তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৮

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৮
হুমাইরা হাসান

রেলগাড়ীর চাকার মতো বিরতিহীন সময় কেটে পেরিয়ে গেল কতগুলো দিন। এ কয়দিনের মাঝে তুরা একদিন ও আসেনি ভার্সিটিতে। সেদিনের পর থেকে তুরার ভার্সিটি আসার রুচি বা মানসিকতা কোনোটাই হয়নি, আবার দিন কয়েক শরীর টাও ভালো যায় না ওর। রুবি খাতুন এক প্রকার জোর করেই রেখেছে বাড়িতে,যদিও তার নিজেরও ইচ্ছে ছিল না
ভার্সিটির গেইটের সামনে পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে তুরা, ক্লাস শুরু হতে যদিও বেশি দের নেই কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। মিনিটের কাঁটা পাঁচ থেকে আটে গড়াতেই রিকশা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে আসল ফারিহা

-এইই সরি সরি,,আসলে একটু লেইট হয়ে গেল। কি আর করব সব দোষ ওই টিনম্যানের। ওই ঢেমনাকে দেখতে গিয়েই দেরি হয়েছে আমার
হড়বড় করে কথা গুলো বলে তুরার সাথে করে এগোতে লাগল ভেতরের দিকে। তুরা শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল
-সাদমানের বাড়িতে গেছিলি তুই?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-বাড়িতে না, ওইদিক দিয়ে আসছিলাম ভাবলাম বলদ টায় কি করে দেইখা আসি, তাই একটু ঢুঁ মেরে আসলাম। রাস্তায় আন্টির সাথে দেখা হয়েছিল উনি সুহানাকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। একটু কথাবার্তা বলতেই দেরি হয়ে গেল
তুরা নিরুত্তর রইল খানিক। সিড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বলল
-ব্যাপার টা আর কতদিন এভাবে টানবি তোরা, এবার কি মনের কথা গুলো প্রকাশ করা উচিত না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল তুরা, ফারিহা তৎক্ষনাৎ ই উত্তর করল

-আর কতভাবে প্রকাশ করব বল তো, বাবাকে নিয়ে ওর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছি। আন্টিরও আপত্তি নেই,উনি বলেছেন ছেলে মেয়ের খুশিতেই তার খুশি।সাদমানের সাথে সে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে মাঝখানেই থামিয়ে দিয়েছে টিনের বাচ্চা। বেটার ভাব বেশি বাড়ছে দিনদিন। আমাকে দেখলে এড়িয়ে চলে, জ্ঞান দেয়। নিজে তো সারাদিন প্রেমপত্রের মতো বই কোলে করে ঘুরে বেড়ায় আবার আমাকেও পড়াশোনায় মন দিতে বলে। আমি বুঝিনা ও কেন এমন করছে,, ওর চোখে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই যা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিন্তু আমাকে দেখলেই গুটিয়ে যায়।

টানা কথা গুলো বলে দম ছাড়ল ফারিহা। এখন নিজেকেও কেমন খাপছাড়া মনে হয় ওর। সাদমান আর কত এমন করবে। তুরা নিরুত্তর কথা গুলো শুনে বেশ খানিক কিছু একটা ভেবে বেশ উৎসাহিত হয়ে বলল
-শোন আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। এবার দেখিস সাদমাইন্না সিউর গলব, ওর মুখ দিয়ে টেপ রেকর্ডারের মত সব মনের কথা গড়গড় করে বেরোবে
-আইডিয়া? কেমন আইডিয়া?
-চল ক্লাসে চল বলছি।

বলে দুজন হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের সামনে এলো। এতক্ষণ উৎসাহিত, উচ্ছ্বসিত মুখটা ক্রমশ গম্ভীর হয়ে গেল। ক্লাসে ঢুকতেই সেদিনের বিশৃঙ্খল দৃশ্যটা ঝকঝক করে চোখের সামনে ভেসে উঠল তুরা, সেদিনের গ্লাণিবোধ উগড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সামলে নিল। যা হয়ে গেছে তার উপর কারো হাত নেই,বরং এখন সামনের টা ভাবতে হবে।

দুজন এগিয়ে গিয়ে ক্লাসে বসল। সাদমান আজ আসবে নাহ। তাই দুজনই বসে লেকচার সীট বের করলে আচমকা একটা মেয়ে তুরার সামনে আসল, মুখ তুলে সামনে তাকাতেই ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো তুরার, ওর সামনেই দাঁড়ান ভীষণ জড়তাগ্রস্ত একটা মুখ, খানিক তাকিয়ে থেকেই মনে পড়ল এই মেয়েটাও ছিল সেদিন যারা তুরাকে কটুক্তি করেছিল। চট করে মুখ নামিয়ে নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলে মেয়েটা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তুরার সামনে, খানিক চুপ থেকে তুরার কোনো রা করা না দেখে নিজেই বাধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল

-আসলে আমি সেদিনকার ঘটনার জন্যে ক্ষমা চাইতে এসেছি। জানি আমি ক্ষমা চাইলেও ওটা অনেক কম হবে, তবুও বলছি আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমিও ওদের মত ভুল বুঝে তোমায় নানা রকম মন্তব্য করেছি। আমার ভুল হয়ে গেছে
চোখে মুখে অনুতপ্ততা,অপরাধ বোধ উপচে পরছে মেয়েটার, তুরা চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারল নাহ। ওরা যতই খারাপ ব্যবহার করুক,অন্যের সাথে খারাপ স্বরে কথা বলতে ওর বাঁধে।

-যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামতে চাইনা। পুরোনো জল ঘোলা করে লাভ নেই, আমি ওসব ভুলে গেছি, ভালো হবে তুমিও ভুলে যাও।তবে হ্যাঁ এতটুকু বলতে পারি ভবিষ্যতে কাওকে নিয়ে কোনো মন্তব্য বা কটুক্তি করার আগে সত্যতা টুকু অন্তত যাচাই করে নিবে
সাবলীল, শানিত কণ্ঠে বলল তুরা, ফারিহা পাশেই বসে আছে চুপচাপ। সামনের মেয়েটা আরও কয়েক পা এগিয়ে এলো এবার ওর সাথে আরও কয়েক এসে যোগ দিয়ে বলল

-আমরা বুঝতে পারিনি তুমি আহান স্যারের বউ। আসলে রিফা আর মারিয়া এভাবে কথা গুলো বলল আর ছবিগুলো উপস্থাপন করল যে আমরা ভেবেছি সত্যিই..
মাথানিচু করে মিনমিনে গলায় বলল মেয়েটা,তুরা প্রথম কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে নিলেও রিফা আর মারিয়ার নাম শুনে চমকে উঠে বলল

-রিফা আর মারিয়া মানে?
-হ্যাঁ, ওরা দুজনই তো আগে বলেছে ছবিগুলোর কথা। আর তার জন্যেই ওদের দুজনকে রেস্ট্রিকটেড করা হয়েছে। আহান স্যার নিজে প্রমাণ সহ দেখিয়েছে যে এগুলো ওদেরই কাজ। তাই সেদিনের পরদিনই ভিসি স্যার ওদের প্যারেন্ট কল করে সব জানিয়েছে তুরা হতভম্ব হয়ে গেল।

ফারিহার দিকে তাকালে দেখল ওউ অনেকটা চমকে আছে। এই কদিন তুরার সাথে ওউ আসেনি ভার্সিটি, তাই এসবের কোনো কিছুই জানে নাহ। ওরা তুরাকে অপছন্দ করে এটা জানতো কিন্তু তা বলে এতদূর!
তবে আরও কিছু বলা বা শোনার আগেই টিচার চলে আসলে ওরা যে যার জাগায় বসে পরে।
প্রথমে অবাক হলেও পরে আর এ নিয়ে মাথা ঘামায় নি তুরা বা ফারিহা। যার যেমন কর্ম তেমন ফল!

-তুমি এখানে কি করছ,আমাকে এভাবে হুট করে ফোন দিয়ে ডেকে আনলে কেন। এভাবে একা মেয়ে এতদূর চলে এসেছ। তুমি কি আমায় হার্ট ফেল করিয়ে মা রতে চাও!
-চুপ করো,,আমাকে বলতে দিবা? এসেছে কে? কথা বলার জন্যে ডেকেছে কে? তোমার তো কোনো খোঁজ নেই। এতদিন যে হয়ে গেল এখানে এসেছ আজ অব্দি বাড়িতে জানাতে পারোনি ওদিকে আব্বু আম্মু আমার জন্য ছেলেও দেখে ফেলছে তুমি কি চাও আমার বিয়ে হয়ে যাক? নাকি এতদিন শুধু টাইম পাস করেছ আমার সাথে? বলো,চুপ করে আছ কেন বলো,উত্তর দাও?

-আমাকে বলার সুযোগ দিলে তো বলব। আর এভাবে রাস্তার মাঝে এমন করলে মানুষ কি ভাববে?
-ভাবুক যা খুশি ভাবুক। তোমাকে চিটার বাটপার ভেবে জেলে দিয়ে দিক।অন্তত তখন তো কারণ হবে যার জন্যে সম্পর্ক টা আগাচ্ছে নাহ
-তোমার মাথা কি সব গেছে, কি দিয়ে কি বলছ..
-তোমরা দুজন কি ঝগড়া করার জন্যে দেখা করেছ?
মাহিদ আর জায়মার কথার মাঝে তুরার গলা শুনে ফট করে ঘুরে দাঁড়াল মাহিদ। তুরাকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হলেও বিস্ময় ছাড়িয়ে এগিয়ে আসল, তুরাকে অস্থির হয়ে বলল

-বুড়ি তুই এখানে? আচ্ছা ভালই হয়েছে তুই এসেছিস। এই এইটারে কিছু বল, মাথার তার গুলো সব গেছে। সিলেট থেকে সোজা এখানে চলে এসেছে তাও একা, ভাবা যায়! আমি ক্লাসে ছিলাম ফোন করে বলল এখনই যদি দেখা না করি তাইলে ও ভার্সিটি চলে আসবে। ওকে একটু বোঝা পাগল হয়ে গেছে
হড়বড় করে উগড়ে দিল কথা গুলো মাহিদ। শান্তশিষ্ট ভাইয়ের এমন চঞ্চলচিত্তে তুরা হাসল সামান্য। তা দৃষ্টিগোচর হতেই জায়মা এগিয়ে এসে বলল

-তুমি হাসছ ভাবি? আসতে বললে এসে গেছি এবার কি করার করো না তো তোমার এই ভাইকে আমি ভালোবাসার জালে ফেলে ছ্যাকা দেওয়ার কেসে জেলের ভাত খাওয়াব বলে দিলাম
মাহিদ বিস্মিত হলো। একবার তুরার দিকে আর জায়মার দিকে তাকিয়ে বলল
-মানে? ভাবি আসতে বলেছে মানে কি?
-মানে জায়মাকে আমিই আসতে বলেছি ইয়াজ ভাই

-তুই? তুই কেন বলেছিস ওকে আসতে। এমনেই তো ওর তার কাটা তুই আমার উসকানি দিয়েছিস।
-একদম বাজে বকবে না বলে দিলাম।নিজের তো মুরদ হয়নি এখনো বাড়িতে আমার নাম বলার আবার বড় বড় কথা
জায়মার কথায় মাহিদ চোখ কুচকে আশেপাশে তাকাল। কেও যদি একবার শুনে ফেলে এসব কথা তাইলে বদনাম হয়ে যাবে সে। মেয়েটা তাকে পাগল করে ছাড়বে

-তুমি একটু থামবে?
-কেন ভাই,ও কেন থামবে। তুমি আর কবে বলবা মামনীকে বলো তো। বুড়ো হওয়ার পর বিয়ে করবে নাকি?
মাহিদ দমলো খানিক। ইতস্তত হয়ে বলল
-বলব তো,আমার একটু সময় দরকার
মাকে তো জানিস,পরে যদি রিয়েক্ট করে তখন
-উফ ভাইয়া,তুমি শুধু শুধু বেশি ভাবছ।দুদিন বাদে যখন মামনী হুট করে একটা মেয়ে ধরে এনে বলবে একেই আমি বাড়ির বউ বানাব তখন কি করবে বলো তো?
মাহিদ থতমত খেলো। চশমা ঠেলে নাকের ডগা থেকে তুলে হাসফাস করে তাকালে তুরা বলল

-আমি জানি তোমার পক্ষে মামনীকে বলা পসিবল না,তাই আমি জায়মাকেই ডেকেছি। আমি নিজে কথা বলব আমার ননদিনীর ব্যাপারে। চলো তো এখন গাড়ি স্টার্ট করো
মাহিদ হকচকিয়ে উঠল। বিব্রতস্বরে বলল
-মানে, কোথায় যাবি তোরা?
-তোরা না আমরা, আমি নিজে কথা বলব মামনীর সাথে। না তো আমরা নিজেই চলে যাচ্ছি কিন্তু, তখন আমরা দুজন শুধু কথা বলব মামনীর সাথে!

সোফায় বসে দুহাত কোলের উপর রেখে জহুরি দৃষ্টিতে তাকাল সামনে বসে থাকা তিন বান্দার দিকে। মাঝখানে তুরা, বা পাশে জায়মা আর ডান পাশে মাহিদ। তহমিনা বারংবার অবাক হচ্ছে মাহিদের অবস্থা দেখে। একটু পরপর কপালের ঘাম মুছছে। আর হাসফাস করছে।
-কি ব্যাপার মাহিদ, তুই এমন করছিস কেন? কোনো প্রবলেম?
চশামার ফাঁকে গোলগোল নজরে তাকাল মাহিদ
ঘনঘন ঘাড় নাড়িয়ে না বলল। তহমিনা তুরার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকালে তুরা বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় খানিক জড়তা নিয়ে বলল

-মামনী তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে
-হ্যাঁ তো সেটা শোনার জন্যেই তো বসে আছি। বল তো, নতুন মেহমান এলো বাসায় একটু কিছু খেতে দিতেও দিলি না গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে। এখন বল তাইলে মেয়েটার ক্ষিদে পাবে তো বেলা কি কম হয়েছে, তুমি দুপুরে খাওনি নিশ্চয় মা? মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে
নরম গলায় বেশ বিচলিত হয়ে বললেন তহমিনা। মাহিদ বেশ বিরক্ত হলো, টানটান গলায় বলল
-কি খাওয়া নিয়ে পরেছ বলো তো। তুরাকে বলতে দাও আগে
তহমিনা অবাক হয়ে তাকাল মাহিদের দিকে। ওর এমন অস্থিরতার কারণ কিছুতেই বোধগম্য হলো নাহ, এদের ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না।কিছু তো একটা ভেজাল আছেই

-তুরা কি হয়েছে বল তো। তোদের চোখ মুখ অন্যরকম লাগছে
-মামনী ও জায়মা। উনার ছোট ফুফুর বড় মেয়ে
-হ্যাঁ তো এই কথা টা তুই এসেই বলেছিস,আগে বল?
-মানে মামনী, মাহিদ ভাই আর জায়মা অনেক আগে থেকেই চেনে একে অপরকে
তহমিনা বিব্রত হয়ে তাকাল ওদের চেহারায়,এদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝছেনা
-আগে থেকে চেনে মানে? কিভাবে চেনে?

-উফ তুরা, এত কাহিনি না করে সোজাসাপটা বল নাহ
ক্ষেপাটে গলায় বলল মাহিদ,তুরা ক্রুর চোখে তাকাল ওর দিকে, ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে এখন গরম দেখাচ্ছে নিজেই। পাশেই জায়মা মাথা নিচু করে বসে আছে, ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ নার্ভাস ও।
-ম্ মানে মামনী ইয়াজ ভাই আর জায়মা বিয়ে করবে
-কিহ,বিয়ে করবে মানে?
-মানে ওরা দুজন চাই
-কি চাই?

তুরা ক্রমশ নিজেই কনফিউজড হয়ে আবল তাবল বলে দিচ্ছে।আর তহমিনা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এদের থামিয়ে মাহিদ নিজেই জোর গলায় বলে উঠল
-আমি বলছি, থামো তোমরা! মা আমি জায়মাকে ভালোবাসি, ওকে বিয়ে করতে চাই
তহমিনা বিস্ফোরিত নজরে তাকালে মাহিদ থতমত খেয়ে বলে
-ম্ মানে যদি তুমি আর বাবা চাও তবে
তহমিনা বেশ কিছুক্ষণ মাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জায়মার দিকে তাকাল। ফর্সা মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে মেয়েটার। ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুটিয়ে বসে আছে।

-ও যা বলছে তা কি ঠিক?
জায়মা বিমূর্ত হয়ে তাকাল তহমিনার দিকে, সামান্য ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তহমিনা অবিলম্বেই আবারও বলল
-ভালোবাসো ওকে?
-হ্যাঁ বাসি
এবার বেশ অকপটেই উত্তর করল জায়মা। তহমিনা নির্লিপ্ত তাকিয়ে রইল দুজনের মুখের দিকে। মাঝখান দিয়ে তুরা পরেছে গ্যাড়াকলে দুজনের মাঝে। তহমিনা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় মাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি মাহিদ। এর জন্যে তোমাকে এত বড় করেছি? এর জন্য তোমার সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করেছি?
মাহিদের ভীষণ জড়তা হলো। এক প্রকার লজ্জা সংকোচবোধ ও হচ্ছে ভেতরে। মা কি তবে ভুল বুঝল?

-মা মানে আমি আসলে
-চুপ কর! লজ্জা করা উচিত।
তিনজনেই ভয়ার্ত চেহারায় তাকাল সামনে। তহমিনা আবারও বলল
-কি মনে করো বাতাসে বড় হয়েছ? আমি নিজ হাতে পালন করিনি? চিনিনা আমি তোমাকে? তুমি যে জম্পেশ প্রেম করছ এটা কি আমি বুঝিনি মনে করেছ?
তিনজনেই অবাকের শীর্ষে। তখন আবারও তহমিনা বলল

-বেশ কয়েকদিন ধরেই তো বলতে চাচ্ছ কিন্তু সাহস করে উঠতে পারোনি। কেন মাহিদ,আমাকে কি তোমার টিভি সিরিয়ালের জল্লাদ মা মনে হয়? তুমি কাওকে ভালোবাসো এটা জানতে পারলে কি আমি তোমাকে অন্য কোথাও বিয়ে করিয়ে দিতাম? নাকি বকতাম? তুমি কি না শেষে একটা মেয়েকে এতদূর থেকে টেনে এনেছ কষ্ট করিয়ে,আবার ছোট বোনকে দিয়ে বলাচ্ছ,লজ্জা করা উচিত! এই তুমি ভার্সিটির লেকচারার হয়েছ?

মাহিদ কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে, কি দিয়ে কি বলবে সব গুলিয়ে গেছে। তার মা যে এমন একটা অভিব্যক্তি করবে ভাবতেও পারেনি। তুরা আর জায়মাও হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তহমিনা তুরার দিকে তাকিয়ে বলল
-হ্যাঁ রে, তুই অন্তত আমাকে বলতে পারতিস? আমি কি এতই পর হয়ে গেছি তোদের কাছে?
-না মামনী তুমি ভুল বুঝছ
-থামো,বোঝা হয়ে গেছে আমার
বলেই উঠে জায়মার পাশে গিয়ে বসলেন। ওর থুতনিতে হাত রেখে বললেন

-আর এই যে তুমি, তোমাকে আমি দেখেই চিনতে পেরেছি। আমার হতচ্ছাড়া ছেলে ফোনের ওয়ালপেপারে তোমার ছবি রাখতে পেরেছে অথচ মাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি
মাহিদ তড়িৎ মুখ ফিরিয়ে নিল।এখন তারই কেমন লজ্জা অস্বস্তি কাজ করছে। তার মানে মা খেয়াল করেছিল সবকিছু! নিজের মাথা নিজের চাপড়াতে ইচ্ছে হলো মাহিদের।
-মামনী তুমি সব জানতে?
-সব আর কি করে জানব। ছেলের চকচক করা মুখ, ফোনের সামনে একটা মেয়ের ছবি দেখেই তো বুঝেছি। কতবার বলতাম তোর কোনো পছন্দ থাকলে বল। বিয়ের বয়স তো হয়েছে। উনি সাধু ছেলের মতো প্রত্যেবার বলত না মা তেমন কিছুই নাহ।

তুরা ফিক করে হেসে দিল। মাহিদের মুখ টা দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে ওর। আর জায়মা তো চোখ মুখ শুকিয়ে জড়ো হয়ে আছে। তহমিনা জায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-তুমি সিলেট থেকে একাই এসেছ? বাড়িতে কেও কিছু বলেনি?
-গ্রুপ ট্যুরের নাম করে এসেছি
মিনমনিয়ে বলল জায়মা। তহমিনা মাহিদের দিকে তাকালেই ও মুখ ফিরিয়ে নিল। মুখ টিপে হাসলেন, প্রত্যুত্তর না করে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
-সেসব কথা পরে হবে, বেলা অনেক হয়েছে তোরা ফ্রেশ হয়ে আই আমি খেতে দেই
তুরা মাহিদ কে খোঁচা দিয়ে আবারও হাসল। জায়মাকে সাথে নিয়ে ঘরের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।

বাড়ি আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে গেল তুরার, তহমিনা অনেক করে বলেছিল আজকের দিনটা থেকে যেতে। কিন্তু বাসায় তো বসে আসা হয়নি বলে থাকল নাহ। তড়িঘড়ি করে রিকশা থেকে নেমে বাড়ি ঢুকে সোজা ঘরের দিকে গেল। ব্যাগ টা রেখেই তোয়ালে আর জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুলে পরল। গোসল করতে হবে, সারা শরীর কেমন গুলিয়ে আসছে।

বেশ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরলো তুরা, চুল ঝাড়তে লাগলে আহান বেলকনি থেকে ঘরের ভেতর আসল, কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল তুরা, আহানের চোখ দুটিতে তাকাতে যেন আকাশ সমান দ্বিধা করে এখনো। আচমকা গাল দুটোয় লালাভ প্রলেপে ভরে গেল, আয়নার দিকে ফিরে চুল মুছতে লাগলে আহান মন্থর পায়ে এগিয়ে এসে পেছনে দাঁড়াল। পেছন থেকে দু’হাতে কোমর জরিয়ে ধরল তুরার। খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শে নিজের গাল ঠেকাল তুরার আধভেজা ঠান্ডা গালে।

ঝিলিক দিয়ে কেঁপে উঠল তুরা, চোখ মুদে নিল। আহান আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল, ভরা গলায় বলল
-এত দেরি কেন করলে বলো তো। অপেক্ষা করছিলাম তো আমি।
ভীষণ আবেদনময়ী শোনালো আহানের গলা। তুরা ভার হয়ে আসা চোখের পাতা খুলে তাকাল আয়নার দিকে। গলায় মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে আহান, লোকটাকে যেন আরও সুন্দর লাগছে,বয়স যেন কমে যাচ্ছে দিনদিন। মোহনীয় নজরে তাকিয়ে থেকেই তুরা বলল

-ম্ মামনীর বাড়িতে গেছিলাম
-উমম,,মাহিদ টেক্সট করেছিল
তুরার গলায় মুখ ঘষে বলল আহান, তীব্র ভাবে কেঁপে খামচে ধরল তুরা আহানের হাত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
-ছাড়ুন
-উহু, এই কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম সময় দিতে পারিনি। তুমি কি রাগ করেছ বউ?
সারা বদনে শীতল স্রোত বয়ে গেল তুরার, আহানের নেশাগ্রস্ত কণ্ঠ শুলের মতো ভেদ করে যাচ্ছে ওর সমস্ত সত্ত্বা। তুরার উত্তর না পেয়ে আহান আবারও বলল

-সরি বউ, এই যে এখন আছি তো। একচুল ও ছাড়ছি না আর
-ছাড়ুন না প্লিজ, মা ডাকবে আমাকে
-বাড়িতে কেও নেই
ভ্রু যুগল কুচকালো তুরা। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে ফিরে বলল
-কোথায় গেছে সবাই?
-মা দিদুন আপিকে আনতে গেছে, ওর শরীর টা নাকি খারাপ করেছে একটু। তুমি ও বাড়িতে আছ বলে আর ফোন দেয়নি।
বলে তুরাকে সাথে নিয়েই ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরল। তুরা উঠতে লাগলে হুট করেই আহান বরফ ভেজা গলায় বলে উঠল

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৭

-আই লাভ ইউ তুরা, আই লাভ ইউ এভরি মোমেন্ট। সারাজীবন ধরে বাসব, অনেক বেশি ভালো বাসব তোমায়। আমার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পাওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তুমি, সারাজীবন তোমাতে মিশে থাকতে চাই।
বলে তুরার বুকে খুব গভীর স্পর্শে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো ঝমঝমিয়ে উঠল তুরার সমস্ত শরীর। ভালোলাগা, ভালোবাসায় অন্তরসত্ত্বা শিহরিত হয়ে উঠল। দুহাতে বুকের মাঝে চেপে ধরলো আহানকে, খুব যতনে,নিভৃতে, আদরে!

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৯