প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৯

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৯
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

‘নিহাল ভাইয়া আপনি এখানে কী করছেন?’
অদিবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় পাশে থেকে দর্শিনীর আওয়াজ পেয়ে নিহাল চমকে তাকায়। হঠাৎ দর্শিনীকে লাল টুকটুকে শাড়িতে দেখে অগোচরে নিহাল মৃদু ঢোক গিলে নেয়। আগে থেকে এই রূপসী মেয়েটাকে তার ভিষণ পছন্দ ছিল। শাড়ি পড়া অবস্থায় প্রথম দেখছে। আজ অনেক আকষর্ণীয় লাগছে দর্শিনীকে।

এদিকে আদিবা অবাক হয়ে দর্শিনী, নিহালকে পর্যবেক্ষণ করছে। আদিবা ভাবছে দর্শিনী কী চেনে এই লোকটিকে?কেমন অভদ্র ম‍্যানার্সহীন লোক যে সামান‍্য সরি বলতে পারেনা। অথচ মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে মন চায়। দর্শিনী উত্তর পাওয়ার আশায় দু’জনের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনেই এতোক্ষণ তর্ক করে মুখে কুলুপ এটেঁ রয়েছে। দর্শিনী আবারো জিগ্যেস করলে আদিবা তী’ক্ষ্ম মেজাজে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘দেখনা প্রিয় আপু! আমি কিডস’জোনের দিকে যাচ্ছিলাম এই লোকটা হঠাৎ ধাক্কা দিলো অথচ সরি বলার প্রয়োজন মনে করলো না। আমি সরি বলতে বললাম। উল্টে বলে কিনা আমি পুচকে মেয়ে আমার নাকি সরি বলা উচিত। কিছুদিন পর অষ্টাদশী হবো।এই অসভ‍্য লোকটা আমাকে পুচকে বলেছে। উনাকে দেখেই আমার মেয়েবাজ মনে হচ্ছে মেয়ে দেখে গায়ে পড়ার বাহানা সব।’

দর্শিনী গলা ঝেড়ে মৃদু কেশে উঠে। মেয়েবাজ?তার নিহাল ভাইয়া? দর্শিনী বুঝতে পারছে দু’জনের মধ‍্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিহাল এতোক্ষণ আদিবাকে ভদ্রভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু হঠাৎ আদিবার এসব কথায় মেজাজ খুঁইয়ে ফেলে। মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,

‘এক্সকিউজমি মেয়েবাজ কে? আমার তাড়া ছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে হাত ঘড়িতে তাকিয়ে ছিলাম আপনি ফোন দেখতে দেখতে আসছিলেন আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন। আপনার মতো পুচকে মেয়ের সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে নেই আমার। আমি মেয়েবাজ নই আপনি ছেলেবাজ। অদ্ভুত মেয়ে!’
দর্শিনী পড়েছে মহা ঝামেলায়। আদিবা রেগে গিয়ে কিছু বলবে তার আগে দর্শিনী তাকে থামিয়ে দেয়। দর্শিনী আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘আদিবা উনি ডা.নিহাল রায়হান। এতোদিন অস্ট্রেলিয়া তে ছিলেন। আমার কাজিন হয়। উনি আমাদের চেয়ে অনেক বড়। হয়তো ভুলে ধাক্কা লেগেছে। এতো রিয়াক্ট করার কিছু নেই। উনি কিন্তু সরি বলেছে তুমি প্লীজ রাগ করো না।’
আদিবা দর্শিনীর কথায় ভ্রুকুঁচকে নিহালের দিকে তাকায়। এই লোকটাকে কোনভাবে তার ডাক্তার মনে হচ্ছে না। কিন্তু লোকটাকে বিদেশী বললে ভুল হবেনা দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফলে হয়তো উনার চেহারাতে আলাদা শুভ্রতা রয়েছে। দর্শিনী নিহালের উদ্দেশ্যে বলে,

‘নিহাল ভাইয়া আদিবা আমার ছোট বোন সমতূল‍্য। বুঝতেই পারছেন ও অনেক ছোট।প্লীজ ওর কথায় রাগ করবেন না। আদিবা অনেক ভালো মেয়ে শুধু একটু রাগী। আপনি অচেনা তাই এমন ভাবে রিয়াক্ট করেছে।__ কথাটা দর্শিনী আদিবাকে আগলে ধরে বলে।

আদিবা এখনো নিহালকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। নিহাল আদিবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে আবার ঘড়ির দিকে তাকায়। দেরী হচ্ছে তার। বিগবাজার হসপিটালের কাছে হওয়ায় সহকারী ডাক্তারদের
সঙ্গে শপিংমলের রেস্টুরেন্টে এসেছে। এখন সবাই তার জন‍্য হয়তো রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে। নিহাল দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘প্রিয় তুই এখানে কী করছিস আন্টি, প্রজ্জ্বল, আঙ্কেল এসেছে নাকি?
‘না ভাইয়া। আমি আসলে ____
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই আবিদ আরহান এসে হাজির হয়। আবিদ নিহালের দিকে একবার তাকিয়ে দর্শিনী আর আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘কী হয়েছে এখানে? উনি কে দর্শিনী?’
দর্শিনী আবিদকে দেখে জিগ্যেস করে,
‘আপনাদের দু’ভাইয়ের কেনাকাটা শেষ?এতদ্রুত?’
‘আপাতত শেষ। সবাই বাসায় রওনা দেবো এখন। বললেন নাতো উনি কে?’
দর্শিনী নিহালের দিকে একবার তাকিয়ে আবিদকে বলে,

‘ওহ্! উনি আমার কাজিন নিহাল ভাইয়া। ডা.নিহাল রায়হান। এখানে হুট করে দেখা হয়ে গেছে। এমনি জিগ্যেস করছিল কার সঙ্গে এসেছি? একা এসেছি কিনা?’___দর্শিনী সন্তপর্ণে আদিবা আর নিহালের তর্কাতর্কির বিষয়টি চেপে যায়। ততক্ষণে বাকি দু’জন হাত ভর্তি শপিং ব‍্যাগ নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসে।

নিহাল, আবিদ আর দর্শিনীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আবিদকে সে চেনেনা ইভেন এদের কাউকেই চেনেনা। এদের সঙ্গে দর্শিনীর কী কাজ থাকতে পারে নিহাল বুঝতে পারছেনা। আবিদ দর্শিনীর কথায় নিহালের দিকে তাকায়। ভদ্রতা বজায় রাখতে হাতটা বাড়িয়ে বলে,

‘আমি আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। দর্শিনীর হবু বর।’
নিহাল স্তব্ধ হয়ে গেছে। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী দর্শিনীর হবু বর?সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। আবিদের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ফর্মালিটি মেইনটেন করতে হাতটা বাড়িয়ে বলে,

‘ডা.নিহাল রায়হান। দর্শিনীর খালাতো ভাই।’___ নিহালের হঠাৎ বুকে ব‍্যাথা হচ্ছে। এতোবছর পর যার জন‍্য আসলো তার বিয়ে হয়ে যাবে অথচ সে জানেনা। একমুহূর্তের জন‍্য নিহালের মনে হয় যা শুনলো সব যেন মিথ‍্যা হয়ে যায়। আবিদ মুচকি হেসে হ‍্যান্ডসেক করলো। যাওয়ার সময় দর্শিনী নিহালকে বাই বলে সবার সঙ্গে রওনা দেয়।

নিহাল সবকিছু সঙ্গে ব‍্যাস্ততা ভুলে দর্শিনীদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। আদিবা অবশ‍্য দু’বার নিহালের দিকে তাকিয়েছে। নিহালকে আদিবার অদ্ভুত লেগেছে একবারো তাকালো না তার দিকে। দর্শিনীর হাতে অনেকগুলো শপিং ব‍্যাগ ছিল। আবিদ এবং দর্শিনী পাশাপাশি যাচ্ছে। আবিদ হঠাৎ দর্শিনীর হাত থেকে শপিং ব‍্যাগ নিয়ে নেয়।

তারপর দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যেতে থাকে। দূর থেকে নিহাল সবটাই লক্ষ‍্য করলো তার বুকে হঠাৎ র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাদের প্রচন্ড কষ্ট দেয়। যা সহজে ভুলে যাওয়ার মতো না। নিহালের কাছে এই পুরো ঘটনাটা অপ্রত‍্যাশিত।

নিহাল দেরী না করে সহকারী ডাক্তারদের কাছে ফিরে যায়। আজকে দ্রুত ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। দর্শিনীর বিয়েটা যে করে হোক আঁটকাতে হবে। নিহাল আজকেই বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে আশরাফ মুহতাসিমের কাছে। সে তো একজন ভালো ডাক্তার নিশ্চয় আশরাফ মুহতাসিম রাজি হবেন তাকে ফিরিয়ে দেবে না। প্রয়োজনে পা ধরে ভিক্ষা চাইবে তবুও একবার চেষ্টা করতে তো দোষ নাই।

চৌধুরী পরিবারের সবাই সবে বাড়িতে ফিরেছে। সবাই ড্রয়িং রুমে এসির মধ‍্যে বসে আছে। প্রচন্ড গরম আজকে। ড্রয়িং রুমের সবগুলো এসি ছেড়েছে আবিদ। গরম একদমই সহ‍্য করতে পারেনা। দর্শিনী ও গরম সহ‍্য করতে পারেনা। গরমে মেয়েটার শুভ্র ত্বক যেন হালকা লালচে হয়ে উঠে। ব‍্যাস বিয়ের আগে আর কয়েক মুহুর্ত দর্শিনী চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে কাটাবে।

আজকে প্রচুর কেনাকাটা করা হয়েছে। অনুসা বেগম দর্শিনীর জন‍্য যেগুলো কিনেছেন সবগুলো আলাদা
করে রেখেছেন। তিনি প্রিয়দর্শিনীর পরিবারের সব সদস্যদের জন‍্য কেনাকাটা করেছেন। আজকে আবিদ নিয়ে যাবে সব। শাহরিয়ার চৌধুরী হতবাক অবশ্য বাড়ির প্রত‍্যেক পুরুষ হতবাক। মেয়েদের কেনাকাটা করার প্রচুর ধৈর্য‍্য।পছন্দ নাহলে শপিংমলের দোকান গুলো বারবার ঘুরতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়না। অথচ ছেলেদের এতো ধৈর্য্য নেই।

পছন্দ হলেও কী?না হলেও কী?ঐ একই দোকান থেকে কিনে নেয় সব। সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। আবিদ স্বাভাবিক ছুটির দিন হলে নিজের রুমে সময় কাটাতো। কিন্তু আজ দর্শিনী আছে সে নিজের রুমে যাওয়ার বদলে সোফায় বসে ফোন দেখতে থাকে। মূলত সে ফোন এবং দর্শিনী দু’জনের দিকেই নজর রেখেছে।

নিহাল নামের লোকটির কথা আবিদকে ভাবাচ্ছে। লোকটির দৃষ্টি দর্শিনীর দিকে ছিল। যেই দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা ছিল। আবিদ এসবে তেমন পাত্তা দেয়না। কারণ দর্শিনী শুধু আবিদ শাহরিয়ারের সে জানে। তবুও অন‍্যকেউ দর্শিনীর প্রতি ভালোলাগার দৃষ্টিতে দেখুক এইটা আবিদ একদমই চায়না।

আবিদ দর্শিনীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়।মেয়েটা হেয়ার ব‍্যান্ড দিয়ে খোঁপা করে আছে সামনে অগোচরে কিছু চুল বেরিয়ে।দেখতে মা’রাত্মক লাগছে। আবিদের আবারো বউ বউ ফিলিংস আসছে। যদি সম্পর্কটা হালাল ভাবে পূর্ণতা পেয়ে থাকতো।তবে এতক্ষণে নিজের রুমে গিয়ে সাজিয়ে রাখতো। যা ইচ্ছে করতে পারতো। মেয়েটা এতো কেনো পোড়ায় তাকে? বিগত একবছর থেকে শান্তি দেয়নি। না চাইতেও আবিদের মনে পড়তো দর্শিনীকে।

শেষে আবিদ তখন লোক লাগিয়ে খোঁজখবর রাখতো কখনো কলেজের সামনে সিভিল পোশাকে মাস্ক পড়ে একবার দেখার জন‍্য ছটফট করতো। কখন,কোথায় যায়?কোন কচিং? সব খোঁজ নিতো আবিদ। আগেও জিলাতে বেশ কয়েকবার গেছে আবিদ। আবিদ বহু আগে থেকে আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে পরিচিত ছিল। এখন শুধু সম্পর্কটা হালালভাবে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষায়। আবিদের কাছে এই সময়টা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।

বিকেল পাঁচটা____
আবিদ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দর্শিনীর জন‍্য অপেক্ষা করছে। দর্শিনীকে অনুসা বেগম ছাড়তে চাইছেন না। একদিনে মেয়েটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে। পুস্পিতা আদিবা দু’জনে গিফট গুলো গাড়িতে রেখে দেয়। অনুসা বেগম দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। দর্শিনীর মনে হচ্ছে আজ এইবাড়িতে আরেকটা মাকে পেলো। যে মা এখানে তাকে সারাজীবন আগলে রাখবে। দর্শিনীকে আসতে দেখে আবিদ গাড়িতে উঠে বসে। আদিবা পুস্পিতা একে একে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরল। আদিবা ইমোশনাল হয়ে বলল,

‘কালকে সবাই মিলে যাচ্ছি তোমাদের বাসায়। কবে যে বিয়েটা হবে আমি অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি আমার ভাবী হয়ে আসো প্রিয় আপু। তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগবে না এখন।’

দর্শিনী আদিবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে গাড়িতে উঠে আবিদের পাশে বসে। অনুসা বেগম আবিদকে আস্তে-ধীরে গাড়ি চালাতে বলেন। দর্শিনী সবাইকে সালাম করে আরো একবার বিদায় জানায়। আবিদের গাড়ি অদৃশ্য হওয়া পযর্ন্ত বেলকনি থেকে সবটা পরোক্ষ করেছে আসফি। হাতে তার স্পীড ক‍্যান।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৮

সে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। দুনিয়ার সবকিছু তার বিষাক্ত লাগছে। সে মনে হয় প্রথম ব‍্যাক্তি যে ভাইয়ের উপর প্রচন্ড হিংসা করছে। কিন্তু উপায় কী আবিদ প্রতিবার তার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আসে। প্রথমে বাবা-মা, তারপর ফুপি, এখন প্রিয়দর্শিনী। কিন্তু আসফি চুপ থাকবেনা এবার। সে লড়ে যাবে যে করে হোক সর্বচ্চো চেষ্টা করবে প্রিয়দর্শিনীকে পাওয়ার জন‍্য। বাকিটা ভাগ‍‍্য!

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২০