মধুমাস পর্ব ৩৫

মধুমাস পর্ব ৩৫
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

শান্ত পরিবেশে উৎসবের আবেশের কলরবে চারদিকে মুখরিত,প্রত্যেকে তুমুল ব্যস্ত।স্বপন ইসলামের একমাত্র মেয়ের বিয়ে আজবাদে কাল, তারিখ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছে। প্রথমে না মানলেও একমাত্র মেয়ে বলে কথা আয়োজনের হইহই রইরই পরে গেছে।

স্বপন ইসলাম বিয়ে নিয়ে নাখোস থাকলেও আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি।ছেলের পক্ষ থেকে মেয়ের জন্য শাড়ি গহনা পাঠানো হয়েছে, স্বপন ইসলামও পিছিয়ে নেই ফিরোজের জন্য মানানসই সেরোয়ানী এনে পাঠিয়েছে, মেয়ে যেহেতু বিয়ে দেবে তাহলে আর মন কষাকষি রেখে লাভ কি?মেয়েকে তো কম বুঝাতে চায়নি,মেয়ের সুখ মেয়ে খুঁজে নিয়েছে,ভবিষ্যতে কখনো কোনো সমস্যা হলে বাবা মাকে কিছু বলতে পারবেনা,দোষ দিতে পারবেনা।যেহেতু মেনেই নিয়েছেন আর মন খারাপ করে লাভ কি এর চেয়ে ভালো অনুষ্টান ওই-ভাবেই এগিয়ে যাক যেভাবে ভালো হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফাতেমা বেগমের মন খারাপ। মেয়েকে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিয়ে দিতে পারেনি বলে আক্ষেপ হচ্ছে।আল্লাহ ভালো যানে মেয়েটার কপালে কি আছে, একে তো ফিরোজ নেতা মানুষ তার উপর ঘরে সৎ মা।প্রেমে অন্ধ হয়ে মা বাবার কথা শুনলো না।ফাতেমা বেগম মন খারাপ করলেও তা দূরে রাখার চেষ্টা করেন,কালকে মেয়ের বিয়ে আজকে এভাবে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না।ফাতেমা বেগম শ্যামার রুমে যায়,শ্যামা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।

“শ্যামা!”
শ্যামা মায়ের দিকে তাকায়।মুহূর্তেই চোখে পানির দেখা মিলে।প্রিয় মানুষকে সারাজীবনের জন্য আপন করে পাবে এটা ভাবলে যেমন খুশী লাগছে তেমনি বাবা মাকে ছেড়ে যেতে মন বিষন্ন হচ্ছে,চোখে পানি আসছে।মাকে দেখে যেনো জলন্ত আগুনে তুষ পড়লো যে এমনি দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।ফাতেমা বেগম হেসে বললো,

“গোসল করে নে।”
“এখনি করছি।”
এতোদিন সবাই মিলে মেয়েটাকে কম মা,রেননি,আজকে শ্যামার ফ্যাকাসে মুখটা দেখে যেনো খারাপ লাগলো,ভিষণ মায়া হলো।
“কিছু খাবি?”
“না। ”

ফাতেমা বেগমের চোখ উপচে পানি পরার আগে উনি সেখান থেকে চলে যায়।শ্যামা ফ্যালফ্যাল করে মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শান্তা যেনো পুরোপুরি বদলে গেছে।যেই মেয়ে ননদকে চোখের দেখা সহ্য করতে পারতো না সে কিনা নিজ হাতে সব করছে।উৎসবে তার কোনো খুশীর কমতি নেই সবার আগে তৈরি হয়ে গিয়েছে।ছুটাছুটি করে সব করার জন্য ব্যস্ত।

রিপন জানে ফিরোজ কেমন ছেলে,এক ক্লাসে লেখাপড়া করেছে যে।মনে মনে নাখোস থাকলেও সব দায়িত্ব সুনিপুণ ভাবে করে যাচ্ছে।বোনের বিয়েতে যেনো কিছুর কমতি না থাকে সে ব্যাপারে কড়া নজর।শ্যামাকে গায়ে হলুদের সাজে স্টেজে তুলা হয়েছে,একে একে সবাই কনেকে হলুদ ছুঁয়িয়ে দিচ্ছে।শ্যামা তার পরিবারের সকল সদস্যের মুখভঙ্গিমা দেখে মনে মনে বললো,

‘একদিন খুব সুখী হয়ে সবার ধারনা বদলে দেবো।প্রমান করে দেবো ফিরোজ খুব ভালো ছেলে,তোমাদের মেয়ে কোনো বাজে ছেলের ক্ষপ্পরে পড়েনি।’
মোহাম্মদ আলীর প্রথম ছেলের বিয়ে।কোনোকিছুতে ঘাটতি রাখা চলবে না।ফিরোজ তার বোনকে সাথে নিয়ে বিয়ের যাবতীয় শপিং করে এসেছে।

ফিরোজ বিছানায় সোজা হয়ে বসে আছে।সন্ধায় গায়ে হলুদ হবে।সে এসব করতে মানা করেছিলো কিন্তু কে শুনে কার কথা ফারিয়া এসব করবেই।ফিরোজের গায়ে হলুদে শ্যামার ভাবিসহ আরো অনেকেই আসে।তারা যাওয়ার সময় ফিরোজের বাড়ি থেকেও কিছু মানুষ যায়।সাথে ফিরোজও যায়,হলুদের সাজে রানীকে দেখতে কেমন লাগছে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।যদিও গ্রামের বাড়ি তার যাওয়া নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েছে সে এসবে পাত্তা দেয়নি।বিয়ে মানুষের জীবনে একটাই সুতরাং মানুষের কথা শুনে পিছু হটার মানে হয় না।

কালকে মেয়েটাকে কেমন মনম,রা লাগছিলো ভাবতেই ফিরোজের মন খারাপ হচ্ছে।এ-ই পর্যন্ত দুজনে ঠিকমতো একমিনিটও কথা বলতে পারেনি,মেহমানের টিটকারি,হট্টগোলে কথা বলা হয়নি।সে শ্যামাকে বলেছিলো তাদের সাথে শপিং এ যেতে কিন্তু সে যায়নি।শুধু শ্যামা তার কাছে আসুক তারপর সব কষ্ট,আ,ঘাত মুছে দেবে,সর্বোচ্চ সুখী করবে তার রানীকে।সে মনে মনে দোয়া করছে যেনো ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যায়, আর কোনো ঝামেলার সূত্রপাত হয়ে যেনো বিয়ে না ভাঙ্গে এই তার কামনা।

শ্যামাদের বাড়ীতে ফিরোজকে দেখে সবাই হইহই করে উঠে।শ্যামার মুখে রাজ্যের খুশী ভর করে।অজানা কারণে একরাশ লজ্জা গাল ছুঁয়ে যায়।ফিরোজ সবার হাসিঠাট্টা উপেক্ষা করে শ্যামার কাছে গিয়ে বসে।চোখ ফিরিয়ে প্রিয়তমার দিকে তাকায়,শ্যামাও তাকায়,ফিরোজকে এতো সুন্দর লাগছে যে শ্যামা বরাবরবে মতো আবারো হোচট খেয়ে নাক মুখ থুবড়ে প্রেমে পরে।ফিসফিস করে বললো,

“আপনার প্রেমে বারবার পরছি,এমন সুদর্শন হতে কে বলেছে?প্রতিবার প্রেমে পরতে পরতে যদি আমিই ম,রে যাই তাহলে ভালো হবে?”
ফিরোজও আস্তে করে বললো,

“তোমাকে এমন করে মা,রতে না পারলে কেমন প্রেমিক হলাম?”
শ্যামা চুপচাপ বসে থাকে।শ্বাস ভরে নেয় ফিরোজের গায়ে মাখা সুগন্ধির সু-ঘ্রাণ।ফিরোজ শ্যামার মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,

“হলুদে একদম হলুদপরী লাগছে।ইচ্ছে করছে এখনি একটু আদর দিয়ে দিতে।”
শ্যামার অধরে ফুটে উঠে লাজুক হাসি।
“আপনি খুব দুষ্টু হয়ে গেছেন।”
“সব বর’ই তো দুষ্টু হয়। ”
“চুপ।”

ফিরোজ দুষ্টু হেসে বললো,
“আচ্ছা।আসল কথা হবে বাসর ঘরে।”
“আল্লাহ!এ কিসের পাল্লায় পরলাম?”
“মধুরাজার পাল্লায়।”
“আপনি পাগল।”
“তোমার জন্য সুন্দরী।”

স্বপন ইসলাম আর ফাতেমা বেগম স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনকে একসাথে সুন্দর লাগছে,মানিয়েছে মাশাল্লাহ।ফিরোজ দেখতে বড়োই সুদর্শন এতোদিন তাদের চোখে যেনো এতোবড়ো রূপ চোখে পরেনি,আজকে দুজনেই ভাবছেন ফিরোজ সুন্দর পুরুষ।মেয়ের সুখী সুখী হাসোজ্জল চেহারা যেনো উনাদের মন ভালো করে দেয়।

রাত বারোটার দিকে মোহাম্মদ আলী,চেয়ারম্যানকে নিয়ে স্বপন ইসলামের বাড়িতে আসে, সাথে ফিরোজও আসে।সে তার আব্বাকে একা এই বাড়িতে আসতে দিতে নারাজ তার এখনো মনে হয় কোনো ঝামেলা হয়ে যাবে তাই রিক্স নেয়ার দরকার নেই।এতো রাতে আসার মূল কারণ হচ্ছে বিয়েতে কতো দেনমোহর হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি কালকে বিয়ের সময় এসব নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে এখনি আলোচনায় বসা ভালো।

মোহাম্মদ আলী বলেন,
“দেনমোহর কতো হলে ভালো হয়?”
স্বপন ইসলাম চুপ করে থাকেন।রিপন বললো,
“আপনারা কতো চাচ্ছেন?”
চেয়ারম্যান বললো,

“ইসলামি হিসাবে ফিরোজের ইনকাম অনুযায়ী দেড় লাখ টাকাই ধার্য করা ঠিক হবে।”
মোহাম্মদ আলী বললো,
“তাহলে দেড় লাখই হবে।”
স্বপন ইসলামের মুখ অন্ধকার হয়ে আসে।
“এতো কম?আজকাল বিয়েতে এতো কমে দেনমোহর হয় নাকি?”
“বিয়েতে দেনমোহর কম হলেই আল্লাহ খুশী হয়,বরকত দেন।”

শ্যামার বুক ধুকপুক করে।এই মূহুর্তে সে কোনো বিপদ চায়না।দেনমোহর কমে তার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তার আব্বা কেনো রাজী হচ্ছেনা? দেনমোহরে কি সুখ হয় ?সে তার আম্মাকে বললো,
“আম্মা,দেনমোহর তো ঠিকই আছে।আব্বাকে রাজী হয়ে যেতে বলো।”
ফাতেমা বেগম চোখ পাকিয়ে বললো,

“তুই চুপ থাক।কি বুঝিস তুই?দেনমোহর একটা মেয়ের খুটি,এমনিতেই তো প্রেমের বিয়ে।”
শ্যামা চুপ করে আবার পুরুষদের দিকে তাকায়।ফিরোজকে গম্ভীর লাগছে,নাকের পাটাতন ফুলে উঠছে।শ্যামা আৎকে উঠে,ফিরোজ কি রেগে যাচ্ছে,এখন রেগে যাওয়া মানেই সমস্যা।শ্যামা মনে মনে আল্লাহকে ডাকে।
স্বপন ইসলাম মোহাম্মদ আলীর কথা মানতে নারাজ।

“দেনমোহর পাঁচ লাখ হবে,আমার এটাই ইচ্ছা।”
মোহাম্মদ আলী বিষ্ফোরিত চক্ষু মেলে তাকিয়ে থাকে।
“আপনার মাথা ঠিক আছে? ”
“জ্বী।”

মধুমাস পর্ব ৩৪

“যদি এতো টাকায় রাজী না হই?”
স্বপন ইসলাম কঠিন গলায় বললো,
“তাহলে বিয়ে হবেনা,এই মজলিসেই আমি আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছি!”

মধুমাস পর্ব ৩৬