঁচিয়ে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।

” তোমার ভালোবাসা পেতে আমার বয়েই গেছে। আমার জন্য কত ছেলে পা’গ’ল তুমি সেটা জানো? কত ছেলেকে আমি আঙুলে নাচাই, সেই ধারনা তোমার আছে? ” দৃষ্টি দুষ্টুমি করে বলল। এরপর সে আবার তাকালো আকাশের দিকে।
দৃষ্টির কথা শুনে নিহান রে’গে অ’গ্নি’শ’র্মা হয়ে যায়। এই মেয়ের কতবড় সাহস, নিজের প্রেমের ফিরিস্তি দেয়! উথাল-পাথাল রা’গ এসে জমা হয় নিহানের সমস্ত শরীরে। এক ঝটকায় ও দৃষ্টিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। রা’গে’র চোটে দৃষ্টির কাঁধের ওড়না সরিয়ে কুটুস করে কা’ম’ড় বসিয়ে দেয়।

” তুই শুধু আমার। খবরদার যদি কখনো শুনেছি অন্য কাউকে পাত্তা দিচ্ছিস, তবে সেদিনই তোকে দুনিয়া ছাড়তে হবে। আর আঙ্গুলে নাচানোর কথা বলছিস? মনে কর একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলি তোর দুই হাতের একটা আঙুলও নেই। তবে কেমন হবে? তাই আগে থেকেই সাবধান হয়ে যা। আমি নিহান দেখতে যতটাই সহজসরল হইনা কেন, আদতে কিন্তু আমি তার বিপরীত। ”

নিহানের কথা শুনে দৃষ্টির বুক শুকিয়ে যায়। ওর পানি পিপাসা পেয়েছে। এদিকে কা’ম’ড়ে’র জায়গায় ভিষন জ্বলছে। ও কল্পনাই করতে পারেনি নিহান এমন করতে পারে। নিহানের রা’গ সম্পর্কে ওর কোন ধারনাই ছিলনা।
” রা’ক্ষ’স একটা। এইভাবে কেউ কা’ম’ড়া’য়? ক্ষুধা লাগলে আমাকে বলতে পারতে। ফুপুর কাছ থেকে কয়েকটা আখ এনে দিতাম। মনে সুখে কা’ম’ড়া’তে। ” দৃষ্টি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল।

” এই একদম চুপ। একটা কথা বলবিনা। আর একটা কথা বলবি তো কানের নিচে তবলা বাজাব। কথা বলার সময় হুঁশ থাকেনা, কি বলছিস? তোর জন্মই হয়েছে এই নিহানের জন্য। খবরদার মনে অন্যকারো চিন্তা আনবিনা। তোর শয়নেস্বপনে শুধু নিহানই থাকবে। তোর দিন শুরু হবে নিহানের কথা ভেবে, তোর রাত আসবে নিহানকেই চিন্তা করে। কানে ভালোভাবে ঢুকিয়ে রাখ আমার কথা। মনে থাকবে? ”
দৃষ্টি নিশ্চুপ।

” কি রে কথা বলছিস না কেন? শুনতে পাচ্ছিসনা আমার কথা? জবাব দে। ”
নিহানের ধমকে দৃষ্টির প্রান যায় যায়। দুচোখে টলমল করছে পানি। শুধু গড়িয়ে পরার অপেক্ষা। আজ পর্যন্ত ওকে কেউ এইভাবে ধমকায়নি। দৃষ্টি অনেক কষ্টে নিজের কান্না সংবরণ করে মুখ খুলল।
” মনে থাকবে। আমার সব মনে থাকবে। শুধু তুমি আমাকে আর বোকোনা। আমার কষ্ট হয়। ”

নিহান ধীরেসুস্থে দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরল। দৃষ্টির ললাটে ওর কালচে অধর ছোঁয়াল। নিহানের এমন স্পর্শে দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। শরীরে আন্দোলিত হতে থাকে সুখের ঝর্ণাধারা। অবশেষে ওর শ্যামপুরুষ নিজের মনে কথা বলেই দিল।
আনান, সিক্তার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু খ’চ্চ’র মেয়েটা সবার সাথে গল্প করলেও, ওর দিকে নজরই দিচ্ছেনা। আনান বুঝতে পারছে সিক্তা ইচ্ছে করেই এমনটা করছে।

” আনান মিঞা, চোরের মত এদিকসেদিক উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? কোন কিছু চুরি করার ধান্দায় আছিস নাকি? সেই বস্তুটা কি জীব নাকি জড়? ” তাহমিদ আনানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
আনান পেছনে তাকিয়ে দেখল তাহমিদ কালো ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে অ্যাশ কালারের টি-শার্ট। ফর্সা চেহারায় অ্যাশ কালারের টি-শার্ট ওকে বেশ মানিয়েছে।

মাঝেমধ্যে ভাবে একটা ছেলেকে কেন এত সুন্দর হতে হবে! ঈশ্বর জগতের সব সৌন্দর্য নারীদের মাঝে ঢেলে দিলনা কেন? পুরুষরা হবে শ্যামলা চেহারার, বলিষ্ঠ হবে তাদের গড়ন। আর নারীরা হবে কোমলমতী, পুরুষের মুখের প্রেমময় বাক্য শুনলেই মাখনের মত গলে যাবে। কিন্তু আনানের কাছে মনে হয় জগতের তিন ভাগের এক ভাগ নারীই হচ্ছে সিক্তার মত খ’চ্চ’র। যারা প্রেমিককে পাত্তাই দেয়না। আচ্ছা ও যদি তাহমিদের মত সুন্দর হত তবে কি সিক্তা ওকে একটু বেশি ভালোবাসত? কুহু যেমন তাহমিদকে ভালোবাসে। তেমন করেই কি সিক্তাও আনানকে ভালোবাসত? কথাটা মনে আসতেই আনানের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। ও কেন তাহমিদের মত সুন্দর হলোনা?

” কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি? চোখের সামনে জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু তুই মৌনব্রত পালন করছিস কেন? ” তাহমিদ সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল।
” ভাই, আমি মেয়ে হলে নির্ঘাত তোমার প্রেমে পরতাম। তোমাকে প্রপোজ করতাম। দিনে তিনটা করে ফুল তোমার রুমে রেখে আসতাম। কেন যে মেয়ে হলামনা। ”

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৮

আনানের এমন লাগামহীন কথায় তাহমিদ বেশ অপ্রস্তুত হয়।
” বাই এনি চান্স, তুই কি গে? তাহলে আমার বোনকে পাওয়ার আশা বাদ দে। কোন অসুস্থ মস্তিষ্কের ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেবনা। ” তাহমিদ তড়িঘড়ি করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
এদিকে আনান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তাহমিদের যাওয়ার পানে। ও কি এমন বলল, যে ভাই এভাবে রিয়্যাক্ট করল! লোকটা আসলেই পা’গ’ল।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪০