ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮
সাইয়্যারা খান

সময়গুলো খুব দ্রুত গতিতে চলে গেল যেন। কারো জন্যই সে অপেক্ষা করতে নারাজ যেন তার খুব তাড়া। এই তো কিছুদিন আগেও বর্ষায় কদমের ঘ্রাণে চারদিকে মৌ মৌ করছিলো অথচ এখন তীব্র খড়া রোদ। আবহাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা ও নেই। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। উলোট পালোট আবহাওয়ার মতো করে কারো কারো জীবন ও উলোট পালোট হয়ে গিয়েছে।

কেউ দিন গুনছে হারানোর, কেউ গুণছে প্রতিক্ষার তো কেউ গুনছে কারো ফিরে আসার। কারো হাতেই যেন কিছু নেই। জীবনের এমন অবস্থায় এসে কারো অবস্থা যেমন ঠিক দিকহারা হয়ে উঠেছে। এ যেন সাতার না জানা সাঁতারু সমুদ্রে পড়েছে। সাঁতার জানলেই বা কি সমুদ্রের কি কিণারা পাওয়া যায়? তবুও মানুষ তো। মনের গহীনে লুক্কায়িত সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসটার জের ধরেই বেঁচে থাকা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পুরো ৭ মাসের পেট এখন রোদের। এত বড় পেট কখনো পরিবারের কেউ দেখেছে কি না সন্দহ। হাতে ইনসুলিন’টা নিয়ে রুমে ডুকলো আদ্রিয়ান। ডুকেই দেখলো রোদ হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ানের বুকটা হু হু করে উঠলো। রোদ তো এখন আর রোদ নেই। কে বলবে এটা বছর খানিক আগের রোদ? কালি পরা তার চোখ দুটো গর্তে ডুকে এখন বড় বড় হয়েছে।

কলার বোনটা অনেকখানি বের হয়ে আছে। মুখের দিকে তাকানো দায় হয়ে গিয়েছে যেন। দূর্বল নেতানো দেহ অথচ পেট ফুলে আছে আর পায়ে পানিতে ফুলে আছে। শরীর ওর ভালো যাচ্ছে না। এই রুম থেকেও বের হয় না। সারাদিন কি ভাবে কে জানে। কথা ও বলে না ঠিক মতো হয়তো শররে কুলায় না। না ঘুমাতে পারে না খেতে। বালিশে মুখ গুজে শুধু কাঁদে মেয়েটা। একটু ঘুমালেও আবার অস্থির হয়ে উঠে যায়। আদ্রিয়ান জিজ্ঞেস করলেই কেঁদে বলে স্বপ্নে খারাপ দেখেছে।

এখন তো আদ্রিয়ান ও কেমন আশা ছেড়েছে মনে হয়। কিছুতেই মন নেই যেন। হারানোর আগেই শোক পালন করছে যেন।
পা চালিয়ে সামনে গেলো আদ্রিয়ান। নিজের শরীর ও ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। সামনে যেতেই রোদ তাকালো একপলক। ভাঙা চেহারাটার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না আদ্রিয়ান। নজর নামিয়ে ওরণা’টা রোদের বুকে দিয়ে বললো,

— মিশান আসছে।
— হু।
ইনসুলিন আদ্রিয়ানই পুশ করতে পারে কিন্তু রোদের বেলায় কেন জানি সাহস পায় না ও তাই মিশান ই দিয়ে যায় দুই বেলা৷ মিশান এসেই মা’য়ের কাছে বসলো। বাবা’র থেকে নিয়ে আস্তে করে মায়ের হাতে পুশ করে দিলো। টু শব্দ ও করলো না রোদ। হয়তো এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে অথবা এত এত ব্যাথার মধ্যে এই ব্যাথা অতি নগণ্য। আদ্রিয়ান মিশান থেকে ইনসুলিন’টা নিয়ে বললো,

— মায়ের কাছে বসো। আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
মিশান ঘাড় দুলালো। আদ্রিয়ান যেতেই মিশান মায়ের দিকে তাকালো। রোদও বাইরে থেকে নজর ফিরিয়ে মিশানের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললো,
— খেয়েছো?
মিশান কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। কথাগুলো গলায় আটকে যায় ওর। রোদ জানে। বুঝে। কি করবে? শরীর তো সায় দেয় না। হাতটা বাড়িয়ে মিশানের গালে রাখতেই মিশান চেপে ধরে সেই হাতে চুমু খেতে খেতে ডাকলো,

— মা?
— হুম।
— আমার ভালো লাগে না। তুমি আদর করে দাও।
বলেই রোদের হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। রোদ নড়লো একটু। মিশানের নিচু করা মাথায় হাত বুলিয়ে ধীম কন্ঠে বললো,
— যাও বোনকে নিয়ে এসো। মা খায়িয়ে দিই।
— উহু।
— বাবা যাও।

মিশানের ভীষণ কান্না পায় মায়ের এমন অবস্থায়। রোদের অবস্থা ও তেমন ভালো না যে বাচ্চাদের সামলাবে। মিশান উঠে বাইরে গেলো মিশি আনতে। আদ্রিয়ান তখনই নাস্তা নিয়ে এলো রোদের জন্য। রোদ কিছু না বলেই চুপচাপ খাচ্ছে। বেশি কথা বলতে মন চায় না এখন। ওর খাওয়ার মাঝ পথেই মিশান মিশিকে কোলে তুলে রুমে আসলো। রোদ হাত বাড়াতেই মিশি মায়ের কাছে এসে পাশ ঘেঁষে বসে পরলো। রোদের মনটা কামড়ে উঠলো। কান্না পায় ওর। মিশি’টাকে মন ভরে আদর করতে পারে না এখন তেমন একটা। রোদ নিজে আদর করে খাওয়ালো দুই বাচ্চা’কে। মিশি মায়ের কাছেই আছে মিশান বায়না ধরে বললো,

— মা আজকে কোচিং না যাই?
— উহু সামনে ফাইনাল। যাও এখনই।
— প্লিজ না যাই?
— উহু। যাও। আজকে তোমার হায়ার ম্যাথ দেখব।
মিশান একটু মন খারাপ করতেই রোদ ওর হাত ধরে বললো,

— আব্বু এক্সাম টা ভালো করে শেষ কর। মা তো খেয়াল করতে পারছি না। তুমি একটু নিজের খেয়াল রেখো।
ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়ালো মিশান। মা’য়ের হাতে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আদ্রিয়ান তেল চিরুনি নিয়ে রোদের কাছে বসতেই তাচ্ছিল্যোর স্বরে রোদ বলে উঠলো,

— কি হবে এত যত্ন নিয়ে?
কথাটা যেন কাটার ন্যায় বিঁধলো আদ্রিয়ানের বুকে। তবুও রোদের খোঁপাটা খুলে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,
— এভাবে কেন বলো রোদ? চুল আবারও হবে। আমি অনেক যত্ন করব তখন আবারও হবে।

রোদ আর তেমন কিছু বললো না। পাঁচ মাস থেকেই ওর মাথার চুল ঝরতে শুরু করেছে যা পরবর্তী’তে কমার বদলে বেড়েছে। এত ঘন চুলগুলো পড়তে পড়তে এখন একদম চিকন হয়ে গিয়েছে। তবুও যেন আফসোস নেই। রোদের মনটাতো শুধু বলে ওর সব চুল ঝরে যাক। সকল সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাক তবুও রোদের বাচ্চা দুটো ভালো থাকুক। এখন তো আবার খুশি বেড়েছে। গত সপ্তাহে ই ওরা জানতে পেরেছে যে একটা মেয়ে একটা ছেলে হবে। ছেলেটাই মূলত দূর্বল বেশি। মেয়েটা গ্রো করছে বাট ছেলেটা মাত্রারিক্ত দূর্বল। এসব ভাবতেই চোখে পানি জমে উঠে।

দুই মাস হয়ে গেল অথচ দিশা’র জীবনে কোন পরিবর্তন এলো না। এক ভাবে আবার এসেছেও বটে। দিশা এখন ফুল টাইম আয়া হয়ে গিয়েছে রাদের ছেলের। বাবা’র সাথে মিলিয়েই নাম রাখা হয়েছে রুহান খান। ছোট্ট পুচকে’টা এত সুন্দর যে দেখলেই আদর লাগে। দিশা তো সারাক্ষণ ওকে নিয়েই থাকবে। সকাল থেকে রাত। কিন্তু রাতে আবার থাকতে হয় না ওর। জামাই বউ সামলে নেয় ওকে। রাদ তো আর বাসায় থাকে না সারাদিন তাই জাইফা একা সামলে উঠতেও পারে না তাই দিশা থাকে। দিশার বিষাদময় দিনগুলোও ভালোয় ভালোয় মিটে যায় কিন্তু দিন শেষে যখন ধরণী আঁধারে নিমজ্জিত হয় তখন বুক ফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে দিশার। গত দশ দিন আগে ও যা জানতে পেরেছে তাতে যেন ওর কষ্টগুলো কমার বদলে বেড়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না মেয়েটা। রাতে নিজের মতো কেঁদে কেঁদেই পার করে দেয়।

রুহান আপাতত মায়ের দুধ খাচ্ছে। এই ফাঁকে দিশা নিজের বাসায় এলো গোসল করতে। বাচ্চাটা’কে একা রেখে কোথায় যেতে মন সায় দেয় না ওর। রুমে ডুকতেই নজরে এলো বিছানায় পরে থাকা অবহেলিত ফোনটায়। এখন ধরা হয় না তেমন একটা। দিশা ফোন’টা হাতে তুলবে এমন সময়ই ওর মা রুমে এলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এমন কিছু বলবে যা হয়তো দিশা আপাতত শুনতে চাইছে না। তাই আগেই বললো,

— কাজের কথা হলে বলো নাহলে আমি গেলাম।
ওর মা যেন ফুঁসে উঠলেন।
— কাজের কথা মানে? কি বলতে চাছ তুই? আমারে কি তোর বোঁকা মনে হয়? দেখ দিশা ভালোয় ভালোয় বলতাসি শশুর বাড়ী যা।
দিশা’র তেমন কোন হেলদুল হলো না। নিজের মতো আলমারি খুলে ড্রেস বের করে ওয়াসরুমে ডুকতে নিলেই ওর মা রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,

— ফাইজলামি করিস তুই? ফাজিল কোথাকার। আজই যাবি তুই।
দিশা ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে। কন্ঠে তার তেঁজ।রাগ অথচ চেহারা’য় তার মেয়েকে নিয়ে হাজারও চিন্তা। মনে মনে হাসলো দিশা। এগিয়ে এসে মায়ের গালে টুপ করে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে বললো,

— এত বার বললে তো আমার নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হয় আম্মু। আমি তো এমনই সবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে আছি। আর কয়টা দিন নাহয় থাকি। কিছুদিন পর আমার দুঃখ বুঝার মানুষ ও আসবে। অবশ্য যদি তুমি এত করে বলো তাহলে চলে যাব। জানোই তো আমার আবার আত্মসম্মান কম নাহলে তোমাদের এত বারবার তাড়ানোর পরও বুঝি রয়ে যাই?

কথাগুলো বলেই দিশা ওয়াসরুমে ডুকে পড়লো। ওর মা থম মে’রে দাঁড়িয়েই রইলো। তার বড় মেয়েটার জীবন এমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল কেন? তার কত চঞ্চল, দুষ্ট মেয়ে ছিলো অথচ এখন কেমন মরা মরা হয়ে থাকে। এক রাদ’কে ভালোবাসে তার মেয়ে আজ কাঙ্গাল আর অপরদিকে রাতুল’কে বিয়ে করে নিঃস্ব হয়েছে।

ওয়াসরুমে সাওয়ারের নিচে বসে আছে দিশা। ক্লান্ত শরীর ওর। শরীর কুলাতে চায় না সেখানে মনে কিভাবে কুলাবে? এই তো দুই মাস আগে ওর শশুর শাশুড়ী এসেছিলো ওকে নিতে কিন্তু দিশা যায় নি। ও জানে গেলেই রাতুলের কাছে ধরা দিতে বাধ্য হবে দিশা। রাতুলের ঐ দিনের করা অন্যায় ভুলে নি দিশা। কিভাবে ভুলবে? এতই সহজ? রোজ যখন দিশা নিজে সায় দিত তখন তো রাতুল বুঝতো তাহলে কেন ঐ দিন রাতে বুঝলো না?

দিশার উন্মুক্ত বুকে যখন রাতুল নিজের ভালেবাসা’র জন্য কাঁদত তখন কি দিশা সান্ত্বনা দেয় নি? রাতুলের প্রতি দায়িত্ব পালন করে নি? সব করেছে দিশা কিন্তু দিন শেষে রাতুল কি করলো? নিজের পুরুষত্ব দেখালো। তাও যদি সেটা ভালোবাসার হতো তাহলেও কথা ছিলো কিন্তু না সেটা তো ডেস্পারেট হয়ে রাতুল করেছিলো। শশুর শাশুড়ী’কে দিশা বুঝ দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু লাভ হয় নি ঐ দিনই রাত বারোটায় রাতুল তাদের আবারও পাঠায়। দিশার বাবা-মা সহ সবাই কারণ জানতে চাইলেও দিশা চুপ ছিলো কিছু বলে নি আবার যেতে রাজি ও হয় নি।

রাতুল এসেছে এই দুই মাসে অনেকবার। দিশা মুখোমুখি হয় নি। কেন হবে? দিশার এখন কাউকে চাই না। ও তো চলে যাবে। নিজের মানুষ আছে এখন দিশার। তাকে নিয়ে জীবন পার করা কঠিন হবে না। সব ছেড়ে দূরে থেকে যাবে দিশা। কোন পুরুষ দরকার নেই ওর। একমনে জায়গা তো দিলো কিন্তু লাভ হলো কই? ঐ তো দিন শেষে খালি হৃদয়ের কাঙ্গাল দিশা।

বের হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো পঁচিশটা মিসকল। রাতুলের সবগুলো। হাসলো দিশা। পুরুষ মানুষ টান লেগেছে তাই হয়তো এত পেছনে লেগেছে নাহলে দিশা’কে কি দরকার তার?
এতবার মন ভাঙায় এখন মেয়েটা হয়তো বুঝতেই পারছে না ভালোবাসা কি। এত বারবার রাতুলের করা আকুলতাপূর্ণ অনুভূতিগুলো ওকে ছুঁয়ে দিয়ে পারছে না।

আর ভাবলো না দিশা। ক্ষুধা লেগেছে ওর। খাওয়া দরকার। তাই সোজা নিচে চলে গেল কিন্তু খাওয়া হলো না। বাবা বসা এখানে সাথে রাতুল। দিশা আস্তে করে ছাদে গিয়ে রাদদের বাসায় ডুকে পড়লো। চাচির কাছে এখন খাবার চাইবে ও। এত ক্ষুধা কি আর সহ্য হয়?
আসার আগে অবশ্য রাতুলের কথা টুকটাক শুনেছে দিশা। দিশার বাবা’কে বলছিলো যাতে দিশা দেখা করে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দিশা চাচিকে বলে উঠলো,

— চাচি খাবার দাও। দুপুরে খাই নি। বেশি করে দিও। ক্ষুধা লেগেছে অনেক।
রাদের মা তারাতাড়ি দিশাকে ভাত বেড়ে দিলেন। দিশা একনাগাড়ে খেয়েই যাচ্ছে হঠাৎ তালুতে উঠতেই রাদ এসে পানি খায়িয়ে বললো,
— আস্তে খাবি তো।
— ক্ষুধা লেগেছে বেশি তাই।
— খেয়াল রাখ।
বলেই পাশের চেয়ারে বসে রাদ বললো,
— আম্মু ভাত দাও।

হঠাৎ করে তীব্র পেট ব্যাথা’য় ঘুম ছুটে গেলো রোদের। পাজি দুটো সারাক্ষণ ই গুতাগুতি করতে থাকে। তারা তো মজাই করে অথচ এদিকে ওদের মা’য়ের যে ব্যাথায় জান যায় তাতে তাদের কোন খোঁজ নেই৷ রোদ’কে ঘুম থেকে হুট করে উঠতে দেখেই আদ্রিয়ান ল্যাপটপ’টা ছেড়ে তারাতাড়ি রোদের কাছে এসে বললো,
— ক..কি হ’য়েছে রোদ? ব্যাথা করছে?
রোদ অল্প হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

— পাঁজি দুটো ফুটবল খেলছে। আমার পেট’কে ওরা খেলার মাঠ পেয়েছে। যখনই মন চায় গোল মা’রে।
আদ্রিয়ান তাকালো। দেখলো। মন ভরে না ওর। এত যে দেখে এই রোদ’টাকে তবুও যেন চক্ষু ক্ষুধা মিটে না ওর। রোদের ফুলা ফুলা গালে হাত দেখে চোখ দুটি মুছিয়ে দিয়ে ছোট একটা চুমু খেয়ে বললো,

— তুমি অনেক ধৈর্যশীল একটা মেয়ে রোদ। আল্লাহ নিশ্চিত তোমাকে প্রতিদান দিবেন।
— প্রতিদান হিসেবে আপনার সাথে চার সন্তান নিয়ে থাকতে চাই ব্যাস। চাওয়া টা কি খুব বেশি হয়ে গেলো?
কি করুন সুর অথচ রোদ স্বাভাবিক ভাবেই বললো। তাহলে কেন আদ্রিয়ানের বুক মোচড়াচ্ছে এমন কথায়? দৃষ্টি ঘুরিয়ে তা আবারও রোদের দিকে তাক করে বললো,

— উহু। বেশি না। আল্লাহ মহান রোদ। তার নিকট বান্দা’দের চাওয়া কোনদিন ই বেশি না। তিনি তো অসীম ক্ষমতা’র অধিকারী। এমন কিছুই নেই যা তিনি পারেন না। আল্লাহ যখন যাকে যা ইচ্ছে দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছে নিয়ে নেন।
রোদ ঠোঁটে একটা হাসির রেখা টেনে আদ্রিয়ানের হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। তখনই আবারও জোরে পেটে লাত্থি খেতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে রোদ। ভরকায় আদ্রিয়ান। পরিহিত ফ্রকটা তুলতে আলগা করে পেট। বড়সড় একটা পেট। হাত বুলায় আদ্রিয়ান তাতই যেন শান্ত হলো রোদ। পেটে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আদ্রিয়ান। পেটে ঠোঁট দুটো রেখেই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলতে তুলতে বললো,

— এই যে বাবা’র আম্মু-আব্বুরা মা ব্যাথা পায় তো। বাবা’র জান’রা এমন লাথি দেয় না। মা কাঁদছে দেখো। আর করো না ঠিক আছে?
কথাটা বলতেই সজোরে আঘাত হলো আবারও। মুখ খিঁচে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো রোদ। আদ্রিয়ান হঠাৎ করেই ঝলমলে হাসলো। কন্ঠে আশ্চর্য ঢেলে বলে উঠলো,
— রোদ? এই দেখো। তাকাও। আমি কি দেখলাম? আল্লাহ! রোদ। দ…দুটো পা দেখেছি। কতটুকু। এতটুকু এতটুকু। মাত্র দেখলাম। তুমি দেখেছো?

রোদ আজ অনেকদিন পর এমন হসতে দেখলো। রোদ আগেই দেখেছিলো। আদ্রিয়ান’কে বলেছিলো কিন্তু কখনো দেখতে পায় নি আদ্রিয়ান। এতদিন আজ দেখলো এই পাগল লোক। দেখেই যেন পাগল হয়ে গেল। খুশিতে পেটে চুমু দিয়ে দিয়ে যেন ভিজিয়ে দিবে। আবার কতক্ষণ রোদকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। আদর করে দিলো। রোদ ভাবলো এতেই শেষ কিন্তু কে জানে এই লোক মিশান,মিশি সহ নিজের মা’কে ও ডেকে ডেকে বলেছে।

আপাতত মিশান আর মিশি রোদের পাশে গোল হয়ে বসে আছে। দুই জনের ই নজর মায়ে’র পেটের দিকে। তাদের ভাই বোনকে বাবা দেখেছে এখন তারা ও দেখবে। আলট্রা রিপোর্টে যদিও দেখেছে এখন আবার নতুন করে এভাবে দেখবে। রোদ ও অসহায়ের ন্যায় বসে বসে আদ্রিয়ানের হাতে ফল খাচ্ছে। কি আর করার এই বাবা’র পাগল ছেলে মেয়ে ও পাগল। এক ঘন্টা ধরে বসেই আছে দেখা’র জন্য। এদিকে পেটের দুটো আবার আরোও পাঁজি তাই তো বড় ভাই বোনকে এমন করে জ্বালাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে না।

খেয়ে দেয়েই ঘুমিয়েছিলো রোদ। তখনকার পর থেকে আর বাচ্চা দুটো একবারও নড়ে নি। ঘাপটি মেরে মায়ের পেটে বসে আছে। রোদ মিশিকে বুঝিয়েছে বাবুরা ঘুমাচ্ছে। মিশানও মন খারাপ করে ছিলো। ঘুম ভেঙেছে ওর প্রায় সন্ধ্যা’র সময়। তখন ছিলো দুপুর দিক। এত সময় ঘুমালো রোদ। ভাবতেই আশে পাশে তাকালো। না কেউ নেই। ওয়াসরুমে যাওয়া দরকার ওর। একা উঠতেও পারছে না। আদ্রিয়ান’কে দরকার এখন।

একবার ডাকও দিলো। লাভ হলো না। অভ্যাসগত কারণে পেটে হাত রাখলো রোদ। বুলালো। এমনি সময় জোরে লাথি সবসময় না মারলেও নড়াচড়া করে। মায়ের হাতের ছোঁয়া বরাবর তারাও নড়ে কিন্তু আজ নড়ছে না। রোদ ভাবলো তখন থেকেই তো নড়ছে না ওরা। থম ধরে বসে অনুভব করার চেষ্টা করলো রোদ। না নড়ছে না। ভয় পাচ্ছে রোদ। হাত-পা কাঁপছে যেন হঠাৎ করে। বাচ্চা দুটো তো নড়ছে না।

কিছু কি হলো? ভাবতেই ঘাম ছেড়ে দিলো রোদের শরীরে। একেবারে যেন ঘেমে নেয়ে উঠলো। উঁচু গলায় আদ্রিয়ান’কে ডাকলো। কেউ এলো না। পেটে হাত বুলাচ্ছে রোদ। মনে আল্লাহ’কে ডাকছে। আদ্রিয়ান এসে রোদ’কে এমন দেখে নিজেও বিচলিত হয়ে এগিয়ে এসে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আদ্রিয়ান’কে ধরে কেঁদে ফেললো রোদ। আদ্রিয়ান ভয় পেয়ে গেলো ভীষণ। কাঁপা হাতে আগলে নিলো রোদ’কে। ওভাবেই বললো,

— র…রোদ কি হয়েছে? এমন করছো কেন? ব্যাথা করছে?
রোদ জড়িয়ে ধরলো আদ্রিয়ানকে। মাত্রই নড়েছে। আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরেই রোদ বললো,
— আমি ভয় পেয়েছিলাম। ওরা নড়ছিলো না।
আদ্রিয়ান শক্ত হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

— নড়েছে?
— মাত্র নড়লো। দুষ্ট কতো। আমাকে জ্বালালো।
বলেই আদ্রিয়ানের গলায় মুখ দিলো রোদ। ওভাবেই কিছুক্ষণ রইলো। নিজেকে সামলাতে আদ্রিয়ান’কে ভীষণ ভাবে দরকার ওর।

রাদ ছাঁদে এসেছে। রাত এখন ভালোই। মাত্র রোদের সাথে কথা হলো। রুমে রুহান ঘুমাচ্ছিলো তাই রাদ ছাঁদে এসেছে। বোনটার জন্য রাদের সুখগুলো যেন পেয়েও পায় না রাদ। তার ছোট্ট রোদ যে কি না কিছুদিন আগেও নিজে ছোট ছিলো তার কি না পুচকু হবে তাও দুটো। ভাবতেই অবাক হয় রাদ। পাশ ফিরে আকাশের দিকে তাকালো। খালি আজ আকাশ। চাঁদ নেই। আশ্চর্য হঠাৎ উদয় হলো। মানে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। গোল একদম বৃত্তাকার চাঁদ। ডুবে যাবে হয়তো দুই একদিনে। হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেল রাদ। মুখ না ঘুরিয়েই বললো,

— চাঁদ টা যেমন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো তেমন ই ভালোবাসা ও লুকিয়ে থাকে। সঠিক সময়ে বের করে না আনতে পারলে একসময় ডুবে যাবে। হারিয়ে যাবে তখন তা ফিরে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। হাজার হাহাকার ও তখন ফেরত আনতে পারবে না সেটা।

রাতুলের দৃষ্টি ঘোলাটে। শুণ্য বুকে কিছু তো অনুভূতি জন্মেছিলো ওর ও কিন্তু ঐ যে টান। সেটা তো রয়ে গিয়েছিলো রোদের প্রতি। তাই হয়তো এতদিনে এত কাছে এতটা নিকটে এতটা গভীর আলিঙ্গনেও দিশার প্রতি নিজের ভালোবাসাটা বুঝতে অক্ষম ছিলো রাতুল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতুল অনুনয়ের সুরে বললো,

— রাদ ওকে একটা বার এনে দে না। শুধু একটা বার। ও তো দেখাই দিচ্ছে না। ঐ দিন হসপিটালে গিয়েছিলো আমি পিছু নিয়েও কিছু জানতে পারলাম না।
রাদের দৃষ্টি তখনও শূন্য আকাশে। চাঁদ লুকিয়েছে আবারও। ঐ দিকে তাকাতেই বললো,

— বলে দেখব নে।
— তোর কথা ফেলতে পারবে না।
— পারবে।
— মানে?
— আগে আমি ওর রাদ ভাই ছিলাম এখন ভাইয়া হয়েছি। ডাকে যেমন পার্থক্য সৃষ্টি করেছে তেমন ওর অনুভূতি’তেও হয়েছে রাতুল। তুই দেড়ী করে ফেললি।
— একটা বার দেখা করিয়ে দে রাদ। কৃতজ্ঞ থাকব।
— চেষ্টা করব।

রাত এখন গভীর। রোদ এইসময় ইদানীং উঠে খায়। ক্ষুধা লাগে ওর। দুটি বাচ্চা সাথে রোদ নিজে ক্ষুধা তো বেশি লাগবেই। আজও উঠলো রোদ। পাশেই আদ্রিয়ান। রোদ নড়তেই আদ্রিয়ান ও নড়ে উঠলো। চোখ ডলে খুলার চেষ্টা করে বললো,
— খাবে না সোনা?
— হু।

বলেই আবারও চোখ বুজে নিলো। আদ্রিয়ান উঠে বসলো। ভালো করে চোখ ডলতে ডলতে নিচে গেলো খাবার আনতে। ফ্রিজেই থাকে শুধু গরম করে আনবে। সব গুছিয়ে আনতে আনতে প্রায় ১৫/২০ মিনিট লাগলো আদ্রিয়ানের। রুমে আসতেই দেখলো রোদ চোখ বুজে আছে। আদ্রিয়ান খাবার সাইডে রেখে রোদের পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো। উঠলো না রোদ। সাড়া দিলো না। আদ্রিয়ান ভাবলো হয়তো আবারও ঘুমিয়েছে কিন্তু না খেয়ে ঘুমাবে তাই? আবারও রোদের কপালে চুমু খেয়ে ডাকলো,

— সোনা উঠো। রোদ? জান দেখো আজ কি এনেছি। তোমার পছন্দের ঝাল করা পাসতা। খাবে না পাখি? বাবুরাও তো খাবে। সোনাপাখি উঠো।
আদ্রিয়ান খেয়াল করলো রোদ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভ্রু কুচকে আবারও ডাকলো। এবার একটু জোরেই ডাকলো। রোদ উঠলো না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৭ শেষ অংশ

কি মনে করে রোদের শরীর থেকে পাতলা কাঁথাটা সরাতেই চমকে গেল আদ্রিয়ান। রোদের নিচে র*ক্ত। আদ্রিয়ানের শরীরের শক্তি গুলো যেন শুষে নিলো। এই সাত মাসে এসেই এমন কিছু হওয়ার ছিলো? বাচ্চাদুটো কি আর বুকে নিয়ে ঘুমানো হবে না? আবারও আদ্রিয়ান’কে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল বুঝি?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৮ শেষ অংশ