রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৬

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৬
সিমরান মিমি

দ্রুতবেগে সকালের নাস্তা করে বাইক নিয়ে পার্টি অফিসের দিকে চললো পাভেল।এটা তার প্রতি দিনের রুটিন।আগে তো ভাইয়ের সাথে যেতো,এখন আর ভাই কাছে নেই বলেই নিজে দৌড়ায়।অনেক বড় মুখ করে পাচ দিনের জন্য সমস্ত দায়িত্ব কাধে নিয়েছে সে।অথচ ভাই যাবার পরের দিনই বিরোধী দলের সাথে মারপিট করেছে দলের সদস্য রা।এটা পরশের কানে গেলে যে ভীষণ ক্ষেপে যাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত পাভেল।তাইতো আর যাতে কোনোরুপ ঝামেলা না বাধে সে জন্যই আগে ভাগে অফিসে ঢুকেছে সে।

বাইক পার্ক করে অফিসে ঢুকতেই দেখলো সুমন হাত-পা হেলিয়ে সোফায় শুয়ে আছে।সেই স্কুলজীবন থেকে আজ পর্যন্ত এই ছেলেটা পাভেল কে ছাড়ে নি।না তো তাদের বন্ধুত্ব কোনোভাবে নষ্ট হয়েছে। এমনকি পাভেল রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে বলে সেও ছুটে এসেছে পাভেলের সাথে।জোরপায়ে হেটে সামনের চেয়ারে বসলো পাভেল। সুমনের দিকে ভ্রু উচিয়ে তাকিয়ে বললো-

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তোর আবার কি হলো?ওমন ভেটকি মাছের মতো পড়ে আছিস কেন?
হতাশার সুর ধরে সুমন আনমনে বললো-
আর বলিস না ভাই,ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছি।
কপাল কুচকে ফেললো পাভেল।তারপর দুম করে সুমনের পিঠের উপর কিল মেরে বললো-
তুই শালা প্রেম করিস।অথচ আজ অবধি আমাকে জানালি না।স্বার্থপর।
লাফ দিয়ে উঠে বসলো সুমন।সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো-

প্রেম আর করলাম কই।তার আগেই তো সম্বন্ধির বাচ্চা বিয়ে দিয়ে দিল আমার বাচ্চা বউটাকে।ওই সোভাম শালা টা যে এত্তো খচ্চর হবে কে জানতো?আগে জানলে তো,আর্শিকে কলেজ যাওয়ার পথেই তুলে নিয়ে আসতাম।
স্তব্ধ হয়ে গেল পাভেল।মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে পড়লো।পুরো মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছে তার।সে কি ভুল কিছু শুনেছে।পুনরায় উত্তেজিত হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো-

এসব কি বাজে কথা।আর্শির বিয়ে হয়েছে মানে কি?ওর তো ক-দিন পরেই পরিক্ষা।ধুরর!তুই মজা করছিস আমার সাথে।
বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সুমন।তারপর ত্যাড়া কন্ঠে বললো-
হ,তুই তো আমার বেয়াই লাগিস। তাই তো মজা করি।ধুর বা*ল আমি বাচি না আমার জ্বালায় আর তুই মজা নিচ্ছিস।ওর ওই সৎ ভাই, সোভাম কু*ত্তা টায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দিছে আর্শিকে।ওই লিট্টি ইদুর টাও নাকি অন্যকারো সাথে প্রেম করতো।সেখানেই ধরা খাইছে।তাই বিয়ে দিয়ে দিছে।আর্শি তো এখন ওর শশুড় বাডিই আছে, ঢাকায়।

ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লো পাভেল।তাহলে এটাই কি আর্শির ফোন না ধরার কারন ছিলো।উফফফ!বুকের ভেতরটা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে।আর্শি কি করে বিয়ে করতে পারলো?কি করে অন্যকারো সংসারে যেতে পারলো তাকে ছেড়ে।এই কি ভালোবাসা।না না,আর্শি এমনটা করতে পারে না।ওকে জোর করেছে সোভাম।নাহলে ও কিছুতেই তাকে ঠকাতে পারে না।নিজেকে খুব কষ্টে সংযত করলো পাভেল।দম নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সুমনকে বললো-

তুই এতোসব জানলি কি করে?কই আর কেউ তো কিচ্ছু জানে না।সাবেক এমপির মেয়ের বিয়ে আর কেউ জানবে না,এটা কি করে হয়।
ক্ষেপে গেল সুমন।বললো-
আরে বাবা তোর কি মনে হয়, আমি মিথ্যা বলবো। ওদের বাড়ির দারোয়ান মফিজ চাচাতো আমাদের বাড়ির পাশেই থাকে।ওর থেকেই আমি আর্শির সব খবর নেই।আর বিয়েটা গোপনে হয়েছে ঘরোয়া ভাবে। তাই কেউ জানে না।
শান্ত হয়ে বসলো পাভেল।পুনরায় বললো-

সোভাম এখন কোথায় থাকতে পারে জানিস কিছু?
ভাবলেশহীন ভাবে কাধ উচিয়ে সুমন বললো-
কোথায় আবার?হয় ওদের পার্টি অফিসে নয়তো ক্লাব ঘরে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো পাভেল।ছোট্ট করে বললো-
এদিক টা দেখিস।আসছি আমি।

বলেই নিচে নামলো।বাইকে উঠে এক টানে সোভামদের পার্টি অফিসের সামনে গেল।কিন্তু হতাশ হয়ে পুনরায় বাইকে উঠলো।অফিসের গেটে তালা লাগানো।হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে আটটা মাত্র।হয়তো এতো তাড়াতাড়ি আসে নি।এবারে ক্লাব ঘরের উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো পাভেল।বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।কলিজা টা কেউ ছিড়ে দু টুকরো করে ফেলেছে।বারবার মন বলছে আর্শি কি একবার ফোন দিয়ে তাকে জানাতে পারতো না।পুনরায় সকল দোষ,ক্ষোভ গিয়ে সোভামের উপরে মজলো। ওই জানোয়ার টা জোর করেছে আর্শিকে। হয়তো মেরেছেও।ওকে তো ছাড়বে না পাভেল।

ভাই,ওরে তো আমি স্কুলে আনা নেওয়া করি। বাড়ির সবাই ওরে না দেইখা আমারে যখন জিজ্ঞাস করবে তখন কি বলবো?
ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে সুজন সোভামকে বললো। পাশেই চিন্তিত অবস্থায় নিরব বসা।সোভামের উদ্দেশ্যে বললো-
ভাই,এইটারে কি মাইরা এই জঙ্গলেই কোথাও পুইতা রাখবো।
সামান্য বিরক্ত হলো সোভাম।সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে সে।ধমক মেরে সুজনকে বললো-

নিয়া আসার আগে মনে ছিলো না বাড়িতে কি জবাব দিবি।ধুর!
পাশ থেকে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে থাকা আরিফ বললো-
আরে এইটা কোনো ব্যাপার হইলো।মাইরা কোথাও একটা পুইতা রাখবা।তারপর সুজন ভাই সোজা বাড়িতে চইলা যাবা।তারপর চিন্তার ভান কইরা বলবা প্রেমা তো প্রাইভেটে ঢুকলো তারপর আর বাইর হইলো না।অনেক খুজছি পাই নাই।ব্যাস।

নিস্তেজ হয়ে সামনের ঘরে পড়ে আছে প্রেমা।হাত মুড়িয়ে পিঠের দিকে বাধা।আর মুখেও সেই আগের মতোই ক্রোস বেল্ট দিয়ে বাধা রয়েছে। পেছনের ঘর থেকে আসা কথাবার্তা গুলো কানে বাজছে তার।দু চোখ দিয়ে স্রোতের ন্যায় গরম জল গড়িয়ে পড়ছে।সে তো বাচতে চায়।মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পায়। সারা শরীর অবশ হয়ে আছে।সামান্য নড়াচড়াও করতে পারছে না।মাটির উপর অতি কষ্টে গড়াতে গড়াতে দরজার সামনে এলো। চাপানো রয়েছে দরজা মাথাটা সামনের দিকে এলিয়ে কাঠের দরজাটা কে অতি কষ্টে সামান্য খুললো।পুনরায় গড়িয়ে বাইরে আসতেই উচু মাটির পিড়া থেকে ধুপ করে জঙ্গলের শুকনো পাতার উপর পড়লো।

বাইক রাস্তায় পার্ক করতেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো পাভেল।তাদের গাড়ি এখানেই পার্ক করা। এটা তো সুজন চালায়। আর নিয়ম অনুসারে প্রেমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া -আসা করার কথা।কিন্তু এই গাড়ি এখানে কেন?
রহস্য ভেদ করতে না পেরে কৌতুহল বশত ক্লাবের সামনে আসছিলো পাভেল। ধুপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল মুখ থুবড়ে পড়া কোনো মেয়েকে।

আরেকটু সামনে এগিয়ে মাথাটাকে তুলতেই দিগবিদিক হারিয়ে ফেললো পাভেল। এটাতো প্রেমা।ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠলো পাভেল।মাথায় বজ্রপাতের ন্যায় অদৃশ্য কিছু পড়লো।শুধুমাত্র স্কুলের ইউনিফর্মের নীল রঙা ফ্রক টা গায়ে প্রেমার।আর কিচ্ছু নেই।পুরো নীল জামাটা লাল রক্তের স্রোতধারায় কালো বর্ণ ধারন করেছে।হাত -মুখ বাধা অবস্থায় এভাবে নিজের ছোট্ট বোনটাকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলো না।

ঝরঝর করে দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।দ্রুত হাতের বাধন আর মুখের বাধন খুললো।দুহাত দিয়ে বোনকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলতেই মুখ চেপে ধরলো প্রেমা।
নিভু নিভু চোখে ভাইকে দেখতেই ঠোট ভেঙে কেদে দিলো।নিঃশব্দের সেই কান্না।চেষ্টা করলেও কন্ঠনালি ভেদ করে কোনো আওয়াজ বের করতে পারছে না প্রেমা।

পাভেল প্রায় পাগলের মতো করছে।মাথা শূন্য হয়ে গেছে তার।পুনরায় কে এমনটা করেছে জানার উদ্দেশ্যে প্রেমাকে ধরতেই নিস্তেজ হয়ে গেল সে।দিকবিদিকশুন্য হয়ে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তার দিকে দৌড় দিল পাভেল।হস্পিটালে নিতে হবে ওকে।বাইকের সামনে আসতেই নিজের প্রতি ধিক্কার জানালো। আজ কেন গাড়ি নিয়ে আসলো না।বাইকে করে কিভাবে যাবে সে।পাশের গাড়িটাও লক করা।

পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগলো।কাপা কাপা কন্ঠে চেচিয়ে বোনকে ডাকতে লাগলো।কিন্তু প্রেমা নিরুত্তর,নিস্তেজ,জ্ঞানহীন।হয়তো এতক্ষণে ভরসার কোনো হাত পেয়েই তার কাছে নিজেকে শপে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।

কিছুদুর যেতেই সামনে ট্যাক্সি পড়লো। দ্রুতবেগে গাড়িতে উঠেই হস্পিটালে যাওয়ার আদেশ করলো।ট্যাক্সির মধ্যে বসা এক মহিলা দ্রুত ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে পেচিয়ে দিল প্রেমার নগ্ন পা দুটো।পাভেল একবার রাস্তার দিকে চাইছে তো একবার বোনের দিকে চাইছে।দুচোখ দিয়ে অবিরতভাবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।মাথাটা নিচু করে প্রেমার দু গালে দুটো চুমু খেয়ে বললো-

ভাই আছে না সোনা।কিচ্ছু হবে না।এই তো এক্ষুনি সব যন্ত্রনা কমে যাবে।
দশ মিনিট অতিবাহিত হতেই স্থানীয় সদর হাসপাতালের সামনে ট্যাক্সি থামলো।দ্রুত প্রেমাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ভেতরে গেল পাভেল।স্ট্রেচারে শুইয়ে দিতেই ডক্টর নার্সে একাকার হয়ে গেল।খুব কমই এসব এলাকায় ধর্ষনের মতো জঘন্য অপরাধ কম হয়।

একটু আগেই প্রেমাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। ধপ করে ফ্লোরের উপর বসে পড়লো পাভেল।গা ছেড়ে দিচ্ছে তার।ইচ্ছে করছে সেও অজ্ঞান হয়ে যাক।ভাইকে কি জবাব দেবে সে।এতো বড় জোয়ান বড় ভাই থাকতেও ছোট্ট একটা বোনকে রক্ষা করতে পারলো না।কি হবে এই রাজনীতি,ক্ষমতা দিয়ে।যেখানে তার ছোট্ট বোনটাই সারাজীবন ভুগতে থাকবে নিজের সম্ভ্রম হারানোর দায়ে।এত ব্যাস্ত কেন ছিলো সে?এই ব্যাস্ততার জন্যই তো আজ এমন হলো।সে কি পারতো না বোনটাকে স্কুলে নিয়ে আসার কাজ করতে।কেন করলো না এমন।দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরলো পাভেল।
বাড়ির কথা মনে পড়তেই দ্রুত ফোন করলো বাবাকে।রিসিভড সাথে সাথে কেদে দিয়ে বললো-

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৫

আব্বু,আব্বু তাড়াতাড়ি সদর হাসপাতালে আসো।এক্ষুনি,মাকে নিয়ে আসবা।
এতোক্ষণে প্রেস মিডিয়ার মানুষে পুরো হাসপাতাল কিলবিল করছে।অসংখ্য মানুষের আনাগোনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে পড়েছে।মা-বাবা,চাচা আসা মাত্রই পাভেল উঠে দাড়ালো।তাদের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস যে পাভেলের নেই।কারো সাথে কোনো প্রকার কথা না বলেই বেরিয়ে গেল হাসপাতাল থেকে।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ২৭