খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৭

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৭
আভা ইসলাম রাত্রি

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শেহজাদ শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। এতক্ষণে পৌঁছে যাবার কথা। অথচ শহর থেকে খবর এসেছে শেহজাদ নাকি আজ মিটিংয়ে পৌঁছায় নি এখনো। মর্তুজা এ কথা নওশাদকে জানানোর সময় অতিরিক্ত চিন্তায় হাঁপাচ্ছে রীতিমত। তার সংশয় হচ্ছে, নেতাসাহেবের কিছু হয়ে গেল না তো আবার। দুপুর পেরিয়ে রাত দশটা বেজে গেছে।

অথছ শেহজাদ হঠাৎ করে লাপাত্তা হয়ে গেল একদম। ব্যাপারটা মর্তুজা একদম অদেখা করতে পারছে না। কোনোকিছু চিন্তা না করেই নওশাদ আয়ুষ্মানকে কল করে সে। নওশাদ তখন সবে আকিকার প্রস্তুতি শেষ করে ঘুমানোর জন্যে বিছানায় এসেছেন। মর্তুজার কথা শুনে নওশাদ এক মুহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। পাশেই রেখা বেগম ঘুমে। তাই তিনি ঝট করে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এসব কী শোনাচ্ছ তুমি? শেহজাদ এখন শহরে পৌঁছে নি?’
‘না, সাহেবজান! আমি ওনাকে ফোনেও পাচ্ছি না। উনার মোবাইল বন্ধ। আপনি কী জানেন উনি এখন কোথায় থাকতে পারেন?‘
‘আজকের মিটিং নিয়ে যে শেহজাদ এত উতলা ছিল, ছেলের আকীকা অব্দি পিঁছিয়েছে, সেই মিটিং এ শেহজাদ যায়নি? ওকে কখন থেকে কলে পাচ্ছ না?,

‘আসরের পর থেকে। বের হবার পর আমার সাথে একবার কথা হয়েছিলো, তিনি বলেছেন তিনি ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছাবেন মিটিংয়ে। অথচ–‘
মর্তুজা কথা শেষ করতে পারেনি, তাৎক্ষণিক চারপাশ অন্ধকার দেখতে লাগেন নওশাদ। শেহজাদ যথেষ্ট সৎ হবার পরও তার শত্রুর অভাব নেই। চারপাশে ভালো মানুষ এর মুখোশ পরে থাকা অমানুষেররা শেহজাদের চারপাশে পাখা গজিযে বসে। কখন কোন পাশ থেকে ছোবল মারবে সেই অপেক্ষায়। নওশাদ জিজ্ঞেস করেন,

‘শেহজাদ লাপাত্তা এ কথা আর কেউ জানে? নাকি তুমি আর আমি?‘
‘জী না, কেউ জানে না আর।‘
‘ভালো করেছ। আমি দেখছি বিষয়টা। রাখো তুমি।‘
নওশাদ কল কেটে দেন। তারপরই কল দেন শহরের ইন্সপেক্টর খন্দকার শোয়েবকে। শোয়েব সাহেব সবে থানা থেকে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। নওশাদ আয়ুষ্মানের কল পেয়ে তিনি কল ধরেন,
‘আসসালামুআলাইকুম স্যার। ভালো আছেন?’

নওশাদ তখন খোশমেজাজে নন। তাই তিনি এসব আমোদ ফুর্তির আলাপে গেলেন না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
‘শেহজাদকে দুপুর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে জানেন কিছু?’
শোয়েব এর ভ্রুঁ কুঁচকে গেল এ কথা শুনে। তিনি আজ সকাল থেকে থানাতেই ছিলেন। তেমন কোনো খবর তো তিনি পান নি। শোয়েব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

‘মেয়র সাহেবের তো আজ শহরে আসার কথা ছিল। আমার পুলিশ ফোর্স তাকে গার্ড দেবার কথা ছিল মিটিংয়ে। কিন্তু কোনো কারণে মিটিং পিছিয়ে গেছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। মেয়র সাহেব সম্পর্কে তেমন কিছু কেউ বলেন নি আমাদের।’

নওশাদ এবার মাথায় হাত দিয়ে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে পরেন। বুকের গতি বেড়ে যাচ্ছে উনার। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সবাই জানে শেহজাদ শহরে যায় নি, অথচ শেহজাদের আব্বাকে সেটা এত রাতে জানানো হচ্ছে। মর্তুজা এতটা আহাম্মক কিভাবে হয়ে গেল? নওশাদ এবার কিছুটা রেগে যান, বলেন;
‘একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র শহরে আসার পথে লাপাত্তা হয়ে গেল, অথচ আপনারা সেটা জানেন না বলছেন? সারাদিন থানায় কি ঘোড়ার ঘাস কাটেন?’

শোয়েব অপমানিতবোধ করেন কিছুটা। কিন্তু মেয়র সাহেবের জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ কেইসে তার বাবা এহেন রেগে যাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক বলে তিনি অপমানটুকু গিলে ফেলার চেষ্টা করে বলেন,
‘জ্বি, স্যার। চিন্তা করবেন না। আমরা ফোর্স লাগাচ্ছি এক্ষুনি। আপনি কি শহরে আসছেন?’
নওশাদ তখন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সৌরভ আয়ুষ্মানের ঘরের দিকে যাচ্ছেন। শোয়েব এর কথায় তিনি দাত খিঁচিয়ে খিঁচিয়ে বলেন,

‘না, শুয়ে আছি বিছানায়। এসি চলছে, এই বাতাস ছেড়ে কি শহরের ধুলোবালিতে আসা যায়? বেয়াদব! ফোর্স লাগাও, আমি আসছি।’
শোয়েব এমন বড়সর ধমক শুনে চিরবিরিয়ে উঠে। তাৎক্ষণিক ক্ষমা চেয়ে কল কেটে দ্রুত কদমে যেদিকে এসেছেন সেদিকে ফিরে যান, অর্থাৎ থানায়।
নওশাদ সৌরভকে সাথে নিয়ে তাৎক্ষণিক গাড়ি ভাড়া করে শহরের দিকে ছুটেন। পলাশ আয়ুষ্মান তখন দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরাম করে বাপ-চাচার দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখছে।

শেহজাদ আয়ুষ্মানকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। মোবাইল বন্ধ, যোগাযোগ করার কোনোরূপ উপায় নেই। নওশাদ এবং সৌরভ চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে, অথচ শেহজাদের খোঁজ পাওয়া গেল না। আর একটু পরেই শেহজাদের ছেলের আকীকা। বাড়ি থেকে কল আসবে বোধহয় একটু পরেই। কি জবাব দেবেন তাদের নওশাদ?

শেহজাদের স্ত্রী-সন্তানের কি হবে? নওশাদ দিশেহারা হয়ে পরেন। শোয়েবের হাতে শিকল দিয়ে বাঁধা এক নেড়ি কুকুর। কুকুর গন্ধ শুঁকে শুঁকে নিজে দৌড়েছে, সবাইকে পাঁচ মাইল দৌড় করিয়েছে। এখনো শুঁকেই যাচ্ছে, আর দৌঁড়ে যাচ্ছে অনবরত। শোয়েব হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। সে ভয়ে ভয়ে নওশাদ আয়ুষ্মানের পাশে এসে বললেন,
‘স্যার, রাগ না করলে একটা কথা বলি?’

নওশাদ ক্লান্তিভরা চোখে শোয়েবের দিকে চান। মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেন। শোয়েব চিন্তিত স্বরে জানায়,
‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কুকুরটা বোধহয় আরো দৌড়াবে। সেটা কয়েক কিলোমিটারও হতে পারে। সেটা দেখে আমি আন্দাজ করছি, মেয়র সাহেবের বোধহয় গ্রামের দিকের রাস্তায় সড়-ক দু-ঘর্ট-না হয়ে —-‘
নওশাদ আঁতকে উঠেন। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। সৌরভ পাশ থেকে দ্রুতদমে বললেন,

‘আমাদের একবার গ্রামটা দেখা উচিত, গ্রামের রাস্তা সড়ক, মহাসড়ক, সবকিছু একবার ভালো করে দেখা উচিত ভাইজান।’
নওশাদ শুনেন। অতঃপর সবাই ছুটেন গ্রামের দিকে। রাস্তায় কল আসে নওশাদের। রেখা বেগমের কল। নিশ্চয়ই এখন কোথায় আছে জানতে চাইবে। নওশাদ গলা পরিষ্কার করে কল ধরেন,

‘কোথায় আছেন আপনি?’
রেখা বেগমের উত্তরে নওশাদ স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেন,
‘একটু শহরে এসেছি, দেরি হবে আসতে। মেহমানরা সবাই চলে এসেছেন?’
‘না, আসবেন একটু পর। শহরে কেন? আজকে নাতির আকীকা ভুলে গেছেন?’
‘ভুলিনি, মনে আছে। নাতির জন্যেই এসেছি। আকিকায় ওকে কিছু দেব না? প্রথম নাতি আয়ুষ্মান বংশের!’
রেখা বেগম হালকা হাসেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন,

‘শহরে যখন গেছেন, শেহজাদ নিয়েই ফিরবেন। ওরও ত আজ ফেরার কথা।’
নওশাদ কি উত্তর দেবেন খুঁজে পেলেন না। মিহি স্বরে জবাব দেন, ‘হুঁ, ফিরব। রাখছি।’
রেখা বেগমের কল কাটার পরপরই শোয়েবের ফোনে কল আসে। শোয়েব কল ধরলে ওপাশ থেকে গ্রাম্য ভাষায় কেউ একজন বললেন,

‘বড়স্যার, একটা লাশ পাইসি মহাসড়কের ঐদিকে। হনে হয় গাড়িতে কইরা আইসিল, ট্রাকের লগে লাইগা গাড়ি ভাইঙ্গা মইরা গেছে।’
শোয়েবের ফোন স্পিকারে দেওয়া। গ্রামের লোকের এ কথা শুনে পাশ থেকে নওশাদ উৎ পেতে শুনেন এরপর কি বলবে। শোয়েব জিজ্ঞেস করে,
‘লাশের সঙ্গে কোনো কার্ড আছে কি না দেখো।’
গ্রামের লোকটি খুঁজল বোধহয়। তারপর আবার বলল,

‘না স্যার, একটা ফোন আছে। ঐটা ভাইঙ্গা লোকের পাশেই পইরা আছে।’
নওশাদ পাশে থেকে অধৈর্য্য গলায় জিজ্ঞেস করতে বললেন,
‘জামা-কাপড় কি পরা জিজ্ঞেস করো।’

শোয়েব জিজ্ঞেস করেন, উত্তর আসে,
‘সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা। রক্তে সাদা পাঞ্জাবি লাল হইয়া গেছে স্যার।’
নওশাদ এবার আর নিজেকে আটকাতে পারেন না। যেটুকু আশা ছিল সেটাও শেষ হয়ে গেল এখন। নওশাদের বুকের ভেতর ঝড়টা কি কেউ একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছে? সৌরভ পাশ থেকে হতভম্বের ন্যায় ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন।
শোয়েব বললেন,

‘লাশকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমরা আসছি। আমরা আসার আগে কোনো ডাক্তার যেন লাশ না ছুঁয়।’
‘জি আইচ্ছা স্যার। ওই লাশরে ধর বে। হাসপাতালের নিবাম।’
শোয়েব কল কেটে দেন। বিষন্ন নয়নে নওশাদের দিকে তাকান। নওশাদ ততক্ষণে সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছেন। শোয়েব নওশাদের কাধে হাত রাখেন,
‘নিজেকে সামলান স্যার। লাশ কার এখনো ভালো করে জানা যায়নি।’
এতকিছু শোনার পরও নওশাদ মনে এখনো কোথাও যেন আশার আলো দেখছেন। লাশটা শেহজাদের নয় ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

হাসপাতালে মর্গের দিকে উদভ্রান্ত ন্যায় ছুটেছেন সৌরভ নওশাদ। মর্গের ভ্যাঁপসা দুর্গন্ধ ছাপিয়ে তাদের কাছে ছেলের চিন্তায় আপাতত মুখ্য। চারপাশে জিজ্ঞেস করেন শোয়েব। জানা যায়, লাশটা আসলে শেহজাদ আয়ুষ্মান বলে কারো নয়। লাশের পরিবার এসে লাশটা নিয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। এ কথা শুনে নওশাদ বোধ হয়, জীবনে তিনি এ দু কান দিয়ে যত কথা শুনেছেন, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে মধুর কথা ছিল এটা।

শোয়েব চারপাশে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, নওশাদ পাশে আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাই। সৌরভ কয়েকবার ডাকলেন, ঠিক যেন ডাকগুলো নওশাদের কানে গেল না। পাথরের ন্যায় হাসপাতালের করিডোরে দাড়িয়ে আছেন। নওশাদের আত্মা লাফিয়ে উঠে, হঠাৎ তিনি শুনতে পান পেছন থেকে কেউ ডাকল তাকে,
‘আ-ব্বাজান!’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৬

গল্পের মোড় যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে, তাই খুশি হয়ে লাভ নেই। জানি এখন অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন আসবে। ধৈর্য্য ধরুন, বাকিটা দ্রুতই জানবেন। আর একটা কথা, যেমন আশা করেছেন এই পর্ব বোধহয় তেমন হয়নি। ফোন নিয়ে সত্যি অতিরিক্ত ঝামেলায় আছি। পুরনো ফোনে এই পর্ব লেখা। কি পরিমান বিরক্ত হয়েছি বলার বাইরে। যা ভেবেছি তা লেখা হয়নি হয়ত। এত পর্বে এসে এই এক পর্বে একটু অ্যাডজাস্ট করে নিবেন দয়া করে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৮