বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪০

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪০
জাওয়াদ জামী

দুই বোনের বাড়িতে সাতদিন কাটিয়ে কায়েসরা গ্রামে ফিরে গেল। এই সাতটা দিন ওদের জীবনের সবচেয়ে মধুর দিন ছিল। শিউলি ভাবতেই পারেনি ননদরা ওকে এতটা ভালোবাসবে। ওকে ভাইয়ের বউ কম বোনের চোখে দেখবে। জীবনে কখনো এত প্রাচুর্য দেখেনি শিউলি। তাই ননদদের বাড়ি তাদের বিলাসবহুল জীবন যতই দেখেছে, ততই অবাক হয়েছে।
কুহুকেও মন থেকে মেনে নিয়েছে। মেয়েটা সুখে আছে দেখে ওর মনটা ভরে গেছে। তাহমিদ যে জামাই হিসেবে অত্যন্ত ভালো সেই বিষয়ে ওর আর কোন সন্দেহ নেই।

দৃষ্টির কাছে সাতটা দিন ছিল স্বপ্নের মত। ও ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেয়েছে। নিহান কথা দিয়েছে মাস্টার্স শেষ করেই ও বাসায় দৃষ্টির কথা জানাবে। তবে দৃষ্টির মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে নাজমা পারভিনেরও বোধহয় দৃষ্টিকে পছন্দ। মেজো ফুপু যেন ওকে চোখে হারায়। এতদিন ফুপুদের থেকে দূরে থাকা দৃষ্টি কখনো ভাবেনি, জীবন দাদার বাড়িতে আসতে পারবে আর না পাবে ফুপুদের দেখতে। জীবনটা আসলেই যে সুন্দর এতদিনে সেটা বুঝতে পারছে দৃষ্টি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাতদিন বেশ আনন্দেই কেটেছে কুহুর। ওর সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে, শিউলি আক্তার ওকে মেনে নিয়েছে। এত বছর পর ছোটমা ওকে ভালোবেসে বুকে জরিয়ে নিয়েছে। আবার যাবার সময় তার গোছানো টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকাও কুহুকে দিয়েছে। কুহু অনেকদিন গ্রামে যায়না, তাই ছোটমা তাহমিদকে রাজি করিয়েছে কুহুকে নিয়ে গ্রামে যেতে। তাহমিদও কথা দিয়েছে দুইমাস পর ও কুহুকে নিয়ে গ্রামে যাবে। এবং সেখানে বেশ কয়েকদিন থাকবে।

নাজমা পারভিন খুব করে চেয়েছিলেন কায়েস স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তাদের সাথে চিটাগং যাক। কিন্তু কায়েস রাজি হয়নি। সে তার ব্যবসা রেখে দীর্ঘদিন কোথাও থাকতে পারবেনা। এমনিতেই ঢাকায় সাতদিন কাটিয়েছে। তবে কায়েস বোনকে কথা দিয়েছে সময় করে সে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিটাগং যাবে। ভাইয়ের প্রতিশ্রুতিতে নাজমা পারভিন বেশ খুশি হয়েছেন।
বোনকে ছেড়ে আসতে দৃষ্টির খুব খারাপ লেগেছে। বেশি খারাপ লেগেছে নিহানের জন্য। আবার কবে নিহানের সাথে ওর দেখা হবে, তার কোন ঠিক নেই।

শিহাবতো আসার সময় কেঁদেই ফেলেছে। কুহুকে ও সবথেকে বেশি ভালোবাসে। কতদিন পর ও আপুকে দেখল। আবার কবে দেখবে তার কোন ঠিক নেই। তাই শিহাবের কান্না কিছুতেই থামছেনা।

‘ কুঞ্জছায়া ‘ র ড্রয়িং রুম থেকে কোলাহল ভেসে আসছে। তাহমিদের কলিগরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের হাসিঠাট্টার আওয়াজে সেখানে টেকা দায়। কুহু এত কোলাহল পছন্দ করেনা। তাই ও কাজের অযুহাতে রান্নাঘরে এসেছে। ফুপুকে নাস্তা তৈরির কাজে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ওর চোখ বারবার ড্রয়িংরুমেই যাচ্ছে। বিশেষ করে তাহমিদের দিকে। ও যেই সোফায় বসে আছে, সেখানে ওর পাশে একটা মেয়ে বসেছে। মেয়েটাকে মারাত্মক সুন্দরী বললেও ভুল হবেনা। সেই মেয়েটা কথায় কথায় তাহমিদের গায়ে ঢলে পরছে। সে কখনো তাহমিদের চুলে আঙুল চালাচ্ছে, কখনোবা হাত ধরছে আবার কখনো জড়িয়ে ধরছে। তাহমিদ এসবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেনা।

এসব দেখে কুহুর মন খারাপ হয়ে গেছে। ওর শুধু মনে হচ্ছে কেন তাহমিদ মেয়েটাকে কিছু বলছেনা। এক পর্যায়ে কুহুর ভিষণ রা’গ হয়। ও আর ড্রয়িংরুম মুখো হয়না। পরে কুহু জানতে পারে মেয়েটির নাম, সিলভি।
রাতে তাহমিদ রুমে এসে দেখল কুহু ঘুমিয়ে গেছে। বিষয়টি তাহমিদকে অবাক করে।

যে কুহু আগে কখনোই তাহমিদের আগে ঘুমায়নি, সেই কুহু আজ তাহমিদকে রেখেই ঘুমিয়ে গেছে! তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে কুহুকে জড়িয়ে ধরে শোয়।
এদিকে কুহু এখনও ঘুমায়নি। ও ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। তাহমিদকে জড়িয়ে ধরতে দেখে রা’গে কুহুর শরীর শক্ত হয়ে যায়। বিষয়টি আবিষ্কার করতে ধূর্ত তাহমিদের বেগ পেতে হয়না। ও এক ঝটকায় কুহুকে নিজের দিকে ফেরায়।
” বউ কি কোন কারনে আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে? কারনটা না বলেই উল্টো হয়ে শুয়ে থাকলেই হবে? কি কারনে রা’গ হয়েছে ফটাফট বলে ফেল। ” তাহমিদের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

এবার তাহমিদের টনক নড়ল। যে মেয়ে কখনোই সহসা ভেঙে পরেনা, সেই মেয়ে হঠাৎ এভাবে কাঁদছে কেন!
” বউ, তোমার কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? প্লিজ আমাকে বল। আমি কি তোমাকে নিজের অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? আমার সোনা বউ কেঁদোনা। একটিবার বল তোমার কি হয়েছে? ” ব্যাগ্র কন্ঠে তাহমিদ জানতে চায়।
” আপনি আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন? আমিতো দেখতে সুন্দরী নই। কোনদিকেই আমি আপনার সমকক্ষ আমি নই। তবুও কেন আমাকে বিয়ে করলেন? ” কুহু ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

” কুহু, ভালোবাসা কি চেহারা কিংবা যোগ্যতা দেখে হয়? ভালোবাসতে সুন্দর একটা মন লাগে। রুপ দেখে যদি ভালোবাসা হত, তবে পৃথিবীর কোন অসুন্দরী নারী কখনোই কারো ভালোবাসা পেতনা। একটা কথা মনে রেখ, নারী মাত্রই সুন্দর। কিন্তু তাই বলে সব নারীকেই কি একজন পুরুষ ভালোবাসতে পারে? হ্যাঁ, হয়তোবা ভালোবাসে কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে নয়। কখনো মা রূপি নারীকে পুরুষ ভালোবাসে, কখনো বোন রূপে। পুরুষ সম্পর্কভেদে ভালোবাসা প্রকাশ করে মাত্র। এইযে যেমন তুমি আমার কাছে আমার হৃদয়েশ্বরী। তেমনি সিক্তা আমার বোন। তোমাদের দুজনের জন্য আমার ভালোবাসা দু রকম। তোমাকে কেন বিয়ে করেছি, সেটা বোঝাতে পেরেছি? ”

” আর আপনার কলিগ সিলভির প্রতি আপনার ভালোবাসা কেমন? ”
কুহুর এমন প্রশ্নে তাহমিদ বেশ অবাক হয়। কুহু হঠাৎ ওদের দু’জনের মধ্যে সিলভিকে টানল কেন? তবে তাহমিদ বুঝতে পারে, বিষয়টাকে এখানেই শেষ করা উচিত। এটাকে বাড়তে দিলে ওদের দাম্পত্য সুখের হবেনা।
” কুহু, সিলভি আমার স্কুল কলেজের ফ্রেন্ড। আবার একসাথে মেডিকেলেও পড়েছি। ওকে আমি ছোটবেলা থেকেই বন্ধুর নজরেই দেখি। একজন বন্ধুর প্রতি, আরেকজন বন্ধুর যে ভালোবাসা থাকা দরকার, সিলভির প্রতি আমার ভালোবাসা সেরকমই। তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ ,বউ? ”

” ও আপনার শরীরে ওমনভাবে ঢলে পরছিল কেন? আপনাদের চুলে ও হাত দেবে কেন? আমি একশোভাগ নিশ্চিত আপনি তাকে বন্ধুর চোখে দেখলেও, সে আপনাকে বন্ধুর চোখে দেখেনা। আপনার আরও কয়েকজন মেয়ে বন্ধু এসেছিল, তারা কেউই ওর মত গায়ে পরা স্বভাবের ছিলনা। ”

” আমার বউকে জেলাস মনে হচ্ছে! এটা ভালো দিক। প্রত্যেকটা মেয়েরই উচিত তাদের স্বামীদের কঠোরভাবে চোখে চোখে রাখা। নইলে পুরুষজাতি এদিকসেদিক উঁকিঝুঁকি মারতে পারে। ”
” আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন? নাকি কথা ঘোরাচ্ছেন? ”
” না আমি তোমার সাথে ইয়ার্কি করছিন,আর না কথা ঘোরাচ্ছি। আমিতো সত্যিটা তোমাকে বললাম। শোন, সিলভি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকে, সেটা ওর সমস্যা। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা আমার গুণ। ”

” রাখেন আপনার গুণ। লু চু পুরুষ মানুষ। সিলভি যখন আপনার সাথে ঢলাঢলি করল, তখন আপনি তাকে নিষেধ করতে পারলেননা? নাকি তার ঢলাঢলি উপভোগ করছিলেন? এখন বুঝলাম সেই মেয়ে কেন এতদিনেও বিয়ে করেনি। নিশ্চয়ই আপনি তাকে আশা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে দেখেই আপনার মত হঠাৎ পাল্টে যায়। ”
এই মাঝরাতে কুহুর এসব কথাবার্তা শুনে তাহমিদের নিজেকে পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে। ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ওর এমন সাধাসিধা বউ এমন রণরঙ্গিণী রূপ ধারন করতে পারে!

” বিশ্বাস কর বউ, আমি মোটেও মত পাল্টাইনি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। সিলভি শুধুমাত্র আমার বন্ধু। ” তাহমিদ পারলে কেঁদে দেয়।
” আবার মিথ্যা বলছেন? আপনি স্কুল জীবনে না এক সিনিয়র আপুর প্রেমে পরেছিলেন? এখন আবার বলছেন শুধুমাত্র আমাকেই ভালোবেসেছেন! আর কত মিথ্যা বলবেন? আমার মনে হচ্ছে, আপনাকে আচ্ছামত চেপে ধরলেই, আপনার আরও কয়েকটা প্রেমিকা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে। ” এবার কুহুর গলায় রাগের ছটা।

” সেই সিনিয়র আপু আমার অল্প বয়সের আবেগ ছিল, বউ। আমি তাকে কবেই ভুলে গেছি। এখন আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে শুধুই তুমি। ”
” এখন আপনার সত্তা জুড়ে আমি! তাহলে আগে কে ছিল? সেই সিনিয়র আপুর পর কে ছিল আপনার সত্তা জুড়ে? নিশ্চয়ই সিলভি? ”

এবার তাহমিদের ইচ্ছে করছে নিজের চুল ছিঁ’ড়’তে। কোন কুক্ষণে যে বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত করেছিল। এখনতো ওর মনে হচ্ছে সিলভিকে সামনে পেলে কাঁচাই চি’বি’য়ে খাবে। কেনইবা সিলভি ওমন ঢং করল, আর কেনইবা ওর সংসারে আ’গু’ন লাগাল।

” বউ, বিশ্বাস কর, আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি ছাড়া অন্য মেয়েদের আমি মা-বোনের চোখে দেখি। তুমিই আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। আজ বিশ্বাস করছনা তো? কিন্তু যেদিন আমি থাকবনা, সেদিন ঠিকই বিশ্বাস করবে, আর আমাকে খুঁজবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভিতর তোলপাড় করে উঠল। নিমেষেই হার্ট একটা বিট মিস করল। ও তাহমিদকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারেনা। ওর শরীর অবশ হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে অক্সিজেনের সংকট হয়েছে। কুহুর ফ্রেশ অক্সিজেন দরকার। ও হাঁচড়েপাঁচড়ে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৯

তাহমিদ অনুভব করল কুহু কাঁপছে। একটু পর কুহু অসার হয়ে তাহমিদের বুক পরে রইল। জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা।
বিঃদ্রঃ অনেকেই আমার শারিরীক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। আমি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি। আজকেও শরীরে স্যালাইন পুশ করতে হয়েছে। বাসার রান্নাবান্না এক রকম বন্ধ রয়েছে। বাবার বাসা থেকে খাবার পাঠাচ্ছে। মাঝেমধ্যে হাজবেন্ড রান্না করছে। তবে আল্লাহর রহমতে ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি চাইলেও বড় করে গল্প লিখতে পারছিনা। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪১