কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৯

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৯
লাবণ্য ইয়াসমিন

দীর্ঘদিন পর আপনালয়ে ফিরে গেছে কহিনুর। পৃথিবীতে কতকিছু অলৌকিক কাহিনী ঘটে যায় যার সঠিক ব্যাখ্যা হয়না ।মানুষের পক্ষে সেসব জানাও সম্ভব হয়না। কহিনুর তেমনই একজন মানবি। মনে হয় অতি সাধারণ কিন্তু ওর মধ্যে থাকা পাথরটা একদম ভিন্ন। পাথরের শক্তি শুভ অশুভ দুটোই ইঙ্গিত করে।

প্রতিটা মানুষের মধ্যে যেমন ভালো খারাপ আছে তেমনই এটার গুণাগুণও তেমন। ভালোর জন্য ভালো আর খারাপের জন্য খারাপ। পাথর কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টিলার উপরে গিয়ে পৌঁছে গেলো। কহিনুরকে বিদায় জানানোর পরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। ভেতরের প\শু শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রকাশের জন্য আহাজারি করে মরছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাথর এই অদম্য শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে রূপ পরিবর্তন ঘটিয়ে ছুটি এসেছে এই টিলার উপরে। চাঁদ ডুবে গিয়েও তার নিজস্ব আলোর রেখা ধরণীতে রেখে গেছে। শরীরের শক্তি প্রায় অর্ধেক শেষ। পাথর নরম ঘাটের উপরে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল,

এমন অভিশপ্ত জীবন কেন দিলে খোদা? জেনে বুঝে কোনো পাপ করিনি তবুও অজানা পাপে জ্বলেপুড়ে মারা যাচ্ছি।এমন জীবন চাইনা আমি।হয় মুক্তি দাও নয়তো মৃত্যু। এভাবে দুই সত্বা নিয়ে আমি বাঁচতে পারছি না।
পাথরের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। প্রতিধ্বনিতে বারবার মুখোরিত হচ্ছে প্রান্তর। দূরে এক নারীর ওষ্ঠে সুক্ষ হাসির রেখা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কথায় বলে, “কারো পৌষমাস আর কারো সর্বনাশ”।পাথরের কন্দনরত আওয়াজ মেয়েটার হৃদয়ে ঝড় তুলেছে। খানিকটা সময় নিয়ে পাথর থামলো। হাটু ভেঙে বসে হাতের তালুতে নিজের মুখটা নিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। ছেলেদের কাঁদতে নেই কথাটা আজ ফিকে হয়ে গেছে। এমন অভিশপ্ত জীবন কারো কাম্য না। মেয়েটা ধীরগতিতে পাথরের পেছনে এসে থামলো। মৃদু হেসে ডান হাত বাড়িয়ে পাথরের কাধে হাত রাখতে যাবে সেই ক্ষণে পুরুষালী গমগমে আওয়াজে পাথর বলে উঠল,

সাবধান আমাকে স্পর্শ করোনা। নোংরা হাতে ইমরোজ খান পাথরকে স্পর্শ করা যায়না। আমার থেকে দূরে থাকো।
মেয়েটা হয়তো এটা আশা করেনি। তীব্র অপমানে ফুলে ফেপে উঠলো। কিছুক্ষণ পূর্বে যে পুরুষ নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে কাঁদছিলো। এক কথায় ভেঙে পড়েছিল সেই পুরুষের মুখে এমন কঠিন শব্দটা মানতে পারছে না তাই ঝাঝালো কণ্ঠে উত্তর দিলো,

জাষ্ট আপনাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছি বৈকি কিছুই না। আপনি দেখি চরম বেয়াদব। উপকার করতে চাইলে অপমান করেন। অহংকারী মানুষকে আপনার সৃষ্টিকর্তা পছন্দ করেতো?
পাথর উঠে দাঁড়ালো। আকাশে চাঁদ নেই তবুও চারদিক অন্ধকার মনে হচ্ছে না। তাছাড়া পাথরের দৃষ্টিশক্তি প্রখর। রাত দিন সমান। পাথর মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুচকে বিরক্ত নিয়ে বলল,

আমার সৃষ্টিকর্তা পরস্ত্রীদের থেকে পুরুষজাতিকে দূরে থাকতে বলেছেন এবং তাদের থেকে এহেন উপকার নিতে নিষেধ করেছেন। আপনি যা ইচ্ছা আমার সম্পর্কে ভাবতে পারেন অসুবিধা নেই। শুধু দূরে থাকুন।
মেয়েটা দূরে থাকলোনা বরং খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,

কি হবে এগিয়ে আসলে? সুদর্শন যুবকের হৃদয়ে এতোটা কঠোরতা বেমানান। আমি অষ্টাদশী সুন্দরী যুবতী একটা মেয়ে। আমার দিকে চেয়ে পৃথিবীর সুন্দরতম ফুল গোলাপও হিংসা করে তবে কেন আপনি এমন করে অপমান করতে পারেন?
পাথর বুঝতে পারলো মেয়েটা অহেতুক ঝগড়া করতে চাইছে। স্ত্রী বুদ্ধি ভয়ঙ্কর তাই এর থেকে এড়িয়ে যাওয়ায় ভালো। ও চুপচাপ পিছিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু হলোনা। মেয়েটা তড়িঘড়ি সামনে এগিয়ে এসে পূণরায় বলল,

যেতে পারবেন না। আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। তাই আমার কষ্ট নিরাময় করার দায়িত্ব আপনার। এভাবে ফেলে যেতে পারেন না। আমি নয়তো আপনার পিছু নিব।
পাথর সহ্য করতে পারলোনা এমন উত্তর শুনে। শরীরের পেশি শক্ত হচ্ছে। আবারও ভেতরের পশুশক্তি বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে না পেরে দাঁত কিড়মিড় করে করলো,

আমাকে রাগিয়ে দিলে ফল ভালো হবে না মেয়ে। আমাকে খুব স্পর্শ করার সখ তাইনা? তবে তাইহোক। আসুন আমার বাহুবন্ধনে। দেখি সুলতানা কহিনুর ফারুকীর নিজস্ব আমানতের তীব্র দহন জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা কতটুকু আপনার। আমি পুরোটাই আমার স্ত্রীর বুঝতে পেরেছেন?
মেয়েটা কহিনুরের নাম শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেল তবে মুখের হাসি এখনো বিলুপ্ত হয়নি। ঢোক গিলে এলোমেলো হেসে উত্তর দিল,

কহিনুর সৌভাগ্যবতী নারী যে নিজের স্বামীকে হাতের পুতুলে রূপান্তরিত করেছে। আচ্ছা আপনি কি ওর রূপের মোহে পড়েছেন নাকি হৃদয় দিয়ে চেয়েছেন কোনটা? শুনেছি মেয়ে বোবা বধির ছিল বিধায় আপনি ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেছিলেন তাহলে এহেন ভালোবাসা কোথা থেকে আসছে? পুরুষ মানুষ রূপের কাঙ্গাল কথাটা কিন্তু মিথ্যা না। মানুষ সৌন্দর্যের পুজারী।

পাথরএবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা। হাত পায়ের নক আবারও দপদপ করে জ্বলছে। মেয়েটা কহিনুর আর ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। তবে একবারের জন্যও প্রশ্ন জাগ্রত হয়নি মেয়েটার পরিচয় কি? পাথর কপালের উপরে নেমে আসা কেশগুচ্ছ হাতের আঙুলের ভাজে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,

আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন করতে আসবেন না। কতটা ভালোবাসি সে আমার হৃদয় জানে। বাইরের মানুষের কাছে প্রমাণ করার কিছু নেই। কহিনুর আমার, পুরোটাই আমার।
কতবার নিজের স্ত্রীকে একান্তে পেয়েছেন? এমন স্ত্রীকে পুরুষের সত্যি কি প্রয়োজন আছে? বরং ছেড়ে দিন এমন সৌন্দর্যের অধিকারীকে যে নিজের স্বামীর থেকে উদাসীন। নামমাত্র স্ত্রী সে।
মেয়েটা আসল কথা বলে দিয়ে ঘনঘন চোখের পাপড়ি নাড়লো। পাথর থমথমে মুখ নিয়ে কিছু বলার পূর্বেই মেয়েলী নরম দুটো হাত ওকে পেছন থেকে আবদ্ধ করে নিলো। পাথরের ওষ্টে হাসি ফুঁটলো। রাগ ক্রমাগত কমে আসলো। পেছনের মেয়েটা সামান্য উঁকি দিয়ে রিনরিনে কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,

সুলতানা কহিনুর ফারুকী বুঝি এসব নর্দমার কিট,পিশাচের কটাক্ষ শুনতে পাগলের মতো নিজের স্বামীকে ছেড়ে রেখেছে?
মেয়েটা যেন ভড়কে গেলো। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
তুমি এখানে?
তো কোথায় থাকব? এতোক্ষন যার সঙ্গে ছলচাতুরি করছিলে তার হৃদয়ের সঙ্গে আমার যে একটা যোগাযোগ আছে সেটা জানতে না? কক্ষে বসে বিশ্রাম করছিলাম কিন্তু তোমার সহ্য হলোনা। একের পর এক অপমান করে চলেছো। কি ভেবেছিলে এসব বলে ওকে আমার বিরুদ্ধে নিবে? এতোটা সহজ মনে হচ্ছে?

পাথর হাত বাড়িয়ে কহিনুরকে পেছন থেকে সামনে এনে জড়িয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। কপালের উপরে ঝুকে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে ছোট করে চুমু দিয়ে বলল,
আসলে কেন? তুমি না ক্লান্ত ছিলে?
কহিনুর উত্তর দিল না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা অরিত্রীর আঠারো বছরের প্রতিচ্ছবি। নির্জন প্রন্তর উঁচু টিলার উপরে তিনটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্রীর ছায়া নেই আছে আকৃতি। কহিনুর সেদিকে চেয়ে শান্ত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল,

একটা অসহায় মেয়ের শরীর ব্যবহার করতে বিকেকে বাঁধেনি? ছেড়ে দাও ওকে আর দাফ/ন করে দাও। মেয়েটা চির দুঃখ নিয়ে জন্মেছে, ম/রেও সুখের দেখা পেলনা।
অরিত্রী রেগে গেলো। হাত বাড়িয়ে দিলো কহিনুরের গলার দিকে। কহিনুর বাঁধা দেবার আগেই পাথর আ/ক্রমণ করে বসলো। ধারা/লো নক দিয়ে আচড় দিলো কাঁধে। এখনো পাথরের এক হাত আর বুকের সঙ্গে বন্ধি কহিনুরের শরীর। অরিত্রীর চোখে আগুন ঝরছে। হাতের নক সরু করে তেড়ে আসার আগেই কহিনুর মৃদু শব্দে উচ্চারণ করলো,

তফসিল মেহেরুন খান।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা থেমে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। শত্রু ততক্ষণ শক্তিশালী যতক্ষণ না তাকে চিহ্নিত করা যায়। পাথর কিছুটা অবাক হয়েছে। ও বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
ওটা তফসিল ছিল? কিন্তু ও অন্যদের শরীরে কেনো?
শরীর নেই তাই। বাদ দিন পরে বিস্তারিত বলব।
পাথর কহিনুরের মুখের দিকে চেয়ে শান্ত হয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

আমি সত্যি কি তোমার সৌন্দর্যকে ভালোবাসি? ওর বলা কথাগুলো কি সত্যি ছিল?
সুন্দরী অথবা বান্দরী সবটাই কিন্তু আপনার। পরের কথায় ঘরে অশান্তি করে লাভ কি? ভালোবাসেন আমাকে নিয়ে ভাবেন এতেই যথেষ্ট। ফিরে চলুন।
পাথর কহিনুরকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ওর মাথায় নিজের থুতনি রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল,

কবে সবটা স্বাভাবিক হবে নূর? আমি ইচ্ছে করলেও তোমাকে কেন নিজের সঙ্গে জড়াতে সাহস পেয়েও পায়না? অর্ধমানবের অভিশপ্ত ছোঁয়া তুমি সহ্য করতে পারবেনা আমি ভয়ে থাকি।
কহিনুরের চোখ ভারি হয়ে উঠলো। সব সময় কঠিনহৃদয়ের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব না। নিজের একান্ত আপন মানুষের কষ্টে হৃদয় হাহাকার করে। কহিনুর দুহাতে ওকে আগলে নিলো। চোখ ভারিহয়ে উঠছে। চোখের পাপড়িতে চিকচিক করছে মুক্তদানার ন্যায় জল। এভাবেই কিছুটা সময় পার হলো। পূর্ব আকাশে আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে। হয়তো ঘন্টা খানিকটা পরে সূর্যের দেখা মিলবে। এখনো ফজর শুরু হয়নি। কহিনুর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

কিছু হবে না। আপনার জন্য এইটুকু যন্ত্রণা আমি আনন্দোচ্ছল হৃদয়ে উপভোগ করব। আফসোস নিয়ে মরতে চাইনা।
পাথরের হাত আলগা হয়ে আসলো। কহিনুরকে সামনে এনে ওর চোখের দিকে চেয়ে উত্তর দিলো,
ভালোবাসি নূর। শুধু কাছাকাছি থেকো এর চেয়ে সুখ পৃথিবীতে আমার জন্য কিছু নেই। কক্ষে ফিরে চলো। বিশ্রাম নিবে। আচ্ছা নূর, অকর্মণ্য সাঈদটাকে তুমি কোথায় পাঠিয়েছ বললে না যে?
কহিনুর চনচল হয়ে উঠলো। ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

ওকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ করেছি। শত্রুর অভাব নেই। আমার দুর্বল জায়গায় হানা দিতে সব প্রস্তুত হচ্ছে। আপনি কিন্তু ওকে কিছু বলবেন না।বেচারা আপনাকে ভয় পেয়ে চলে। ওষুধের বিষয়টা আমি ওকে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি সঙ্গে থাকলে ওরা আপনার ক্ষতি করতে পারে। খুব সরি।

পাথর চুপচাপ কহিনুরের কপালে আবারও ওষ্ঠ রাখলো। সব সময় রাগলে চলে না। পরিস্থিতি বুঝতে হয়। নির্জন টিলার উপরে এই দুজন দম্পতির হৃদয়ের আদান প্রদান খানিকটা সময় নিবিড়ভাবে হলেও সেটা সূর্যমারার উঁকিঝুঁকিতে বাধাগ্রস্ত হলো। ফিরে আসলো আপনালয়ে।

সুলতান হাউজে নতুন দুজন গৃহপরিচারিকার প্রধান কাজ হচ্ছে পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খেয়াল রাখা। নিয়মিত আসবাবপত্র পরিস্কার করে ঝকঝকে করে তোলা। আলফা ওদের খোঁজ নিতে গিয়ে তেমন কোনো তথ্য না পেয়ে পুলিশে ইনর্ফম করেছে। গোপনে এদের বিরুদ্ধে নজরদারি করা হচ্ছে। জুবায়ের ছেলেকে ভরসা না করলেও আপাতত এখন বাধ্য হয়েছে কথা শুনতে।

দৃষ্টির বাইরে যাওয়া বন্ধ। অধরার সম্পত্তির বিষয়ে উকিলের নোটিশ এসেছে। ও ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় সেটা দখল করতে পারে। সকাল সকাল রিজু শিকদার ছেলেদের নিয়ে সুলতান হাউজে পা রেখেছেন। ড্রয়িং রুমে ওদেরকে বসতে দিয়েছে কাজের মেয়েগুলো। এখনো কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। আলফা আর দৃষ্টি বাইরের টেনিস কোডে উদ্দাম গতিতে খেলতে নেমেছে। দৃষ্টি বরাবর হেরে যায় তাই আজ শপথ নিয়েছে হারবে না। তবে সেটার বাস্তবায়ন হবেকি এখনো অজানা। দূরে থেকে মাহিম রিজুয়ান ওদেরকে দেখতে দেখতে খানিকটা এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল,

দুজনেই চমৎকার খেলছেন। আমাকে সঙ্গী করবেন?
দৃষ্টি থমকে গেল। বাইরের লোকজনের সামনে ওর অস্বস্তি হয়। আলফা বুঝতে পেরে মাহিমের দিকে এগিয়ে এসে উত্তর দিল,

ধন্যবাদ আপনাকে। কক্ষে চলুন অতিথি আপ্যয়নের সুযোগ দিয়ে ধণ্য করুন। খেলা অন্যদিন হবে।
আলফা কৌশলে খেলা বন্ধ করলো সেটা মাহিম বুঝতে পারে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বলল,
সুলতানরা দেখি বড্ড চালাক। কথার প্যাচে ফেলে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে।
নিজস্ব স্বার্থে এইটুকু করাই যায়।

আলফা কথা বলতে বলতে মাহিমকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। দৃষ্টি পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেছে। ইতিমধ্যে বাড়ির অন্যরা উঠে গেছে। অধরা চিন্তিত বেশ। সম্পত্তির বিষয়ে ওর তেমন আগ্রহ নেই। জুবায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।মেয়ের উপরে ভরসা রেখে চুপচাপ আছে।জামসেদ বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
আপনি কি সম্পত্তির দখল দিতে প্রস্তুত আছেন?

রিজুর মুখটা ছোট হয়ে গেলো। এতো কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হচ্ছে মানতে বুক কাঁপছে। কি বলবে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মাহিম নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে। পাশে ওর ছোট ভাই বাবা এমন পরিস্থিতি সামলাতে উত্তর দিলো,
অবশ্যই আঙ্কেল। টাকা পয়সার থেকেও দামি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। আপনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মার। কখনও যেন মলিন না হয় সেইটুকু আশ্বাস দিয়ে আমাদের ধণ্য করলেই চলবে। বাবা এসেছেন সামান্য একটা অনুরোধ নিয়ে। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না। আমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে যাকে উপযুক্ত মনে করবেন তার জন্য আপনাদের দু’কন্যার একজনকে নির্বাচন করুন প্লিজ। আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা তাতেই রাজি।

ছেলেটার প্রস্তাব শুনে আলফা হতবাক হলো। মামা বাড়ির আবদার যেনো। সুলতান পরিবারের দুই কন্যা রাজকুমারীর সমান। তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত এভাবে কিকরে হবে? আলফা দৃষ্টির জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করবে। সেখানে নানারকম ছেলের মধ্যে একজনকে বেছে নিবে বোনের জন্য। পৃথিবী জানবে আজও মেয়েরা নিজের জীবন সঙ্গীকে বেছে নেয়ার অধিকার রাখে। কথাগুলো ভেবে ও ভ্রু কুচকে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,

সম্ভব না। আমার এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বাকিটার বিয়ে এভাবে হবে না। আমাদের পাত্র নির্বাচন করা আছে। দয়াকরে এসববের মধ্যে আমার সরল সোজা বোনদের টানবেন না। ওরা ইনোসেন্ট বাচ্চা টাইম। দয়াকরে এই টপিকে আর কথা তুলবেন না। টাকার দরকার হলে আপনাদের সাহায্য নিশ্চয়ই করব তবে এভাবে না। কথার প্যাঁচে ফেলবেন না লাভ হবে না। এই বাড়ির মেয়েদের কোনো কিছুর বিনিময়ে বিনিময় করা হয়না।
আলফার কথার ধরন শুনে ছেলেটা চুপসে গেলো। রিজু শিকদার বেশ অপমানবোধ করছেন। ওদেরকে বাঁচাতে জামসেদ মুখ খুললো,

বড়দের সামনে এভাবে বলতে হয়না বাচ্চা। আমরা আছিতো উনাদের বুঝিয়ে বলছি। তুমি নিজের কক্ষে যাও।
কিন্তু আমিতো ভুল কিছু বলিনি চাচ্চু। তুমিই বলো কখনও সম্ভব এটা?
পাশ থেকে মিরা আলফাকে ফোড়ন কেটে বলল,
ও এখানেই থাকবে। বাবু তুই কাউকে ভয় পাবিনা। ছোট মায়ের মতো উচিত কথা মুখের সামনে বলে দিবি। ছোট থেকে কাছাকাছি রেখেছি ভুলভাল শিক্ষা দেবার জন্য না। আমাকে সাপোর্ট করতে এটা ভুলে যাবি না।

আলফা কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে ছোট মায়ের দিকে চাইলো। এই বাড়িতে এই একটা মানুষ ওকে কারণ ছাড়া ভুল করলেও সাপোর্ট করে। আগলে রাখার চেষ্টা করে। জামসেদ বেশ অসন্তুষ্ট হলো স্ত্রীর উপরে। বউয়ের বুদ্ধি কম সেটা ওর অজানা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাইরের লোকজনের সামনে বোকামি করে ফেলে। অবস্থা নাগালের বাইরে যাওয়ার আগেই ও জুবায়েরকে ইশারা করলো। জুবায়ের এতোক্ষন চুপচাপ ছিল। ভাইয়ের ইঙ্গিত শুনেই হুকুম করলো,

আলফা ছোট আম্মুকে নিয়ে উপরে যাও। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে।
আলফা উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে উঠে আসলো। মিরা ওর পিছু নিলো। কহিনুর শেষ রাতে কক্ষে ফিরে এসেছে বাড়ির কেউ জানেনা। ওকে নিয়ে অধরা বেশ চিন্তিত থাকে। সাঈদ মাঝেমাঝে খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করে এটাই ভরসা। মাহিম রিজুয়ান কথার ছলে কহিনুরের সঙ্গে দেখা করার কথা উল্লেখ করতেই সকলের মুখ চুপসে গেলো। জুবায়ের কিছু বলতে চাইলো তার পূর্বে অধরা বলে দিলো,

ও নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে আছে। ফ্লু হয়েছে তাই খানিকটা অসুস্থ। বাইরে আসতে পারবে না। আপনারা রাজি থাকলে আপনার যেকোনো ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি আছি। কহিনুর আমার একান্ত বাধ্য মেয়ে। আমি যেমন বলবো তেমন শুনবে অসুবিধা নেই। আপনারা সিদ্ধান্ত নিন।
অধরার বাক্য শুনে বজ্রপাতের ন্যায় সকলে থমকে গেলো। জুবায়েরের কপালে ভাজ পড়লো। মাহিম রিজুয়ানের ওষ্ঠে হাসি বিরাজ করছে। জামসেদ কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরেই প্রশ্ন করলো,

কি বলছো তুমি?পাগলের মতো উদ্ভট কথাবার্তা বলছো কি হয়েছে তোমার?
আমি ঠিক আছি। যেটা বলেছি সেটাই হবে। কহিনুর বিয়ের জন্য প্রস্তুত। তাছাড়া অসুবিধার কিছুতো আমি দেখছি না। বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে বিয়ে দিবো এটা আনন্দের বিষয়।
জুবায়ের দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল,
আমার মনে হচ্ছে তুমি কফির মধ্যে ওয়াইন মিক্স করে খেয়ে নিয়েছো। প্লিজ উপরে চলো। আমি বউ ছেলেমেয়েদের চাপে হার্টের রুগী হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। যাইহোক শিকদার সাহেবে, আমার স্ত্রী অসুস্থ প্লিজ আপনারা কিছু মনে করবেন না।
জুবায়েরের কথা ধোপে টিকলো না। অধরা পূণরায় বলল

আমি ঠিক আছি। আচ্ছা আপনারা এখন আসুন আমি বাসার সবাইকে রাজি করিয়ে ফোন দিব। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন বিয়ে হচ্ছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
রিজু শিকদার হাসিমুখে দুই ছেলেকে নিয়ে বিদায় নিলেন। ওর চলে যেতেই জুবায়ের চেচামেচি শুরু করলো। মেয়ের সম্পর্কে সবটা জানার পরেও অধরা কিভাবে রাজি হতে পারে ওর মাথায় আসছে না। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৮

আপনার মেয়ের বলা কথাগুলো আমি এখানে উচ্চারণ করেছি মাত্র। আমাকে যেটুকু বলতে বলা হয়েছে আমি সেটুকু বলেছি। কিছুক্ষণ পূর্বে সাঈদ আমাকে বলে গেছে বিয়েতে রাজি হতে। কেনো আর কিজন্য বলেছে সেটা কহিনুর ভালো জানে। আপনারা বরং ওর থেকে উত্তর জেনে নিন। মেয়েটার মাথায় কি চলছে কে জানে

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩০

2 COMMENTS

Comments are closed.