ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১ শেষ অংশ

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১ শেষ অংশ
সাইয়্যারা খান

রোদ হাটতে পারবে না বিধায় আদ্রিয়ান একটা স্ট্রেচিং চেয়ার আনালো। সেটাতে রোদকে বসিয়ে নিজেও কিছুটা ভর আরিয়ানের উপর দিয়ে হাটা দিলো কেবিনের বাইরে। যতটা এগুচ্ছে ততটাই বুকটা ধুকপুক করছে দু’জনের। আরিয়ান ওদের ভেতর দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। আদ্রিয়ান রোদ তখনও দেখে নি তাদের ছোট্ট সোনাকে।

কাঁচের ঘেরাও দেয়া একটা বেডে শুয়ে আছে অতি ছোট্ট একটা জান। একেবারেই পুচকু। কাঁপা পায়ে রোদের সাথে এগিয়ে আসছে আদ্রিয়ান। রোদ এখনও বুঝে উঠতেই অক্ষম নিজের অনুভূতি। কেমন লাগা উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না রোদ। যারা এত মাস ওর পেটে’র ভেতর ছিলো তারা কি না এখন হাতে। অতি ভালোলাগায় রোদ কেঁদে ফেলবে যেন। নিজের এই অপ্রকাশিত অনুভূতি রোদ দেখাতে অপারগ। আদ্রিয়ানের সামনে দূর্বল হওয়া চলবে না। মোটেও না। আদ্রিয়ান রোদের দিকে তাকিয়ে ওর অভিব্যক্তি বুঝার প্রয়াস চালাল। বুঝতে পারলো না নিজেও। দু’জনের চোখাচোখি হলো। চোখেচোখে কথা হলো। আদ্রিয়ান অল্প স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— দেখি এবার?
— হু।
দু’জন একসাথে নজর দিলো। রোদ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই যে দৃষ্টি পড়েছে আর ফিরাচ্ছে না। হাজার হোক রোদ মিশান,মিশি কে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছে। হাজার ওদের’কে নিজের সবটুকু বিলিয়ে ভালোবাসুক। হাজার ওদের মাঝেই নিজেকে প্রথম নিজের কাছে মা লেগেছিলো কিন্তু এই অনুভূতি। এই বিচলিত মন। এই ক্ষণ’টা কি কখনো পেয়েছিলো রোদ? কখনোই না। এমন মুহূর্ত কখনো পাওয়া সম্ভব নয়।

নিজের পেট থেকে এত কষ্ট, এত সমস্যা, এত ভালোবাসার সুমিষ্ট ফল ই এই অতিছোট্ট শিশুটা। এমন অনুভূতি কোথাও পাওয়া অসম্ভব। নিজের সত্তা নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই অনুভূতি। রোদ আদ্রিয়ানের শার্টের হাতাটা খাঁমচে ধরেলো। কেমন একটা এলোমেলো অনুভূতি হচ্ছে। রোদ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে আদ্রিয়ান ধপ করে বসে পরলো। কাঁচের ঘেরাও করা দেয়ালটা ধরে বসে রইলো হাটু গেড়ে। ওর ছেলে। চারদিনের ছোট্ট একটা জান।

অথচ আদ্রিয়ান কি না বেখবর ছিলো? এতটা খারাপ বাবা ও? ছেলেটা নিশ্চিত এতদিন বাবা মায়ের স্পর্শ পায় নি। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ও তা সরিয়ে নিলো আদ্রিয়ান। ওর কেন জানি ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও ছুঁয়ে দিলেই চলে যাবে এই প্রাণটাও। রোদ একদম কাছে এলো। ঢোক গিললো বারকয়েক। বা হাত দিয়ে তখনও আদ্রিয়ানের শার্ট খাঁমচে ধরা। ডান হাতটা আস্তে আস্তে এগিয়ে নিলো। খুবই আলতো একটা ছোঁয়া দিলো ঘুমন্ত শিশুটির ছোট্ট আঙুলে। মায়ের ছোঁয়া পেতেই কিছুটা নড়ে উঠলো সে। কেঁদে ফেললো রোদ। নিজের শক্ত খোলস টা আর ধরে রাখতে পারলো না।

এমন বাবু তো দুটো থাকার কথা। তাহলে কেন একটা? রোদ ম’রে যেত। ওর বাবুটা ঠিক থাকত। হিচকি উঠে গেলো রোদের। আদ্রিয়ান যে ওকে থামাবে সেই শক্তি টুকু যেন নেই। ও নিজেই কেমন করে তাকিয়ে আছে। বাবুটা হঠাৎ করে ছোট্ট মুখটা খুলে হামি তুললো। একদম ছোট্ট একটা গোল হয়ে মুখটা খুলে আবারও বন্ধ করে নিলো। চোখ খুলে নি সে এখনও। হয়তো জেগে যাবে এমন একটা অবস্থা।

নিজের বুড়ো আঙুল’টা মুখে ডুকিয়ে চুষতে ব্যাস্ত হলো ঘুমের মধ্যেই। আদ্রিয়ান কিছু বললো না। হাত বাড়িয়ে আস্তে করে ছুঁয়ে দিলো ছেলেকে। হাতটা মুখ থেকে নামিয়ে দিলো। বাচ্চারা একটু নড়চড় করলো পরপর ঘুমিয়ে গেল। চোখ দিয়ে কয়েকটা কষ্টের ফোঁটা গড়িয়ে পরলো আদ্রিয়ানের। কেন ছেলেটাকে অবহেলা করলো? আদ্রিয়ানের কি উচিত ছিলো না ছেলেটার প্রতি মনোযোগী হওয়া? যদি এই প্রাণটাও চলে যেত? তখন কি নিজেকে মাফ করতে পারত আদ্রিয়ান? সারাজীবন না ধুঁকে ধুঁকে ম’রত?

বাইরেই আরিয়ান দাঁড়ানো। হঠাৎ রাদ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এসে বললো,
— রোদ’কে দেখেছেন? কেবিনে নেই। আদ্রিয়ানের কাছে গেলো নাকি আবারও?
আরিয়ান চোখের ইশারায় এনআইসিউ এর দিকে ইশারা করলো। রাদ দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই বড় একটা শ্বাস নিলো। এত দিনে বাচ্চাটার ভাগ্য হলো মা-বাবা’র ছোঁয়া পাওয়ার?

ঘড়ির কাটা এখন ঠিক সোজা। মিনিট আর সেকেন্ড একদম সোজা হয়ে আছে। তারা জানান দিচ্ছে এখন রাত বারোটা ত্রিশ। এত রাত। সবাই ঘুম অথচ নিশাচর পাখি’র ন্যায় জেগে জেগে প্রহর গুণছে রোদ। ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখ দুটো ফুলে আছে। মন চাইছে গলা ছেড়ে কাঁদতে অথচ সম্ভব হচ্ছে না। পাশের বেডেই গুটিয়ে শুয়ে আছে মিশি আদ্রিয়ানের মায়ের বুকে।

রোদের মা ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে মেয়ের কাছে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রোদের চোখ গলিয়ে পানি পরছে। অঝোর তার ধারা। থামতে চাইছে না। মা হয়ে তার আর মেয়েকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না কেন কাঁদছে তার মেয়ে। একটু এগিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। রোদ ফুঁপিয়ে উঠলো। বুক ফেটে কান্না আসছে ওর। কলিজা’টা যেন ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে। রোদের মা মেয়ে’র কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

— কাঁদে না মা। নিজেকে শান্ত রাখ। আল্লাহ সহায় হবেন। ছেলেটার প্রতি মনোযোগী হ। আদ্রিয়ান’কে বুঝা। ছেলেটা কি থেকে কি হয়ে গেল। এখন তুই যদি এমন হয়ে যাস তাহলে কি হয় মা? আম্মু আমার এমন করে না। মিশি আছে না আমাদের। ওই তো তোর মেয়ে।

রোদ কেঁদেই যাচ্ছে। কিভাবে বুঝ দিবে নিজেকে? কিভাবে মন’কে মানাবে যে তার মেয়ে নেই তার বুকে? যেই মেয়ে’টা চারদিন আগেও তার পেটে ছিলো সেই মেয়েটা কেন তার বুকে নেই? কিভাবে সামলাবে রোদ নিজেকে? আদ্রিয়ানের সামনে তো নিজেকে কেঁদে হালকা ও করতে পারে না। রোদ মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো,

— আম্মু…আম্মু আমি তো ওকে ভুলতে পারছি না আম্মু। আমি তো দেখলাম ও না। তোমরা কেন আমার অপেক্ষা করলে না? আমাকে কেন জাগালে না? এই আম্মু আমি কেন ওর জায়গায় কবরে গেলাম না? আমার মেয়ে আম্মু…আমার মেয়ে….
রোদের আহাজারি বাড়তেই লাগলো সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিশি রাতের অন্ধকার। এই ঘনঘটা অন্ধকার যেন পুরো জীবন জুড়ে ঘনিয়ে দিচ্ছে রোদের।

একজন মা হাহাকার করে উঠছে নিজের মায়ের বুকে তার মেয়ের জন্য। রোদের এত কান্নার শব্দে আদ্রিয়ানের মা ও চোখ খুলে তাকালেন। মাত্র ই চোখ লেগেছিলো একটু। ঝট করে উঠে নিজেও পাশ থেকে জড়িয়ে নিলেন। থামাতে পারল না রোদকে। হঠাৎ একটা ঘুম জড়ানো চিকন কন্ঠে থেমে যায় রোদ। একদম চুপ। এত এত আহাজারি। কষ্ট। নির্মম সত্য গুলো গিলে ফেললো। মিশি ঘুমু কন্ঠে আবারও ডেকে উঠলো,

— মাম্মা মিশি তোমার কাছে ঘুমাবে।
রোদের কান্নার শব্দেই মিশি উঠে গিয়েছে। হসপিটালের বেড’টা উঁচু হওয়াতে নামতে পারছে না। হাত বাড়িয়ে মা’কে ডাকছে। রোদ ততক্ষনাৎ উঠতে চাইলেই বাঁধা দিলো আদ্রিয়ান। রোদ একদম চোরের মতো করে মুখ নামিয়ে নিলো। কান্না থেমেছে ওর। আদ্রিয়ান মিশিকে কোলে তুলতেই মিশি বাবা’কে জড়িয়ে নিলো। আদ্রিয়ান একদম বুকে মিশিয়ে নিলো মেয়েকে। রোদের কাছে দিতেই রোদ চুমুতে ভরিয়ে তুললো ওকে। আদ্রিয়ান খুবই ঠান্ডা এবং চওড়া গলায় মা আর শাশুড়ী’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি আছি এখানে।
তারা বুঝলেন কিছুটা। দু’জন ই বেরিয়ে গেলেন।আদ্রিয়ান রোদের পাশে বসলো। রোদের বুকে আসতেই মিশি আবারও ঘুৃমে তলিয়ে গেলো। আদ্রিয়ান কিছু না বলে মিশিকে কোলে তুলে পাশের বেডে শুয়িয়ে দিয়ে বালিশ দিয়ে ঘেরাও দিয়ে দিলো।
রোদ তখনও মাথা তুলে নি। আদ্রিয়ান এবার ধীর পায়ে এসে ওর পাশে বসলো। রোদের মাথাটা বুকের বা পাশে চেপে ধরে বললো,

— কাঁদো।
কাঁদে না রোদ। কাঁদা তো দূর টু শব্দ ও হলো না। আদ্রিয়ান মনোযোগ দিলো। বুঝার চেষ্টা করলো কাঁদে কি না। কিছুটা হুকুমের স্বরে বললো,
— কাঁদো। কাঁদতে বলেছি না?
রোদ দুই হাত বাড়িয়ে আদ্রিয়ানের পিঠ বেরিয়ে ধরলো। মুখটা ঘঁষে দিলো আদ্রিয়ানের বুকে। আবদারের সুরে বললো,

— বাবু’কে আবার দেখব।
— এখন এলাউ করবে না।
— কেন কেন আমার বাবু। এলাউ কেন করবে না?
— ঘুমাবে। ঘুমাও। আসো।
বলে বুকে নিয়ে শয়ে পরলো আদ্রিয়ান। একটু পরই ঘুমে ঢলে পড়ে রোদ। আদ্রিয়ান ঘুমন্ত রোদ’কে চুমু খায় বেশ কয়েক। অল্প সল্প স্বরে বলছে,

— আমার ছোট্ট বউ এত বড় কবে হলো টেরই পেলাম না। এত ভালো কিভাবে বাসে ও? এই বয়সে এত দৃঢ় ভালোবাসা কি থাকে? এখন তো সবই আবেগ থাকে তাহলে রোদটা ভিন্ন কেন? কেন ভিন্ন তার ভালোবাসার রং?
আদ্রিয়ান বছর খানিক ধরে যে মেয়েটাকে আগলে রাখছে সেই ই নাকি এখন আদ্রিয়ানকে আগলে রাখে? এই রোদটা এতটা বুঝদার ই বা কবে হলো? এত ভালোবাসা কিভাবে মনের গভীরে সঞ্চয় করলো?
কথাগুলো ভাবতেই চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি গড়ালো।

হসপিটালের এই ফ্লোর’টা যেন বাসা হয়ে উঠেছে। মিশি দৌড়াদৌড়ি করছে করিডরে। চারজন ডক্টরের পরিচিত হওয়াতে সবাই যেন আদরে আদরে রাখে। মিশানও মায়ের কাছে বসে আছে।
আদ্রিয়ানের মা রোদের মুখে বাকি সুপটুকু দিয়ে মুখ মুছিয়ে বললো,
— নার্স আসবে এখনই।
বলতে বলতেই আদ্রিয়ান আর নার্স ডুকলো। নার্স এসে রোদের ক্যানেলা টা খুলে মুচকি হেসে বললো,

— কেমন আছেন ম্যাম?
— আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা বাবু কখন দিবেন?
— এইতো এসে পরেছে।

পেছন থেকে ইয়াজ বলেছে কথাটা। ওর হাতেই বেবিটা। বেবি টাওয়ালে পেচিয়ে রাখা সে। রোদ খুশিতে উঠতে নিলেই বাঁধা দিলো আদ্রিয়ান। সবাই বের হলো কেবিন থেকে একে একে। রয়ে গেল আদ্রিয়ান আর রোদ। ইয়াজ রোদের হাতে বাবু দিয়েই বের হয়েছে। নার্স অবশ্য ছিলো কিন্তু আদ্রিয়ান বের করে দিয়েছে। বলেছে সে নিজেই যথেষ্ট। রোদ মন ভরে দেখছে ছেলেকে। বাবুটাও অবশ্য এই প্রথম মা দেখলো। বাবা’কে দেখেছে ঘন্টা খানিক আগে। রোদ চুমু খেল কয়েকটা। ছলছল চোখ করে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে রোদের মাথায় হাত দিয়ে বললো,

— ফিড করাতে হবে সোনা।
রোদ বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে কি করবে। তাই ঝটপট করে বললো,
— আম্মুকে ডেকে দিন।
— উহু। আমি আছি না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫১

বলে আদ্রিয়ান সাহায্য করলো রোদকে। রোদের তখন অনুভূতি কেমন সেটা বলতে বা উপলব্ধি করতে নিজেই অপারগ রোদ। রোদের এহেন কান্ডে হাসলো আদ্রিয়ান। কেমন বাচ্চা কোলে নিয়ে সে নিজেই বাচ্চামো করছে। ছোট্ট বাবুটা মায়ের দুধ পান করছে। আদ্রিয়ানের মনটা হঠাৎ ই বলে উঠলো, এই সুখটা কি কখনো পেয়েছিলো আদ্রিয়ান? কখনোই না। এই সব সুখ কখনোই পায় নি আদ্রিয়ান। আজ পেলো। এরজন্য শুকরানা করা দরকার। একটু বেশিই দরকার।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫২