অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৪

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৪
অরনিশা সাথী

জারাফ ঢাকায় ফিরেছে আজ চারদিন হলো। এই চারদিনে রুজবা জারাফকে ফোন ম্যাসেজ দেয়নি জারাফ’ও এসবে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। গত চারদিনে বোধহয় দু বার কিংবা তিন বার কথা হয়েছে রুজবার সাথে। এতেই রুজবা বুঝে গেছে জারাফের মনে রুজবার জায়গা’টা আর আগের মতো নেই। রুজবা’ও চেষ্টা করছে না আর। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক। দেখা যাক এভাবে কতদূর গড়ায়।

দেড় বছর অতিবাহিত হয়েছে এর মাঝে। রুজবার এইচএসসি শেষ, রেজাল্ট বেরিয়েছে। এখন ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নুহাশ’ও নিজের পড়াশোনা শেষ করে ইউএসএ’ই ওর ছোট মামার বিজনেসে জয়েন করেছে। লিয়া’র সাথে নুহাশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যদিওবা নুহাশ লিয়াকে বোন আর বন্ধুই ভাবে কিন্তু লিয়া নুহাশ’কে নিজের করে চায়। ইতিমধ্যে জারাফ’ও মাস্টার্স কমপ্লিট করে জহির সাহেবের অফিসে বেশ উচ্চ পদেই আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জারাফ নিদ্রাকে নিয়ে ডিনার করতে বের হয়েছে আজ। জারাফ নিজে থেকেই ডিনারের কথা বলেছিলো, নিদ্রা’ও রাজি হয়ে যায় সাথে সাথেই। খাবার অর্ডার করে বসে আছে দুজনেই। নিদ্রা টেবিলে রাখা হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
–“আজ হঠাৎ আমাকে নিয়ে ডিনার করতে ইচ্ছে হলো যে?”
জারাফ মৃদু হেসে বললো,

–“এমনি, অনেকদিন ধরেই বের হবো ভাবছিলাম আজ যেহেতু দ্রুত কাজ শেষ হয়েছে তাই আজই বের হলাম। কেনো খুশি হওনি তুমি?”
নিদ্রা একগাল হেসে বললো,
–“আমি তো ভীষণ খুশি।”

জারাফের ফোন বেজে উঠলো। রুজবার ফোন। জারাফ ফোন কেটে দিলো। আবারো ফোন দেয় রুজবা এবারে আর জারাফ ফোন রিসিভ না করে এমনিতেই রেখে দিলো। রুজবা আবারো ফোন দিলে জারাফ ফোন কেটে ম্যাসেজ দিলো,
–“ব্যস্ত আছি দেখেই তো ফোন তুলছি এরপরেও ফোন করছো কেন? ফ্রি হলে আমি ফোন দিবো।”
রুজবা আর রিপ্লাই করলো না। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। গত দেড় বছর ধরে এমনটাই হচ্ছে। চোখের পানি মুছে সাহিলকে কল করলো। সাহিল রিসিভ করতেই বললো,

–“সাহিল ভাই? জারাফকে ফোন দিয়ে আমাকে কলে অ্যাড করো।”
–“কেন? হঠাৎ___”
–“যা বলছি করো প্লিজ।”
–“কিন্তু___”
–“প্লিজ সাহিল ভাই, আমার কথাটা রাখো।”
–“আচ্ছা।”

সাহিল লাইন কেটে জারাফকে কল করলো। দুবার রিং হতেই জারাফ ফোন রিসিভ করলো। সাহিল তৎক্ষনাৎ রুজবাকে কলে অ্যাড করলো। জারাফ বললো,
–“হ্যাঁ মামা বল, কি খবর?”
–“ভালো, আজকাল তো তোর খবরই পাওয়া যায় না। খুব ব্যস্ত থাকিস নাকি?”
–“কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ততা থাকে। তুই যতটা বলছিস অতটাও না।”
–“আচ্ছা, কি করছিস?”
–“নিদ্রাকে নিয়ে ডিনারে বের হয়েছি।”

–“আচ্ছা, রুজবার সাথে কথা হয়নি আজ? ওকে কি সময় কম দিচ্ছিস? মেয়েটা কেমন সবসময় মনমরা থাকে।”
–“নিদ্রা আছে সাথে এখন এসব কথা না বলি?”
রুজবা মুখে ওড়না চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। নিদ্রার সাথে ডিনার করতে বের হয়েছে তার মানে এটাই জারাফের ব্যস্ততা। নিদ্রা’র সামনে রুজবার কথা বলা যাবে না।

রুজবা বুঝে গেছে জারাফের লাইফে রুজবার আর কোনো ভ্যালু নেই। এভাবেই জারাফ ধীরে ধীরে ওর জীবন থেকে রুজবাকে চিরতরে বের করে দিবে। সাহিল চাইছে আজ সবটা রুজবার সামনে আসুক। সবটা জানতে পারুক রুজবা, যে জারাফ আর ওকে ভালোবাসে না। মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে যে সাহিলের ভালো লাগে না। তাই সাহিল রুজবার সামনে সবটা ক্লিয়ার করার জন্য বললো,

–“বাই এনি চান্স, তুই কি নিদ্রা’কে ভালোবেসে ফেলেছিস?”
–“জানি না দোস্ত, ওর আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। ওর ভাবনা সারাক্ষণ মাথায় থাকে। ভাবছি প্রপোজ করবো আজ।”
সাহিল তাচ্ছিল্য হাসলো। রুজবা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সাহিল বললো,
–“তাহলে রুজবার কি হবে? জারাফ রুজবা তোকে ভালোবাসে ভীষণ, তোর জন্য ও নুহাশের সাথে নিজের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে আর তুই বলছিস তুই নিদ্রাকে প্রপোজ করবি? তোর আর রুজবার এতদিনের সম্পর্কের কথা কি ভুলে গেলি?”

–“ও’ও থাকবে৷”
–“মানে? একসাথে দুজনকে ঠকাবি তুই? ইতিমধ্যেই কিন্তু রুজবাকে বাজে ভাবে ঠকাচ্ছিস তুই।”
–“ইগনোর, অবহেলা করলে এমনিতেই ছেড়ে যাবে ও আমাকে। আর তাছাড়া ওর বাবা আমার জন্য ওকে কত দিন ঘরে বসিয়ে রাখবে, বিয়ে দিবে না? যখন দেখবে আমার দিক থেকে কোনো আগ্রহ নেই তখন ঠিকই ওর বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দিবে। বড়জোর এক-দেড় বছর দেখবে এর পরেই ওকে আবার বিয়ে দেওয়ার তোরজোর করবে দেখে নিস তুই।”

–“ঠিক করছিস না জারাফ।”
–“লাইফে ভালো থাকাটা আগে সাহিল। ভালোবাসা দিয়ে সারাজীবন ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকতে হলে টাকা পয়সা লাগে। যা নিদ্রা’র আছে। রুজবা আমাকে শুধু ভালোবাসা দিতে পারবে আর নিদ্রা’র থেকে ভালোবাসা টাকা দুটোই পাবো আমি।”

সাহিল আর রুজবা দুজনেই অবাক হয়ে সবটা শুনছে। রুজবার চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। সাহিল কিছু বলার আগেই রুজবা চোখের পানি মুছে বললো,
–“থ্যাংকিউ সো মাচ জারাফ, নিজের মুখেই সব সত্যিটা বলার জন্য। কত বোকা আমি, এতদিন যে তুমি আমায় ইগনোর করেছো আমি সেটা ব্যস্ততা ভেবে আকাশে উড়িয়েছি। আজ কলে অ্যাড না থাকলে তো এসব জানতেই পারতাম না আমি। আর না সাহিল ভাই আমায় নিজ মুখে তার প্রিয় বন্ধুর এই প্রতারণার কথা কখনো জানাতো।”
জারাফ অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,

–“রুজবা তুমি___”
–“কত বোকা আমি তাই না? তোমার মতো থার্ড ক্লাস অর্থলোভী একটা ছেলেকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি। হিরা’কে পায়ে ঠেলে কাঁচ’কে কাছে টেনেছিলাম আমি। রক্তাক্ত তো হতেই হবে আমাকে। যে ছেলে আমায় এত ভালোবাসলো তাকে পায়ে ঠেলেছি আর যে আমাকে এভাবে ঠকাচ্ছে তাকেই ভালোবেসেছি আমি।

নুহাশ ভাই আমাকে এক আকাশ সমান ভালোবেসেছে তার বিনিময়ে আমি এক আকাশ সমান যন্ত্রণা দিয়েছি। একজন ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিয়ে আমি রুজবা যে ভালো থাকবো এটা ওই উপরওয়ালা চায়নি, এইটুকু কষ্ট তো আমি’ও ডিজার্ভ’ই করি তাই না? ওকে ব্যাপার না। ভালো থাকেন আপনি মিস্টার জারাফ জুহায়ের, আজ এখান থেকেই আমাদের সব যোগাযোগ বন্ধ হলো। সুখি হোন আপনি নিদ্রা’কে নিয়ে।”

–“রুজবা, রুজবা শুনো___”
ততক্ষণে রুজবা লাইন কেটে দিয়েছে। জারাফ রাগান্বিত স্বরে সাহিলকে বললো,
–“এটা কি করলি তুই? রুজবাকে কলে রেখেছিলি আমাকে বলিস নাই কেন?”
–“রুজবা রিকুয়েষ্ট করেছিলো তাই বাধ্য হয়েছি। এত অস্থির কেন হচ্ছিস? ওকে তো আর ভালোবাসিস না। তাহলে ওর ব্যাপারে ভেবে লাভ নেই, তুই বরং নিদ্রাকে নিয়ে ভাব এই মূহুর্তে।”

এইটুকু বলে সাহিল’ও লাইন কেটে দিয়েছে। জারাফ নিজেই নিজের চুল খামচে ধরলো। ও চেয়েছিলো রুজবাকে ধীরে সুস্থে সবটা বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু এই মূহুর্তে হুট করে সব শুনে আবার উল্টাপাল্টা কিছু ঘটালে তখন কি হবে? এই ভেবে জারাফের চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে।

–“হেই নুহাশ, কি করছো তুমি?”
নুহাশ ডিভানে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো। এমন সময় লিয়া ঘরে ঢুকে কথাটা বললো। নুহাশ ল্যাপটপে মনোযোগ রেখে বললো,
–“কিছু কাজ পেন্ডিংয়ে আছে, সেগুলোই কমপ্লিট করছি, বসো।”
লিয়া ধপ করেই নুহাশের পাশে গিয়ে ওর গাঁ ঘেঁষে বসে পড়লো। নুহাশ তৎক্ষনাৎ আবার দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করলো। লিয়া বললো,

–“তুমি এরকম কেন নুহাশ?”
–“গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি আমার একদম পছন্দ না লিয়া।”
লিয়া চুপ করে নুহাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর দেখতে ছেলেটা৷ শ্যামলা গায়ের রং। কুচকুচে কালো ভ্রু। বড় বড় চোখের পাপড়ি। আর খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি। এতেই ছেলেটাকে এত্ত কিউট লাগে লিয়ার কাছে। তার উপর নাকের ডগায় ছোট্ট একটা কুচকুচে কালো তিল। যা নুহাশের সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ করেছে। লিয়া আগাগোড়া নুহাশকে দেখে একটা শুকনো ঢোক গিললো। তারপর বললো,

–“নুহাশ একটা কথা বলি?”
–“বলো।”
লিয়া কোনো সংকোচ ছাড়াই চট করে বলে দিলো,
–“আই লাভ ইউ।”

নুহাশ কাজ থামিয়ে এক পলক তাকালো লিয়ার দিকে। তারপর আবার কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“আই লাভ অ্যানাদার পারসোন।”
–“কিন্তু রুজবা তো তোমাকে ভালোবাসে না। এতদিনে মেবি ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে সুখে সংসার করছে ও।”
নুহাশ ল্যাপটপ অফ করে বললো,

–“এখনো বিয়ে করেনি ওরা। রুজবার সব খবর আছে আমার কাছে।”
–“করেনি, একদিন তো করবে।”
–“করুক।”
–“তো? ওর জন্য কি তুমি একা থাকবা নাকি? তোমারটা ওয়ান সাইড লাভ ছিলো নুহাশ। কিন্তু তুমি চাইলে আমার ভালোবাসা ওয়ান সাইড হবে না। তুমি চাইলে আমরা সুন্দর একটা রিলেশনে যেতে পারি। সুন্দর পরিনতি হতে পারে___”

–“নট নিড। এখন তুমি যাও প্লিজ, টায়ার্ড আমি।”
লিয়া নুহাশের চুলে হাত দিয়ে বললো,
–“আমি চুলে হাত বুলিয়ে দেই? ভালো লাগবে তোমার।”
নুহাশ মাথা সরিয়ে নিয়ে বললো,
–“লাগবে না, তুমি যাও প্লিজ।”

লিয়া বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। নুহাশ উঠে গিয়ে দরজা লক করে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলো। রুজবাকে ভীষণ মনে পড়ছে আজ ওর। রুজবাকে স্বচক্ষে দেখার তৃষ্ণা’টা শুধুই বাড়ছে। কিন্তু দেশে ফিরে যাওয়ার’ও আর ইচ্ছে নেই। দেশে গেলেই সবাই আবার বিয়ে করানোর জন্য উঠে পড়ে লাগবে যা নুহাশ একদমই চায় না। সাথে রুজবার সাথে জারাফকে’ও দেখতে পারবে না ও। এসব ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো নুহাশ।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৩

|এ কদিন গল্প না দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমি আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, বাড়িতে মেহমান আছে কিছু দিন গল্প আসবে না। এখন থেকে আগের মতোই গল্প পাবেন। আর পর্বটা কেমন হয়েছে অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন, ধন্যবাদ|

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৫