কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৬

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৬
লাবণ্য ইয়াসমিন

সময় থেমে থাকে না। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরছে। জোছনামণ্ডিত চন্দ্র মাঝেমাঝে মেঘের আড়ালে গিয়ে ধরণী অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রাহুর কবলে ধরণী থরথর করে কেপে উঠছে। হয়তো ভূমিকম্প হচ্ছে। সমুদ্রের পানি খানিকটা ফেপে উঠে ঢেউয়ের তরঙ্গ তীরের দিকে ছুটে আসছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।

গ্রীষ্মের নিশীর মধ্য প্রহর চলছে। নিশাচর প্রাণী ব্যতীত সকলেই গভীর নিদ্রামগ্ন। নিস্তব্ধ পৃথিবীর বুকে কত হৃদয় ভাঙা হাহাকার ঘুমন্ত অবস্থায় আছে তার ঠিক নেই। কহিনুরের শরীর ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। বিন্দু বিন্দু র/ক্ত ঘাসের উপরে স্তুপ আকারে পড়ে আছে। পাথর সেদিকে চেয়ে আছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। সাঈদ এখনো তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার চোখে আজ মায়া মমতা বা কষ্টের কোনো চিহ্ন নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছলচাতুরি করছে এমনটাও না। ভাবতে ভাবতে একটা মিনিট শেষ হতে চলেছে। পাথর একপা দুপা করে পিছিয়ে গেলো। প্রহেলিকা কহিনুর পেয়ে বেজাই খুশী।আশেপাশের কোনো কিছুতে ওর তেমন আগ্রহ নেই।পাথর কিছুটা সময় ভেবে নিলো।ভদ্রমহিলার ভেতরে কোনো রহস্য বা জাদুবিদ্যা আছে কিনা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।হুট করে আঘাত করলে যদি না ম/রে তবে নূরকে বাঁচানো সম্ভব না।ভাবতে ভাবতে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।

ভেতরের প/শু শক্তি পূণরায় প্রকট হতে চাইছে।অর্ধমানবদের এই এক সমস্যা কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।পাথর ও পারলো না।শরীরের হাড় মাংস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।পাথর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হুঙ্কার ছাড়লো।চামড়া ভেদ করে শক্ত লোম গজিয়ে উঠছে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শরীর পরিবর্তন হয়ে উর্ধমানবে রূপ নিলো। মাথার উপরে পূর্ণাঙ্গ চাঁদের আলোতে ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।প্রহেলিকা কহিনুর নিয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে। ওর সঙ্গে লয়ের্ড আছে। দুজনেই খুশীতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। কতগুলো বছরের প্রচেষ্টা সফল হতে চলেছে এর চাইতে সুখের কিবা আছে। পাথর দৌড়ে গিয়ে ওদের সামানে গিয়ে হাজির হলো। প্রহেলিকা ভ্রু কুচকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

আমার সম্মুখে বাঁধা সৃষ্টি করোনা যুবক বাঁচতে পারবে না। এই শক্তি একবার পুরোপুরি হাছিল করি পৃথিবীর কাউকে আর পরোয়া করবো না। যেই আসবে তাকেই আমি সরিয়ে ফেলবো। শক্তি সৌন্দর্য্য ক্ষমতা যা আমি চেয়ে এসেছি সবটাই এই হাত দুটোর মধ্যে আবদ্ধ। ওকে মরতে দাও।

পাথর কথাগুলো শুনে গর্জন করে উঠলো। আলেক্স লয়ের্ড কিছু না ভেবেই হাতের রিভলবার দিতে পাথরের দিকে গুলি ছুড়ে দিলো। সেটা পাথরের গায়ে লাগলেও তেমন কিছুই হলোনা। শরীরের পুরু চামড়া ভেদ করতে পারেনি। পাথর রেগে গিয়ে থাবা দিলো। লোকটা পাহাড়ের ঢালে গিয়ে পড়লো। প্রহেলিকা তেড়ে আসতে গিয়ে থেমে গেলো। ওর কাছে কোনো শক্তি নেই। কহিনুর হাতের মুঠোয় নিলেও সেটা পুরোপুরি নিজের করতে পারেনি। তাছাড়া কহিনুরের শক্তি ইচ্ছে করলেও নিজের করা যায়না।

যতক্ষণ ওর পূর্বের মালকিনের শরীর বিলীন হচ্ছে ততক্ষণ পযর্ন্ত এটা তার আমানত। সাঈদ আমানতকারীর আমানতের খেয়ানত করবে না। কথাটা ভেবে ওর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ওকে ঠকানো হয়েছে। সাঈদ জেনে বুঝে ওকে ঠকিয়েছে। বিষয়টা ভেবে ও পেছনের দিকে দৌড়ে গেলো। এখান থেকে পালাতে হবে সেটা যেভাবেই হোক। পাথর ওর পরিকল্পনা সফল হতে দিলোনা।

লাফিয়ে গিয়ে ওর কাধে নিজের নখের বিষটুকু প্রদান করে ছিটকে আসলো। প্রহালিকা কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়েছে। পাথরের ছোঁয়াতে ওর শরীরে কিছু জায়গায় ফোসকা নিয়েছে। শরীর মৃদু মৃদু কাঁপুনি দিচ্ছে। হাতের কহিনুর অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাথর পা দ্বারা ওর শরীরে লাথি দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিলো। তারপর আবারও দৌড়াতে শুরু করলো। গ্রহণ শেষ হয়েছে সমুদ্রের পানি নামতে শুরু করেছে। পাথর ছুটে গিয়ে কহিনুরের সামনে গিয়ে থামলো। সাঈদ ইতিমধ্যে কহিনুরের মাথা নিজের পায়ের উপরে তুলে ওর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। সেটা পাথরের সহ্য হলোনা। ক্রমান্বয়ে নিজের রূপে ফিরতেই ছুটে গিয়ে কহিনুরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

বেইমান অকৃতজ্ঞ জ্বীন শয়তান আমার নূরের থেকে দূরে থাকো। কি ভেবেছিলে? পাথর বেঁচে থাকতে ও দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে? তোমার মতো শয়তানের সাহায্য আমার লাগবে না। আজ থেকে নূরের আশেপাশে ঘেঁষার চেষ্টাও করবে না। তোমাদের মতো শয়তানকে আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।
পাথরের কণ্ঠ কাঁপছে। চোখ ছলছল করছে কিন্তু মুখটা কঠিন করে রেখেছে। কহিনুরের শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই আর না আছে কোনো র*ক্ত। সাঈদ পাশেই বসে আছে। অসহায় কণ্ঠে ছোট করে উত্তর দিলো,

নূরের ভালোর জন্য এইটুকু আমাকে করতেই হতো। তাছাড়া সবটা পরিকল্পিত ছিল বিশ্বাস করুন। আমি যেকোনো পরিস্থিতিতে ওকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি। প্লিজ ওকে দেখতে দিন। ওর জ্ঞান ফিরলে সবটা জানতে পারবেন।
তোমাকে বিশ্বাস? কখনও না। আমাকে কহিনুর পাওনি যে তোমার আবোলতাবোল কথাবার্তা আমি বিশ্বাস করে ঠকবো। বাজে জ্বীন দূর হও আমার সম্মুখ থেকে।

পাথর রেগে আগুন হয়ে আছে। সাঈদ কহিনুরের মুখের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটা উঠলেই ঝামেলা শেষ হবে কিন্তু কখন উঠবে? ওদের দুজনকেই চমকে দিয়ে হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো। তীব্র আলোকরশ্মির জন্য ওরা চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা স্বাভাবিক। পাথর চোখ খুলে একটা পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। ওর পাশে কহিনুরের মুখের আদলে আরেকটা মেয়ে বসে আছে। কহিনুর এখনও ওর বুকে অচেতন হয়ে আছে। পাথর অচেনা মেয়েটিকে দেখে বলে উঠলো,

কে তুমি? ছদ্মবেশে কেনো এসেছো?
মেয়েটা শব্দহীন হাসলো। ডান হাত কহিনুরের মুখে রেখে উত্তর দিলো,
আমি ওর অস্তিত্ব।ওর মধ্যে বসবাস করা শক্তি যাকে পেতে হাজারটা শয়তান উৎসুক হয়ে আছে।
পাথর ভ্রু কুচকে বিরক্তের সহিত বলল,

ওকে সাধারণভাবেই আমার প্রয়োজন। তুমি চলে যাও। যতদিন তুমি ওর সঙ্গে থাকবে ততদিন ওকে হারানোর ভয় আমাকে যন্ত্রণা দিবে। আচ্ছা তুমিই বলো প্রেয়সীর সঙ্গ পেতে চায়না এমন পুরুষ পৃথিবীতে কি একটাও আছে? অথচ দেখো আমি কতটা অসহায়।
পাথরের কথা শুনে মেয়েটা মজা পেলো। শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

আমি আর ও আলাদা বুঝি? যাইহোক আমি ওর মধ্যে থাকি বা না থাকি তাতে কি যায় আসে? আপনি যতদিন পযর্ন্ত অভিশপ্ত থাকবেন ততদিন পযর্ন্ত কহিনুর আপনার জন্য অভিশাপ। সাঈদকে ক্ষমা করে দিন ওকে দোষারোপ করবেন না। ভেবে দেখুন চন্দ্র আপনাকেই কেনো দেখা দিয়েছিলো? প্রহেলিকা বা ওই শয়তানের মৃত্যু মানুষের হাতে না কোনো অর্ধমানবের হাতেই হবে এটা জেনে ও আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলো। আমি নূরের থেকে আলাদা হয়ে গেছি আমাদের এক করতে সাহায্য করুন।
মেয়েটা একটা পাত্র পাথরের দিকে এগিয়ে দিয়ে পূণরায় বলল,

ওর মুখে ছিটিয়ে দিন।
পাথর উত্তর করলোনা। নানারকম প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে কিন্তু এখানে বলে লাভ হবে না। ও চুপচাপ কহিনুরের মুখে তরলটা ছিটিয়ে দিতেই আবারও চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো। মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে সেখানে গোলাকাকৃতির পাথর ঝলমল করতে করতে কহিনুরের ভেতরে প্রবেশ করলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কহিনুরের শরীর গরম হতে শুরু করলো। হাত পা নড়াচড়া করছে। পাথর পুরুষালী শক্ত হাতটা কহিনুরের কোমল বদনে রেখে খানিকটা চাপ দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,

নূর তুমি ঠিক আছো? কথা বলো প্লিজ টেনশনে মারা যাচ্ছি।
পাথরের কথা ওর কান অবধি পৌচেছে কি বোঝা গেলোনা। তবে একটু একটু করে মেয়েটা চোখ খুলে চাইলো। এতোক্ষন আটকে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে ফুপিয়ে উঠে বলল,
সরি খুব সরি।
পাথর বুঝতে পারলো না সরি কেনো বলা হচ্ছে তবে সেসবে ও পাত্তা না দিয়ে কহিনুরের কপালে কয়েকবার ওষ্ঠদ্বয় রেখে নিজেকে শান্ত করলো। ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে বলল,

এখানে আসবে বলোনি কেনো? একা একা চলে এসেছো। তুমি জানো ওই সাঈদ শয়তানটা কি করেছে? তোমার দিকে তলোয়ার উঠিয়েছিরো। কতবার বলেছি তুমি বিশ্বাস করোনি।
কহিনুরের শরীর যথেষ্ট দুর্বল তবুও পাথরের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পাশে সাঈদকে দেখে উত্তর দিলো
আপনি ওকে বকেছেন?
পাথর খাপছাড়াভাবে উত্তর দিলো,

না চুমু দিয়ে আদর করেছি। তোমাকেও করবো কাছে আসো। ফাজিল মেয়ে কতবার বলেছি ওর থেকে দূরে থাকো তবুও ওর চিন্তা করছো। একদম রাগাবেনা আমাকে।
আমার কথাগুলো আগে মনোযোগ সহকারে শুনুন তারপর ভাববেন কে অপরাধী তারপর সিদ্ধান্ত নিবেন ঠিক আছে?
পাথর কথার উত্তর দিলোনা দেখে কহিনুর শুরু করলো,

প্রহেলিকা শয়তানের আরাধনা করে। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব তার হাতে এমন শয়তানের মৃত্যু হলে সেটা আমাদের জন্য সুখের ছিল না। তাছাড়া ওর প্রাণ নিলে আমার মধ্যে থাকা শক্তি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়তো। সেদিন চন্দ্র এইজন্য আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলো। আর ওই ধাঁধার মানেটাও এমন ছিল। যখন আমার শরীর থেকে লাল রক্ত মাটির সঙ্গে মিশবে ঠিক তখনই ওই শয়তানের মৃত্যু হবে। আর সেটাই হলো। সাঈদ ওদেরকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। কহিনুরের শক্তি কখনও আমার থেকে দূরে যাবেনা যতক্ষণ না আমি নিজ থেকে ওকে মুক্ত করি।

সাঈদ কোনো জড় পদার্থ না যে ওকে ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করা যাবে। সাঈদকে আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে আপনাকে ভয় দেখাতে আর প্রহেলিকাকে এখানে আনতে পারে। ও ভেবেছে পাথরটা ও সত্যি পেয়ে গেছে তাইতো চন্দ্র গ্রহণের সময় কোনো সিকিউরিটি ছাড়া এখানে এসেছে। আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বললে আপনি আমাকে নিষেধ করতেন। সরি এই জন্য যে আপনার অজান্তেই এমন একটা কাজ করিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এটা ছাড়া কোনো অপশন ছিল না। আমি নিজের কষ্টের চাইতে সকলের কষ্টের কথা ভেবেছি। শত্রুর বিনাশ প্রয়োজন।

কহিনুর বুঝিয়ে বলল কিন্তু পাথর তখনও চুপচাপ। ভেতরে কি চলছে কে জানে। সাঈদ এবার মুখ খুলল,
জনাব দয়াকরে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কখনও এমন করবো না প্রমিজ। শেষবারের মতো ক্ষমা করুন।
পাথর মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো,
আমি যাচ্ছি ওকে দেখে রেখো। তোমরা ঠিক আছো আসলে আমারই ভুল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার অর্ধাঙ্গী কোনো সাধারণ রমণী নয়। তার হৃদয় অতি নিষ্ঠুর। আমার কষ্ট বা খারাপ লাগাতে কিছু যায় আসেনা। অর্ধমানবদের কোনো অনুভূতি থাকতে নেই। সাঈদ ক্ষমা করে দিও অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আসলে শয়তানের বসবাস তোমার মধ্যে না আছে আমার মধ্যে। তাইতো প্রহেলিককে হত্যা পবিত্র শরীর না বরং পশুর দ্বারা লেখা ছিল। হয়েছেও তাই। আমি অনুতপ্ত। আসছি ভালো থেকো।

পাথর একটা সেকেন্ডও অপেক্ষা করলোনা। দ্রুত স্থান পরিবর্তন করলো। হাওয়ার গতিতে চলে গেল। কহিনুর হতভম্ভ ওর এমন ব্যবহারে। লোকটা অভিমান করেছে। সাঈদ ছলছল চোখে ভেজা কণ্ঠে বলল,
জনাবতো ভুল বুঝলেন এবার কি হবে? আমি বলেছিলাম তোমাকে তবুও শুনলে না।
কহিনুর সোজা হয়ে বসলো। এতোক্ষন পাথরের বুকের সঙ্গে হেলে ছিল। শরীরে শক্তি নেই তেমন। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বর শুরু হবে।

ওকে নিয়ে ভেবোনা। মাথা ঠান্ডা হলে ফিরে আসবে। না ফিরলে খুজে নিব। সুলতানা কহিনুর ফারুকীর থেকে ওর মুক্তি নেই। নথিভুক্ত নিজস্ব সম্পত্তি সে হারিয়ে গেলেও খুজে পাওয়া আহামরি কঠিন না। আমি কক্ষে ফিরবো শরীর খারাপ করছে।
সাঈদ অপেক্ষা করলো না। কহিনুরকে উঠতে সাহায্য করলো। বাতাসের গতিতে দুজনে সুলতান ভেলায় ফিরে আসলো।

ড্রয়িং রুমে পায়ের উপরে পা তুলে বসে আছে মোহ। যাদের কাছে মানুষ হয়েছিল হঠাৎ কিভাবে জানি ওরা গায়েব হয়ে গেছে। আশ্রয় বলতে সুলতান পরিবার ছাড়া কেউ নেই। তাছাড়া কহিনুর ওকে সঠিক রাস্তা দেখিয়েছে। প্রহেলিকা ওকে ছোট থেকে মানুষ করেছে নিজের মেয়ের পরিচয়ে। সব সময় সুলতান পরিবারের বিষয়ে ওর কানে বিষ ঢেলেছে তার দরুন ও এই মানুষগুলোকে ভুল বুঝেছে আর বারবার আক্রমণ করেছে। জোবায়ের ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। পাশেই বাড়ির বাকি সদস্যরা বসে আছে। মোহ কয়েক দফায় ক্ষমা চেয়েছে তবুও শেষবারের মতো বলল,

প্লিজ আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না। আমি ইচ্ছা করে এমন করিনি। ওরা ছোট থেকে যেটা বুঝিয়ে এসেছে আমি তাই বুঝেছি। আমার যাওয়ার কোনো যায়গা নেই। নিজের বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।
জোবায়ের বোনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো তাই এই মেয়ের উপরে ওর রাগ নেই কিন্তু আলফা ভয়ানক চটে আছে। ওর কাজকর্ম সবটা মনে আছে। দুদিন আগেও মেয়ের চোখেমুখে হিংস্রতা ছিল আর আজ শীতল নদী ভাবা যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদের সুরে বলল,

তোমাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। দৃষ্টিকে ভয় দেখিয়েছো সঙ্গে আমাকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছো সবটা মনে আছে আমার। এইটুকু একটা মেয়ে তার মনে কি ভয়ংকর চিন্তা ভাবনা। তুমি আমাদের জন্য বিপদের কারণ। আমি কিছুতেই তোমাকে এই বাড়িতে থাকার অনুমতি দিচ্ছি না। সময় থাকতে এখুনি বের হয়ে যাও।
আলফা খানিকটা ধমক দিয়ে কথাগুলো বললো। জুবায়ের ছেলের উপরে বিরক্ত সেটা দেখে মিরা বললো,

ভাইয়া বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারেনি।বাবুকে কিছু বলবা না। তাছাড়া মেয়েটা যা করেছে তাতে ওকে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন। বাবু ভুল কিছু বলেনি। তুমিই বলো ওরা যা বর্ণনা দিলো তাতে ওদের কেমন অনুভূতি হয়েছিলো? বাচ্চারা এতো বড় কথাটা আমাদের কথা ভেবে গোপন করেছে। আমি বাবুর সঙ্গে একমত কিন্তু তবুও একবার সুযোগ দেওয়া উচিত ভেবেই চুপ থাকছি।

মিরার কথা শুনে অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। মিরার বুদ্ধি আলফাকে বাঁচানোর সময় কিভাবে জানি প্রকট হয়ে অতুলনীয় হয়ে উঠে। মেয়েটা যেভাবেই হোক আলফাকে বাঁচিয়ে নেয়। মাতৃহৃদয় বলে কথা। জুবায়ের সেটা বুঝতে পেরেই উত্তর দিলো,

ওকে বলে দাও যখন বড়রা কথা বলে তখন চুপচাপ শুনতে হয়। সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমরা আছি তাহলে ও কেনো কথা বলছে?
আলফা রেগে ছিল বাবার এমন কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। সোফা থেকে উঠে গিয়ে মিরার দিকে চেয়ে বলল,

ছোট আম্মু আমি রুমে যাচ্ছি। যেখানে আমার মতামতের দাম নেই সেখানে আমি থাকি না। আর আমার অপরাধীর ক্ষমা বা মাফ দুটোই আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত তাই সেখানে যেনো বাড়ির বড়রা না আসে। আমি এতোটা অন্ধ না যে আমাকে কেউ বোকা বানাতে আসবে আর আমি বোকা হয়ে গাধামি করবো।
আলফা একটুও সময় নষ্ট করলো না। গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জুবায়ের হতবাক ছেলের এমন আচরণ দেখে। ওকে গাধা বলে গেলো কেমন লাগে? মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে এই বেয়াদব ছেলের জন্য। বড় হচ্ছে আর বেয়াদব হচ্ছে। জোবায়ের চোখমুখ শক্ত করে হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা চেপে ধরলো। অধরা সেদিকে চেয়ে ওষ্ঠ কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,

আরে আমার বাচ্চার উপরে রাগ করছেন কেনো? আপনার কার্বন কপি তাই রাগ ওকে না দেখিয়ে এদিকে ব্যবস্থা করুন। মোহ তুমি এখানেই থাকো আমার ছেলের উপরে রাগ করোনা প্লিজ। মাথা গরম থাকে ওর।
মোহ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। যে কাণ্ড ঘটিয়েছিলো এখন লজ্জা পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে দৃষ্টি এই মেয়েকে ভয় পাচ্ছে তাই আলফার পিছু নিয়েছে। দরজার সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

ভাইয়া দরজা খুলে দাও।
আলফা দরজা খুলে ওকে ভেতরে টেনে নিয়ে আবারও বন্ধ করলো। পায়চারি করতে করতে বলল,
ওই মেয়েকে এখানে রাখতে সকলে রাজি হয়েছে?
দৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,

হুম ভাইয়া ভয় লাগছে। আচ্ছা ওকি আমাদের মতো মানুষ? ওইদিন ওগুলো কিভাবে করতে পারলো জাদু জানে কিছু?
কিসের জাদু? ওইটা একটা ভয়ংকর পেত্মী। শোন তুই একদম ওর সঙ্গে কথা বলবি না। যতদিন না আপদ যাচ্ছে ততদিন তুই আমাকে সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। এই বাড়ির লোকেরা অন্ধ হয়ে গেছে। নূর আপি কক্ষে আছে?
দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ। আপি রাত থেকে এখনো রুম থেকে বের হয়নি।
আলফা শান্ত হলো। অযথা রাগ করে লাভ হবে না। কহিনুরকে সবটা বলবে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

জোবায়ের জন্য কফি তৈরী করতে গিয়ে অধরা বিরক্ত হলো। পাতিলে দুধ রাখা ছিল সেটা ছানা কেটে জমাট হয়ে আছে। মাঝেমাঝে লাল রঙ করা। কফি পাউডারের কৌটায় লাল রঙের পানির ফোটা। অধরা পানিটা হাতের আঙুল নিয়ে চেক করলো আঠালো টাইপ। কিচেন রুমে কিসের একটা পচা গন্ধ করছে। অধরা চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো ঠিক সেই সময় ওর কর্ণকুণ্ডলে ফিসফিস আওয়াজ এসে ধাক্কা খেলো। কোনো মেয়েলি কণ্ঠের রিনরিনে হাসির সঙ্গে ভেসে আসছে,

রাত যখন গভীর হয় শান্তিপুরি শান্ত হয়। নিদ্রাদেবি প্রকট হয়। শাণিত খঞ্জর শত্রুর বক্ষস্থল এইতো সুযোগ….
অধরা বাকীটা শুনতে পেলনা।ভয়ে শিউরে উঠলো। দ্রুত কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতেই ড্রয়িং রুমে গিয়ে থমকে গেলো। এসি আছে বিধায় ড্রয়িং রুমে কোনো সিলিং ফ্যান নেই অথচ কোনো মেয়ে দিব্যি ঝুলে আছে। আবছা আলোতে মেয়ের মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণত আলো জ্বালানো থাকে কিন্তু আজকে লাইট অফ করা আছে। অধরা চিৎকার করবে ভেবে সামনে পা এগোতে গিয়ে পূণরায় ছিটকে আসলো।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৫

কোনো মানুষের শরীরের উপরে পা রেখে ফেলেছে। ও দ্রুত নিচের দিকে চেয়ে দেখলো সেখানেও একজন মহিলা শুয়ে আছে। গভীর রাত দুইটা লা/শ একটা ওর পায়ের কাছে অন্যটা অদৃশ্য দড়ির সাহায্যে ঝুলে আছে। অধরা সহ্য করতে পারলোনা। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে গেলো হঠাৎ পেছন থেকে শিতল একটা হাত ওর মুখ আটকে ধরলো। এতেই জানি ষোলো কলা পূর্ণহলো। যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল সেটাও হাওয়া। অধরার পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ওকে পিছনের দিকে টেনে নিচ্ছে হাতদুটো। অধরা বুঝতে পারছে না কে এমন করছে। এরা কে হতে পারে?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব ( ১ম অংশ )