বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪১

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪১
জাওয়াদ জামী

এক ধ্যানে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে তাহমিদ। ও ভাবতেই পারেনি, সামান্য একটা কথায় কুহু জ্ঞান হারাবে! অথচ জীবনে আজ পর্যন্ত মেয়েটা অনেককিছুই সহ্য করেছে। অনেক লড়াই করে বেঁচেছে। কখনো ধৈর্য হারা হয়নি। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!

রাতে কুহু হঠাৎ করে ওভাবে তাহমিদের বুকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায়, তাহমিদ ভিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ওর দুনিয়া থমকে গেছে। কেউ ওর শ্বাসনালী টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলেছে। হাওয়ায় কোন অক্সিজেন ছিলনা। সেকারণেই বুঝি তাহমিদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল! বেচারা ঘেমে-নেয়ে একাকার। অথচ সে জীবনে বহুবার মানুষের হৃদপিণ্ডে ছু’রি-কাঁ’চি চালিয়েছে। তখন একটাবারও ওর হাত কাঁপেনি। চোখের সামনে কতশত মৃ’ত্যু দেখেছে। সেসবে কষ্ট হলেও কখনো ঘাবড়ায়নি। অথচ আজ চোখের সামনে কুহুকে অজ্ঞান হতে দেখে নিজেকে কেমন উদভ্রান্তের ন্যায় লাগছিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে, কুহুর চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে, মেয়েটার জ্ঞান ফেরায়।
জ্ঞান আসার পরই কুহু কেমন পা’গ’লা’মি করছিল। নিজেকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল তাহমিদের বুকে। যেন বাঁধন একটু আলগা হলেই, সে ছুটে পালাবে।

কুহুর এমন পা’গ’লা’মি দেখে, তাহমিদ ওকে স্লিপিং পিল খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরই কুহু গভীর ঘুমে ঢলে পরে।
এরপর সারারাত তাহমিদের ঘুম হয়নি। ঘুমন্ত কুহুর মুখখানি দেখেই ওর বাকি রাতটুকু কেটেছে। তাহমিদ ভেবে পায়না ওর সামান্য কথায় কুহু যদি এভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে সত্যিই যেদিন ও থাকবেনা। সেদিন মেয়েটার কি হবে!

সারাটারাত তাহমিদ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছে, দুজনের মৃ’ত্যু যেন একই সাথে হয়। কারন তাহমিদ নিজেও কুহুকে ছাড়া একদিনও বাঁচতে পারবেনা। এই মেয়েটা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এই মেয়েটাই ওর বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
পরম আদরে তাহমিদ ছুঁয়ে দিচ্ছে কুহুর মুখাবয়ব। এত মায়া কেন এই মুখে! তাহমিদ আজও ভেবে পায়না এই সাদামাটা চেহারার মেয়ের মাঝে কি দেখেছিল সে? যার দরুন মেয়েটাকে সে আপন করেই ছেড়েছে। যে মেয়েটার মাঝেই ওর অস্তিত্ব খুঁজে পায়।

ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে তাহমিদ ঘুমাতে যায়। কুহুর ঘুম সহসাই ভাঙ্গবেনা। তাই মেডিকেল যাওয়ার আগ পর্যন্ত ও একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়।
কিন্তু তাহমিদের ঘুম সকাল নয়টায়ও ভাঙ্গলনা। কুহুও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
ঠিক সকাল দশটায় তাহমিদ ঘুম থেকে উঠল। দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়তেই ওর মাথা খারাপ হবার জোগাড়। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে দৌড় দেয়।

তাহমিদ যখন তৈরি হচ্ছে কুহু তখনও ঘুমে। তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরোনোর সময় কুহুর কপালে, চোখেমুখে আদরে ভরিয়ে দেয় তাহমিদ।
নিচে গিয়ে মা-বড়মাকে কুহুর অসুস্থতার কথা জানিয়ে, বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তাহমিনা আক্তার অনেকবার বলেও ছেলেকে খাওয়াতে পারলেননা।

তাহমিদের কাছে কুহুর কথা শুনেই আফরোজা নাজনীন দৌড়ে ওদের রুমে যান। ঘুমন্ত মেয়েটার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তিনি একটা কথাই ভাবছেন, কায়েসকে তিনি কি জবাব দেবেন।
দুপুর সাড়ে বারোটায় ঘুম ভাঙ্গলে কুহু নিজের পাশে তাহমিনা আক্তার, আফরোজা নাজনীন ও দিদুনকে বসে থাকতে দেখল। মাথা ভার হয়ে থাকায় চেষ্টার পরও শোয়া থেকে উঠে বসতে পারলনা।
তাহমিনা আক্তার ছেলের বউকে ধরে তুলে বসালেন।

” মা, আপনার ছেলে কোথায়? উনাকে দেখছিনা যে? ”
” কুহু মা, তাহমিদ কি এখন বাসায় থাকে! ও না সেই সকাল সাড়ে দশটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। চল তোকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাই। একবারে গোসল করে বের হবি। দেখবি শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। ”
তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে শোনার পর তাহমিনা আক্তারের কোন কথা কুহুর কানে যায়নি। ও ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

জ্ঞান হবার পর থেকে মাকে দেখেনি। মায়ের আদর কেমন তা কুহু জানেনা। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আজ এই পর্যন্ত এসেছে। গতরাতে হঠাৎই তাহমিদের মুখে ঐ কথা শোনার পর কুহু ভেতর থেকে ভেঙে পরেছে। ঐ মানুষটাই নিঃসার্থ ভালোবাসা দিয়েছে। জীবন চিনতে শিখিয়েছে। ঐ মানুষটাকে ছাড়া কুহু একধাপও চলতে পারবেনা। তাহমিদকে ছাড়া কুহু নিঃস্ব। তাকে ছাড়া এক মুহুর্ত বাঁচার চিন্তা কুহু করতে পারেনা।
কুহুকে কাঁদতে দেখে রুমে উপস্থিত সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

” ও সোনা মা, তুই কাঁদছিস কেন? তাহমিদতো প্রতিদিনই মেডিকেলে যায়। ও যে পেশায় আছে, সেখানে ওর ফাঁকিবাজি মানায়না, মা। তুই কান্না থামা। আমাদের বল কি হয়েছে? ”
” তোমরা উনাকে বাসায় আসতে বল। উনি বাসায় না আসলে আমি না খেয়ে থাকব। উনি একদমই নিজের খাওয়াদাওয়ার নজর দেননা। নিজের খেয়াল রাখেননা। তোমরা উনাকে এখনই আসতে বল। ” কুহু হেঁচকি তুলে কাঁদছে।

তাহমিনা আক্তার মায়াময়ী চোখে তাকিয়ে আছেন কুহুর দিকে। তিনি ভাবছেন, তার ছেলে ভাগ্যবান, কুহুর মত বউ সবাই পায়না। তিনি মনে মনে প্রানভরে দোয়া করলেন তাহমিদ-কুহুকে।
আফরোজা নাজনীন বাধ্য হয়ে তাহমিদকে ফোন দিয়ে কুহুর পাগললামির কথা বললেন। সেই সাথে তিনি তাহমিদকে বাসায় আসতে বললেন।

বড়মার ফোন পেয়ে তাহমিদ দেরি না করে বাসায় রওনা দেয়।
সাতদিন পেরিয়ে গেছে। নীরা তাওহীদের সাথে চলে গেছে। জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। তাহমিদ অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কুহুকে স্বাভাবিক করেছে। এরমধ্যে তাহমিদ দুইদিন কুহুকে এদিকসেদিক ঘুরাঘুরি করেছে।

সাতদিন পর কুহু ভার্সিটিতে যায়। বেশ কয়েকদিন ক্লাস করতে পারেনি, তাহমিদ ওকে রাজি করিয়েছে ভার্সিটি যেতে।
ড্রয়িং রুমে দুইটা টি টেবিল ভর্তি নানান খাবারে। একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দেদারসে খাবারগুলো গলাধঃকরণ করছে। এতসব খাবার যেন তার ক্ষুধা নিবারন করতে পারছেনা। চোখের পলকেই যেন খাবারগুলো উধাও হয়ে গেছে!

কুহু ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে ভদ্রলোকের খাওয়া দেখছে আর ভাবছে, এত খাবার একজন মানুষ কিভাবে খেতে পারে!

” বুঝলেন স্যার, ছেলে কিন্তু নাম্বার ওয়ান। ছেলেরা তিন ভাই দুই বোন। ভাইবদের মধ্যে ছেলে চতুর্থ। ছেলের বড় দুই ভাই একজন প্রশাসন ক্যাডারে আরেকজন শিক্ষা ক্যাডারে আছে। আর এক বোন ব্যাংকার। ছোট বোন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। দুই ভাই, এক বোনের বিয়ে হয়েছে। এবার এই ছেলের পালা।

আমিও তাদের বলেছিন , আমাদের মেয়েও কোন কিছুতেই কম নয়। আপনাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তারা রাজি হয়েছে। এবার আপনাদের পালা। আপনারা রাজি থাকলেই তবে তারা এই সম্পর্কে এগোবে। ” খাওয়া শেষে সেই ভদ্রলোক পান চিবাতে চিবাতে বলল।
এবার কুহু বুঝতে পারল লোকটির পরিচয়। ইনি নিশ্চয়ই সিক্তার বিয়ের বিষয়ে কথা বলছেন।

” আমরা আপনার কথা শুনলাম। দেখুন সিক্তা আমার ছোট মেয়ে। এবং সবথেকে আদরের। একদিন না একদিন ওকে বিয়ে দিতেই হবে। আপনার আনা সম্মন্ধও খারাপ নয়। তবে আমার দুইটা ছেলেই এখন বাসায় নেই। একজনতো শহরের বাহিরেই থাকে। আর দ্বিতীয়জন বর্তামানে মেডিকেলে আছে। আগে ওদের সাথে আলোচনা করে নেই। বোনের বিয়ের ব্যাপারে ওদের মতামতকে আমি অবশ্যই প্রাধান্য দেব।এছাড়া আমার মেয়েরও বিয়েতে মত আছে কিনা, আগে আমাকে সেটা জানতে হবে। আমি জোর করে ওর ওপর কিছুই চাপিয়ে দিতে চাইনা। আপনি ছেলের এবং তার ফ্যামিলির বায়োডাটা আমাকে দিয়ে যান। আমি ওদের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাব। ” একটানা কথা বলে থামলেন সানাউল রাশেদিন।

” ঠিক আছে, স্যার। এই যে নিন ছেলে এবং তার ফ্যামিলির বায়োডাটা। ” ঘটক তার কালো রংয়ের লেদারের ব্যাগ ঘেঁটে কয়েকটা কাগজ বের করে সানাউল রাশেদিনের কাছে দিল।
কুহু মনযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিল। এমন সময় ওর কথা শোনার বারোটা বাজিয়ে ফোন বেজে উঠল। ও যেখানেসেখানে যাক না কেন ফোন সাথে রাখতেই হয়। এটা তাহমিদের অর্ডার।
কুহু ফোনের দিকে না তাকিয়েই রিসিভ করল।

” আমার বউ, কি করছে? তার মন মেজাজ কি ঠিক আছে? ”
” ওহ্ আপনি। দিলেনতো আমার মনোযোগের বারোটা বাজিয়ে। এখন সব কথা শুনব কেমন করে! ” কুহুর গলায় স্পষ্ট অভিযোগ।

” কি করছিলে? কার কথা শুনছিলে মনযোগ দিয়ে? এক মিনিট, তুমি কারও রুমের দরজায় আঁড়ি পেতেছ নাকি? বউ, তোমার এত অধঃপতন হয়েছে, এটা আমি ভাবতেই পারছিনা। ”
” আপনি একদম আজেবাজে কথা বলবেননা। আমি ডাইনিং রুমে আছি। এখান থেকে ড্রয়িংরুমে বসা ঘটক আর ফুপার কথা শুনছিলাম। ”

” মাই গড! তোমার ফুপা কি আরেকটা বিয়ে করছে! এই বয়সে তার বিয়ে করার শখ জেগেছে! ছিহ্ বউ ছিহ্, তুমি তাকে না আটকিয়ে আঁড়িপেতে তাদের কথা শুনছ? ”
” আবারও আজেবাজে কথা বলছেন? ফুপা নিজের বিয়ের জন্য নয়, সিক্তার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছেন। ঘটক সিক্তার জন্য একটা পাত্রের সন্ধান এনেছে। সে বিষয়েই কথা হচ্ছে। ”
” আচ্ছা! তা সিনিয়র ভদ্রলোক, ঘটকের কথা শুনে কি বলল? রাজি হয়েছে নাকি? ”

” উহু। তিনি ভাইয়া, আপনি আর সিক্তার মতামত জানতে চান। আপনাদের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ”
” গুড। ভদ্রলোকের ভুঁড়িতে বুদ্ধি গজিয়েছে তাহলে। আমাকে না জানিয়ে যদি সে রাজি হত, তবে তার কপালে খারাবিই ছিল। আচ্ছা বউ, আমি এখন রাখছি। তুমি কিছু খেয়ে নিও। আমার বাসায় যেতে রাত হবে। এতক্ষণ না খেয়ে থেকোনা। ”
” আচ্ছা, রাখছি। অযথাই ফুপাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেন। আপনি সাবধানে থাকবেন। সাবধানে বাসায় আসবেন। ”
” ওক্কে, সোনা বউ। লাভিউ। রাখছি। ”

তাহমিদ ফোন রাখলে কুহু আর কিছুক্ষণ ফুপাদের কথা শুনে, সোজা সিক্তার রুমে যায়। সিক্তা আনানের সাথে কথা বলছিল। কুহুকে দেখে ও ফোন রেখে দিল।
” সিক্ত রে, আমাদের বাসায় বিয়ের আয়োজন হতে চলেছে। খুব আনন্দ লাগছে। কখনো আপনজনদের বিয়ে কাজ থেকে দেখিনি। এবার দেখব, আনন্দ করব। ” কুহু সিক্তাকে জড়িয়ে ধরে বলল।

” কার বিয়ে! এসব কি বলছিস! ” সিক্তা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
” তোর বিয়ে। নিচে ঘটক এসেছে। তোর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। খুব ভালো পরিবার থেকে সম্মন্ধ এসেছে। কি রে খুব খুশি হয়েছিস, নাকি লজ্জা পেয়েছিস? ”

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪০

কুহুর কথা শুনে সিক্তার বুকের ভেতর হার্টবিটেরা ডামাডোল শুরু করেছে। বাবা যদি রাজি হয়ে যায়, তবে আনানের কি হবে? আনান ওকে ছাড়া ম রে ই যাবে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সিক্তা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪২