ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৮

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৮
নীহারিকা নুর

সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাদের ইহজগতের কোন খেয়াল নেই। আজ তাদের সাথে কি হবে সে সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা নেই। তারা সবাই তো এখনো নিশ্চিত মনে আছে যে কাল ভোরে হয়ত তারা এখান থেকে নতুন জায়গায় যেতে পারবে। কিন্তু রাতের খাবারের সাথে যে ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল সেটা তো আর কেউই জানে না। কেউ কেউ তো খাবার শেষ ও করতে পারে নি। চোখ এমন ভাবে লেগে আসছিল। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রাত তখন নিস্তব্দ। আসিফ বসে বসে কিছু একটা নিয়ে ভাবছিল। তখন রবিন ভাই ডেকে বললো রাফিন এদিকে একবার এসো তো

– কেনো ভাইয়া কিছু লাগবে?
– হ্যাঁ, স্যার এসেছে এখন মূলত সার্জারী হবে।
রবিনের কথায় আসিফ সেখান থেকে উঠে রবিনের পিছু পিছু যায় সেখানে গিয়ে দেখতে পায় ডক্টরের এপ্রন পড়া কেউ একজন দাড়িয়ে আছে। মুখে মাস্ক পরা। আসিফ সেখানে যেতে যেতে দেখলো ডক্টর তার এপ্রন খুলে ফেলছে, আসিফ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখ দেখার জন্য। সেই মুহূর্তে ডক্টর তার মুখের মাস্ক নামালো। ডক্টরের জায়গায় আবীরকে দেখে চমকালো আসিফ। মনে মনে একটা শব্দই কয়েকবার বারি খেলো ডক্টর আবির আহামেদ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আসিফ এতো দিন সব ডক্টরি প্রফেশন টাকে সব থেকে বেশি সম্মানের চোখে দেখতো কিন্তু সেই সম্মানের প্রফেশনের টেগ গায়ে লাগিয়ে আবির কিসব অনৈতিক কাজ করছে এটা ভেবেই গা ঘিন ঘিন করছে।
ড. আবির আহমেদ এর নির্দেশে সব গার্ড গুলো একটা রুমের ভিতরে প্রবেশ করল। আসিফ ও তাদের পিছু পিছু গেল। রুমটাকে দেখে আসিফ এর কাছে ছোট খাট একটা অপারেশন থিয়েটার মনে হতে লাগল। তবে অত বেশি কিছু নেই।

রুমটার মাঝ বরাবর একটা খাট রাখা। তার পাশেই একটা ছোট টেবিল এর উপর একটা ট্রে তে অপারেশন এর সব সরঞ্জাম রাখা৷ আসিফ বুঝল এইটাই সেই বেড যে বেড এ একবার কাউকে শোয়ানো হলে সে আর জীবনের আলো দেখে না। আবির আহমেদ এর নির্দেশে দুজন গার্ড গিয়ে পাশের একটা ঘর থেকে একজন লোককে তুলে আনল। লোকটা ঘুমে কাদা। রাতের আধারে তার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

তবে তার জীর্ণ শরীর টার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। যতই কাছে নিয়ে আসছে চেহারাটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। আসিফ এর ভীষণ কষ্ট হতে থাকে লোকটার জন্য।এই ঘুমই হয়ত তার জীবনের লাস্ট ঘুম। আসিফ এর ভীষণ ইচ্ছে করে চিতকার করে বলতে যে এমন অমানবিক কাজ তোমরা করো না। কিন্তু এখানে অপারগ আসিফ। ও যদি একটা ভুল পদক্ষেপ নেয় তবে ওকে আর এখান থেকে বেচে ফিরতে হবে না। যে উদ্দেশ্য এসেছে তা পুরোপুরি ব্যার্থ হবে।

চোখ বন্ধ করে মনকে শক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে আসিফ। ইতোমধ্যেই লোকটাকে সেই মধ্যেখানে রাখা খাটিয়ার উপরে শোয়ানো হয়। লোকটা ঘুমানোর মতো আরাম স্থান পেয়ে আবার শান্তি করে ঘুৃমানোর প্রস্তুতি নেয়। এতক্ষণ টানা হেচড়া করায় তার ঘুমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। আসিফ চোখ খুলতেই দেখল শরীরে কি যেন একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো। আসিফ এর এসব বিষয় ধারণা অতটা নেই তাই বুঝল না।

কিন্তু যখন আবির নির্দয়ের মতো তার হাতের নাইফটা ব্যাবহার করল। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল আসিফ। এরকম ভয়াবহ দৃশ্য ওর পক্ষে দেখা সম্ভব না। আসিফ এর হাটু মনে হচ্ছিল কাপতেছে। আবির এর সামনে এ যে একটা মানুষ সেটা যেন মনেই হচ্ছে না৷ নির্দয়ের মতো সে তার হাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্য গার্ড গুলোও তাকিয়ে আছে যেন এটা কোন সাধারণ বিষয়। আসিফ বুঝল এরা এসব দেখে দেখে অভ্যাস্ত হয়ে গেছে। আসিফ এর হাটুর কাপুনি যেন কমছে না। থর থর করে হাটু কাপতেছে। আসিফ পেছনে থাকা দেয়ালে হাতে ভর করে দাড়াল। ওর মনে হচ্ছিল ওর আর দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না। যতক্ষণ ওখানে ছিল চোখ বন্ধ করেই ছিল। কেউ একজন ওর কাধ ধরে ঝাকানি দিতেই চোখ খোলে আসিফ। আর কেউ না বরং রবিন ই ধাক্কা দিয়েছে।

– কি হলো দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
– না। এসব দেখতে পারছি না৷।
– আরে বস কি দেখে তোমাকে আমাদের সাথে এড করল বলো তো৷ যাই হোক এর কাজ শেষ।
– শেষ মানে?
– ও আর এ জগতে নেই। এখন এই লাশটা আমাদেরকেই ফেলে আসতে হবে।

এরকম একে একে কয়েকটা অপারেশন ক্লান্তিহীন ভাবে শেষ করল আবির। আসিফ আবিরকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। এমন একটা নোংড়া মানুষের সাথে নুরুল ইসলাম কীভাবে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হন সেটা ভাবতেই অবাক লাগে। আসিফ ওইদিন ওই বোকামিটুকু না করলে তো আবির এর এত বড় সত্যিটা জানতেই পারত না৷

সব শেষ করে সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হলো। এখন গার্ডদের খাওয়ার টাইম দেয়া হয়েছে। এখন পড়ল আসিফ বিপাকে। এখন যদি মাস্ক খুলে খায় তাহলে তো ধরা পড়ে যাবে। এতক্ষণে রবিন ভাই এর সাথে ভালোই কথা বার্তা হওয়ায় তাকে একটু ভালো মনে হলো আসিফ এর। সে রবিনকে এক সাইড এ ডেকে বলল

– রবিন ভাই আপনি তো জানে এসব এই প্রথম বার এসব দেখছি।
– হুম তো এখন কি হয়েছে।
– এসব দেখে আমার পেট কেমন মোচড় দিচ্ছে। বমি বমি পাচ্ছে। এখন লোকমা খাবার ও যদি পেটে পড়ে তাহলে তা বমির সাথে বেরিয়ে আসবে৷ তাই একটু রেস্ট নিতে চাচ্ছি।

রবিন দ্বিমত করল না। প্রথম প্রথম অনেকেই এসব সহ্য করতে পারে না তাই সে আসিফ কে রেস্ট করার জায়গা দেখিয়ে দিল। আর বলে গেল আমরা রাতে ডিউটি করব। এখান থেকে একদম বেরুবে না। আসিফ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
রবিন চলে গেল সেখান থেকে। এখানে আসা অন্য মানুষ গুলো ঘুমুচ্ছে। গার্ডরাও সবাই এখন খাওয়ায় ব্যাস্ত। এই মুহুর্তর থেকে সেরা সুযোগ আর আসিফ পাবে বলে মনে হলো না। সে পা টিপে টিপে উঠে সেই রুম থেকে বেরুলো।

তারপর এখানে আসা লেকগুলোকে যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সে ঘরে গেল। যে উদ্দেশ্য গিয়েছিল তা পেয়েও গেল। সেখানে থাকা আলনার উপরে একটা ঢিলেঢালা শার্ট পেল। তার পাশেই একটা ঢিলেঢালা প্যান্ট ও ছিল। আসিফ এর মনে হলে এগুলো গায়ে একদম কোন ঝামেলা ছাড়াই ঢুকে যাবে। সেগুলো কাধে চাপিয়ে পা টিপে টিপে গেল সেই রুমের উদ্দেশ্য যেখানে সে সেই গুপ্ত সুরঙ্গের সিড়ি দেখেছিল। এ পাশে দরজাটা ঠেলেঠুলে কোন মতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারল খুব বড় ভুল করে ফেলেছে আসিফ। ওর বোঝা উচিত ছিল যে রাত্র বেলা এই পথ থাকবে দুর্ঘম৷ এত অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে যাবে সেটা জানা নেই। ভেতরে যতটা তাকাচ্ছে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আসিফ মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকতে৷ জীবনে কোন দিন এত এত এডভেঞ্চার এর সম্মুখীন হতে হবে সেটা কল্পনাতেও ভাবে নি আসিফ। তাও মনে সাহস যুগিয়ে হাত দিয়ে অনুমান করে করে সামনে এগুতে থাকে।

আসিফ যতটুকু জানে এই পথে অন্য রাস্তায় যাওয়ার সুযোগ নেই৷ এই পথের শেষ সেই জঙ্গলের মুখেই। আসিফ অন্ধকার হাতড়ে সামনে যাচ্ছে। এখন একমাত্র লক্ষ্য এখান থেকে বের হওয়া। কোন দুর্বল হার্ট এর মানুষ এখানে থাকলে হয়ত এতক্ষণে হার্ট কয়েকবার তার স্পন্দন বন্ধ করে দিত। অন্ধকারে যদিও অনেক ভয় লাগছিল তবুও সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে জপতে প্রায় ঘন্টা খানিক সময় লাগিয়ে সেই মুখের দেখা পায় আসিফ।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৭

মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। তবে আসিফ এর এটা মাথায়ও ছিল না যে সেদিন এটা দুজন মিলে সরিয়েছিল। তার উপর এর উপর লতা পাতা দিয়ে ঢাকা। এখন এটা কীভাবে সরাবে৷ এখন তো আর ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবার খাওয়া শেষ। সবাই পাহারা দিচ্ছে। এখন ওদিকে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। আর এই ভারী দরজাই বা কীভাবে সরাবে। কোন পথে বেরুবে আসিফ সেটা জানেনা।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৯