খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৯

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৯
আভা ইসলাম রাত্রি

স্বামী! সম্বোধনটা যেন চিত্রাকে আলোড়িত করে তুলল। চিত্রার বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে উঠল যেন। দুরুদুরু বুক নিয়ে চিত্রা এগিয়ে গেল শেহজাদের দিকে। চিত্রা এখনো অনেকখানি দুরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই নিজেই কিছুটা ঘন হয়ে দাঁড়াল শেহজাদ। বুক টানটান করে শেহজাদ আদেশ করল,

‘পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দাও।’
চিত্রা কেমন নড়ে উঠল। এলোমেলো দৃষ্টিতে চাইল শেহজাদের বুকের দিকে। লোমশ বুক উঁকি দিচ্ছে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবির ফাঁকে। শেহজাদ চিত্রাকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ভ্রু কুঁচকে আবারও আদেশ করল,
‘এসো?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চিত্রার পায়ে-মনে-সর্বাঙ্গে ভূমিকম্প বয়েছে যেমন। তবুও চিত্রা হাত বাড়াল। শেহজাদ যেমন ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে আছে, চিত্রার সাহস হয়নি তার আদেশ অমান্য করার। চিত্রা পাঞ্জাবির বোতামে হাত রাখল। প্রথম বোতাম লাগানোর সময় চিত্রার হাত থেকে বারবার বোতাম খসকে পরছিল। শেহজাদ সব লক্ষ্য করল, কিছুটা সাহায্যও করল বটে। শেষ বোতাম লাগানোর সময় কেঁপে উঠে চিত্রা ঝুঁকে গেল শেহজাদের বুকের উপর।

শেহজাদের বুকে নাক স্পর্শ হলে, মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠে চিত্রা। শেহজাদ সঙ্গেসঙ্গে চিত্রার বাহু স্পর্শ করে সামলে নেয়, সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। বোতাম লাগানোর পরপরই চিত্রা ছিটকে সরে আসে। শেহজাদ স্বাভাবিকভাবে নজর বুলায় হাতঘড়িতে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে! গ্রাম থেকে ঢাকা যাবে, ঢাকা থেকে আমেরিকা!

সেভাবেই টিকেট কাটা তার। চিত্রা লজ্জায় জমে! আর একমুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না সে। দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। শেহজাদ ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। মেয়েটা একদম নিশ্চুপ নয়, বরং সময় উপযোগে কিছুটা চঞ্চলও বটে। শেহজাদ গা ঝাঁকাল। আঙ্গুল সব ফুটিয়ে নিয়ে, লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

নওশাদ পুত্রের হাতে সৌদিআরব থেকে নতুন কিনে আনানো আতর ধরিয়ে দিলেন। শেহজাদ ‘শুকরিয়া’ আদায় করে আতর শরীরে মেখে অতঃপর পকেটে পুড়ে। রেখা কয়েক ধরনের শুকনো খাবার প্যাকেট করে গাড়িতে তুলে দিলেন। যাবার আগে সবাইকে সালাম করল শেহজাদ। চিত্রাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শেহজাদ জিজ্ঞেস করল,

‘আম্মাজান, সুভাষিণীকে ডেকে দিলে ভালো হত। কিছু জরুরি কথা ছিল।’
রেখা বেগম ইশারা করলেন মেয়েকে। শেহজাদের ছোট বোন হিয়া ডেকে আনল চিত্রাকে। শেহজাদ-চিত্রাকে একা বসার ঘরে রেখে সবাই উঠোনের দিকে চললেন। চিত্রা কেমন নেতিয়ে আছে! লজ্জায় মুখ রক্তিম আকার ধারণ করছে। শেহজাদ তা দেখেও এড়িয়ে গেল। চিত্রার দিকে চাবির গোছা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আমার ঘরের চাবি, লাইব্রেরির চাবি, বিছানায় পাশে তোমার গয়না যে ড্রয়ারে রাখা তার চাবিও এখানে আছে। সাবধানে রেখো।’
চিত্রা কম্পিত হাতে চাবির গোছা নেওয়ার জন্যে হাত বাড়াল। চাবি নেওয়ার সময় সম্পূর্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দুজনের আঙ্গুল ছুঁয়ে গেল পরম আবেশে। চিত্রা দ্রুত চাবির গোছা হাতে নিয়ে আঙ্গুল চেপে ধরলো। শেহজাদ হাত সরিয়ে স্বাভাবিক স্বরে জানাল,

‘ভালো থেকো, খুব শীগ্রই ফিরব আমি। আল্লাহ্ হাফেজ।’
শেহজাদ চলে গেল। চিত্রা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে গ্রিলে হাত রেখে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল বাইরের পানে। যতক্ষণ শেহজাদের গাড়ি দেখা গেল, দু চোখের পলক পরল না চিত্রার।

চিত্রা ঠিক করেছে শেহজাদ আসার আগ অব্দি সে হিয়ার কাছে শুদ্ধ ভাষা চর্চা করবে। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন বই পড়ার চর্চা করবে। চিত্রা চায় এ বাড়ির যোগ্য বউ হয়ে উঠতে কদিনের মধ্যে। হিয়া নিজের ঘরে পড়াশোনা করছে। চিত্রা হিয়ার ঘরের দরজায় টোকা দেয়,

‘আমি চিত্রা। ঘরে আমু?’
হিয়া ভেতর থেকে উত্তর দেয়,
‘আসেন ভাবিজান, অনুমতি নিচ্ছেন কেন?’
চিত্রা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হিয়া বই বন্ধ করে চিত্রার দিকে তাকাল। চিত্রা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। হিয়া ইশারা করল,

‘দাঁড়িয়ে কেন? বসেন বিছানায়।’
চিত্রা বসল। দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে চিত্রার বিয়ের। অথচ এখনো চিত্রা এ বাড়ির মানুষের সামনে সংকোচ নিয়ে চলে। কেমন ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময। ছোট ঘরের মেয়ে বড় ঘরে এলে মানিয়ে নিতেই জীবনটা ফুরিয়ে যায়। চিত্রা বিছানায় বসে। হিয়া বলে,

‘ভাইজানের জন্যে মন খারাপ আপনার, ভাবিজান?’
চিত্রা চমকে উঠে সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিল,
‘ছিঃ ছিঃ, ওমন কিচ্ছু না।’
‘তাহলে? কি চিন্তায় আছেন?’
চিত্রা কিছুক্ষণ আঙ্গুলে আঙ্গুল ঘষল। একটু পর উত্তর দেয়,
‘আমারে শুদ্ধ ভাষা শেখাইবে?’
হিয়া খানিক চিত্রার দিকে চেয়ে রইল। পরপরই মৃদু হেসে বলল,

‘কে বলেছে শিখতে? আপনার ভাষা এমনই শুনতে ভালো লাগে।’
‘আমি নিজেই শিখবার ছাই। শেখাইবে?’
হিয়া হাসল খানিক। এ বাড়ির কেউ অতটা হাসে না, কথা বলে মেপেঝেপে। অথচ এ ষোড়ষী কন্যার ঠোঁটে যেন হাসি সরে না। হিয়া চেয়ার টেনে চিত্রার মুখোমুখি হল। বলল,
‘অবশ্যই শেখাব, ভাবিজান। আজ থেকে আমি আপনার বাংলা মাস্টার। ঠিকাছে?’
চিত্রা মৃদু হেসে সম্মতি দিল।

শেহজাদ এবং মেহজাদ দু ভাই মুখোমুখি বসে আছে। মেহজাদ এখনও অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে শেহজাদের দিকে। ঘুমঘুম চোখ ঢলে নিয়ে আবারো মেহজাদ বলল,
‘ভাইয়া, তোমার সামনের মাসে আসার কথা ছিল! এখন কেন? শিট! আমি যাব না দেশে এখন।’
শেহজাদ কথা বাড়াল না। একটা লাগেজ টেনে মেহজাদের মুখোমুখি রাখল। চেয়ারে আবারও নেতার মত বুক টানটান করে বসে বলল,

‘লাগেজ তৈরি করো, আমরা আগামীকাল দেশে যাচ্ছি। আর কোনো বাড়তি কথা নয়।’
মেহজাদ এখনো জেদ দেখিয়ে বিছানায় বসে আছে। গতকাল রাতে দেরি করে পার্টি করে রুমে এসেছে সে। ঘুমাতে ঘুমাতে বড্ড রাত হয়ে গেছে। মাথা এখনো হিবিজিবি হয়ে আছে। এখনো ঘুম কাটে নি তার। মেহজাদ কপালের এলোমেলো চুল হাত দিয়ে খামচে ধরলো। ভাইয়ের দিকে অসহায় নয়নে চেয়ে বলল,

‘আমি এই সেমিস্টার শেষ করে তবে যাই? মাঝপথে ছেড়ে গেলে প্রবলেম হবে।’
শেহজাদ আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে। গা ঝাঁকিয়ে আরাম করে বসে ভ্রু কুঁচকে জানাল,
‘আমি প্রফেসরের সঙ্গে কথা সেরে ফেলেছি। তিনি অনুমতি দিয়েছেন। আর কোনো অজুহাত দেবার আছে তোমার?’
মেহজাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ উল্টে বিরক্ত হয়ে বলল,

‘এত বুদ্ধি নিয়ে চলা ভালো না, ভাইয়া। তাছাড়াও আমি অজুহাত দেখাচ্ছি না। আমি দেশে যাব না মিনস যাব না। দ্যাটস ফাইনাল।’
শেহজাদ আচমকা উঠে দাড়াল চেয়ার ছেড়ে। প্রচন্ড রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে দেখল মেহজাদকে। শেহজাদের এমন রাগান্বিত চাওনি দেখে গলা শুকিয়ে গেল মেহজাদের। শেহজাদের এমন রক্তিম চোখ সবাই দেখে না সাধারণত। তবে যারা দেখে তাদের আত্মা কেঁপে উঠে। শেহজাদের মুখে আর কিছুই বলা লাগল না। মেহজাদ ভয়ে সে দু কদম পিছিয়ে হাত উঁচু করে বলল,

‘কুল ভাইয়া, কুল! আমি যাব তো দেশে, আমি আবার কখন মানা করলাম দেশে যাব না। যাব, অবশ্যই যাব। এইতো লাগেজ গুছাচ্ছি।’
মেহজাদ দ্রুত দুই হাতে লাগেজ গুছানো শুরু করল। শেহজাদ আবারও বসল চেয়ারে। তীক্ষ্ম চোখে মেহজাদের একেকটা কর্ম দেখতে থাকল।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৮

শেহজাদের কড়া নজরদারিতে মেহজাদের কোনো ফাঁকিবাজি কাজে লাগল না। মেহজাদ এই মুহূর্তে বড্ড অসহায় বোধ করছে। উর্বশীকেও বলা হয় নি সে দেশে যাচ্ছে! জানলে মেহজাদকে মেরে ফেলবে এ মেয়ে। একবার কি লুকিয়ে কল করবে মেহজাদ তাকে?

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১০