অনেক সাধনার পরে পর্ব ১১

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১১
অরনিশা সাথী

–“কাবিন হয়নি জারাফ, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি এইটা নুহাশ ভাইকে বলতেই উনি বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেছে।”
রুজবার কথায় ক্ষানিক চমকালো জারাফ। সব কিছুই অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে। নুহাশের কথা মাথায় আসতেই জারাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,

–“নুহাশ বিয়ে ভেঙে চলে গেছে মানে? তোমার বিয়ে নুহাশের সাথে___”
–“হ্যাঁ, নুহাশ ভাইয়ের সাথেই বিয়ের কথা হয়েছিলো।”
–“বিয়েটা কেন ভাঙলে রুজ? আমি তো বলেছিলাম বিয়েটা করে নিতে৷ তোমাকে বিয়ে করাটা এখন আমার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“যখন সম্ভব হবে তখনই বিয়ে করবে আমায়৷”
–“আর এতদিন কি করবে তুমি?”
–“তোমার অপেক্ষায় থাকবো।”
–“যদি তোমার অপেক্ষার ফল মিষ্টি না হয়? তোমার অপেক্ষার মূল্য যদি না দিতে পারি আমি?”
জারাফের এমন কথায় রুজবা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কি বোঝাতে চাইছে ও? রুজবা বললো,

–“তুমি ঠিক থাকলে তোমার জন্য করা আমার অপেক্ষার ফল অবশ্যই মিষ্টি হবে, আর আমার অপেক্ষার মূল্য’ও পাবো আমি। শুধু তুমি ঠিক থেকো তাহলেই হবে।”
–“আচ্ছা, তোমার সাথে পরে কথা বলছি আমি। বড় চাচা এসেছে কথা বলার জন্য।”
–“আচ্ছা।”

জারাফ আর কিছু না বলেই লাইন কেটে দিলো। রুজবার বিয়ে না হওয়াতে ও যে খুশি হয়নি সেরকমটা না। জারাফ অবশ্যই খুশি হয়েছে। কিন্তু যতটা খুশি হওয়ার কথা ঠিক ততটা খুশি যেন জারাফ হতে পারছে না। এসব ভাবতে ভাবতে জারাফ ড্রয়িংরুমে গিয়ে ওর মায়ের পাশের সোফায় বসলো। জারাফের বড় চাচা সিঙ্গেল সোফায় বসে জারাফের মায়ের সাথে কথা বলছে। জারাফকে দেখে জারাফের বড় চাচা জহির বললো,

–“ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা কি জারাফ? তোমার বাবা তো বেঁচে নেই। পরিবারের হাল তোমাকেই ধরতে হবে। তোমার বাবা তো এই বাড়িটা আর সামান্য কিছু অর্থ ছাড়া সেরকম কিছুই রেখে যেতে পারেনি ভবিষ্যতের চিন্তা তো করতে হবে নাকি।”

–“হ্যাঁ, হুট করেই তো ব্যবসা করা যায় না৷ আগে ঢাকায় গিয়ে দেখি চাকরি-বাকরির খোঁজ করতে পারি কিনা।”
–“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু চাকরি করলে তোমার পড়াশোনার কি হবে?”
–“পড়াশোনার পাশাপাশি’ই চাকরি করবো।”
–“আচ্ছা তো ঢাকায় আমার বাসাতেই উঠো এবার। ওখানে থেকেই পড়াশোনা করবে আর আমার অফিসেই জয়েন করো। তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী’ই চাকরি দেওয়া হবে।”

জহির সাহেবের কথা শুনে জারাফ এবং জারাফের মা দুজনেই ভীষণ খুশি হলো। জারাফ কোনোমতে একটা চাকরি পেয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না ওদের। জহির সাহেব বললো,
–“আমার আরো একটা কথা আছে।”
জহির সাহেবের কথায় জারাফের মা বললেন,

–“বলুন ভাই, এতে অনুমতি নিচ্ছেন কেন? জারাফের বাবা নেই এখন। আপনিই তো ওদের অভিভাবক এখন।”
জহির সাহেব নড়েচড়ে বসলো। তারপর জারাফের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“নিদ্রা আমার একমাত্র মেয়ে। ও আমার খুব আদরের যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। সেটা তো তোমরা জানোই। নিদ্রা জারাফকে ভীষণ ভালোবাসে। তোমাদের সম্মতি পেলে আমি এ বিষয়ে এগোতে পারি।”
জহির সাহেবের কথায় পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা৷ জুহি জারাফের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। জারাফের উত্তর কি আসবে সেটা বোঝার জন্য৷ জারাফের মা বললো,

–“এখানে আমার কিছু বলার নাই ভাই৷ নিদ্রাকে আমার’ও ভীষণ পছন্দ। তবে আমার পছন্দ আমি আমার ছেলের উপর চাপিয়ে দিবো না। জারাফের যদি সম্মতি থাকে আমার কোনো আপত্তি নেই এতে।”
জহির সাহেব জারাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“এ বিষয়ে তুমি কি বলো জারাফ?”
জারাফ বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,

–“আমি ভেবে জানাবো চাচা।”
–“আচ্ছা, তাহলে আজ উঠি। আমার আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। তুমি কাল পরশুর মধ্যে আমার বাসায় চলে যেও। আমি তোমার পড়াশোনা আর চাকরির সব ব্যবস্থা করে রাখবো।”
জারাফ মাথা নাড়ালো। জহির সাহেব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। জারাফের বাবারা দুই ভাই, কোনো বোন নেই। তার মধ্যে জহির সাহেব বেশ প্রভাবশালী। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি করেছে। বড় বিজনেস সামলাচ্ছে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন তিনি। উনার একটাই মেয়ে আর সে নিদ্রা, আর কোনো ছেলে/মেয়ে নেই উনার। ছোট ভাই জাবেদের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গ্রামে এসেছিলেন তিনি। এখন আবার নিজের গাড়ি করেই ঢাকায় ফিরছে তিনি।

জারাফ নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে জহির সাহেবের বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলো। কি করবে ও? কি মতামত দিবে? রুজবা নাকি নিদ্রা? কাকে বেছে নিবে জীবনে? জারাফ এইটুকু খুব ভালো করে বুঝতে পারছে রুজবা ওর জীবনে ভালোবাসা নিয়ে এসেছে। আর নিদ্রা সফলতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিদ্রাকে বিয়ে করলে সফলতার চরম শেখরে পৌঁছে যাবে ও। বর্তমান সময়ে চাকরির জন্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়।

বড় বড় ডিগ্রী নিয়েও অনেকে চাকরি পাচ্ছে না বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর জারাফ সহজেই চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। পরিবারের হাল ধরতে পারবে। ভালো জায়গায় বোনের বিয়ে দিতে পারবে। বোনের সকল শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারবে। মা’কে সুখে রাখতে পারবে৷ তাছাড়া জারাফের মায়ের’ও নিদ্রাকে পছন্দ৷ নিদ্রাকে বিয়ে করলে সবকিছু অতি সহজেই জারাফের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিবে। কিন্তু রুজবা? নিদ্রার কথা ভাবলে সারাজীবনের জন্য রুজবাকে ভুলে যেতে হবে। কি করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না ও। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে রইলো জারাফ। বড্ড দোটানায় পড়ে গেলো জারাফ।

এর মাঝে বেশ কিছু দিন কেটেছে। জারাফ রুজবার সাথে আগের মতোই কথা বলে। রুজবা ভীষণ হ্যাপি জারাফকে পেয়ে৷ জারাফ ঢাকায় চলে গিয়েছে। ঢাকায় যাওয়ার আগে পুরো একটা দিন রুজবার সাথে কাটিয়েছে জারাফ। যে দিনটা রুজবা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। রুজবার জীবনে খুব সুন্দর একটা দিন ছিলো সেদিন। জারাফ এখনো নিদ্রার বিষয় নিয়ে ভাবেনি। থাকুক না এভাবে, যতদিন চলে চলুক।

এতদিন না হয় রুজবার সাথেই থাকুক। জারাফের মা বেশ কয়েকবার জারাফের মতামত জানতে চেয়েছে। জারাফ পরিষ্কার ভাবে কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে পরে জানাবো। অফিসে কাজ করছিলো জারাফ। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। কাজের চাপে এখনো খেতে যাওয়া হয়নি। এমন সময় নিদ্রা কেবিনে নক করলো। জারাফ নিদ্রাকে দেখে মুচকি হেসে বললো,

–“এসো।”
নিদ্রা মৃদু হেসে খাবারের বক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। প্লেটে খাবার ঢালতে ঢালতেই বললো,
–“কাজের চাপে তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাচ্ছো একেবারে। নিজের দিকে’ও তো নজর দিতে হবে মশাই।”
জারাফ মৃদু হেসে ফাইল বন্ধ করে বললো,

–“আমার দিকে নজর দেওয়ার মানুষের অভাব নেই তো। তাই আর আলাদা করে নিজের দিকে নজর দেই না।”
–“অনেক মানুষ আছে বুঝি?”
–“হ্যাঁ দুজন।”
নিদ্রা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“কাকি বাদে নিশ্চয়ই? কে সে দুজন?”
জারাফ মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“এই যে তুমি আছো।”
–“আর একজন?”
–“বাদ দাও এসব, ক্ষিধে পেয়েছে ভীষণ আগে খেয়ে নি? তুমিও নিশ্চয়ই খাওনি?”
–“তোমার সাথে খাবো বলে খাইনি।”

কথাটা বলে নিদ্রা এক প্লেট জারাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য প্লেট নিজে নিলো। জারাফ চামুচে করে একবার মুখে দিতেই ওর ফোন বেজে উঠলো। নিদ্রা খাওয়া থামিয়ে সেদিকে তাকালো। জারাফ ফোন রিসিভ করে বললো,
–“হ্যাঁ বলো।”
–“খেয়েছো?”
–“এইতো খাচ্ছি। তুমি খেয়েছো?”
–“না।”
–“আচ্ছা খেয়ে নাও আগে। পরে ফ্রি হলে ফোন দিবো আমি।”

কথাটা বলে রুজবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জারাফ লাইন কেটে দিলো। রুজবার মন খারাপ হয়ে গেলো। পরে আবার ভাবলো নতুন অফিস জয়েন করেছে কাজের চাপ হয়তো বেশি তাই সময় নিয়ে আগের মতো কথা বলতে পারে না। ছেলেটা আজকাল বড্ড বেশিই ব্যস্ত থাকে মনে হয়। এই ভেবে রুজবা খেতে চলে গেলো।
জারাফ ফোন রাখতেই নিদ্রা বললো,
–“কার ফোন ছিলো?”
–“এক ফ্রেন্ড এর।”
ভ্রু কুঁচকে নিদ্রা জিজ্ঞেস করলো,
–“স্পেশাল কোনো ফ্রেন্ড নাকি?”
–“আরে না, তুমি খাও তো এখন।”
কথাটা বলে জারাফ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। নিদ্রা’ও আর বেশি কিছু বললো না।

কাল বিকেলে নুহাশের ফ্লাইট। নুহাশের বড় মামা বেশ অনেক বছর ধরেই আমেরিকার বাসিন্দা। পুরো পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকেন তিনি। যখন যে দেশে ইচ্ছে স্ব পরিবারে ঘুরে বেড়াতে পারেন। আমেরিকায় নিজে একটা বিজনেস করেন। বেশ নামডাক তার। তাই আর নুহাশের ওখানে যাওয়া নিয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি তার। নিজেই সব কাগজপত্র বের করেছেন।
নিজের সবকিছু গোছগাছ করছে নুহাশ। পাশেই শাহানা বসে কাঁদছে। নুহাশ বললো,

–“আহ মা! কাঁদছো কেন তুমি?”
–“তোর না গেলে হয় না বাবা?”
–“এর আগে তো তোমরাই আমাকে ওখানে পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলে। তাহলে আজ আমি যখন নিজ ইচ্ছায় যাচ্ছি তখন কাঁদছো কেন?”
–“তুই তো এখন অভিমানে, কষ্টে দেশ ছাড়ছিস। রুজবাকে যাতে আর কখনো না দেখতে হয় সেজন্য।”
হাত থেমে গেলো নুহাশের। এক পলক শাহানার দিকে তাকালো। শাহানা বললো,

–“তুই কি ভেবেছিস? আমি কিছু বুঝি না? তুই তো রুজবাকে খুব ভালোবাসিস বাবা, ওকে বিয়ে করার জন্য এত কিছু করলি। তাহলে শেষ পর্যন্ত ওকে বিয়ে কেন করলি না? কেন দেশ ছেড়ে যাচ্ছিস?”
নুহাশ হাতের শার্ট’টা লাগেজে রেখে ফ্লোরে বসে পড়লো। শাহানার কোলে মাথা রেখে বললো,

–“রুজবা যে আমাকে চায় না মা। ও তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমি যাতে ওকে বিয়েটা না করি সেজন্য ও সেদিন আমার পায়ে পড়তে দ্বিধা করেনি। আমি কি করে আমার ভালোবাসার মানুষটার চোখে পানি সহ্য করি বলো? এখন আমি যতটা কষ্ট পাচ্ছি রুজবাকে বিয়ে করলে আমার কষ্ট’টা দ্বিগুণ হয়ে যেতো এজন্য যে আমার বউ আমাকে না অন্য ছেলে কে ভালোবাসে। আমার রুজবা’ও ভালো থাকতো না। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজেই অসুখী কি করে করি বলো তো?”
ভাঙা গলায় কথাগুলো বলে থামলো নুহাশ। শাহানা কেঁদে দিলো ছেলের কথা শুনে। নুহাশের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

–“আল্লাহ তোর ভালো করবে বাবা দেখিস। খুব সুখী হবি তুই জীবনে।”
–“আর কাউকে জড়াতে চাই না লাইফে। এভাবেই চলে যাবে। আমার ভালোবাসাটা আজীবন রুজবার জন্যই থাকবে সেখানে অন্য কেউ কোনোদিনও আসবে না। রুজবা ভালো থাকুক এটাই চাওয়া আল্লাহ’র কাছে।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১০

কথাগুলো বলতে নুহাশের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও বলছে ও। নুহাশ খুব ভালো করে জানে রুজবার পাশে অন্য কাউকে ও সহ্য করতে পারবে না। রুজবা অন্য কাউকে ভালোবাসবে এটাও কাছ থেকে দেখতে পারবে না নুহাশ। তাই তো এই দেশ ছাড়ার এত আয়োজন নুহাশের।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১২