অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৩

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৩
অরনিশা সাথী

–“তোমার কি মনে হচ্ছে না আজকাল তুমি আমায় ইগনোর করছো?”
গত আধ ঘন্টা যাবত রেস্টুরেন্টে বসে আছে রুজবা আর জারাফ। এসেছে পর থেকে জারাফ এখন অব্দি একটা কথা’ও বলেনি। আসার পর থেকেই ফোনে কি যেন করে চলেছে। ক্ষানিক বাদে বাদে আমার মুচকি হাসছেও। শেষে বাধ্য হয়েই রুজবা উপরোক্ত কথাটা বলে। রুজবার কথায় জারাফ ফোন থেকে চোখ তুলে রুজবার দিকে তাকায়। রুজবা কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জারাফের দিকে। জারাফ আবারো ফোনে কিছু একটা টাইপিং করে ফোনটা পাশে রেখে দিলো। রুজবার হাত ধরে বললো,

–“কি যে বলো না, তোমাকে ইগনোর কেন করবো রুজ?”
রুজবা নিরব দৃষ্টিতে তাকালো। জারাফ রজবার হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বললো,
–“ইগনোর করলে কি তোমার সাথে দেখা করতাম বলো?”
রুজবা কিছু বললো না। অনুভুতি শূণ্য হয়ে জারাফের দিকে তাকালো। আগে জারাফের স্পর্শ ভালোবাসার আভাস পেতো রুজবা৷ যা আজকাল পাচ্ছে না। জারাফের এই স্পর্শ রুজবার মনে দাগ কাটতে পারেনি, অথচ আগে জারাফ হাত ধরলেই রুজবার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠতো। অন্যরকম অনুভূতি হতো। জারাফ আবারো বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“চুপ করে আছো যে?”
–“এমনি।”
এমন সময় আবারো জারাফের ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো। ম্যাসেজ এসেছে হোয়াটসঅ্যাপে। নিদ্রার’র ম্যাসেজ, “তোমার ফেভারিট ডিশ রান্না করেছি দুপুরে একসাথে খা____” লক স্ক্রিনে এইটুকু লিখা শো করছে। রুজবাকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জারাফ দ্রুত ফোন হাতে নিলো। কিছু একটা টাইপিং করে ফোন এবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো৷ রুজবা জিজ্ঞেস করলো,

–“কার ম্যাসেজ ছিলো?”
–“কাজিন।”
–“আজকাল শুধুমাত্র তোমার এই কাজিনের সাথেই বেশ কথাবার্তা হচ্ছে মনে হয়?”
–“কি বলতে চাইছো তুমি?”
–“কিছু না।”

বলে রুজবা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা চালালো। জারাফ সেদিকে তাকিয়েও তাকালো না। মিনিট দুয়েক বাদে রুজবা উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বললো,
–“আজ আসি, কাল ভোরে তো মনে হয় ঢাকায় ফিরবে। সাবধানে যেও।”
জারাফ রুজবার হাত ধরে বললো,

–“সেকি, কিছু খেয়ে যাও। এভাবে খালি মুখে চলে যাচ্ছো।”
রুজবা ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
–“তোমার ফেভারিট ডিশ রান্না করেছে তোমার কাজিন। সে নিশ্চয়ই তোমার অপেক্ষায় খাবার নিয়ে বসে থাকবে? তুমি বরং আজ তার সাথেই লাঞ্চ করে নিও।”
কথাটা শুনে জারাফ রুজবার হাত ছেড়ে দিলো। রুজবা মেকি হেসে সেদিকে তাকালো একবার। তারপর চলে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে।

–“সাহিল ভাই?”
রাতে সাহিল ওর গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলো। এমন সময় মেসেঞ্জারে ম্যাসেজ টোন আসে। স্ক্রিন চ্যাট হেডে রুজবার আইডি। সাহিল ওর গার্লফ্রেন্ড আনিকা’কে বললো,
–“তোমাকে একটু পর কল ব্যাক করছি আমি। রুজবা ম্যাসেজ দিয়েছে।”
–“জারাফের জিএফ না রুজবা?”
–“হু।”

–“মেয়েটা জারাফকে কতটা ভালোবাসলে কাবিনের দিন নুহাশ নামক ছেলেটার পায়ে ধরে জারাফকে ভালোবাসার কথা বলে আর এই বিয়ে ভাঙতে বলে। সত্যিই খুব ভালোবাসে ও জারাফকে তাই না?”
–“হ্যাঁ, ভীষণ।”
–“জারাফ এই দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। দোয়া করি সারাটা জীবন যাতে দুজনে একসাথেই থাকে।”
সাহিল ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,

–“সেটা বোধহয় আর হবে না।”
–“ক্যানো?”
–“পরে বলছি। রুজবার সাথে কথা বলে দেখি।”
–“আচ্ছা।”

এইটুকু বলে আনিকা নিজেই লাইন কেটে দিলো। সাহিল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জারাফ যে রুজবাকে ঠকাচ্ছে। রুজবার ভালোবাসা নিয়ে খেলছে, প্রথম প্রথম জারাফের রুজবার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও এখন যে সেটা নেই সাহিল সেটা খুব ভালো করে জানে। এই কথাটা সাহিল কি করে বলবে রুজবাকে? একদিকে বেস্ট ফ্রেন্ড অন্যদিকে রুজবা, যাকে নিজের বোন মেনেছে সাহিল। সাতপাঁচ না ভেবে সাহিল মেসেঞ্জারে ফোন করলো রুজবাকে। সাথে সাথেই রিসিভ করলো রুজবা। সাহিল হেসে বললো,

–“হ্যাঁ রুজবা, কেমন আছিস?”
–“ভালো ভাই, তোমার কি খবর? আনিকা আপু ভালো আছে?”
–“হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ।”
–“কি করছিলে?”
–“আনিকার সাথেই কথা বলছিলাম।”
-“আচ্ছা তাহলে তো বিরক্ত করলাম, কথা বলো তোমরা আমি পরে___”
–“এক থাপ্পড় দিবো, আমি বলেছি বিরক্ত হয়েছি?”
–“উঁহু।”
–“তাহলে? কি বলবি ফটাফট বলে ফেল।”

রুজবা ভেবে পেলো না জারাফের কথা ও কিভাবে সাহিলকে জিজ্ঞেস করবে? তাছাড়া সাহিল’ই বা কি ভাববে? তাই চুপ করে রইলো। সাহিল বললো,
–“নির্দ্বিধায় বল তো কি বলবি? আমাকে কিছু বলবি তাতে এত ভাবা লাগে?”
–“আচ্ছা সাহিল ভাই ও কি এই সম্পর্কে খুশি না? জারাফ কি সম্পর্কটা কন্টিনিউ করতে চায় না? ঢাকা থেকে এবার এসেছে পর থেকে ও কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমার সাথে দেখা করলেও সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। সারাক্ষণ ম্যাসেজ করে নিদ্রার সাথে আর একা একাই হাসে। নিদ্রা___”

রুজবাকে থামিয়ে দিয়ে সাহিল বললো,
–“তুই কিভাবে জানলি ও নিদ্রার সাথে ম্যাসেজ করে?”
–“কাল যখন আমরা একসাথে ছিলাম তখন নিদ্রার ফোন এসেছিলো। আমি স্ক্রিনে নাম দেখেছি। কার ফোন ছিলো জিজ্ঞেস করাতে বলে কাজিন, আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম ছেলে না মেয়ে? তাতেই জারাফ রেগে গেলো। নিদ্রা ফোন করে ওকে বাসায় ডাকতেই ও আমাকে বিদায় দিয়ে বাসায় চলে গেলো।

আবার আজও আমরা যখন একসাথে ছিলাম তখনো ও ম্যাসেজ করছিলো আমার পাশে বসেই। ফোন যখন টেবিলে রেখেছিলো দেখলাম নিদ্রা রিপ্লাই করে বলছে ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে ওর পছন্দের খাবার রেঁধেছে নিদ্রা। ওদের দুজনের মাঝে কি কিছু চলছে সাহিল ভাই? তুমি তো জারাফের বেস্ট ফ্রেন্ড তুমি নিশ্চয়ই জানো। বলো না আমাকে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে দিলো রুজবা। সাহিল হকচকিয়ে গেলো রুজবার আচমকা কান্নাতে। কি বলে রুজবাকে শান্তনা দিবে সেটাও ভেবে পেলো না ও। রুজবার কান্নার বেগ বাড়ছে। সাহিল অস্থির কন্ঠে বললো,

–“আরে পাগলী কাঁদছিস কেন? কান্না থামা।”
–“তোমার বন্ধুর এখন আর আমাকে পছন্দ না তাই না?”
–“সেরকম না আসলে___”
–“আসলে কি সাহিল ভাই?”
–“আমি তোকে একটা কথা বলি রুজবা? রাখবি?”
–“হ্যাঁ বলো, অবশ্যই রাখবো আমি।”

–“বেশি না জাস্ট তিনদিন তুই নিজে থেকে জারাফকে ফোন/ম্যাসেজ দেওয়া বন্ধ করে দে।”
–“কেন?”
–“তাহলেই বুঝতে পারবি তোর জায়গায় জারাফের মনে অন্য কেউ এসেছে কি আসেনি। তখন তোর কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
–“কিন্তু আমি যে ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না।”
–“পারবি, চেষ্টা কর একটু৷ এই তিনদিন না হয় ফ্রেন্ডদের বেশি সময় দে, নিজেকে সময় দে। নয়তো কাজিনদের সাথে ঘুরতে চলে যা। তবুও আগামী তিনদিন নিজে থেকে কোনো ফোন/ম্যাসেজ করিস না জারাফকে।”

–“কিন্তু___”
–“আমার এই কথাটা রাখ?”
–“আচ্ছা।”
–“ঠিক আছে, এখন তাহলে ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”
রুজবা সম্মতি জানাতেই সাহিল লাইন কেটে দিলো। রুজবা ফোনটা বিছানার পাশে রেখে চোখ বন্ধ করতেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো৷ জারাফ যদি ওকে ঠকিয়ে থাকে তাহলে রুজবা সেটা সত্যিই মানতে পারবে না৷ রুজবা যেন একেবারে শেষ হয়ে যাবে। বড্ড ভালোবাসে তো জারাফকে।

আমেরিকায় এখন দুপুর বারোটা। অন্যদিকে বাংলাদেশে সবাই এই মূহুর্তে গভীর ঘুমে মগ্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন রাত একটা বাজে। নুহাশের আজ অফডে। তাই অফিস যায়নি। নিজের ঘরেই বসে আছে। সকালে ব্রেকফাস্ট শেষে যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি ও। এখানে এসেছে আজ মাস দুয়েক হবে। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে নুহাশ। ব্যস্ততার মাঝে থাকলে যদি রুজবার কথা ভুলে থাকে তা’ও ভালো। কিন্তু মন যে অবাধ্য, সে কারো কথা শুনতে রাজি না। নিজ মর্জিতে চলে। নুহাশ ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে রুজবার ছবি বের করে গত এক ঘন্টা যাবত শুধু রুজবাকেই দেখে যাচ্ছে। ছবিতে নিজের আঙুল স্পর্শ করে নুহাশ বললো,

–“তোমার জন্যই তো এত দূরে পাড়ি জমিয়েছি রুজবা৷ তবুও তোমার ভাবনা আমার পিছু ছাড়ছে না কেন? তেরো হাজার দুইশো উনিশ কিলোমিটার দূরে থেকেও এভাবে পুড়াচ্ছো কেন আমাকে? পুড়তে পুড়তে যে কয়লা হয়ে যাচ্ছি, আর পুড়তে ভালো লাগে না আমার। তুমি___”
এমন সময় দরজায় নক করল কেউ৷ নুহাশ চোখের কোনে জমা পানি মুছে ফোনের সাইড বাটন ক্লিক করে পাওয়ার অফ করলো। তারপর বললো,

–“কাম।”
সাথে সাথেই থ্রি-কোয়াটার আর টি-শার্ট পড়া একটা মেয়ে গুটিগুটি পায়ে ভিতরে আসলো। মেয়েটা নুহাশের মামাতো বোন। নাম লিয়া, ভার্সিটিতে পড়ে। নুহাশ সরে বসে লিয়াকে বসার জায়গা করে দিয়ে বললো,
–“বসো।”
লিয়া ধপ করেই নুহাশের পাশে বসে পড়লো। নুহাশকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি করছিলে তুমি?”
–“কিছু না, কিছু বলবে তুমি?”

–“এমনি গল্প করতে আসলাম তোমার সাথে, এসেছো পর থেকেই তো তুমি বিজি আর আমিও ক্লাস করে বন্ধুদের সাথে হই হুল্লোড় শেষে তোমার সাথে আর গল্প করার সময় হয়ে উঠেনি। আজ যেহেতু দুজনেই ফ্রি তাই চলে এলাম।”
–“আচ্ছা, পড়াশোনা কেমন চলছে?”
–“বেশ ভালো।”

কথাটা বলে লিয়া আগাগোড়া নুহাশকে স্ক্যান করলো। নুহাশের পড়নে কালো টাউজার আর ছাই রঙা টি-শার্ট। লিয়ার অদ্ভুত চাহনিতে নুহাশ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বিছানা থেকে উঠে ওয়েন্ডো’র সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“কি দেখছো ওভাবে?”
লিয়া দৃষ্টি সরালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
–“ইউ’র লুকিং সো সে/ক্সি।”
–“হোয়াট?”

ক্ষানিকটা চেঁচিয়ে বললো নুহাশ। লিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলো নুহাশের এমন রিয়্যাক্টে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
–“এরকম রিয়্যাক্ট করছো ক্যান? এটা বিডি না নুহাশ, এটা ইউএসএ আর এখানে এসব কমপ্লিমেন্ট নরমাল।”
–“তুমি ইউএসএ মানুষ হলেও আমি বিডিতে মানুষ। সো আমাকে নিয়ে বা আমার সামনে এসব ওয়ার্ড ইউজ করার আগে দু বার ভাববে।”
–“আচ্ছা স্যরি স্যরি, আর হবে না এমন।”

কথাটা বলে লিয়া বিছানার উপর থেকে নুহাশের ফোন হাতে নিলো। নুহাশ তখন বাইরে তাকিয়ে ছিলো। লিয়া ফোনের সাইড বাটন ক্লিক করতেই ফোন আনলকড হয়ে গেলো। এতে বেশ অবাক হয় লিয়া। আজকাল নিজের ফোন কেউ আনলকড রাখে? স্ক্রিনে নজর দিতেই দেখলো একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা শাড়ি পড়া। লাল পাড়ের সাদা জমিনের শাড়ি পড়েছে আটপৌরে ভাবে। লিয়া ছবিটা দেখে বললো,

–“ওয়াও বিউটিফুল লেডি।”
লিয়ার কথা শুনে নুহাশ পেছনে ফিরে দেখলো লিয়ার হাতে ওর ফোন। নুহাশ দ্রুত লিয়ার থেকে নিজের ফোন নিয়ে দেখলো লিয়া রুজবার ছবি দেখে উপরোক্ত কথাটা বলেছে। নুহাশ ব্যাক বাটনে ক্লিক করে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে গেলো। ধমকের স্বরে বললো,

–“পারমিশন ছাড়া আমার ফোন ধরেছো কেন? ম্যানার্স নেই কোনো?”
লিয়া নুহাশের কথায় পাত্তা না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
–“কে মেয়েটা?”
–“তোমার না জানলেও হবে।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১২

কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় নুহাশ। লিয়া নুহাশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
–“আই লাইক ইউ’ও এটিটিউড নুহাশ। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। এ্যাজ এ্যা লাইফ-পার্টনার। তোমার মতো কাউকেই তো চাই আমি।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৪