তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৭

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৭
হুমাইরা হাসান

পুরো ক্লাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা, টানটান উত্তেজনা সবার মাঝে। তুরা ছেলেটাকে থা’প্পড় দেওয়ায় ক্লাসভরে এতক্ষণ যেই উত্তাপ,উচ্ছ্বাস, দৃঢ়তা ছিল তা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
এক কোণায় ফারিহার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুরা রক্তিম মুখশ্রীতে। সেই পানে চেয়ে বক্ষস্থলের রক্তক্ষরণ দাঁতে চেপে দমিয়ে রাখল আহান। ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব, ব্যকুল, উৎকণ্ঠিত হলেও অভিব্যক্তি পানির ন্যায় শীতল।

-তারপর বলো তোমাদের এরূপ দুঃসাহসিকতার কারণ কি? কোন সাহসে তোমরা এমন জঘন্য কাজ করেছ
সামনে দাঁড়ানো থাকা ছেলে দুটোর অবিন্যস্ত, এলোথেলো অবস্থা, গায়ে মাটি কপালে আঘাতের দাগ। ওদের মাঝে একজন বলে উঠল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-ও আমাকে আগে থা’প্পড় দিয়েছে, আমার বন্ধুরা প্রতিবাদ করতে গেলে সাদমান উল্টো আমাদেরই মে’রেছে
আহান চুপচাপ আড়চোখে তাকাল ওদের দিকে,,কপালে, ঘাড়ের রগ গুলো ফুলে টানটান হয়ে আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত কচলাচ্ছে বারংবার। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করবার প্রচেষ্টা করলেও তুরার বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখে তার জন্য দায়ী মানুষ গুলোকে চিরে ফেলার অদম্য ইচ্ছে হানা দিচ্ছে
-শুধু শুধু তো কোনো মেয়ে তোমাকে থা’প্পড় দিবে নাহ। হয়েছিল টা কি?
ভিসির আবারও করা প্রশ্ন ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাদের মুখ থেকে শব্দ বেরোলো নাহ।এতক্ষণ মজা নেওয়া ছেলেমেয়ে গুলোও এখন থরথর করে কাঁপছে ভিসি আর সিনিয়র,সহকারী স্যারদের আগমনে। রিফা আর মারিয়া বারংবার কপালের ঘাম মুছছে।

-স্যার পারমিশন দিলে আমি বলতে চাই
সাদমানের কথায় ভিসি নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকাল, মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলে সাদমান বলতে আরম্ভ করল
-স্যার ভার্সিটি এসে থেকে আমরা খেয়াল করছিলাম পুরো ক্লাস কিছু একটা নিয়ে কানাঘুষা আর হাসাহাসি করছে,, আর খুবই বাজে কটুক্তি।

তুরা আসলে ওকে উদ্দেশ্য করে ইমন খুবই বাজে কথা বলে যা শুনে তুরা উত্তেজিত হয়ে ওকে চ-ড় দিলে ওর বন্ধুরা এসে তুরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তাই আমি বাধ্য হয়েছি ওদের গায়ে হাত তুলতে
-তুরাকে নিয়ে ওদের কটুক্তির কারণ?
থমকে গেল সাদমান। এবার বলতে খুব দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে,আড়চোখে তাকাল তুরার দিকে। ওর দৃষ্টি নিচে। এভাবে সবার সামনে বলতে যখন সাদমানের আকাশ সমান জড়তা কাজ করছিল তখন কর্ণকুহরে একটা বরফের ন্যায় শীতল বাক্য আসল

-বলতে থাক সাদমান, যা দেখেছ তাই বলো
প্রচণ্ড বিহ্বলিত চোখে তাকাল আহানের দিকে। আহান চোখের মৃদু ইশারায় সম্মতি দিলে আবারও বলতে আরম্ভ করল
-ওদের ফোনে আহান স্যার আর তুরার কিছু ক্যামেরাবন্দী মুহূর্ত ছিল। যেখানে তারা একই গাড়িতে আসা যাওয়া করছে এবং তুরাকে একাধিকবার আহান স্যারের সাথে তার বাড়িতে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে, যেটা দেখেই ওরা জঘন্য মন্তব্য আর বাজে কথা গুলো বলছিল

-ওয়াইফ তার হাসব্যান্ড এর সাথেই যাওয়া আসা করবে আর একই বাড়িতে থাকবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
ভিসির বলা কথাটি যেন কর্ণকুহরে বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় তরঙ্গিত হলো, বিস্ফোরিত চোখে তাকাল ক্লাসভর্তি একঝাঁক ছেলেমেয়ে। আশ্চর্যান্বিত ভাব ভর্তি হলো প্রতিটি দৃষ্টির কানায় কানায়। শিক্ষকদের উপস্থিতিতেই গুঞ্জন শুরু হলো একে অপরের। এর মাঝেই একটা ছেলে মুখ ফসকে বলে ফেলল
-হাসব্যান্ড ওয়াইফ মানে?

-মানে আমি তুরার হাসব্যান্ড, আর তুরা আমার বিয়ে করা বউ। সি ইস মাই ওয়াইফ ড্যাম গট ইট!
বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলল আহান, এতক্ষণের চাপা রাগ ক্ষোভ উতলে পরল কণ্ঠস্বরে। শব্দের তরঙ্গ কাঁপিয়ে তুলল পুরো ক্লাসরুম। পাশে দাঁড়ান ভিসি আর সিনিয়র প্রফেসরদের পরোয়া না করে তীব্রবেগে এগিয়ে গেল, ভীড়ের মাঝখান থেকে তুরার কব্জি মুষ্টিবদ্ধ করে এনে দাঁড় করাল সবার সামনে।
ক্লাসে টু পরিমাণ শব্দের উপস্থিতি নেই, অত্যন্ত বিমূর্ত দৃষ্টিতে সবাই চেয়ে তুরার হাত চেপে ধরে রাখা আহানের দিকে। মেঘের মতো গর্জন করে আবারও বলল আহান

-এই যে এই মেয়েটা,যাকে নিয়ে যা তা মন্তব্য করছিলে এতক্ষণ, আমার আর যার ছবি উইদাউট পারমিশন ক্যাপচার করে রীতিমতো হ্যা’রাস করেছ যাকে। সে আমার বিয়ে করা বউ, দ্যা লিগ্যাল ওয়াইফ অফ প্রফেসর ইরফান মাহমুদ আহান!

পুনরাবৃত্ত করা কথাটি যেন আবারও অবাকের ঢেউ বয়ে দিল সকলের মাঝে। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক সকলের। তুরাও তার ব্যতিক্রম নয়। হতবাকের ন্যায় তাকিয়ে আছে আহানের দিকে। এভাবে সকলের মাঝে যে আহান এভাবে বলে দিবে এটা ভাবতেও পারেনি ও। আর ভাববেও বা কি করে এভাবে বলে কয়ে বেড়ানোর লোক তো আহান নয়। সে নিজেই বলেছিল প্রফেশনাল আর পারসোনাল লাইফ টাকে আলাদা রাখতে চাই। টিচার আর স্টুডেন্ট এর বিয়েটা যে কেও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখবে না, কানাঘুঁষা হবে সেকারণেই এতদিন গোপন রাখা। আর আজ এভাবে!

-আহান, কাম ডাউন। লেট মি হ্যান্ডেল
ভিসির কথায় নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল আহান, মুষ্টিবদ্ধ রাখা চিকন হাতটা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল। ব্যাথা লাগলেও তুরা চুপ করে সয়ে নিল। এ মুহুর্তে আহানের ভেতরের ঝড়টাকে সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।
ভিসি বলতে শুরু করল

-তুরা অ্যান্ড আহান আর লিগ্যালি ম্যারিড। আর এ ব্যাপার টা সর্ম্পকে আমরা সকলেই অবগত। অ্যাজ এ প্রফেসর সে তার পারসোনাল লাইফ টাকে হাইলাইট করতে চাইনি বলেই পাবলিক করেনি কথাটা। বাট আমরা সকলেই কিন্তু জানি সে ব্যাপারে। সেখানে ওদের পারসোনাল ছবি ক্যাপচার করে তা ভাইরাল করে রীতিমতো তার ওয়াইফকে হ্যা’রাসের মতো জঘন্য কাজ করেছ তোমরা,এর শাস্তি কি হতে পারে নূন্যতম আইডিয়া আছে?
মুহুর্তেই রক্ত জমে গেল উপস্থিত কয়েকজনের মুখে। তুরাকে কটুক্তি করা ছেলেটার বন্ধু এগিয়ে এসে কম্পিত গলায় বলল

-আমাদের ভুল হয়ে গেছে স্যার, আসলে ছবিগুলো এভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে যে আমরা ভুল বুঝে ফেলেছি। আমাদের ক্ষমা করে দিন তবুও রেস্ট্রিকটেড করবেন নাহ প্লিজ
-তোমাদের প্যারেন্টস কল করা হবে, রেস্ট্রিকটেড করার ও পসিবিলিটি আছে। একজন প্রফেসরের ওয়াইফকে হ্যা’রাস করার শাস্তি কতটুকু জানো তুমি? আর শুধু একজন প্রফেসরের ওয়াইফ কেন, যে কোনো মেয়েকেই এভাবে কোনো শুধুমাত্র ছবির উপর ভিত্তি করে অপ°মান,কটুক্তি করা এক ধরনের ক্রাইম তা জানো? কারো ছবি তার পারমিশন ছাড়া তার ছবি ভাইরাল করাও সাইবার ক্রাইমের মধ্যে পরে

এতক্ষণ নীরব ভূমিকা পালন করা মাহিদ বলল কথাগুলো। সকলের মুখে যেন তালা পরে গেল৷ বলার মতো শব্দ, বাক্য কোনোটাই বোধগম্য হলো নাহ। সিনিয়র একজন প্রফেসর এগিয়ে এসে বলল
-যে বা যারা এই কাজের মূলে তাকে তো অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে, তার আগে ছবিগুলো ডিলিট হওয়া চাই গ্রুপ থেকে। আর যারা বেয়াদবি করেছ প্রত্যেকের বাবা না আসা পর্যন্ত ছাড়া হবে নাহ।
আহান চুপ ছিল এতক্ষণ, এবার নিজেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় শান্ত করে ভরাট গলায় বলল

-কে বা কারা যখন গ্রুপে ছবি গুলো আপলোড করে দিল আর নিমিষেই বিশ্বাস করে নিলে? কোনো ঘটনা নিয়ে মাতামাতি করার আগে তার সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ টুকুও নেই? নাকি একটা জিনিস পেয়ে গেলেই সেটা নিয়ে কাহিনি শুরু করে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকো? কয়েকটা ছবির উপর ভিত্তি করে কোনো যাচাই বাছাই হীনায় চরিত্রহীনার ট্যাগ লাগিয়ে দিলে? একটা মেয়েকে অশ্রাব্য ভাষায় যা নয় তা বলে দিয়েছ? এটাই কি তবে তোমাদের আধুনিক সমাজের নমুনা? এই জন্যে শিক্ষা নিতে আসো যাতে শিক্ষককেই অপদস্ত করা যায়?
এক দমে বলে স্থির হলো আহান। সকলের মাথা তখন নত। লজ্জা নাকি সংকোচে বোঝা গেল নাহ। আহান চোখ সরিয়ে তুরার দিকে তাকাল। চুপচাপ মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সারামুখে বিধ্বস্ত অবস্থা, কাঁদছে না কিন্তু চোখে স্পষ্ট রক্তিমা ভাব।

আরও দীর্ঘসময় ধরে চলল এসব কথাবার্তা, ছেলে গুলোর গার্জেন কল করা হলো।
এক পর্যায়ে ভিসি এগিয়ে এসে দাঁড়াল আহানের দিকে, ইশারায় ওকে বাইরে আসতে বলল। আহান তুরার হাত ধরেই বাইরে আসলে তিনি বললেন
-যা হয়েছে ব্যাপারটা একেবারেই ভালো হয়নি,আমি দুঃখিত তোমার কাছে। আমার অধিনস্থ প্রতিষ্ঠানে তোমার স্ত্রীর অপমান মানে আমারও অপমান। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ব্যাপারটা এখানেই শেষ করার,আর অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দেওয়ার।

-আপনার দুঃখিত হবার কারণ নেই, আমাদের সমাজ টাই এখন হীনমন্যতায় ভরে গেছে। মানুষের মন মানসিকতা এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা বাছ বিচার ছাড়াই একটা মানুষকে অপদস্ত করে
বলেই থেমে গেল আহান। আর কিছু বলার ইচ্ছে করছে নাহ আর। ভিসি তুরার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল
-তোমার সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে আমরা দুঃখিত, কিন্তু মন খারাপ কর নাহ, জীবনে চলার পথে তো অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়, আমি আশা করছি তুমি স্ট্রং উইমেন এর মত এসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেবে কেমন?
বলেই আলতো করে হাত রাখল তুরার মাথায়। ইশারা করে আহানকে বলল তুরাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। এখন এই পরিবেশে থাকলেও ও অসুস্থ হয়ে যাবে। আহান নিঃশব্দে সম্মতি দিয়ে তুরার হাত ধরে হাঁটা ধরল, সোজা সিড়ি বেয়ে নেমে এগোতে লাগল

-তুরা?
মাহিদ দৌড়ে এগিয়ে এল ওদের কাছে। আহান দাঁড়ালে মাহিদ এগিয়ে আসল। তুরার মুখের দিকে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছিল ওর। তবুও হাসি মুখ করে বলল
-একদম মন খারাপ করবি না কিন্তু এসব নিয়ে। যা খারাপ ছিল কে’টে গেছে তুই একদম কাঁদবি নাহ, তোর ইয়াজ ভাই আছে তো! আর সবচেয়ে বড় কথা তোর হাসব্যান্ড আছে তো তোর পাশে। যে তোর সে তোকে কতটা সম্মান করে, তোকে নিয়ে কতটা ভাবে তুই শুধু সেটাই আমলে নিবি। কে কি বলল কি করল ওসবে বুদ্ধিমতি মেয়েরা কান দেয়না। তুই না লক্ষী বোন আমার
তুরা ঘাড় নাড়াল শুধু, কথা আর শব্দগুলো কণ্ঠনালিতে আটকে গেছে, কিছুতেই কোনো শব্দ করতে পারছে নাহ। মাহিদ আহানের দিকে তাকিয়ে বলল

-ওকে বাড়ি নিয়ে যাও আহান, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকার দরকার নেই
আহান মাহিদের কাঁধে হাত রাখত, স্মিত হেসে বলল
-থ্যাংকস টু ইউ, তুমি আমাকে সময়মত ইনফর্ম না করলে আরও অনেক কিছু হতে পারত।
-সি ইজ মাই সিসটার ব্রো, একমাত্র বোন আমার। ওর অপমান মানে আমার অপমান, কি করে সহ্য করব বলো
আহান আর কথা বাড়াল নাহ। চুপচাপ তুরার হাত ধরে হাঁটা ধরল বাইরে। পুরোটা রাস্তা তুরা না মুখ তুলে চাইল না কিছু বলল। বাড়িতে আসতেই দৌড়ে রাইমার ঘরে গিয়ে দরজা ঠেলে দিল।

মধ্যাহ্নের শেষ সময় প্রায়, নীলাভ আকাশটাতে কমলা রঙের প্রলেপ পরতে শুরু হয়েছে। আকাশের বুকে ছোট ছোট নকশার মতো লাল,হলুদ,কালো পাখিগুলো মিলেমিশে উড়াউড়ি করছে। ক্লান্ত রোদের ধীমি আলো এসে পরেছে বারান্দা ভেদ করে ঘরের অংশ জুড়ে।
নিচে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে নিস্তেজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুরা সেদিকে। মন মস্তিষ্ক জড়ান ম্রিয়মানে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সকালের সেই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা

ছেলেটাকে থাপ্প’ড় দেওয়ায় সাথে সাথেই ওর বন্ধুরা হাম’লে পরতে আসে তুরার দিকে, সাদমান ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে ওকে ও আ’ঘাত করতে আসলে হাতাহাতি তে এক প্রকার মা’রামারি শুরু হয়। ফারিহা আর তুরা চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি, আশেপাশে সবাই শুধু দেখছিল আর মজা নিচ্ছিল। সেই সময়ে মাহিদ এসে তুরাকে ভীড়ের মাঝখান থেকে সরিয়ে এনে সকলকে শান্ত করে। ভয়ে, বিমূঢ় হয়ে মাহিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল তুরা। মাহিদ তুরাকে সামলে আহানকে ফোন করলে দশ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল সিনিয়র টিচারদের সাথে।

এত স্বল্প সময়ে আহান কিভাবে এসেছিল তা তুরার জানা নেই। কিন্তু ওর কল্পনায় বারবার ভেসে উঠছে সকালে দৃশ্য।
ব্যাপারটাতে খুব তাড়াতাড়ি স্টেপ নেওয়ায় ভার্সিটির বাইরে ছড়াতে পারেনি, কিন্তু তবুও তুরার কানে অনবরত বেজে চলছিল অপমান, লাঞ্চনা।

হুট করেই দরজা খোলার শব্দে মাথা ঘুরাল তুরা, দরজার সামনে দু হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে আহান। খানিক তাকিয়ে থেকেই চোখ ফিরিয়ে নিল, তীব্র অভিমান জমল মনে, বাড়ি এসে থেকে এতক্ষণ হয়ে গেছে অথচ এখন আসার সময় হলো! এতক্ষণ তুরা ঘরে বসেছিল কিন্তু একবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না?
আহান দরজা ভিড়িয়ে এগিয়ে আসল, তুরার পাশে বসলে অন্যদিকে ঘুরে বসল তুরা। আহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-এদিকে তাকাও?

তবুও ফিরল নাহ। ঠাঁই অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আহান পুনরায় শাণিত কণ্ঠে বলল
-আমার উপরেও রেগে আছ? আচ্ছা আমার দিকে একবার তাকাও তো
অকস্মাৎ ঘুরে আহানকে জড়িয়ে ধরল, ফোঁপানোর শব্দে বুক কেঁপে উঠল আহানের। উষ্ণ দৃষ্টিতে হিমানীর ছাপ পরল। আলতো ভাবে হাত রাখল তুরার পিঠে।

তুরা আহানের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সশব্দে। পারলনা নিজেকে ধরে রাখতে। আপন মানুষটার কাছে ভেঙে পরল, বুক চিরে বেরিয়ে এল তীর্ব আর্তনাদ,দুঃখ। অপমানের আত্মগ্লানিতে নয়ন ভরে উপচে পরল পানিবিন্দু।
কাঙ্ক্ষিত মানুষটির পরম যত্নে আগলে নেওয়াতে আরও ছাপিয়ে উঠল কান্না।
-হুসস,কাঁদে নাহ।আমি আছি নাহ? কে কি বলল ওটা মনে করে কেন রাখছ, আমি আছি তো!

আহানের আদরে আশকারা পেয়ে আরও ফুঁপিয়ে উঠল তুরা, দু’হাতে খামচে ধরল আহানের বুক, নাক টেনে টেনে বলল
-সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে, বাজে মন্তব্য করেছে, আর ওই ছেলেটা তো বলেছে যে আমি..
ফুঁপিয়ে আসা কান্নার হিড়কে বাকিটুকু বলতে পারল না তুরা।আহান সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে তুরা আবারও ভাঙা ভাঙা গলায় বলল

-সবাই খারাপ বলেছে ওরা, আমাদের সম্পর্কটাকে নষ্ট বলেছে। আপনি তো আমার স্বামী বলুন,ওরা কেন খারাপ বলল, কেন বাজে কথা বলল বলুন!
আহান আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরল তুরাকে, পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-শান্ত হও তুরা, ওরা বললেই কি হয়ে যাবে। যাদের মানসিকতা নোংরা তারা নোংরা কথায় বলবে। তা বলে কি আমাদের সম্পর্ক খারাপ হবে? সত্য একটাই যে তুমি আমার বউ, আমার বিয়ে করা বউ আর আমি তোমাকে ভালোবাসি। এর চেয়ে বেশি সত্য কিছুই না,পুরো দুনিয়া যা খুশি বলুক আমি আছি সব সামলাতে

তুরা ফুঁপিয়ে গেল আর কিছুই বলল নাহ। বুকের ভেতরে ওঠা তোলপাড় আর অশান্তি হুট করেই হিমানীর প্রলেপে ঠান্ডা হয়ে গেল।বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সমুদ্রের ন্যায় শীতল হয়ে গেল। কি আশ্চর্য! এতক্ষণ ধরে নিজেকে হাজারো বার বুঝিয়েও একচুল শান্ত করতে পারেনি সেখানে আহানের এই অল্প আদর আর শান্তবাক্যে সব ঠান্ডা হয়ে গেল, উত্তপ্ত অন্তঃসত্ত্বা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত ভোরের মতো শীতল হয়ে গেল।

হয়তো ভালোবাসা এমনই হয়! স্বামী নামক মানুষটার বুকে মাথা রাখলে হয়তো দুনিয়ায় অশান্তি উবে যায়, স্বামীর দেওয়া ছোট ভরসা আর সাহসে ভেতরের প্রলয়ের ঝড়কেও হয়তো শান্ত করা যায়। আর কিচ্ছুটি ভাবতে পারল নাহ তুরা, প্রশস্ত বুকের মধ্যিখানে মিশে গেল আবরণের ন্যায়,আহানের বুকের ধুকপুকানির শব্দে সব অবজ্ঞা অপমানের শব্দ গুলোও হারিয়ে গেল!

কৃষ্ণাভ প্রহর কাটিয়ে উদর হলো নরম প্রভাতের। পাখির কলরবমূখর পরিবেশে মৃদুমন্দ হাওয়ার সুর। আড়মোড়া ভেঙে টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকাল তুরা, পাশ ফিরে আহানকে দেখতে পেল নাহ। খানিক সময় নিয়ে উঠে বসল, ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিচে আসতে দেখল ইনসাফ মাহবুব নাস্তা করছেন আর রুবি খাবার বেড়ে দিচ্ছে।

মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তুরার, কাল মা আর দিদুন রাইমাকে দেখতে গেছিল বলে সারাদিন বাড়িতে কেও ছিল নাহ। সন্ধ্যা নাগাদ ঘুমিয়ে পরায় রাতে ফিরে তুরার সাথে দেখাও হয়নি। মৃদু পায়ে নেমে এলো সিড়ি ভেঙে
-তুরা,,ঘুম ভেঙেছে? এখন শরীর কেমন মা? আহান বলল কালকে শরীর খারাপ করেছিল নাকি তোর?
তুরা এগিয়ে এসে ইনসাফ মাহবুবের পাশে বসল। আহান নিশ্চয় বাড়িতে ওই ব্যাপার টা জানায়নি। ভালই করেছে, ওরকম জঘন্য একটা ব্যাপার জানিয়ে কাওকে দুশ্চিন্তায় না ফেলায় ভালো।

-একটু মাথা ধরেছিল আরকি,এখন ভালো আছি বাবা
-ভালো আছি বললে হবে! চোখ মুখের অবস্থা দেখেছ? শেষে কি না ঠিকঠাক খেতে দেয়না এমন দুর্নাম নিতে হবে দেখছি।
রুবি খাতুন তুরার প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বলল। চুমকি আমেনা খাতুনের এক হাত ধরে এগিয়ে এনে টেবিলে বসতে সাহায্য করে আবারও রান্নাঘরে গেল

-দাদুভাই কোথায় রুবি?
আমেনা খাতুন বসেই আহানের কথা জিজ্ঞেস করলে রুবি খাবার বাড়তে বাড়তে বলল
-কি জানি,কাজ আছে বলেই তো বেরোলো সকাল করে ।
ললাটে ভাঁজ পরল তুরার, এখন কি কাজ হতে পারে? তবে টেবিলে বসে সকলের সাথে কথা বলতে বলতে ব্যাপার টা ভুলে গেল।

শরীর খারাপের দোহায় দিয়ে আজ রুবি তুরাকে ভার্সিটি যেতে দিল নাহ। এমনিতেও তুরার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার উপর শরীরটাও খুব দূর্বল লাগছে। ঘরের মধ্যেই এদিক পায়চারি করতে করতে বেল বাজার শব্দ হতেই গিয়ে দরজা খুলল।

-তুই? এখানে?
-কেন আসতে পারিনা?
দরজার সামনে ফারিহাকে দেখে বিস্মিত হলো তুরা, আজ অব্দি ফারিহা কখনো আসেনি এ বাড়িতে
-তুই চিনলি কি করে বাড়ি?
-ওমাহ প্রফেসরের বাড়ি খোঁজা আবার ব্যাপার হলো নাকি, আর ফারিহা সব পারে ইউ নো। আর তুই কি আমাকে দরজায় ই দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়াল তুরা, ফারিহা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
-আজকে ক্লাস করার একদম ইচ্ছে নেই বুঝলি। তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু আড্ডা দিয়ে যাই। তুই তো ডাকবি নাহ তাই আমিই চলে এলাম, কি ঠিক করেছি না ডিয়ার?

ফারিহার কথার মাঝেই রুবি খাতুন এলে তুরা ফারিহাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। রুবি খাতুন বেশ খুশি হয়ে বলে
-ওমা বসো বসো,খুব ভালো করেছ এসে, মাঝে মধ্যেই চলে আসবা, ও তো একাই থাকে বাড়িতে
-আসতে বললে তো আসব। ও তো আপ্যায়নের ভয়ে আসতেই বলে নাহ
রুবি হেসে দিল ফারিহার বলার ভঙ্গিমায়, ওদের বসিয়ে দু’একটা কথা বলে রান্নাঘরের দিকে গেলে ফারিহা তুরার কাছে ঘেঁষে বসে, খুব গুরুতর ভঙ্গিতে বলে

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৬

-ম্যালা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে দোস্ত, আমাকে হেল্প কর

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৮