ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১
সাইয়্যারা খান

রাতুল এলোমেলো পা ফেলে বাড়িতে ডুকলো। কলিং বেল চাপতেই দরজা’টা ফট করে খুলে গেলো। দিশা যেন এতক্ষণ রাতুলের অপেক্ষাতেই ছিলো। অবিন্যস্ত রাতুল’কে দেখেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। হসপিটালে রাতে ছিলো দিশা কিন্তু এত মানুষ থাকা এলাউড না তাই চলে আসতে হয়েছিলো। এখন ভোর রাত। আলো ফুটবে ফুটবে ভাব। দিশা ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়াতে রাতুল দুই কদম পেছালো। কোন মতে দিশা’কে ধরে ক্লান্ত কন্ঠে বললো,

— এখনও ঘুমাও নি কেন দিশা?
— রোদের কি অবস্থা? দুলাভাই ঠিক আছেন? আর ছেলেটা?
রাতুল উত্তর দিতে পারলো না। দিশা’কে নিয়েই ভেতরে ডুকে বললো,
— চেঞ্জ করতে হবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দিশা রুমে তারাতাড়ি সব গুছিয়ে দিলো। রাতুল প্রায় ঘন্টা লাগিয়ে সাওয়ার নিলো। দিশা অপেক্ষা করছে। রাতুল বের হতেই এতক্ষণের কৌতুহল গিলে নিলো দিশা। লাল টকটকে হয়ে আছে রাতুলের চোখ জোড়া। এরমানে কেঁদেছে এতক্ষণ। দিশা কিছু না বলে রাতুলের জন্য খাবার নিয়ে এলো। নিজ হাতে খায়িয়ে দিলো। রাতুল একবার শুধু বললো,
— তুমি ও তো খাওনি দিশা। খেয়ে নাও।

দিশা’র চোখটা টলমল করছে। এই কথাটা’র মধ্যেই যেন ও রাতুলের ভালোবাসা খুঁজে পেলো। আর কি চাই? খাওয়া হতেই সব রেখে এলো দিশা। আসতেই দেখলো কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে রাতুল। লাইট’টা অফ করে দিশা রাতুলের মাথার কাছে বসলো। মাথায় হাত রাখতেই রাতুল ফট করে দিশার কোলে মাথা তুলে দিয়ে মুখ গুজে দিলো পেটে। সুতির কাপড়’টা ভিজে উঠলো। রাতুল কাঁদছে। দিশা কাঁদতে দিলো ওকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন দেখিয়েন।
রাতুলের কান্না’র এবার শব্দ হলো। ছেলেটা কেঁদে যাচ্ছে। রাতুলের এমন ফিকড়ে উঠা কান্না যেন সহ্য হচ্ছে না দিশার। রাতুল ওভাবেই বলে যাচ্ছে,

— আ…আমার সামনেই হলো ছোট্ট একটা পরি দিশা। কত সুন্দর জানো তুমি? আ..আমি ছুঁতে চেয়েছিলাম।পারি নি। এত রুপ নিয়ে এসেছিলো পরিটা। একদম জীবন্ত পুতুল একটা। ক…কিভাবে কি হয়ে গেলো? আমি দেখেছি ছোট্ট জানটার প্রাণহীন দেহটা। মনে হচ্ছিলো ঘুমাচ্ছে। কবরে রেখে এলাম। কি…কিভাবে রেখে এলাম? এই দিশা রুদ্রিতা তো ওর সন্তান’কে চোখের দেখা ও দেখলো না। ছেলেটা মনে হয় না বাঁচবে। যেই সন্তানের জন্য এত এত কষ্ট সেই সন্তানই চলে গেল।

আর বলতে পারলো না রাতুল। ছেলেটা কাঁদছে। এদিকে দিশাও কেঁদে যাচ্ছে। কিভাবে রোদকে সামলাবে যখন জানবে ওর মেয়ে’র দাফন হয়েছে ওকে ছাড়া?

ধীমি গতিতে সময় গড়ালো। সবাইকে দুশ্চিন্তা’য় ফেলে দুই কেবিনে রোদ আদ্রিয়ান শুয়ে আছে। এনআইসিউ তে ছোট্ট ছেলেটা আজ চার দিন ধরে। না পেয়েছে মা’য়ের ছোঁয়া আর না ই পেয়েছে বাবা’র স্পর্শ। ছোট্ট প্রাণ’টার কপালটাকি এতটাই খারাপ? আদ্রিয়ান আপাতত অসুস্থ। ঐ দিন হার্ট অ্যাটাক এসেছিলো ওর দ্বিতীয় বারের মতো।

ডক্টর সোজা বলে দিয়েছে দুশ্চিন্তা না করতে। রিস্ক জোনে আছে আদ্রিয়ান। পরবর্তী’তে কিছু হলে আদ্রিয়ান বাঁচবে কি না বলা মুশকিল। গত চার রাত ধরে হসপিটালেই শয্যাশায়ী হয়ে আছে ও। কারো দিকে খেয়াল নেই। গত রাত থেকে হুসে এসেছে কিছুটা। একটু আগেই কেবিনে দেওয়া হলো ওকে। আদ্রিয়ান শুধু জানে রোদ আর ছেলে বাচ্চা’টা বেঁচে আছে। শুনেছে কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখায় নি এমনকি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস ও করে নি। না দেখতে চেয়েছে স্ত্রী সন্তানকে।

রোদের অবস্থা যেহেতু আগে থেকেই খারাপ ছিলো তাই ওর সুস্থ হতে সময় লাগবেই। সমস্যা হলো বাচ্চা’টাকে এখন ব্রেস্ট ফিডিং করানো দরকার। এতদিন হসপিটালে বিশেষ প্রকৃয়া’তে দুগ্ধ পান করানো হয়েছে তাকে। এখনও মায়ের শাল দুধ পায় নি সে। তারমধ্য অতিশয় দূর্বল বাচ্চা তা ও কি না প্রিমেচিওর চাইল্ড।

আজকে রোদ সাড়া দিয়েছে অল্প। হুসে ছিলো না এতদিন। আজ’কে সকাল থেকেই রেসপন্স করছে রোদ। সারাদিন ডক্টরের অবজারভেশনেই আছে। কেউ না কেউ কাছেই থাকে। ওর রেসপন্স সবার আগে ইয়াজই খেয়াল করেছিলো। শক্ত মানুষ গুলো কিভাবে যেন ভেঙে পড়েছিলো। ইয়াজ গত চারদিন রাত নেই দিন নেই হসপিটালে ছিলো। রাতুল কাছে আসতো না তেমন একটা। সবার সাথে দেখে দেখে গিয়েছে। কেন জানি তাকাতে পারে না রোদের দিকে। শুধু ভাবে রোদের অবস্থা কি হবে জ্ঞান ফিরলে?

চোখ খুললো রোদ। আস্তে আস্তে পেটে ব্যাথা অনুভব করলো। কেমন চিনচিন ব্যাথা। ব্যাথার চোটে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। একহাত পেটে ওর। উপস্থিত সবাই ধরফরিয়ে উঠলো। রাদ এগিয়ে এসে বোনকে ধরে বললো,
— সোনা কোথায় ব্যাথা করছে? ভাই’কে বল।
— প…পেটে।

ইয়াজ তখনই একটা রোদের কোমড়ের দিকে একটা ইনজেকশন পুশ করলো। দুই মিনিট যেতেই ব্যাথা কমে এলো। রোদ ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— উনি কোথায়? আর বাবু’রা?
সবাই চুপ করে গেলো। রোদের বাবা এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় চুমু খেলেন। রোদ ছলছল চোখ করে তাকিয়ে ডাকলো,
— আব্বু।
— জ্বি আম্মা।

— তোমার আম্মা আবারও মা হয়ে গিয়েছে। ওদের দেখেছো? মিশান মিশি আসে নি?
রোদের বাবা এতটা শক্ত হওয়ার পরও ভেঙে পড়লেন যেন। কোন উত্তর না দিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। রোদ মুখ ঘুরিয়ে সবাই’কে দেখে নিলো। সবার চেহারার মাধ্যমে ও বুঝার চেষ্টা করছে কিছুটা। জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা উনি কোথায়? ডেকে দাও।
ইয়াজ পা ঠেলে এগিয়ে এসে রোদে’র বা হাতটা ধরে বললো,

— রোদ, এখন রেস্ট নিবি। পরে সব।
— কি হয়েছে?
— কি হবে? কিছুই না।
— সত্যি বল ইয়াজ।৷ আমার কেমন জানি লাগছে।
ইয়াজ সবার দিকে তাকালো। এই ধ্রুব সত্যি টা কিভাবে লুকাবে? সবাই মুখ চাওড়া চাওড়ি করছে। কেউ ই সাহস পাচ্ছে না বলার। কিভবে একটা মা’কে তার সন্তানের মৃত্যু’র কথা জানাবে?
ইয়াজ শান্ত স্বরে রোদকে বলতে লাগলো,

— রোদ নিজেকে শক্ত রাখ।
— ঠিক করে বল।
এবার কিছুটা দৃঢ় শুনালো রোদের কন্ঠ। ইয়াজ রোদের হাতটা ধরে বললো,
— ছেলে বাবুটা অসুস্থ রোদ। জানিস ই তো আগে থেকে গ্রোথ কম ছিলো।
রোদ যেন ছটফটিয়ে উঠলো। উঠার চেষ্টা চালালো। রাদ তারাতাড়ি বোনকে ধরে বললো,

— এখন ঠিক আছে ও রোদ। শান্ত হ।
— আমাকে এনে দাও ওকে। কোথায় আছে ও?
— এনআইসিউ তে আছে সোনা। এমন করে না।
— আমার মেয়ে? আমার কোথায়? আর উনি কোথায়? উনাকে ডাক। নিশ্চিত কাঁদছে তাই না? আমি জানি তো।

ঢোল গিললো ইয়াজ। যতটুকু উগলেছে তা ই অনেক সাধ্য ছিলো। আর কিছু বলতে পারবে না ও। রোদের হাতটা ছেড়ে দিলো ইয়াজ। রাদ বোনকে ধরে রাখলো। জীবিত সন্তানের জন্য যে এমন করছে তাকে মৃত সন্তানের খবর কিভাবে জানাবে? কিভাবে জানাবে চারদিন আগেই যে তার সন্তান দুনিয়া ত্যাগ করেছে?

বড়জোর কয়েক মিনিটে’র মেহমান ছিলো সে। রাদকে বারবার জিনিস করছে রোদ। কেউ কোন উত্তর করছে না। এবার রোদ ছটফটানি বাড়িয়ে দিলো তখনই ওর পেটের সেলাই’তে টান পরলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো রোদ। রাদ দেখলো পরিস্থিতি খারাপ। রোদ পাগলামি করছে এখন রীতিমতো। মায়ে’র মন কিছুটা আন্দাজ করেছে বোধহয়। বোনকে দুইহাতে আগলে নিলো রাদ। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,

— বলছি। শান্ত হ। রোদ? তাকা!
রোদ ঝাপ্সা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকলো। ও বুঝতে পারলো না ওর মা, শাশুড়ী এরা এভাবে কাঁদছে কেন? রাদ থেমে থেমে সত্যি’টা বলে দিলো,
— রোদ মেয়ে…..বাবুটা খনিকের….. মেহমান ছিলো সোনা।
থমকে গেলো রোদ। অবিশ্বাস্য চোখে ভাইকে দেখে নিলো। শুধু বললো,

— দ…দাফন করে ফেলেছো?
রাদ বুক’টা যেন ছলাৎ করে উঠলো। আরিয়ান এগিয়ে এসে রোদে’র মাথায় হাত রেখে বললো,
— আজ চারদিন তুই বেহুস রোদ।
যা বুঝার বুঝে গেলো রোদ। এই কথার অর্থ কি তা বুঝার ক্ষমতা আর বোধ দুইটাই আছে রোদের। হঠাৎ করে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো মেয়েটা। ভাইয়ের বুকে সন্তানের জন্য আর্তনাদ করে উঠলো। বারবার বলে যাচ্ছে,

— আ..আমি আমি তো দেখলাম না ভাই। আমি তো দেখলাম না। এ..এক একটা বার ও দেখলাম না। ভাই আমাকে কেন দেখালা না? আমি ওকে দেখলাম না। আমার মেয়ে….আমার মে…
আর বলা হলো না। জ্ঞান হারালো রোদ রাদের বুকে। কেঁদে ফেললো রাদ। জানের বিনিময়ে জান পাওয়া গেলে বোনের এই আর্তনাদ শুনার অপেক্ষা বুঝি রাদ করে? নিজেকে না বিলিয়ে দিতো রাদ? কলিজার বোন ওর। তার এহেন রুপ কিভাবে সহ্য করবে ও?

ইয়াজ মাথা’টা চেয়ারে এলিয়ে চোখ বুজে আছে। তখনই ধীর পায়ে কেউ কেবিনে ডুকলো। খুব আস্তে হাতে রাখা জিনিসগুলো টেবিলে রাখলো। এগিয়ে এলো ইয়াজের মাথার নিকট। হাত রাখলো চুলের ভাজে। চোখ মেলে তাকালো ইয়াজ। ওমনি চোখে ভেসে উঠলো জারবা’র লাল লাল ফুলা চোখ। মেয়েটা শুধু কাঁদে। অন্য সময় হলে ইয়াজই দেখে নিতো কিন্তু এখন আর সম্ভব না। ইয়াজ নিজেই জারবাকে থামাতো। আপাতত ইয়াজ নিজেই ডিসট্রেকটেড। জারবা ইয়াজের কপাল চেপে দিলো কিছুসময়। নরম নরম হাতের অল্প চাপ ভালোই লাগলো ইয়াজের। মাথাটা ধরেছিলো বটে। রোদটার চিন্তা’য় ঘুম হারা আজ চারদিন। জারবা কিছুসময় পর নরম ভেজা গলায় বললো,

— হাত মুখ ধুয়ে আসুন। খাবেন।
— রোদ জেনে গিয়েছে?
— বড় ভাইয়া বললো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমি দেখে আসলাম।
ইয়াজ উঠে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলো। জারবা খাবার বেড়ে দিলো ইয়াজকে। সবার খাবার ই পাঠানো হয়েছে তখন জারবা ইয়াজের জন্য ও নিয়ে আসে। জারবা জানে নিজ হাতে খাবে না ইয়াজ। এক লোকমা মুখে তুলেই আর খায় না তাই জারবা ভাত মেখে ওর মুখে তুলে দিলো। ইয়াজ চুপচাপ খেয়ে নিলো। শরীরে তো শক্তি দরকার।

জ্ঞান ফিরেছে রোদের। একদম চুপ মে-রে আছে ও। কারো সাথে কথা বলছে না। ওর মাথায় চলছে অন্য কথা। আদ্রিয়ান কোথায়? লোকটা পাগল হয়ে যায় নি তো? রোদের বুকে কিছু একটা হলো। কেমন মোচড়ে উঠছে বারবার। আশে পাশে তাকাতেই দেখলো সোফাতে আর পাশের বেডে ওর মা, শাশুড়ী আর দিশা মাথা এলিয়ে চোখ বুজে আছে। হয়তো ক্লান্ত। নার্স ডুকতেই রোদ জিজ্ঞেস করলো,

— আমার হাসব্যান্ড কে চিনেন? লম্বা করে সুন্দর। ডেকে দিন একটু।
— ম্যাম আপনার হাসবেন্ড এখন কিভাবে আসবে?
— মানে?
না বুঝে প্রশ্ন করলো রোদ। নার্স ও সরল মনে বলে উঠলো,

— উনার তো হার্ট অ্যাটাক এসেছিলো চারদিন আগে। এখন পাশের কেবিনেই আছে।
“হাট অ্যাটাক”। আদ্রিয়ানের? রোদ ভাবতে পারলো না আর। শরীরে’র সর্বশক্তি প্রয়োগ করে উঠে বসে পরলো। সারা শরীর কাঁপছে ওর। নার্স ওকে ধরার চেষ্টা করতেই রোদ নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কেঁদে ফেললো। জেগে উঠলো সবাই। রোদের এই অবস্থা দেখে ভয় ও পেলো কিছুটা। রোদ বলে যাচ্ছে,

— উনার কাছে যাব। উনি ভালো নেই। আমাকে দরকার তার।
চেঁচামেচি শুনে রাদ সহ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাতুলও দৌড়ে ডুকলো। রোদকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। রাদ’কে দেখেই রোদ হাত বাড়িয়ে দিলো। রাদের বুকে হালকা কাঁপন ধরলো। মনে পরলো ছোট্ট রোদটা যখন ব্যাথা পেতো তখন এভাবে হাত বাড়িয়ে দিতো ভাইকে। ভরসার এর অন্য নাম হলো রাদ রোদের কাছে।

রোদ ছুটন্ত পায়ে এসে ঝাপটে নিলো বোনকে। পাজা কোলে তুলে নিয়ে গেলো আদ্রিয়ানের কেবিনে। মুখে মাস্ক লাগানো। হাতে স্যালাইন চলছে আদ্রিয়ানের। চেহারার অবস্থা ভালো না। কপালে ব্যান্ডেজ। রোদ আদ্রিয়ানকে দেখেই শান্ত হয়ে গেল। কান্না থেমে গিয়েছে। রাদ একদম এগিয়ে এসে আদ্রিয়ানের সামনে দাঁড়াতেই রোদ নামতে চাইলো। রাদ আস্তে করে পাশের খালি বেডে রোদকে বসাতেই রোদ রাদকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে গেলো।

এমনি সময় সিজারের দুই দিন পরই রুগী হাটতে পারে কিন্তু রোদে’র ব্যাপার’টা কিছুটা ভিন্ন। রাদকে ধরেই আদ্রিয়ানের কাছে এলো। দুই কদম হাঁটতে’ই পা বেয়ে লাল র*ক্তের ধারা বয়ে গেলো। রোদের মা ধরতে গেলেও রোদ সরে এলো আদ্রিয়ানের কাছে। ঘুমাচ্ছে লোকটা। রোদ হাত বুলিয়ে দিলো আদ্রিয়ানের কপালের ব্যান্ডেজে। চুমু খেল সরু কপালে। আদ্রিয়ানের বুকে হাত দিয়ে হাতিয়ে দিচ্ছে বারবার। হঠাৎ চোখ খুলে তাকালো আদ্রিয়ান। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চোখ জোড়া। রোদকে দেখে যেন এই মুহূর্তে বড্ড আশ্চর্য হলো। খাদে নামা কন্ঠে রাদকে জিজ্ঞেস করলো,

— ও এখানে কেন?
রাদ রোদকে ধরে নিয়ে বললো,
— এবার চল।
— উহু। তুমি যাও।
রোদের মা এগিয়ে এসে জোর করে ধরে বললো,
— মা আমার এমন করে না। ব্লিডিং হচ্ছে তোর। পেটে চাপ পরবে।

কেউ বুঝতে পারছে না রোদের কষ্ট এসবে না। ওর কষ্ট তো পুরোটা আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানের এহেন দশা। রোদ ঠাই বসে রইলো। আদ্রিয়ান ওর দিকে তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। এসবে যে রোদ পুড়ছে তা কি লোক’টা বুঝতে পারছে না?
রোদ যাবে না আবার দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না। দাঁত খিঁচে কোনমতে রাদ’কে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও। রোদ এখন যে যাবে না তা ঠিক বুঝতে পারলো রাদ। আরিয়ান নার্স ডেকে আনতেই তিনি রোদের পা মুছে দিলেন।

রোদকে চেয়ারে বসিয়ে সাইড থেকে রাদ ধরে রাখলো। আদ্রিয়ান তখনও শুধু দেখে গেলো। রোদের দিকে তাকাতে পারলো না। বুকে কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে যা কেউ দেখতে বা উপলব্ধি করতে অক্ষম। রোদ হাত রাখলো আদ্রিয়ানের চেহারায়। মাস্ক থাকার কারণে ঠিকঠাক ছুঁয়ে দিতে পারলো না। ওভাবেই ঝুঁকে গলা জড়িয়ে নিলো আদ্রিয়ানের। সাথে সাথে পাতলা কাপড়ে ফুটে উঠলো লাল র*ক্তের দাগ। রোদ ছাড়লো না আদ্রিয়ান’কে। রাদ ধরে টেনে সরাতে চাইলো পারলো না। অবশেষে ধমকে উঠলো,

— এই পর্যন্ত দুই বার সিলি ছুটেছে। আর একবার যদি হয় থাপড়ে তোর গাল লাল করে দিব বেয়াদব। উঠ। রোদ!
রোদ নড়ে না তবুও। ওর আদ্রিয়ান। ওর ভালোবাসা। ওর প্রাণ। কেন ছাড়বে রোদ? একটুও ছাড়বে না। ওর আদ্রিয়ানের মনের খবর ও বাদে কে জানে? লোকটার এখন দরকার রোদকে। তাহলে কেন যাবে রোদ?
রোদকে নড়াতে না পেরে এবার রাদ জোর করে তুলে নিলো ওকে। রোদ আদ্র গলায় বলে উঠলো,

— ভাইয়া’কে নামাতে বলুন। এই আপনি বলুন। আমি যাব না তো। আপনার কাছে থাকব।
আদ্রিয়ান বললো না। তাকালো না পর্যন্ত। অনুভূতি শূন্য’র মতো চোখ বুজে নিলো। বদ্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে বেয়ে পরলো রংহীন পানি।

রোদকে ধরে চেঞ্জ করানো হয়েছে। আবারও স্যালাইন লাগানো হয়েছে। রোদ চোখ বুজে আছে। বারবার আদ্রিয়ানের বেরঙ মুখটা ওর চেহারার সামনে ভেসে উঠছে। হঠাৎ কেউ যেন ওর গলা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ছোট ছোট হাত দুটি প্রসারিত করে জড়িয়ে আছে। এমন ভাবে ধরেছে যেন হারিয়ে যাওয়া কিছু পেয়েছে সে। রোদ বা হাতটা দিয়ে নিজেও জড়িয়ে নিলো। রোদ ও অজ্ঞান ছিলো তাই দিনদুনিয়ার হুস ছিলো না কিন্তু ওর বাচ্চাগুলো পরিবার তারা কিভাবে পার করেছে চারটা দিন? এত মানুষিক আঘাতই বা কিভাবে সহ্য করেছে? ফুঁপানোর শব্দ পেলো রোদ। নিজের সাথে আরোকটু চেপে ধরলো মিশি’কে। মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় ডাকলো,

— মা।
মিশি মুখটা তুলে উত্তরে মায়ের ঠোঁট চুমু খেয়ে আবারও গলায় মুখ গুজে দিলো। রোদের হাহাকার করা বুকটা শীতল হলো বুঝি? হ্যাঁ, হলো তো। এই যে রোদে’র মেয়ে। এই মিশি’টা ই তো ওর মেয়ে। কে বলে রোদের মেয়ে নেই। এই তো আছে ওর মেয়ে। ভাবতেই কান্না চলে এলো ওর।

— মাম্মার কিশমিশ। তাকাও। এই যে মা। দেখি। কাঁদে না।
মিশির চোখ মুছিয়ে দিলো রোদ। সামনে তাকাতেই বুঝলো রাদ কোলে করে একেবারে রোদের মাথার কাছে দিয়েছে। রোদ নজর ঘুরাতেই দেখলো আদ্রিয়ানের মায়ের কোণ ঘেঁষে বসে আছে ওর ছেলে। মিশানটা কেমন জানি। প্রকাশ করতে পারে না কিছু। রোদ ডেকে উঠলো,

— আব্বু এখানে এসো।
মিশান উঠলো না। দাদির হাত ধরে বসে রইলো। রোদ আবারও ডাকলো,
— মিশান আসবে না বাবা?
মিশান উঠলো। দুই পা এক পা করে এগিয়ে এলো। রোদের সামনে টুলটাতে বসতেই ওর মন চাইলো মিশির মতো মায়ের বুকে মুখ চেপে কান্না করতে কিন্তু পারলো না। কিভাবে পারবে মিশান কি এভাবে ছিলো কোনদিন? কোনদিন কি এমন পরিস্থিতি’তে পড়েছে ও?

উহু না পরেনি তো। রোদই হাত বাড়িয়ে দিলো। মিশান যেন এর ই অপেক্ষায় ছিলো। জড়িয়ে ধরলো মায়ের গলা। কেঁদে ফেললো ছেলেটা। ভাইয়ের কান্নায় মিশিও আবার কেঁদে উঠলো। ছোট্ট মিশি তো এখনও জানে না ওর ছোট্ট বোন যে নেই কিন্তু মিশান তো জানে।তাই তো ছেলেটা কেমন পাগল পাগল হয়ে কাঁদছে। একদম বাবা’র মতো। সহনশীলতা কম। কেঁদে ফেলে আপন কারো কিছু হলে।

সবার অবস্থাই এখন উন্নতির পথে। অন্ধকার এখন বাইরে। মিশি আর মিশান আজ রয়ে গেল। কেউ ই যাবে না আর রোদও ছাড়বে না। আপাতত মিশি রোদে’র মা’য়ের কাছে পাশের বেডে ঘুমাচ্ছে। রাদ মিশানকে টেনে টুনে খেতে নিয়েছে। ছেলেটা মায়ের হাত ধরে শুধু কাঁদছেই আসার পর থেকে। আপাতত রুদ্র বসে আছে বোনের হাত ধরে। রোদ রুদ্র’কে একটু আদর করে দিলো। ভাইটা শুধু কাঁদে। রুদ্র তখনও টুলে বসে মাথাটা রোদের বলিশেই রেখেছে। মাঝে মধ্যে আবার বোনের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
মিশান আসতেই রোদ ডেকে বললো,

— মামা কোথায় তোমার?
— নিচে দেড়ী হবে একটু।
— বাবা মা’কে একটু উঠতে সাহায্য করো।
মিশান আর রুদ্র দু’জনই সাহায্য করলো। রোদ নামতে নিলেই মিশান বাঁধা দিয়ে বললো,
— কি করছো?
— আস্তে তোমার দিদা উঠে যাবে। মা’কে ধরো। তোমার বাবা’র কাছে যাব।

মিশান আর রুদ্র দুজনই না করলো। তবুও রোদের জোড়াজুড়ি’তে রাজি হয়ে দুই জন দুই দিক থেকে সাপোর্ট দিলো। রোদ আস্তে আস্তে ওদের উপর ভর দিয়ে পাশের কেবিনে ডুকলো। আদ্রিয়ান আর আরিয়ান দু’জনই চমকালো। আরিয়ান উঠে এসে ওকে ধরে ভেতরে নিতেই রোদ বললো,

— আমি একটু একা থাকব।
আরিয়ান আন্দাজ করলো কিছুটা। কিছু না বলে ওদের নিয়ে বের হয়ে গেল। রোদ তখন আদ্রিয়ানের পাশে হেলান দিয়ে বসা। রোদ আদ্রিয়ানের গালে হাত রাখলো। আবার বুকে রাখলো। বুকটাতে নরম হাতে আদর দিলো। আদ্রিয়ানের ধৈর্য হারা হতে সময় লাগলো না।রোদকে ঝাপটে ধরে বুকে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো। দুই হাতে রোদ ওকে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

— আর কত কাঁদবেন। চার বাচ্চার বাবা কি না এভাবে কাঁদে যেন নিজেই বাচ্চা।
— আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি রোদ। হারিয়ে ফেলেছি। আমার মেয়ে রোদ। আমার মেয়ে। আমার কোলে ছিলো। হাসলো। তো..তোমার মতো গালে টোল পড়ে। আমি দেখেছি।

রোদের বুকে চাপ অনুভব হলো। মন চাইলো একটু আদ্রিয়ানের সাথে বিলাপ পারতে। বলতে যে, “আপনি তো চোখের দেখা দেখলেন। স্পর্শ করলেন কিন্তু অভাগী মা সাড়ে সাত মাস পেটে রেখেও দেখা বা ছুঁয়ার সুযোগ টুকু পেলাম না”।
কিন্তু বললো না রোদ। ভাঙলে চলবে না। আদ্রিয়ানটাকে স্বাভাবিক করতে হবে। রোদ আদ্রিয়ানের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— আপনার মেয়ে তার বাবা’কেই দেখতে এসেছিলো। তার বুক শান্ত করতে এসেছিলো অথচ তার বাবা কি না এভাবে পরে আছে?
— ও আমাকে দেখেছিলো। জানো…. জানো তু…তুমি আ…আমি ওর প্রা*ণ*হী*ণ দে…হটা….

আর বলতে পারলো না আদ্রিয়ান। রোদ শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ওকে নিজের মাঝে। কলিজাটা যেন ওর ছিন্ন বিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরলো রোদ। মুখে নোনতা স্বাদ দেতেই বুঝলো ঠোঁট কেটেছে। নিজেকে দমিয়ে রেখে রোদ বললো,
— আচ্ছা পরিস্থিতি, অবস্থা সবকিছুর সাপেক্ষ তো কারো বাঁচার কথা ছিলো না। না আগে আর না ই ঐদিনের পরে। তাহলে? এতটা নাশুকরি কেন? আল্লাহ যদি আরো প্রাণ তার কাছে নিতো তাহলে? আপনার কিছু হলে মিশি, মিশানের কি হতো? কেমন পাগলামি এসব হু?

বলেই আদ্রিয়ান’কে বুক থেকে তুলে চুমু খেল কপালে। আদ্রিয়ান ফুঁপাচ্ছে। রোদ ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,
— জানেন তো ছোট্ট বাবুরা জান্নাতি হয়। তারা নাকি মা-বাবা ছাড়া জান্নতে যেতে চায় না। তাহলে ও নিশ্চিত আমাদের নিয়ে যাবে তাই না? আল্লাহ তো সব ভালোর জন্য ই করে। তওয়াক্কুল তো রেখেছিলেন তাহলে এখন কেন এত আহাজারি হুম?
আদ্রিয়ান বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়লো। পরপরই রোদের বুকে মাথা দিয়ে চুপ রইলো। রোদ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— ছেলে’টা এখনও দেখি নি। চলবেন? একটু দেখি। ও কি ভাববে যে চারদিন ধরে পৃথিবীতে এসেছে অথচ ওর মা-বাবা কি না দেখতেও এলো না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫০

আদ্রিয়ানের বুকটা হু হু করে উঠলো। আসলেই তো ওর আরেকটা জান তো আছে। তাকে তো দেখল না। ছেলেটা তো অতি দূর্বল। কেমন বাবা হলো আদ্রিয়ান তাহলে? ছেলেটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারলো না এখনও? রেগে আছে নাকি পুচকু টা?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১ শেষ অংশ