অনেক সাধনার পরে পর্ব ১০

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১০
অরনিশা সাথী

কাবিনের আগে নুহাশকে পাঠানো হয় রুজবার ঘরে। ফারিন’ই ডেকে নিয়ে গেছে। ফারিন আর একটা বার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায়। রায়হান সাহেব তো মানেনি, নুহাশকে যদি কোনো ভাবে বোঝানো যায়। নুহাশ ঘরে ঢুকতেই ফারিন দরজা চাপিয়ে দিলো। নুহাশ রুজবার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। মেয়েটার হাল নেই। রুজবা তখনো জানে না কার সাথে ওর কাবিন হবে আজ। ফারিন নুহাশের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

–“জারাফ আর রুজবা দুজন দুজনকে ভালোবাসে নুহাশ ভাই। দুদিন আগেই জারাফের বাবা মারা যায়। পরিস্থিতির কারণে রুজবার হাতটা শক্ত করে ধরতে পারছে না ও। পরিস্থিতি ওদের আলাদা করে দিচ্ছে। ওরা একে-অপরকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না৷ আর না আপনি ভালো থাকবেন যদি রুজবার সাথে আপনার বিয়েটা হয়। ভালোবাসার কষ্ট’টা তো আপনি বুঝেন, গত তিন বছরে রুজবাকে এক তরফা ভালোবেসে প্রতিনিয়ত ভালোবাসার দহনে পুড়েছেন আপনি। আপনি কি চান আপনার ভালোবাসার মানুষটা’ও সে কষ্টে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাক? একটু ভেবে দেখুন, আজ আপনার আর রুজবার বিয়ে হলে তিন তিনটে জীবন শেষ হবে। কেউ ভালো থাকতে পারবেন না আপনারা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফারিনের মুখে এসব কথা শুনে কান্না থামিয়ে চোখ তুলে তাকালো রুজবা। নুহাশ এখানে? তারমানে নুহাশের সাথে ওর কাবিন হচ্ছে আজ? এখনই বুঝতে পারলো রুজবা৷ নুহাশ কিছু না বলে অপলক দেখছে রুজবাকে। রুজবাকে এরকম হালে একদমই সহ্য করতে পারছে না নুহাশ। ও তো চায় না রুজবা কষ্ট পাক। জোর করে কি আর ভালোবাসা পাওয়া যায়? রুজবা চোখের পানি মুছে নুহাশের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

–“আপনি তো ভালোবাসেন, ভালোবাসার কষ্ট কেমন এটা’ও আমার থেকে ভালো জানেন আপনি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন অথচ আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি আর জারাফ একে-অপরকে ভালোবাসি। প্লিজ আমাদের আলাদা করে দিবেন না৷ এই কাবিনটা হতে দিবেন না আপনি প্লিজ।”
কথাটা বলে রুজবা নুহাশের পায়ে ধরে বসে পড়লো। নুহাশ হকচকিয়ে গেলো রুজবার কর্মকাণ্ডে। দ্রুত দুই কদম পেছনে সরে গিয়ে রুজবার বাহু ধরে ওকে দাঁড় করালো। রুজবার গাল স্পর্শ করে বললো,

–“ভেবেছিলাম জারাফের প্রতি তোমার ভালো লাগা কাজ করে৷ এটা ভাবিনি যে তুমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসো৷ আর যাই হোক তোমার চোখে পানি, তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না৷ চিন্তা করো না কাবিন হচ্ছে না আজ।”
কথাটা বলেই উলটো ঘুরে গেলো নুহাশ। চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও৷ ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবাইকে কি বলেছে সেটা নুহাশ’ই ভালো জানে। তবে কাবিনিটা আর ওদের হয়নি। তেমন লোক জানাজানি হয়নি বলে রায়হান সাহেব’ও আর এ বিষয়ে কথা বাড়ায়নি৷ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটাই চুপচাপ মেনে নিয়েছেন উনি।

ফারিনকে জাপটে ধরে আধ ঘন্টা ধরে কেঁদেই যাচ্ছে রুজবা। কষ্টের কান্না নয়, খুশির কান্না। রুজবার কাবিনটা হয়নি নুহাশের সাথে। ফারিন রুজবার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“এই তিনদিন অনেক কেঁদেছিস, এবার চোখের পানি মোছ তো। যা গিয়ে শাড়ি পালটে আয়।”
–“তুই বোস, আমি এক্ষুণি আসছি।”

কথাটা বলে জামা হাতে ওয়াশরুমে চলে যায় রুজবা। মিনিট ছয়েক বাদে চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসে। শাড়িটা ব্যালকোনিতে ঝুলানো রশিতে মেলে দিয়ে আসে। রুজবা ফারিনকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“থ্যাংকিউ সো মাচ দোস্ত, তুই যদি নুহাশ ভাইয়ের সাথে কথা না বলতি উনাকে না বোঝাতি তাহলে এই কাবিনটা আটকানো যেতো না।”
ফারিন মলিন হেসে বললো,

–“একটা কথা বলি?”
–“বল, অনুমতি নিচ্ছিস কেন?”
–“আমার জন্যই আজ নুহাশ ভাই তার পুরো পরিবার নিয়ে এখানে উপস্থিত ছিলো৷ আমি সেদিন নুহাশকে ভাইকে বলেছিলাম তোকে ভালোবাসার কথা জানাতে।”
রুজবা ফারিনকে ছেড়ে দিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,

–“মানে?”
ফারিন সেদিন নুহাশের সাথে বলা সব কথাই বললো রুজবাকে। কথাগুলো বলে ফারিন মাথা নিচু করে নিলো। রুজবা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে ফারিনের দিকে। ফারিন অপরাধী গলায় বললো,
–“কিন্তু বিশ্বাস কর‍, আমি এটা জানতাম না যে উনি উনার পরিবারকে মানিয়ে কাকা’কে রাজি করিয়ে সরাসরি বিয়ে করতে চলে আসবে।”

এবারেও নিরব থাকলো রুজবা। ফারিন রুজবার হাত ধরে বললো,
–“আ’ম স্যরি দোস্ত। প্লিজ মাফ করে দিস।”
–“সমস্যা নেই। আবার তুই-ই তো নুহাশ ভাইকে বুঝিয়েছিস বিয়েটা না করতে। তবে হ্যাঁ আজ যদি বিয়েটা হয়ে যেতো তাহলে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না তোকে। সে যাই হোক এখন এসব টপিক বাদ, বুকে আয়।”
ফারিন আলতো হেসে রুজবাকে জড়িয়ে ধরলো।

–“আমেরিকায় ছোট মামার ওখানে যাবো। মামাকে সব ব্যবস্থা করতে বলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে চাই আমি।”
কথাটা বলে নুহাশ নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিবির বললো,
–“তোর পড়াশোনা?”
–“ওখানেই শেষ করবো।”
নুহাশের কথা শুনে নোমান সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললো,

–“এসবের মানে কি নুহাশ? গত কয়েকদিন ধরে তুই নিজেই পাগল করে ফেলছিলি রুজবার বাবাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য আর আজ যখন সব ঠিকঠাক ছিলো। আর কিছুক্ষণ বাদেই তোদের কাবিনটা হয়ে যেতো ঠিক তখনই তুই বিয়েটা করবি না বলে আমাদের ওখান থেকে নিয়ে চলে এলি। কিন্তু কেন? সবসময় তোর এরকম জেদ মানবো না আমরা। ওখান থেকে আসার আগে আমাদের দুই পরিবারের সম্মানের কথাটা ভেবেছিস একবারো? তোর এসব আর সহ্য করবো না আমি।”

–“সহ্য করতে হবে না। জাস্ট ছোট মামাকে বলো সব কিছু রেডি করতে। থাকবো না আমি এখানে। না তোমাদের সামনে কখনো পড়বো আর না রুজবার সামনে।”
কথাগুলো বলে গটগট করে নিজের রুমে চলে যায় নুহাশ। বাসার সবাই ড্যাবড্যাব করে নুহাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর মতিগতি কেউ বুঝতে পারছে না। গত কয়েকদিন রুজবাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে ছিলো। আর আজ দুই পরিবার রাজি ক্ষানিক বাদেই বিয়ে হতো সেখানে থেকে উঠে চলে আসলো বিয়ে করবে না বলে।

বেশ জোরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো নুহাশ। এত জোরে দরজা আটকে দিয়েছে যে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলেই কমবেশি কেঁপে উঠেছে। বিছানা ঘেসে ফ্লোরে বসে পড়ে নুহাশ। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। কষ্ট’ও কিছু কমছে না। বেড সাইড টেবিলে থাকা ফুলদানি’টা ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। চোখের পলকেই ফুলদানি ভেঙে ঝংকার তুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফ্লোরে পড়ে রইলো। সারা রুমে যেন তান্ডব চলছে৷ একের পর এক জিনিসপত্র ভাংচুর করছে নুহাশ। বাইরে থেকে শাহানা, নিবির আর আদিরা দরজা ধাক্কাচ্ছে বারবার। দরজা খুলতে বলছে সকলে। কারো কথা কানে নিচ্ছে না নুহাশ। নোমান সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললো,

–“শাহানা, তোমার ছোট ছেলেকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে লাফাঙ্গা দের মতো আচরণ করতে বলো৷ ওর এরকম আচরণ সহ্য করবো না আমি। আমার বাড়িতে থাকতে হলে ভদ্র ভাবে থাকতে হবে। ওর এসব খামখেয়ালি মেজাজ বরদাস্ত করবো না আমি।”

কথাগুলো বলার পরপরই নুহাশ বাইকের চাবি নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ সবার ডাকে তোয়াক্কা না করে হনহনিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় ও৷ পড়নে সাদা রঙের পাঞ্জাবীটা’ও জায়গায় জায়গায় কুঁচকে আছে। শাহানা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। ছেলের এমন আচরণ সহ্য হচ্ছে না উনার। এই কয়েকদিনে এইটুকু উনি বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছেন উনার ছোট ছেলে রুজবা’কে বেশ ভালোবাসে।

যে ছেলে রুজবাকে এত ভালোবাসে সে ছেলে রুজবাকে নিজের করে পাওয়ার এত কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসার কারণটা বুঝতে পারছেন না উনি। কি এমন হয়েছে? রুজবাকে যাতে না দেখতে হয় সেজন্যই যে নুহাশ দেশ ছাড়ছে এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে সবাই। নয়তো যে ছেলেকে এত বলেও ওর ছোট মামার ওখানে আমেরিকায় পাঠানো যায়নি আজ সে ছেলে নিজে থেকে আমেরিকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে বলছে। উনার ছেলেটা যে ভীষণ কষ্টে আছে এটা শাহানা বেগম নুহাশের শুকনো মুখ দেখেই বুঝতে পারছে। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা।

রুজবা জারাফকে বারবার ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু জারাফ ফোন রিসিভ না করে উলটো কেটে দিচ্ছে বারবার। এতে রুজবার ভীষণ রাগ হচ্ছে। এতবার রুজবার ফোন দেখে জারাফ ফোন সাইলেন্ট করে রাখলো। ওর এই মূহুর্তে রুজবার সাথে কথা বলার একদম ইচ্ছে নেই। আর মায়া বা ভালোবাসা কোনোটাই বাড়াতে চায় না ও।

ভুলতে চায় রুজবার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে। কিন্তু আদেও কোনোদিন ভুলতে পারবে তো? হয়তো পারবে, হয়তো পারবে না। জারাফ ফোন রেখে ওয়াশরুমে গেলো। এমন সময় জুহি জারাফের ঘরে আসে জারাফকে ডাকতে। ওর বড় চাচা এসেছে। জারাফের সাথে কথা বলতে চায় সেজন্য। জুহি ঘরে ঢুকে দেখলো বিছানার উপর রাখা জারাফের ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলছে। কাছে গিয়ে দেখলো রুজবা ফোন করেছে। নাম্বার ‘রুজ’ দিয়ে সেভ করা। রুজবার সাথে জুহির আগে কয়েকবার কথা হয়েছে। তাই জুহি ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রুজবা অস্থির কন্ঠে বললো,

–“এতবার ফোন দিচ্ছি, ফোন তুলছো না কেন জারাফ? তুমি ঠিক আছো? আন্টি জুহি ওরা ঠিক আছে তো?”
–“আমি জুহি রুজবা আপু।”
রুজবা শান্ত হলো। জুহিকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। জুহি রুজবার সাথে ফোনে কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। রুজবা শান্তনা দিলো ওকে। বোঝালো বেশ কিছুক্ষণ, পৃথিবীতে সবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না। একদিন সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জুহি কিছু বলার আগেই জারাফ বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। জুহি বললো,

–“ভাই এসেছে কথা বলো।”
কথাটা বলে জুহি জারাফের দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। জারাফ কল মিউট করে বললো,
–“না জিজ্ঞেস করে রিসিভ করেছিস কেন?”
জুহি মাথা নিচু করে বললো,

–“রুজবার আপুর ফোন তাই রিসিভ করেছিলাম, স্যরি ভাই।”
–“আচ্ছা যা এখন, আমি আসছি।”
–“বড় চাচা এসেছে কি কথা যেন বলবে তোমার সাথে। দ্রুত কথা শেষ করে এসো।”
জারাফ ছোট্ট করে জবাব দিলো,

–“আচ্ছা।”
জুহি চলে গেলো। জারাফ দেখলো রুজবা ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। জারাফ ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবারো রুজবার কল আসলো। জারাফ দরজা চাপিয়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করে বললো,
–“কেন মায়া বাড়াচ্ছো রুজ? নতুন জীবন শুরু করেছো, নতুন ভাবে আবার সবকিছু শুরু করো না।”
–“করবো, নতুন ভাবেই সব কিছু শুরু করবো। তাই তো তোমাকে ফোন দেওয়া।”
–“তোমার বরের সাথে কথা বলো। আমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করো না। আর হ্যাঁ কংগ্রাচুলেশনস ফর ইউ’র নিউ লাইফ।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৯

|কে নায়ক হবে এখনো আমি সিয়রলি বলতে পারছি না। নায়ক হওয়ার চান্স এখনো দুজনেরই আছে। যে-কেউ নায়ক হতে পারে। নুহাশ কাবিন করেনি বলে যে ও নায়ক না, জারাফ নায়ক এরকমটা ভাববেন না। গল্প এখনো অনেক বাকী। এত সহজে তো কেউ কাউকে পাবে না। আর আশা রাখছি যে-ই নায়ক হোক না কেন আপনারা সমান ভাবেই সাপোর্ট করবেন আমাকে। আর হ্যাঁ বেশি বেশি রেসপন্স করবেন। অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন কেমন হয়েছে আজকের পর্ব, ধন্যবাদ|

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১১