ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩২

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩২
নীহারিকা নুর

মানুষ এরকম অকৃতজ্ঞ কীভাবে হয় ভেবে পাচ্ছে না তুরাগ। এই মুহুর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে মেরিনা বেগমের প্রতি। বসা থেকে উঠে দাড়ায়। ঠিক করে এখনি মেরিনা বেগমের রুমে যাবে। জানতে চাইবে তিনি এরকম কেন করলেন। উল্টো ঘুরে দরজার দিকে হাটা ধরতেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরল তরু। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

– আপনি তাকে কিছু বলবেন না। অনুরোধ রইল।
জবাব দিলো না তুরাগ। তরুই আগ বাড়িয়ে বলল
– দেখুন তার অবস্থা এখন ভালো নয়। দুটো মেয়ে তার। একজন তো নেই৷ আরেকজন বেচে থেকেও নেই। এই জিনিসগুলো তার মস্তিষ্কে ভীষণ ভাবে এফেক্ট ফেলছে। এজন্য এরকম উগ্র আচরণ করেছে। আপনি দয়া করে তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলবেন না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– সে অন্য কারো সাথে মিসবিহেভ না করে তোমার সাথেই কেন করল। সে যদি তোমাকে অপছন্দই করে তাহলে সেদিন আমাকে কেন বলেছিল বিয়ে করার জন্য। আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। তিনি সেদিন কেন জোর করেছিলেন। আর আজ কেন আমার স্ত্রীর সাথে মিসবিহেভ করবে।
তুরাগের মুখে আমার স্ত্রী কথাটা শুনে যেন একটা ধাক্কা খেল তরু। এতটাও আশা করেনি।

– আমি জানি এর উত্তর।
তুরফার কথায় তুরাগ তরু দুজনই ঘুরে তাকায়। সমস্বরে জানতে চায়
– কেন?
– সেদিন আন্টি হসপিটালে থাকা অবস্থায় বাবা গিয়েছিল হসপিটালে। সে কথা বলেছে আন্টির সাথে। বাবা তাদের সমস্ত দায়িত্ব নিবেন। ভরণপোষণ, চিকিৎসা খরচ। এভরিথিং। এর জন্য বাবার শর্ত তাকে মানতে হবে। আর তা যদি না হয় তবে কোন না কোন ভাবে ভাইয়াকে তাদের থেকো সরিয়ে নিবে।

সেই ভয়ে সেদিন তিনি রাজি হয়েছিলো তোকে বোঝাতে। তবে তিনি মন থেকে চাননি তোর বিয়ে টা৷
তুরফার কথায় চোখ বন্ধ করে ফেলেন তুরাগ। জোরে শ্বাস নেন। আবার দম ফেলতে থাকেন। নিজের রাগকে দমানোর চেষ্টা। এই মুহুর্তে কি এক যাতাকলে পরে গেছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে বাবার প্রতি। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। একের পর এক ভুুল কাজ করেই চলেছে। রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় তুরাগ। এই মুহুর্তে নিজেকে মেরুদণ্ডহীন মনে হচ্ছে।

মেরিনা বেগম বাদে সবাই উপস্থিত রয়েছে বসার ঘরে। অপেক্ষা করছে তুরাগের ফেরার। একটা বাজতে চলল তখনও তুরাগের ফেরার নাম নেই। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন তিনি। কিন্তু তুরাগ আসছে না। ফোন দিলে ফোন ও রিসিভ করছে না। চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তায়েফ সাইয়িদ এর। তুরফার পাশে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে তরু। তায়েফ সাইয়িদ উচু কন্ঠে মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন

– বাসায় কি ঝামেলা করে গেছে ও?
প্রথমে ঠিক করল সবটা খুলে বলবে তুরফা।কিন্তু তরু হাত চেপে ধরল। বলতে দিলো না। কিন্তু তায়েফ সাহেবের প্রশ্নে অবশেষে বাধ্য হয়ে বলে দিলো তুরফা। তায়েফ সাহেবের চিন্তা যেন এতে আরো বেড়ে গেলো। তুরাগ এমনিতেই তরুকে পুরোপুরি স্ত্রী হিসেবে মানে না।

তার উপর আজ এসব হলো। এখন যদি আর বাসায়ই না ফেরে। বসে থাকতে পারলেন না তিনি। উঠে পায়চারি শুরু করলেন। ফোন করলেন সব পরিচিত জনদের। কিন্তু তুরাগ তাদের কারো সাথেই নেই। এমনিতেও তুরাগ প্রায়শই রাত করে বাড়িতে ফেরে। সেটা সমস্যা নয়। প্রান্ত সাথে থাকে তখন। কিন্তু আজ প্রান্তর সাথে একবারও দেখা হয়নি।
রাত তখন আরো গভীর হয়৷

কিন্তু তুরাগের ফেরার কোনো নাম নেই। তরু জোর করে সবাইকে রুমে পাঠালো। জানালো সে অপেক্ষা করবে তুরাগের জন্য। কেউ যেতে রাজি না হলেও এক প্রকার জোর করেই সবাইকে রুমে পাঠালো তরু। সে বসে অপেক্ষা করতে লাগল তুরাগের জন্য। বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখ লেগে আসল। ঘুমিয়ে পড়ল সোফার উপরেই।
তুরাগ যখন বাসায় ফিরল তখন ফজরের আজান শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

অনেক বার চেয়েও কলিং বেল চাপ দেয়ার সাহস হলো না। মনে পড়ে গেলো কয়েক মাস আগের কথা। সেই যে রাত বেশি হলে বেলকনি টপকে ঢুকত। আর মা কখনো বেলকনির দরজা লাগাতেন না। আজও সেই চেষ্টাটাই করল তুরাগ। অনেক দিন আগের মতো অনুভূতি। আজও বেলকনির দরজা চাপানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। রুমে এসে চারদিকে চোখ বুলালো তুরাগ। লোথাও কেউ নেই। পুরো রুম ফাঁকা পড়ে আছে।

গতকাল সকালে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমন। তার মানে তরু আর এই রুমে আসে নি। গেল কোথায় মেয়েটা। রুম থেকে বেড়িয়ে এলো তুরাগ। ভেবেছিল তুরফার রুমে হবে হয়ত। কিন্তু তুরফার রুমে যাওয়ার আগেই দোতলা থেকেই নজর গেল নিচতলায় বসার রুমে। সোফার উপরে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে আছে তরু। ঠান্ডা লাগছে বোধহয় অনেক। আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো তুরাগ। তরুর সামনে হাটুমুড়ে বসল।

মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখের বন্ধ পাতার দিকে তাকালো তুরাগ। চোখের নিচে পানি শুকিয়ে যাওয়ার দাগ রয়ে গেছে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তুরাগের। এই মেয়েটা কান্না কেন করছিল? তবে কি ওর জন্যই কান্না করছিল মেয়েটা। তুরাগের মনে হচ্ছে সে নিজের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য মেয়েটাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে। মনস্থির করল সে নিজের ভুলগুলোর শাস্তি এই মেয়েটাকে দিবে না।

উঠে দাড়ালো তুরাগ। পাজাকোলে তুলে নিল তরুকে। কোলে তুলে নেয়ার সাথে সাথেই তরুর চোখের পাতাগুলো তিড় তিড় করে কেপে উঠল। তুরাগ ভেবেছিল হয়ত এখনি ঘুম ভেঙে যাবে তরুর। কিন্তু ভাঙল না। চোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কোলে তুলেই দোতলায় নিয়ে আসল তরুকে। বিছানায় শুয়িয়ে দিল। ব্লাঙ্কেট টেনে দিল গায়ে। তারপর বেড এর এক সাইডে বসল তুরাগ।

এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তরুর দিকে। কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মুখখানা। এই মেয়েটা তাকেই কেন বিয়ে করতে গেল। ওরও তো একটা সুন্দর জীবন হতে পারত। শুধু শুধু নিজ হাতে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে ওর লাইফে এলো। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে আওড়ালো কিছু কথা –

জানো পিচ্চি মেয়ে যেদিন তুমি দুনিয়ায় এসেছিলে না সেদিন প্রথম তোমাকে কোলে আমিই নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কোলে আসার পরেই তুমি কান্না শুরু করে দিলে। সাথে সাথে আম্মু তোমাকে আমার কোল থেকে নিয়ে গেলো। সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার। তুমি আমাকে পছন্দ করতে না বলেই তুমি কান্না করছো। এটাই মনে হয়েছিল।

সে বার চলে আসার প্রায় তিন বছর পর আবার গিয়েছিলাম গ্রামে। তখন তোমার তিন বছর। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সারা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলে। বার্বিডলের মতো একটা ড্রেস পড়িয়েছিল মামিমা তোমাকে। তোমাকেও দেখতে একদম বার্বিডলের মতোই লাগছিল। সেটা দেখেই তো তুরফা তোমার নাম দিয়েছিল ছোট্ট পুতুল। তুরফা যখন তোমাকে কোলে নিতে গেল তুমি ঠিকই ওর কোলে উঠলে। কিন্তু তুরফাও তো ছোট ছিল। পরলে দুজনই উল্টে। এরপর যেই আমি তোমাকে তুলতে গেলাম অমনি গলা ফাটিয়ে কাদতে শুরু করলে।
কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল তুরাগ। আবার বলতে শুরু করল

– আজ নিয়তি কোথায় এনে দাড় করিয়েছে দেখো। ছোট বেলায় তোমাকে একটু আদর করতে গেলেই ভ্যা ভ্যা করে কাদতে। আর এখন তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন্তু আমি কেন পারছি না বলোতো। বলবে কীভাবে তুমি তো শোনোই নি আমার কথা। আমি তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করব না। চেষ্টা করব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। তবে সময় প্রয়োজন আমার। কষ্ট পেও না। আর কান্নাকা’টি তো মোটেও করবে না।

কথাগুলো শেষ করে আবারো তরুর মুখের দিকে তাকায় তুরাগ। তরুর চোখ এখনো বন্ধ। তবে সামনের ছোট চুলগুলো বারবার মুখের উপর এসে পড়ছে। আর তাতেই চোখ মুখ কুচকে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে এক অবাধ্য ইচ্ছে জেগে উঠল মনে। অবাধ্য ইচ্ছেটা চেপে না রেখে পূরণ করেই ফেলল।

বন্ধ চোখের পাতায়ই ঠোট ছোয়ালো তুরাগ। ওমনি ফট করে চোখ খুলল তরু। তুরাগ সজ্ঞানে এসব করল ভাবতেই লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেলো। ওমনি কাত হয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। তরুকে জেগে থাকতে দেখে তুরাগ নিজেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। উঠে যেতে নিলো পাশ থেকে।
– আমাকে কি ভালোবাসা যায়না?

তরুর কথায় পা থেমে গেলো তুরাগের। থম মে’রে সেখানেই দাড়িয়ে গেল। তবে জবাব দিল না কোনো। তরু মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি আটল। কন্ঠ গম্ভীর করে বলল

– আসলে আপনি ভালোবাসলে আমারি লস। আমার বয়ফ্রেন্ড চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমি তার কাছে চলে যাবো। তখন তো আবার আপনাকে একাই থাকতে হবে। তাই ভালো না বাসাই ভালো হুহ।
তরুর কথা শুনে চোখ গুলো লাল হয়ে গেল তুরাগের। তরুর দিকে না ঘুরেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। তুরাগের রাগ কেন হচ্ছে নিজেই বুঝছে না। সেখানে আর না দাড়িয়ে গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে।

আমার প্রফিট এর ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার আমি আমার দুই মেয়েকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আর আমার প্রোপার্টি চার ভাগে ভাগ হবে। তিন ভাগ তিন ছেলে মেয়ে পাবে। আর একভাগ আমার নামেই থাকবে। আমার নামে যেটা থাকবে সেটা আমার মৃ’ত্যুর পরেও আর কোন ওয়ারিশ থাকবে না। সেটা কোনো এতিম খানার নামে চলে যাবে৷ উইল এভাবেই করবে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩১

ওপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। কিন্তু তায়েফ সাইয়িদ জবাবে বললেন
– আমি এরকমটাই চাই। ব্যাবস্থা করো যত শীগ্রই সম্ভব।
কথাগুলো বলতে বলতে হাটছিলেন তিনি। তার আড়ালে যে কেউ কথাগুলো শুনে কুটিল বুদ্ধি আটতেছে তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলেন না তিনি।

ভালোবাসার বর্ষণ শেষ পর্ব