বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৯

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৯
নিশাত জাহান নিশি

রাফিন ও জারিফ কী তবে রুমকির জায়গায় ভুল করে জেনিয়াকে তুলে নিয়ে গেল? বিভ্রান্ত হয়ে গেল মিশাল। মাথায় হট্টগোল লেগে গেল। দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। উদ্বিগ্ন হয়ে সামান্তাও মিশালদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে গিয়ে থেমে গেল। মিশাল ও সামান্তা মুখোমুখি হয়ে গেল। শঙ্কিত দৃষ্টি সামান্তার। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হয়েছে?”
“জেনিয়া রুমে নেই।”
“বাড়ির অন্য কোথাও আছে হয়তো। এতে এতো পেরেশান হওয়ার কী হলো?”
“আমার মনে হচ্ছে আমার সন্দেহই সঠিক।”
“কী সন্দেহ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জেনিয়াকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে!”
“কোন ওরা? কী বলছ তুমি?”
“আমাকে আগে দেখে আসতে হবে রুমকি রুমে আছে কি-না।”
সামান্তাকে পাশ কাটিয়ে মিশাল বাড়ির মেইন গেইটে চলে এলো। পিছু ডাকল সামান্তা। মৃদু চিৎকার করে বলল,
“মিশাল ভাইয়া থামো। রুমকি রুমেই আছে। সাইফার সাথে ঘুমুচ্ছে। আমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি।”

থামলো মিশাল। রুমকি নিরাপদে আছে এতে তার কোনো সন্দেহ রইলনা। কেননা মিশাল ও সামান্তা এতোক্ষণ ধরে সামান্তাদের বাড়ির ভেতরেই ছিল। তাদের সামনে থেকে রুমকিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস কখনও দেখাবেনা রাফিন ও জারিফ। তবে কাকতালীয়ভাবে সামান্তা আজ মিশালের বড্ড উপকারই করল।

রুমকিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এসে! নয়তো জেনিয়ার জায়গায় আজ রুমকি থাকত। কোনোরকমে রুমকিকে তুলে নিয়ে যেতে পারলেই তারা দুজন মিলে রুমকিকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে রুমকির সর্বনাশ করে দিতো। রুমকির জায়গায় জেনিয়াকে দেখলে তারা এমনিতেও জেনিয়াকে ছেড়ে দিবে! তবে এই ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

তড়িঘড়ি করে মিশাল তার সেলফোনটি বের করল। সাহিলের নাম্বারে ট্রাই করল। স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই সাহিল দ্বিতীয় বারের কলটি তুলল। ঘুমে আচ্ছন্ন সে। তবে বেশিক্ষণ হয়নি চোখ লাগিয়েছে। ঘুম কাতুরে গলায় বলল,
“হ্যালো।”
“কুইকলি আমাদের বাড়িতে আসো তো।”

“এই রাতে-বিরাতে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কাল আসব। এখন ফোন রাখ।”
“ওকে ফাইন। রাখছি ফোন। তুমি মরার মতো ঘুমাও। আর ঐদিকে তোমার জিনিয়া ফুলকে তারা চটকে দিক!”
ঘুম যেনো আপনাআপনি চোখ থেকে উবে গেল সাহিলের! শক লাগল গাঁয়ে। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে গেল। চোখ দু’খানা প্রকাণ্ড করে সে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী বললি তুই? জেনিয়া কোথায়?”
“তোমার ফুলকে তুলে নিয়ে গেছে ওরা। এখনি কিছু একটা করতে হবে। রিস্ক নেওয়া যাবেনা। তুমি আসলে আমরা থানায় যাব। প্লিজ কাম অন।”

উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সাহিল উদোম শরীরে রুম থেকে বের হয়ে গেল! দিশা যেনো হারিয়ে ফেলল সে। তবে গাড়ির চাবি নেওয়ার কথা ভুললনা। ফোনটা ও বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেছে। ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে সে গাড়িতে ওঠে বসল। যতো দ্রুত সম্ভব গাড়ি ছেড়ে দিলো।

কলটি কেটে মিশাল অধৈর্য হয়ে বাড়ির মেইন গেইটে দাড়িয়ে রইল। সাহিলের অপেক্ষায় রইল। পাশাপাশি রাফিনের নাম্বারে অবিরত কল করতে লাগল। নাম্বারটি বন্ধ আসছিল। ঐ মুহূর্তে সামান্তা এসে মিশালের পাশে দাড়ালো। ভীত সামান্তা। শুকনো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোথায় খুঁজবে এখন জেনিয়াকে?”
“সোজা পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। এভাবে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবেনা।”
“চাচী কি এই বিষয়ে কিছু জানে?”

সামান্তার কথায় সন্দিহান হয়ে ওঠল মিশাল। শাহনাজ বেগমকে এমনিতেও এখন বিশ্বাস করতে পারেনা মিশাল। তার মতে, শাহনাজ বেগমের দ্বারা সব সম্ভব। আক্রোশিত হয়ে মিশাল শাহনাজ বেগমের মুখোমুখি হওয়ার জন্য বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। পরক্ষণেই তার মনে পরল শাহনাজ বেগম যদি এর মধ্যে থাকতেন তবে রুমকির জায়গায় জেনিয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বোকামি তারা করতনা!

তবুও পিছপা হলোনা মিশাল। রাফিনের অন্য কোনো কন্ট্রোক্ট নাম্বার আছে কি-না তার সন্ধান তো অন্তত শাহনাজ বেগম দিতে পারবেন! সেই ভেবে মিশাল শাহনাজ বেগমের রুমের দরজায় টোকা মারল। ঘুম ঘুম চোখে দরজাটি খুলে দিলেন শাহনাজ বেগম। এই মাঝরাতে মিশালকে দেখে তিনি অবাক হলেন। হামি তুলে শুধালেন,

“কী ব্যাপার? এতো রাতে তুই?”
“আপনি কী সত্যিই ঘুমুচ্ছিলেন? না-কি ঘুমানোর ভান ধরছেন?”
“মানে? এসব কী বলছিস তুই?”
“বাড়িতে এতো বড়ো একটা কান্ড ঘটে গেল আর আপনি এখন আমার সামনে দাড়িয়ে হামি তুলছেন? কিছু টের পাননি আপনি?”

“কী টের পাব? কী হয়েছে বাড়িতে?”
“জেনিয়াকে আপনার গুনধর পুত্র তার গড ফাদারকে দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে! তাও আবার রুমকির পরিবর্তে ভুল করে। আমরা এখন পুলিশ স্টেশন যাচ্ছি। আপনি যদি সত্যিই আপনার ছেলের ভালো চেয়ে থাকেন তবে বের করার চেষ্টা করুন আপনার ছেলে কোথায়। নয়তো তার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে।”

মাথা ঘুরে এলো শাহনাজ বেগমের। তিনি জানতেন রাফিন একটা ব্ল্যান্ডার করে বসবে। আর এজন্যই সে সকাল থেকে কলটি তুলছিলনা। কী করবেন এখন তিনি? রাফিনের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবেন? তখনই হঠাৎ শাহনাজ বেগমের মনে পরল রাফিনের আরও একটি নাম্বার রয়েছে। যে নাম্বারটি রাফিন সচারাচর ব্যবহার করেনা। তবে কোনো বিপদে পরলে সে ঐ নাম্বারটি দিয়েই শাহনাজ বেগমের সাথে যোগাযোগ করে! ফোন ঘেটে শাহনাজ বেগম নাম্বারটি বের করলেন। মিশালের দিকে আড়চোখে তাকালেন। বললেন,

“আমি ট্রাই করছি।”
মিশাল তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইশারায় বুঝালো ওকে। প্রথম কলটি ফোনে ঢুকা মাত্রই অপ্রত্যাশিতভাবে রাফিন কলটি তুলে ফেলল! চ্যাচিয়ে ওঠল সে তার মায়ের সাথে। বলল,
“কোথায় লুকাইছ তুমি তোমার মেয়েকে?”
“আগে বল তুই কোথায়?”

“বড়ো রাস্তার মোড় থেকে নিয়ে যাও তুমি তোমার বোনের মেয়েকে! শালা প্ল্যানটাই ভেস্তে দিলো। আর তোমার ঐ দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেকে বলে দিও ব্যাপারটা এখানেই ক্লোজ করতে। আমরা যাকে তুলে নিয়ে গেছি তাকে অক্ষত অবস্থাতেই ফিরিয়ে দিয়ে গেছি।”

ঝট করে কলটি কেটে দিলো রাফিন। অনবরত সিগারেট ফুঁকতে লাগল সে। পাশেই উগ্রতা নিয়ে দাড়িয়ে জারিফ। গাড়িতে জোরে একটি লাথ মারল সে। খিটখিটে মেজাজে বলল,
“শালা। মিশালের সাথে পাঙা নেওয়া মনে হচ্ছেনা এতো সহজ হবে। কী সুন্দর বুদ্ধি করে বোনকে সরিয়ে ফেলল। কাঁচকলা ধরিয়ে দিলো আমার হাতে! নেক্সট টাইম আরও স্টং প্ল্যানিং করতে হবে আমাদের। রুমকিকে আমার চাই মানে চাই।”

“চিন্তা করিসনা। রুমকি তোরই হবে। মা তো আমাদের পক্ষেই আছে। সব মুশকিল আছান হয়ে যাবে। চিল কর এখন। সময় আমাদেরও আসবে।”
দুজন আবারও প্ল্যানিং করতে লাগল! মিশাল ও সামান্তা দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। দ্রুত পায়ে হেঁটে তারা বড়ো রাস্তার মোড়ের দিকে রওনা হলো। সাহিল গাড়ি নিয়ে ছুটে আসছিল। বড়ো রাস্তার মোড়টি পার হতে গিয়েই সাহিল আচমকা থেমে গেল। গাড়ির সামনে একটি মেয়ে চলে এলো! অস্ফুটে দৃষ্টিতে সাহিল মেয়েটিকে সঠিক দেখতে পেলোনা। তবে গলার স্বরটি পরিচিত মনে হলো। তাৎক্ষণিক সাহিল গাড়ি থেকে নেমে গেল।

অপ্রত্যাশিতভাবে সাহিলকে দেখে জেনিয়া প্রাণ ফিরে পেলো। নির্জন রাত, শুনশান রাস্তাঘাট, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল সে। ভরসার জায়গা খুঁজে পেয়ে জেনিয়া দৌড়ে এলো সাহিলের দিকে। হেচকি তুলে কেঁদে বলল,
“প্লিজ হেল্প মি।”

জেনিয়ার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সাহিলের বুকটা ধক করে কেঁপে ওঠল। দৃষ্টি জোড়া নিষ্ক্রিয় হয়ে এলো। হাজার বারণ ভুলে সে জেনিয়াকে তার বুকের সাথে চেপে ধরল! শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,
“তুমি ঠিক আছো?”

জেনিয়াও আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠল। হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে সাহিলের বুকের সাথে মিশে গেল! ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
“আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন প্লিজ। আমার অনেক ভয় লাগছে।”
পূর্বের তুলনায় আরও শক্তভাবে জেনিয়াকে চেপে ধরল সাহিল। নিষ্প্রভ গলায় বলল,
“এখনও ভয় লাগছে?”
“উঁহু!”

“তাহলে কী আমি আরও একটু জড়িয়ে ধরে থাকতে পারি?”
নিরুত্তর জেনিয়া! ভয়ভীতি ও ঘোরে ডুবে রয়েছে। সে নিজেই বুঝতে পারছেনা তার সাথে এখন কী কী ঘটছে। মৌন ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া তার। মিশাল ও সামান্তাও ঐ মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হলো। দৌড়োতে দৌড়োতে দুজনই প্রায় হাঁপিয়ে গেল। সাহিল ও জেনিয়াকে একসাথে মিশে থাকতে দেখে দুজনই হতবাক হয়ে গেল! ক্রুর হাসল মিশাল। তাদের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল। সামান্তা পেছন থেকে মিশালের হাত টেনে ধরল। দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,

“এই কোথায় যাচ্ছ তুমি? আক্কেল জ্ঞান নেই তোমার?”
থেমে গেল মিশাল। পিছু ঘুরে তাকালো। ভাবশূণ্য গলায় বলল,
“তাদের ডিস্টার্ব করতে না পারলে আমার শান্তি লাগবেনা!”
“এহ্! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? তাদের ডিস্টার্ব করবে কেন?”
“আমারও কাউকে জড়িয়ে ধরার ফিলিংস হচ্ছে! তাই তাদের ডিস্টার্ব করতে হবে!”

“ওহ্ রিয়েলি? আসো আমরা জড়িয়ে ধরি!”
লাজুক গলায় কথাটি বলল সামান্তা। নাক সিটকালো মিশাল! হেয়ো স্বরে বলল,
“এহ্ আইছে! তোকে জড়িয়ে ধরার চেয়ে তো কলাগাছকে জড়িয়ে ধরা ভালো!”
“তুমি আমাকে কলাগাছের সাথে তুলনা করলে?”

“কেন খুশি হোসনি? কলা তো আমার প্রিয় ফল। আয় ফল হিসেবে তোকে জড়িয়ে ধরি!”
কদাচিৎ হেসে মিশাল সামান্তার দিকে দু-কদম এগিয়ে গেল। দু-হাত বাড়িয়ে মিশাল যেইনা সামান্তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল অমনি সামান্তা রেগেমেগে বোম হয়ে মিশালের গলা চেপে ধরল! চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“একদম না। আমাকে জড়িয়ে ধরার বিন্দুমাত্র সাহসও দেখাবেনা তুমি। প্রতিবার আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার ছুঁতো খোঁজো তুমি তাইতো? হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাবোনা। বছরের পর বছর কেটে যাবে কতো ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। কিছু ভালোবাসা হয়তো ভেঙেও যাবে। তবুও আমার ভালোবাসা তোমার চোখে পরবেনা। আচ্ছা তুমি কী ইচ্ছে করেই আমাকে এড়িয়ে চলো নাকি আমাকে তুমি ভালোই বাসো না?”

নিশ্চুপ মিশাল। ভেতর থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে জড়িয়ে ধরল রাগান্বিত সামান্তাকে! আগুন পানি করতে চাইল। রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলল,
“তুই হলি আমার কাছে সিগারেটের একটান ধোঁয়ার মতো!

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৮

সিগারেটের একটান ধোঁয়ায় যেমন সাময়িকভাবে আমার ভেতরের সমস্ত অশান্তি দূর হয়ে যায়, সেই ধোঁয়া কেটে যাওয়ার পর কিন্তু তা আমার শরীরের ভেতরটাকে নিদারুনভাবে ধ্বংসও করে দেয় তেমনি তোকে কাছে পেয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও তাই! সাময়িক শান্তি। আমার জীবনের এক সেকেন্ডেরও ভরসা নেই। এখান থেকে যাওয়ার পর একটু পরেই আমার সাথে কী ঘটবে আমি জানিনা। তাই কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই ভালো।”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৪০