খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৮

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৮
আভা ইসলাম রাত্রি

‘আব্বাজান!’
বহু আকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বর শুনে হৃদয়ের স্পন্দন থমকে গেল নওশাদের। দ্রুত পেছনে ঘুরে তাকান তিনি। শেহজাদ রক্তে ভেজা পাঞ্জাবি গায়ে ক্লান্তিভরা দৃষ্টিতে এদিকেই চেয়ে। নওশাদ ছেলেকে দেখে বিভ্রম নিয়ে চেয়ে থাকেন। সৌরভ দৌঁড়ে এগিয়ে যান ভাতিজার দিকে। ভাতিজার সারা গা ছুঁয়ে দেখেন দুহাতে। শেহজাদ গলা পরিষ্কার করে চাচাজানকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে বলে,

‘ছোট একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এখন ঠিক আছি চাচাজান। ব্যস্ত হবেন না অযথা!’
সৌরভ তারপরও শেহজাদের গা আগাগোড়া ছুঁয়েদেখে বলেন,
‘তোমার শরীরে এত আঘাত কিভাবে হলো? কিভাবে হলো অ্যাকসিডেন্ট? গাড়ি কোথায় তোমার?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেহজাদ সৌরভের চোখে চোখ রাখে। দুর্বল গলায় কিছু বলতে চায়। বলতে পারে না। চোখ দুটো ব্যথায় বুজে আসছে যেমন। নওশাদ হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন। ছেলের কপালে ব্যান্ডেজ করা, খুঁতহীন চেহারায় স্পষ্ট কাটার দাগ। গালের চামড়া দেবে গেছে ভেতরের দিকে। হাতের মধ্যে প্লাস্টার লাগানো। এমন অবস্থায় ছেলে তার বলছে কিনা সে ছোট একটা অ্যাকসিডেন্ট করে এমন হাল করেছে শরীরের। নওশাদ শেহজাদের দিকে চেয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন,

‘গতকাল সারাদিন খবর পাওয়া যায়নি তোমার। অ্যাকসিডেন্ট করেছ, দুঃখের কথা। কিন্তু সে কথা বাড়িতে না জানানো ঠিক কতটা যুক্তির কাজ হয়েছে? গ্রামের নেতা, শহরের মেয়র হয়ে এমন ছেলেমানুষী কাজ সাজে তোমার? তোমাকে আমি দায়িত্ববান ভেবেছিলাম শেহজাদ।’

শেহজাদ নওশাদের কথা শুনে। কিছু উত্তর করে না। আড়চোখে সৌরভের দিকে চায়। সৌরভ সবেই ছেলেকে এতবছর পর কাছে পেয়েছেন। ছেলের প্রতি সবার সামনে রূঢ় ব্যবহার করলেও শেহজাদ জানে, এসব শুধু সৌরভের উপরের রাগ। ভেতরে ভেতরে তিনি ছেলের প্রতি এখনো ঠিক ছোটবেলার ন্যায় দুর্বল! পলাশের ব্যাপারে এহেন সত্য তিনি হয়ত বরদাস্ত করতে পারবেন না। শেহজাদ তাই নওশাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘দুঃখিত আমি। আসলে পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না বলেই জানানো হয়নি। গাড়ি ট্রাক ধাক্কা দেবার আগেই আমি গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় ছিটকে পরি বিধায় আজ আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। আমাকে আহত অবস্থায় দেখে এখানকার একজন পুলিশ অফিসার হাসপাতালে নিয়ে আসেন।আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন এতেই কি আমাদের খুশি হওয়া উচিত নয় আব্বাজান?’

নওশাদ ছেলের কথা গলে যান মুহূর্তেই। শেহজাদ এমন এক সুপুরুষ! যার কথাবার্তার মধ্যে নরম মেজাজের আভাস বিদ্যমান। যে কয়েক মিনিট শেহজাদের কণ্ঠ মন ভরে শুনে, তার সকল চিন্তা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা নিমিষেই দূর হয়ে যায়। নওশাদ জানে না, শেহজাদ এই অভ্যাস কার থেকে রপ্ত করেছে। নওশাদ সহ আয়ুষ্মান বংশের পুরুষদের রাগ বরাবরই চূড়ান্ত। রাগ তাদের নাকের ডগায় লেগে থাকে সবসময়। এমন বংশে শেহজাদের মত পুরুষ জন্মানো সম্পূর্ণ আয়ুষ্মান বংশের জন্যে গর্বের! নওশাদ ছেলের কাঁধে হাত রাখেন। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করেন,

‘ডাক্তার ঔষুধ দিয়েছেন? এই অবস্থায় বাড়ি না গিয়ে কেবিনে ভর্তি হয়ে যাও? আমি সব ব্যবস্থা করব?’
শেহজাদ কপালের ব্যান্ডেজ চুলকে মৃদু আওয়াজে উত্তর করে,
‘না, আজ আকীকা! এত মেহমান আম্মাজান, মেহজাদ একা সামলাতে পারবেন না। আমাদের যাওয়া উচিত।’

নওশাদ আরেকবার বলতে চাইলেন ভর্তি হবার কথা। কিন্তু শেহজাদের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে সেবারের ন্যায় চেপে গেলেন এ কথা। শেহজাদকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলেন সৌরভ। শোয়েব শেহজাদের অ্যাকসিডেন্ট বিবরণ নিচ্ছেন। যদি এ কাজ বিরোধী দলের কারো হয়, তবে এ অ্যাকসিডেন্ট এর মামলা আদালতে তোলা হবে। শেহজাদ অবশ্য শোয়েবের কথার কোনো উত্তর দিচ্ছে না।

সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছে। চোখের সামনে ভাসছে চিত্রার হাস্যোজ্বল মুখ! তাদের দুজনের ভালোবাসার ফসল তাদের ছয়দিনের ছেলে এখন নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু জানতেই পারল না, আরেকটু হলে সে এতিমের খাতায় নাম লেখাত! আল্লাহ সহায় ছিলেন! শেহজাদ বেঁচে ফিরেছে। পলাশ যখন শেহজাদকে বাড়িতে ফিরতে দেখবে, কেমন হবে তার বিস্মিত চেহারা? সে কি কখনো জানবে, শেহজাদ আয়ুষ্মান মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিভাবে বেঁচে ফিরল?

এখন শেহজাদের প্রথম কাজ, পলাশ আয়ুষ্মান এর ভালোমানুষির মুখোশ ছিড়ে ফেলা। সবার সামনে পলাশের কুৎসিত মনের পর্দা উঠানো। তাকে বোঝাবে কোথায় হাত দিয়েছে সে, শেহজাদ আয়ুষ্মান বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা একটা লোকও আজ অব্দি পৃথিবীর আলো দেখায় সক্ষম হয়নি। আর এ তো চুনোপুটি!

শেহজাদের মনে পরে, পলাশ কি সেই অচেনা ঘর শত্রু বিভীষণ? শেহজাদ জানে না। যদি তাই হয়! তবে আজ শেহজাদ আল্লাহর নাম করে কসম কাটে, পলাশ পস্তাবে। পরিবারের প্রতি দুর্বল শেহজাদ আয়ুষ্মান যেমন পরিবারকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসতে পারে, তেমনি নিজের পরিবার বাঁচানোর বেলায় পরিবারের আপন শত্রুকে ভেঙে গুড়িয়েও দিতে পারে। রাগে শেহজাদ প্লাস্টার লাগানো হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে। হাতের শিরা-উপশিরা ফুলে ফেঁপে উঠে। সাদা প্লাস্টারের গা ঘেঁষে বেরিয়ে আসে চিকন লাল রক্তের স্রোত!

চিত্রা সকাল থেকে আকিকার আয়োজন করছে। অসুস্থ শরীর, ছেলের কান্নাকাটি, এসব পরোয়া না করে শাশুড়ির কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করছে। চিত্রার বিয়ের এক বছর পেরিয়ে গেল। এখনো চিত্রা রেখার থেকে খোঁটা শুনে আসছে। কাজের মধ্যে কোনো ত্রুটি রেখা পছন্দ করেন না। তিনি চান, চিত্রা যেন তার মতো করেই আয়ুষ্মান মহলের সকল কাজ সামলায় একদম নিখুঁত ভাবে।

অথচ অল্পবয়সি চিত্রা আয়ুষ্মান মহলের কায়দা কানুন এখনো ভালো করে রপ্ত করতে পারেনি ততটা। ছেলে হবার পর চিত্রা রান্নাঘরে তেমন আসতেই পারেনা। ছেলে তাদের সারাক্ষণ কাঁদে, বুকের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে হয় সারাক্ষণ।
দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। মেহমানরা আয়ুষ্মান মহলে গিজগিজ করছেন রীতিমত। অথচ শেহজাদ এখনো ফেরে নি।

বাড়ির সকল পুরুষরাই আজ হঠাৎ করে সারাদিনের জন্যে বাইরে। শুধু মেহজাদ বাড়িতে। মেহমানদের অ্যাপায়ন সেই করছে। চিত্রা অভিমানে গাল ফুলায়। প্রথম ছেলের আকীকা, অথচ শেহজাদ কেমন দায়িত্বহীনের ন্যায় নেতাগিরি নিয়ে ব্যস্ত। আজ আসলে চিত্রা উনার সঙ্গে কথাই বলবে না। সবসময় নেতাগিরি তার কাছে বড়, চেঁচিয়ে ভাষণ দেওয়াটা উনার কাছে চিত্রার সঙ্গে দু নরম কথা বলার চেয়েও প্রিয়। চিত্রা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বারবার সদর দরজার দিকে চেয়ে দেখে। এই বুঝি এলেন তিনি!

শেহজাদ ফিরে! তবে আহত অবস্থায়। রেখা বেগম শেহজাদের এমন অবস্থায় রেখে সেখানেই ধপ করে মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরেন। বসার ঘরে রীতিমত হইচই লেগে গেছে। মেহমানরা একে একে সবাই বসার ঘরে ভিড় জমিয়েছেন। শেহজাদ কোনরকম রেখাকে সামলায়। রেখা ছেলের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ছেলের এমন করুন অবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না একদম।

শেহজাদ ফিরেছে শুনে চিত্রা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। বসার ঘরের সামনে পুরুষদের ভিড় দেখে সেদিকে আর যেতে পারে না। বড় পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে শেহজাদকে। শেহজাদ অ্যাকসিডেন্ট করে ফিরেছে! এক কান দু কান করে এ কথা চিত্রার কানেও পৌঁছে। সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা অস্থির হয়ে যায় শেহজাদকে দেখার জন্যে। বুকের ভেতরে ঝড় বয়ে চলে যেমন। বসার ঘর থেকে মেহ্জাদ এদিকেই এলে চিত্রা দ্রুত মেহজাদকে আটকায়! মেহজাদের হাতে ঔষধের বাক্স। চিত্রা জিজ্ঞেস করে,

‘দেবরজি! তোমার ভাইয়ের কি হয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো উনার?’
চিত্রার অস্থিরতা দেখে মেহ্জাদ কোনো কথা বলার সাহস পায়না। কোনরকম জানায়,
‘ভাইয়া এখন চাম্পকে দেখতে নিজের ঘরে যাবেন। আপনি এক কাজ করুন। ভাইয়ার ঘরে চলে যান। ভাইয়া আসছে একটু পর।’

চিত্রা আর কথা বাড়ায় না। দ্রুত নিজেদের ঘরে চলে আসে। দশ মিনিট পর শেহজাদ ঘরে এলে চিত্রা চায়। নজরে পরে আপাদমস্তক রক্তাক্ত স্বামীকে। আচমকা চিত্রার মাথা ঘুরে যায়। গতকালই তো ভালো ছিলেন। আজ এই কাটাছেড়া—- এতবড় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তার? চিত্রা ঠাই চেয়ে থাকে শেহজাদের দিকে। যেন পাথরের মূর্তি বনে গেছে সে। শেহজাদ চিত্রাকে দেখে, এ নারীমনে এখন কেমন ঝড় বইছে সেটা আর ঘটা করে বলে দিতে হল না শেহজাদকে। শেহজাদ সম্মোহিত স্বরে ডাকে,

‘সুভাসিনী!’
প্রিয় মানুষের এত আদরভরা ডাক চিত্রার হৃদয় কেটে ঝাঁজরা করে ফেলে। চিত্রা আর নিজেকে আটকাতে পারেনা। দৌঁড়ে গিয়ে শেহজাদের রক্ত মাখা বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। শেহজাদ ব্যথায় কুকড়ে যায়। কিন্তু এটুকু ‘আহ্’ অব্দি করে না। দুহাতে চিত্রাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। বুকটা বোধহয় সম্পূর্ণ এক রাত প্রখর রোদ্রের খরার মত যন্ত্রণায় থাকার পর এতক্ষণে শান্ত হল। শেহজাদ চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চুল গুছিয়ে দেবার ভঙ্গি করে সুধায়,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৭

‘নতুন শাড়িতে রক্ত লেগে যাচ্ছে। গোসল করে নিই?’
চিত্রা শুনে না। বরং হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে! তার জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিমা প্রমাণ করে যে, যে মানুষটা আপাদমস্তক স্বয়ং চিত্রার,তার কাছে কিসের সংশয়। তার রক্তের দাগ চিত্রার নতুন শাড়ি নষ্ট করে খানখান করে দিক। চিত্রার তাতে এটুকু মন খারাপও হবে না , কখনো না।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৯