প্রেয়সী পর্ব ৪২

প্রেয়সী পর্ব ৪২
নন্দিনী নীলা

নাফিসা বেগম হঠাৎ করেই এনগেজমেন্টের আয়োজন করে আত্নীয় স্বজন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছে‌। তাও সবটা সবাইকে না জানিয়ে। এই বিষয়ে জানে শুধু নাফিসা বেগম ও মিতুল। দুজনে প্লান করেই এসব করেছে। নাফিসা বেগম একা একাই এনগেজমেন্টের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে তা নিয়ে ফুয়াদ চিৎকার করার সুযোগ পাওয়ার আগেই বাসার অনেকে ঝামেলা রাগ অভিমান বের হ‌ওয়া শুরু করে দিয়েছে।

তার মধ্যে প্রথমে আছে রাহী। যে বিয়ের পর শশুর বাড়ি যাওয়ার পর বাসা থেকে কারো খোঁজখবর নিতে আসতে দেখেনি সবাই কলে কথা বলেছে। মায়ের থেকে সে সব শুনেছিল কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দিয়েই সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে আছে তাকে কেউ আনতে পর্যন্ত যায় নি। রাগ দুঃখে নিজেই বাসায় এসেছে নাঈম কে নিয়ে। এখানে এসেই শুনে ফুয়াদের এনগেজমেন্ট এক দিন পর‌ই অথচ সে কিছুই জানে না। সে না আসলে তো জানতেই পারত না। নাফিসা বেগম কমিউনিটি সেন্টার বুকিং ও করে ফেলেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে ফুয়াদের বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া চলছে।
রাজীব খান একটা কথাই বারবার চিৎকার করে বলছেন,,” আমার ছেলের এনগেজমেন্ট আর আমিই‌ জানি না! আমাকে না জানিয়ে তুমি এই সিদ্ধান্ত একা কীভাবে নিতে পারলে?”
নাফিসা বেগম বললেন,,” বিয়ে ঠিক, মেয়ে ঠিক সেটা তো সবাই জানতেই‌। শুধু ডেট টা আমি ঠিক করেছি তাতেই তুমি অখুশি। দেখো রাহীর মা বাপ এমনিতেই রাগ করছে। এখন তুমিও এমন করলে কীভাবে হবে একবার আমার দিকে টা ভাব।”

” মেয়ে বিয়ে সব তো নিজের পছন্দে একা করেছ আমি শুধু জেনেছি। আর আজ এনগেজমেন্ট ও একা ঠিক করে সবাইকে ইনভাইট করে দিয়েছ‌। দুই দিন পর তো ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ব‌উ এনে আমার সামনে হাজির করবে। বাবা হিসেবে আমার কি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নাই?”
” আমার সিদ্ধান্তে কি তোমার মত নাই?”
রাজীব খান রাগী কন্ঠে বলল,” না নেই।”

নাফিসা বেগম না শুনতেই রেগে বোম হয়ে গেল বললেন,,” দেখো বেশি বাড়াবাড়ি করবে না।”
” কি বললে আমি বাড়াবাড়ি করছি?” রাগে ফেটে পড়লেন রাজীব খান।
” হ্যা তুমি বাড়াবাড়ি করছো। সামান্য একটা ব্যাপার জটিল করছো। আগামীকাল ই এনগেজমেন্ট হবে।”
রাজীব খান রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না নাফিসা কে এক চর মেরে বসলেন। নাফিসা বেগম চর খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন।

মিতুল দরজার মাথায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিল ও দেখছিল। এসব দেখে দৌড়ে পালায় রাহীর রুমের দিকে। রাহী এসেছে বাসায় ও ভুলেই গিয়েছিল। রাহী নাঈম রুমে কিছু নিয়ে কথা বলছে। ওদের আওয়াজ পেয়ে মিতুল কোন রুমে যাবে ভাবছে। এতো দিন তো এই রুমেই ও থাকত।

মধু অনেক দিন পর ফোন হাতে পেয়েছে। এই বাসায় আসার আজ তিন দিন ফুয়াদ ওকে রুম বন্দি করে রেখেছে। ও আজ সকালেই ফুয়াদ কে অনেক রিকোয়েস্ট করে ফোন নিয়েছে। নিয়েই চার্জে বসাইছিল। ফুয়াদ রুমে নাই এই সুযোগ খালামনিকে কল দেওয়ার। ও কল দিল খালামনিকে। রিং হচ্ছে ও ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। খালামনি কল রিসিভ করেছে।

ও ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল‌।
” হ্যালো খালামনি। কেমন আছো?”
ওপাশ থেকে আগে কয়েকটা ঝাড়ি দিল তারপর বললেন,,” ক‌ই ছিলি তুই কতবার কল দিছি খবর আছে? ফোন বন্ধ রেখেছিলি কেন? কি হয়েছে তোর ঠিক আছিস তো?”
” আমি ঠিক আছি। কিন্তু বাবা আর ভাই তো সব জেনে গেছে এখন এখানে এসে ঝামেলা করছে। তুমি কবে আসবে দেশে।”
” দুলাভাইয়ের সাথে বাড়ি চলে যা ‌ আমি বাংলাদেশে চলে আসছি‌।”

মধু লাফ দিয়ে বলল,,” সত্যি?”
” হ্যা রে তোর ওখানে….
মধু পেছনে তাকাতেই দেখে ফুয়াদ পেটে হাত গুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। মধু বাই দিয়ে ফোন কেটে কোমরে হাত গুজে এগিয়ে এসে ফুয়াদের মুখোমুখি দাঁড়াল।
তারপর বলল,,” কি ব্যাপার এখানে কি করছেন? আপনি কি আমার কথা শুনছিলেন?”
ফুয়াদ কথা বলল না। চুপ করে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মধু আবার বলল,,” কি হলো হ্যাবলার মতো চেয়ে আছেন কেন উত্তর দিন?”

” আমি তো তোমায় দেখতে ব্যস্ত এখন কথা বলতে পারব না।”
” আর ইউ ম্যাড?” রাগী কন্ঠে বলল মধু।
ফুয়াদ আত্নবিশ্বাসী কন্ঠে বলল,” No, I’m a lover.”
মধু হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে।
ওর কথা শুনে মধু মুখটা হা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,” পাগলের লাভার!”
ফুয়াদ মধুর হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল,” তুমি পাগল?”

” আজব আমি পাগল হতে যাব কেন?”
ফুয়াদ ওর কপালের ছোটো ছোটো চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,” তুমি পাগল বলেই তো আমাকে পাগলের লাভার বললে।”
” আমি পাগল না আপনি পাগল।”
” হুম আমি পাগল আর তুমি আমার পাগলি।”
মধু বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,” ধ্যাত..”

মধু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এল রুম থেকে। ও সিঁড়ি বেয়ে নামছিল তখনি শুনল ফুয়াদের এনগেজমেন্ট সেসব নিয়েই গোল মিটিং চলছে। আজ ফুয়াদ দরজা না আটকেই কোথায় যেন চলে গেছে। দুপুরে‌ এসে ওকে জ্বালিয়ে কোথায় জানি চলে গেছে ও সুযোগ পেতে বেরিয়ে এসেছে। প্রথমে যখন এই বাসায় এসেছিল সবাই কত ভালোবাসা তো আর এখন সবার থেকে লুকিয়ে রুম বন্দি থাকতে হচ্ছে সামনে গেলে কড়া কথা বলছে।

মধুর চোখ ছলছল করে উঠল। ও দেখল চিত্রা ভাবি দাঁড়িয়ে আছে নাফিসা বেগম এর সামনে। তার পাশে বসা মিতুল। মিতুল আর চিত্রা ভাবি শপিং এ যাবে। আগামীকাল এনগেজমেন্ট আজকে শপিং এ যাবে। রাহী এসেছে তাদের কথা শুনে জানতে পারল মধু। ও নিচে থেকে আবার উপরে উঠে এল আর সোজা রাহীর রুমে নক করল।
রাহী মধু কে পেয়েই জাপ্টে ধরল আর ওকে বলতে লাগল ফুয়াদ আর মিতুল এর এনগেজমেন্ট এর কথা। সব শুনে মধু তদ্ধা খেয়ে র‌ইল।

” তুমি ভাইয়া কে কিছু বলবে না মধু। সবাই চাচির উপর রেগে আছে মিতুল চাচিকে কান পরা দিয়ে এসবে রাজি করিয়েছে। সবাই রাগ এতে। শুধু ফুয়াদ ভাইয়াই কিছু বলছে না। সে তোমাকে ভালোবাসি বলে এতো কিছু করল। আর এখন এনগেজমেন্ট এও রাজি হয়ে বসে আছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি। ভাইয়ার সাথে কথা বলে আমি তো হতবাক। তিনি নাকি এনগেজমেন্ট করবে। আগের বার রিং পড়াতে পারে নি এবার নিজ হাতেই নাকি পড়াবে।”

মধু নিজেও অবাক। সারাদিন ভালোবাসি বলে ওর কান জ্বালা পারা করে এখন নাকি সে আরেকজনের সাথে এনগেজমেন্ট করতে রাজি। কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। ও আজ রাতে বাসা থেকে পালিয়ে যাবে ভেবেছে। কিন্তু এখন ও প্লান পরিবর্তন করে ফেলল। ও আগামীকাল ফুয়াদের এনগেজমেন্ট আগে দেখবে তারপর যাবে।

মধু বিছানায় বসে নখ কাটছে। ও বিলিভ করতে পারছে না ফুয়াদ এনগেজমেন্ট এ রাজি হয়েছে। এটা শোনার পর থেকেই ওর রাগ লাগছে। ও তো ফুয়াদকে পছন্দ করে না তাহলে কেন ওর রাগ লাগছে। ও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। ওর কেবলি খালি মন বলছে, ফুয়াদ এনগেজমেন্ট ও করবে আবার ওকেও সারাদিন ভালোবাসি বলে। বহুত বদমাইশ তো লোকটা। গাছের ও খাবে তলায় ও কুড়াবে‌।

মধু বিড়বিড় করেই থতমত খেয়ে গেল। নিজেই নিজেকে সরি বলে বলল,,” এসব কি ভাবছি। যাকে খুশি তাকে বিয়ে করুক এনগেজমেন্ট করুক আমার কি? আমি কি উনাকে ভালোবাসি নাকি। আমি তো চলেই যাব উনি কি করল তাতে আমার কি?”

” তোমার ই তো সব সুইটহার্ট। তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমাকে রেখে আরেকজনের সাথে এনগেজমেন্ট করতে যাচ্ছে। তুমি তো কেঁদে ভাসাবে আজ আমি তো তোমায় সান্ত্বনা দিতে আসলাম।”
পাশ থেকে ফুয়াদের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই মধু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
” এই আপনি হুটহাট কোথা থেকে চলে আসেন?”
” আমি তো কোথাও যাই ই না। আমি তো তোমার সঙ্গেই থাকি।”
” দেখুন…” আঙুল তুলে বলল মধু। ফুয়াদ ওর আঙুল ধরে বলল,,” কি দেখাতে চাও দেখাও।” বলেই ফুয়াদ ওর শরীরের দিকে চেয়ে চোখ টিপল। মধু বিড়বিড় করে ওকে ফাজিল বলে হাত ছাড়িয়ে নিল হাত ঝামটা দিয়ে।

তিন্নি মধুর হাতে একটা গর্জিয়াস লেহেঙ্গা দিল। মধু লেহেঙ্গা হাতে নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,,” এটা আমাকে দিচ্ছিস কেন?”
” এটা পরেই তুই যাবি।”
” এটা পরলে তো সবাই কনফিউশন হবে যাবে পাত্রী কে।”
” আমি তো সেটাই চাই। ভাই যা করছে তাতে এটা করাই দরকার।”
” আমি এসব করতে চাই না। আমি বেঁচে গেলাম উনি আমার পিছু ছাড়াতে।”
তিন্নি ওর হাত ধরে বলল,,” তুই সত্যি খুশি নাকি কষ্ট পাচ্ছিস।”

” আজব কষ্ট কেন পাব। উনার বিরক্ত করা থেকে বেঁচে যাব এটাই তো বড়ো পাওয়া। আমি যে কত খুশি বুঝাতে পারব না তোকে।”
চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে।
” এতো খুশি হলে তোকে তো আরো সুন্দর করে সেজেগুজে যাওয়া উচিত নয়তো ভাইয়া মনে করবে তুই তার বিরহে কাতর আছিস।”

মধু রাজি হলো ও লেহেঙ্গা পরল আর সুন্দর করে সাজগোজ ও করল। ও কষ্টে নাই এটা বুঝাতেই এতো সাজগোজ।
সমুদ্রের সাথে গাড়ি করে মধু, তিন্নি ও ফাহাদ কমিউনিটি সেন্টারে এল। গতকাল রাতেই লাস্ট ফুয়াদের সাথে দেখা হয়েছিল মধুর তারপর আর দেখা হয়নি। লোকটা ওকে আর ডিস্টার্ব করছে না। খুব বেশি সময় তো পার হয়নি তাতেই ওর কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ও নিজের মনকে নিজেই বুঝতে পারছে না। ডিস্টার্ব করলেও ও খুশি হতে পারে না। এখন ডিস্টার্ব করছে না তাতেও খুশি হতে পারছে না।

মধু গাড়ি থেকে নামতে যাব সমুদ্র ওর হাত ধরে নামাল। ও কাঁচুমাচু মুখ করে নেমেই হাত ছাড়িয়ে নিল।
সমুদ্র ফিসফিস করে বলল,,” ছোটো অবশ্যই কোন প্লান করেছে ও তোমাকে ছাড়বে না আমি জানি।”
তিন্নি আর মধু পাশাপাশি হাঁটছিল। ওদের পেছনে ছিল সমুদ্র আর ফাহাদ। সবাই এনগেজমেন্ট পার্টিতে আসলেও ফুয়াদের বাবা অনুপস্থিত। মধু হাঁটতে হাঁটতে দূরে লক্ষ্য করল মিতুল আর ফুয়াদ কে। দু’জনে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল ফুয়াদের বাহু জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। মধু ওদের এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটতে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। ও হাঁটা থামিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

” দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”
” দু’জনের এতো ভালোবাসা কবে হলো?”
মধু পূর্ণদৃষ্টি মেলে ফুয়াদের দিকে চেয়ে থেকে বলল। ফুয়াদ নীল রঙের শেরোয়ানি পরেছে। আর মধু নীল লেহেঙ্গা। দু’জনের এই মিল টুকু মধু খেয়াল না করলেও। মধু দেখল মিতুলের গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা টা। দারুন লাগছে মিতুল কে। মধু কে দেখতেই মিতুল আরো ঘনিষ্ঠ হলো ফুয়াদের সাথে।

নিজের মাথা নিয়ে ঠেকালো ফুয়াদের বাহুতে। মধু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে লাগল। না চাইতেও ওর রাগ লাগছে। দু’জনকে একসাথে একটুও ভালো লাগছে না মধুর কাছে। সব কিছু অসহ্য লাগছে ওর কাছে। ও খেয়াল করল ফুয়াদ ওকে দেখেও না দেখার ভান করে চলছে। ওর দিকে তাকালোই না। মিতুলের সাথে কিছু নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে চলে গেল ওকে ইগনোর করে। তিন্নি ওর রাগে লাল হ‌ওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

প্রেয়সী পর্ব ৪১ শেষ অংশ

জ্বর কমলেও। ঠান্ডা, গলা ব্যথা কিছুই কমে নাই‌। তবু আলহামদুলিল্লাহ আগের থেকে অনেক ভালো আছি। সবাই দোয়া করবেন।

প্রেয়সী পর্ব ৪৩