তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৬

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৬
হুমাইরা হাসান

-কি হলো, মুখটা এমন করে রেখেছ কেনো? কথা বলবেনা? হয়েছে টা কি তোমার,সারা রাস্তা এমন করে আছ
বলেই হাত ধরতে গেলে এক ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আরও সরে গেল তুরা। আহান বিবশ ভঙ্গিমায় তাকাল তুরার দিকে, কিন্তু সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।সারাটা রাস্তায় মুখ ফুলিয়ে রেখেছে,একটা কথা অব্দি বলেনি। সকাল সাতটার বাসে রওয়ানা দিয়েছে ওরা,,আসতে দিতে কেও চাইনি কিন্তু আহানের কথার কাছে হাড় মানতে হয়েছে। তবে তার যুক্তিটাও অহেতুক নয়,ভার্সিটি খুলেছে অথচ তার পরীক্ষার খাতা দেখা হয়নি। বারবার কল আসছে তাই তার থাকার ইচ্ছে থাকলেও আপাতত সেটা সম্ভব নয়।

কিন্তু এ কথাটা তার এই বউটাকে কি করে বোঝাবে, গাল ফুলিয়ে একেবারে প্যানকেক করে রেখেছে। আহানের ইচ্ছে করছে ওই গালেই প্রচন্ড জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে মনের মাঝেই দাহ করে চুপচাপ তাকিয়ে রইল ঘাড় কাত করে।
প্রায় সাত ঘন্টার পথ পারি দিয়ে দুপুর দুইটা নাগাদ এসে পৌঁছাল। মাহিদ গাড়ি থেকে নেমে ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। বাড়ির গাড়িটা আগে থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছে, আহান আর তুরা সেটাতে করে বাড়ির দিকে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-সমস্যা কি,এবার কিন্তু মার খাবে তুমি তাকাও এদিকে!
চাপা স্বরে ধমকে উঠল আহান। তুরা সামনে ড্রাইভারের দিকে তাকাল। সে গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত। তবুও তার সামনে এমন না করলেই নয়!
আড়চোখে একবার আহানের দিকে তাকিয়ে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিলো। কথা নেই,কোনো কথা নেই এর সাথে। মানুষটা কত বড় খারাপ নিষ্ঠুর।খাগড়াছড়িতে গেল অথচ কোথাও না ঘুড়েই চলে আসতে হলো। এই দুঃখ তুরা কোথাই রাখবে। বলা নেই কওয়া নেই সাত সকালে তুলে দিয়ে বলে রেডি হও বাড়ি যাব। তার সাথে কি কথা বলা যায়! আপনারাই বলুন?

-তোমাকে এদিকে তাকাতে বলেছি
এবার দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল আহান। তুরা শুকনো ঢক গিলে তাকাল ওর দিকে। এক হাত বাড়িয়ে তুরার কোমর চেপে ধরে বলল

-আরেকবার অন্যদিকে মুখ ফিরালে আমি তোমাকে এই ড্রাইভারের সামনেই চুমু দিয়ে দেব বলে দিলাম
চাপা স্বরে ধমকে বলল কথাটা। তুরা হতবিহ্বল হয়ে আহানের দিকে তাকিয়ে রইল৷ চোখ মুখ কঠোরতার সাথে শক্ত করে রেখেছে। মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে তুরা কত বড় অন্যায় করে ফেলেছে। আজব, এই লোকটা কি পাগল? ড্রাইভারের সামনে চুমু দিলে কি অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে সে একা পরবে নাকি সে ইনভিসিবল হয়ে আছে? বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আহান আবারও ওকে ধরলে তুরা আঙুল তুলে চাপা স্বরে বলল

-খবরদার,আরেকবার যদি হম্বিতম্বি করেছেন তো আমি সোজা মামনীর বাড়ি চলে যাব। আমি খুব রেগে আছি,আমার সাথে ধমকা ধমকি করবেন না বলে দিলাম
-কেন রেগে আছ তুমি। আর রেগে থাকলে কথা কেন বলবে নাহ। আমার দিকে তাকিয়ে থাক
-কেন আপনার কি দুটো শিং গজিয়েছে যে তাকিয়ে থাকতে হবে
-না গজালেও তাকাতে হবে, আই আম ইউর হাসব্যান্ড
-কোন হাসব্যান্ড, কিসের হাসব্যান্ড। মানি নাহ আমি কাওকে মানি নাহ। আপনি একটা নিষ্ঠুর,রসকসহীন মানুষ। আমি রেগে আছি চুপ করে থাকুন

-হ্যাঁ তো রেগে থাকলে কথা কেন বলছ নাহ। এসব আমি একদম মেনে নেব না। ঠ্যাং খোরা করে দেব,ভুলে যাবে না আই আম ইউর টিচার!
-তো টিচার হয়ে স্টুডেন্ট এর সাথে লুতুপুতু করতে লজ্জা করে না আপনার?
-হোয়াট! লুতুপ.. মানে? সেটা আবার কি।এসব কি ধরনের জঘন্য ভাষা শিখেছ তুমি?
-ঠিকই বলেছি,সরুন সরুন একদম চিপকে থাকবেন না আমার সাথে
বলেই আহানকে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে ড্রাইভার হুট করেই পেছনে ফিরে তাকায়। হয়তো দুজনের ফিসফাস ঝগড়া শুনেই তাকিয়েছে।

ড্রাইভারকে আকস্মিক এভাবে তাকাতে দেখে দুজনই ভড়কে গেল। তুরা সামান্য মেকি হাসলে ড্রাইভার ও হেসে সামনে তাকিয়ে গাড়ি মোড় ঘুরালো। দুই মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেল। আহান আর কিছু বলেনি বাড়ি আসা অব্দি। গাড়ি থেকে নেমেই তুরা দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে সকলের সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলে তুরা ঘরে গেল। খাগড়াছড়ির তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা অনেকই বেশি। উপরে উঠে রাইমার ঘরে ঢুকল। রাইমাকে ইমান এসে নিয়ে গেছে তুরা খাগড়াছড়ি যাওয়ার পরদিনই। ঘরে ঢুকেই একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরল। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে চুল গুলোও ঠিক করে না মুছে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। দীর্ঘ সময়ের জার্নি আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে ক্লান্ত শরীরে মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুম নেমে এলো।

ভার্সিটি থেকে খানিক দূরেই, স্টুডেন্ট ক্যাফে নামের কফিশপ। রুফটপে দুজন,তিনজন করে চেয়ার পেতে বসার জায়গা আর তার মাঝে বর্গাকৃতির টেবিল। আশেপাশে লোকজন গিজগিজ করছে।
এর মাঝে সাদমান এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখ মুখ শক্ত করে। মুখাবয়ব দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটাতে সে চরম বিরক্ত অথবা রাগান্বিত।
টেবিলের সামনের ছেলেটা টিস্যু হাতে নিয়ে হাতটা মুছে দিতেই গর্জে উঠল মৃদু স্বরে

-ফারিহা?
সাদমানের ডাকে কফিতে চুমুক দিতে দিতে তাকাল ফারিহা। সাদমান এগিয়ে এলো ভ্রু কুচকে এক পলক তাকাল ফারিহার সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। আবারও গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল
-তুই এখানে কি করছিস?
-কফিশপে মানুষ যা করে,কফি খাচ্ছি
বলেই স্ট্র তে চুমুক দিল দায়সারা ভাবে। সাদমান কাঠ কাঠ মুখে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কফি খেতে খেতে সামনের ছেলেটাকে দেখিয়ে ফারিহা বলল

-ওকে চিনিস তো? পলাশ,,আমাদের ক্লাসেরই
সাদমান চোখ ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালে ছেলেটা সহবত সুলভ হাই বললেও সাদমান উত্তর দিল নাহ। চোখ গেল টেবিলের উপরে রাখা ফারিহার হাতের কাছাকাছি পলাশের হাতের দিকে। আচমকা মেজাজ খারাপ হয়ে গেল,তবুও আশপাশের লোক সমাবেশ দেখে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল

-এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কফি খাবি?
উত্তর করলনা সাদমান। এর মাঝেই পলাশ নামের ছেলেটির ফোন বেজে উঠলে ও সরে যেতেই সাদমান ধপ করে বসল ফারিহার সামনের চেয়ারে। ফর্সা মুখে লালাভ বর্ণ পরেছে। তা রাগে কি রোদে বুঝতে পারল নাহ ফারিহা। অনেক
অবুঝের মত করেই বলল

-কি হয়েছে, এমন টোম্যাটো লুক দিয়েছিস ক্যান
বলেই আবারও স্ট্রতে চুমুক দিতে গেলে সাদমান এক ঝটকায় কেড়ে নিলো কোল্ড কফির ঠান্ডা গ্লাসটা। মুখাবয়ব কঠোর করে বলল
-ওই ছেলেটার সাথে কেন এসেছিস তুই?
-আমি ওর সাথে কেন আসব আমিতো একাই এসেছি
চোখে মুখে উপচে পরা গাম্ভীর্য আরও দ্বিগুণ হলো।চাপা স্বরে ভরাট গলায় বলল

-ডোন্ট লাই টু মি। আমি নিজে দেখেছি তুই ছেলেটার সাথেই সিড়ি দিয়ে উঠছিলি
-হ্যাঁ তো আসার সময় ওর সাথে দেখা হলো। একই ক্লাসে তো পড়ি দেখা হলে কি না চেনার ভান করে চলে যাব। ও বলল এখানেই আসছে তাই এলাম।এখন এখানে আমার কি করার আছে আজব,দে আমার কফি দে
বলেই গ্লাসটা এগিয়ে নিতে গেলে সাদমান ওর হাত চেপে ধরে বলল

-তাহলে একসাথে বসেছিস কেন? নাকি একই ক্লাসে পড়ে বলে একসাথে বসতেই হবে এমন নিয়ম হয়েছে
ফারিহা ভড়কে গেল সাদমানের এরূপ জেরা করায়। ও ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল
-আশেপাশে দেখত। রুফটপে একটা মাত্রই বসার জায়গা ফাঁকা ছিল। তাই ও বসার জন্য রিকুয়েষ্ট করল। আমি কি বলব না তুমি বসো নাহ,, আমার পাশে বসলে অনিষ্ট হয়ে যাবে
সাদমানের মেজাজ দ্বিগুণ চড়াও হলো ফারিহার হেয়ালিপনা কথাবার্তায়। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল

-ওই ছেলে তোর হাত কেন ধরছিল? বাইরে আসিস এসব করার জন্যে? কফি খাওয়ার নামে হাতি ধরাধরি করতে বেড়য়েছিস তুই?
-আরে এভাবে বলছিস কেন। আমার হাতে লেগে কাপ থেকে হাতে পরে গেছিল ও শুধু টিস্যু দিয়ে মুছে দিয়েছে এতে ধরাধরির কি আছে।

-স্টপ ইট, মুখটা বন্ধ রাখ। বাপ তোরে মাথায় তুলে রেখেছে বলে যা খুশি করে বেড়াবি? তুই একা কেন বেড়িয়েছিস? এত কফি খাওয়ার শখ বাড়িতে নিজে করে খেতে পারিস নাহ?
-আমার ইচ্ছে করেছে তাই এখানে এসেছি। এতে কারো কোনো প্রবলেম হতে পারে বলে তো জানা ছিল নাহ
-জানা লাগবে না তোর ওঠ,এখানে আর এক মিনিট থাকলে তোর কপালে দুঃখ আছে
বলেই সাদমান উঠে ফারিহার হাত ধরে টানতে টানতে সিড়ির দিকে নিয়ে এল

-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তুই?কফির বিল টা তো দিতে দে
-ফরমালিটি দেখাতে যাকে এনেছিস, সেই দিয়ে দেবে তোর কফির বিল
বলে সিড়ি বেয়ে নেমে ফারিহার হাত ধরে রাস্তা পার করে এগিয়ে গেল ডান দিকের রাস্তায়। দ্রুতপায়ে হাঁটছে সাথে ফারিহাকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

নিঃশব্দে মৃদু হাসল ফারিহা,এটাই তো চেয়েছিল ও। বিকেল বেলা ঘটা করে কফি খেতে এসেছেই তো সাদমানকে জ্বালাতে। একা একাই আসছিল ফারিহা,যখন দেখল সাদমান তাকে খেয়াল করেছে তখন কফিশপের দিকে এল, ওকে একা এখানে আসতে দেখলে সাদমান নিশ্চয় পেছনে আসবে সেই ভেবেই এসেছিল।
কিন্তু মাঝে পলাশ নামের ছেলেটা এসে মেঘ না চাইতেই জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ফারিহা ইচ্ছে করেই সাদমানকে দেখিয়ে দেখিয়ে ছেলেটার সাথে এত ন্যাকামি করছিল যাতে সাদমানের হিংসে হয়।

আর হলোও তাই, হুট করেই একরাশ ভালো লাগা ঘিরে ধরল ফারিহাকে,সাদমান কখনও এর আগে এভাবে অধিকার দেখিয়ে কথা বলেনি,আর নাইবা হাতটা ধরেছে এভাবে। সাদমানের অজান্তেই আলতো করে ধরে রাখা হাতটার আঙুলেই ছুঁয়ে দিল ওর হাত!

ঘুম ভেঙে উঠে বসে দেখে আশপাশ জুড়ে অন্ধকার নেমেছে। চোখ মুখ ডলে উঠে বসে দেওয়াল ঘড়িতে তাকালে দেখল সাড়ে সাতটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে তুরা? অথচ কেও ডাকেও নি?
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। নিচে আপাতত কেও নেই। মা দিদুন যে যার ঘরে। বাবা এখনো আসেনি। চুমকি হেলেদুলে এটা ওটা করছে আর টিভি দেখছে। তুরা নামতেই ওকে দেখে বলল

-আরে ভাবি, যাক আপনার ঘুম ভাঙলো। আমিতো ভাবলাম শেষে ঢাক ঢোল আনতে হবে
বিরক্তিতে ভ্রু জড়ো করল তুরা। একে তো ক্ষুধাও পেটে চো চো করছে তার উপর চুমকির এসব আজগুবি কথাবার্তা।
-মা আর দিদুন কোথায়?

-মা রান্নাবান্না সেরে ঘরে গেছে। আর দিদুন তো ঘরেই। বের হয়না খুব একটা পায়ে অনেক ব্যথা তো
বলেই আবারও টিভি দেখায় ব্যস্ত হলো। তুরা রান্নাঘর থেকে ভাত বেড়ে এনে চুমকির সাথে টিভি দেখতে দেখতে খেলো। ভাত খাওয়ার পরেও বেশ ঘন্টা খানেক সময় ধরে ওর সাথে টিভি দেখে হুট করেই আহানের কথা মনে পরলে বলল
-উনি কোথায় চুমকি? দুপুরে খেয়েছিলেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল চুমকি। মাথা চুলকে বলল

-কে ভাইজানের কথা কন? সেও এসে গোসল করেই ঘুমিয়েছিল, সন্ধ্যার একটু আগেই খেয়েছেন। ঘরে যাওয়ার সময় বলেছেন আজ যেন তাকে কেও বিরক্ত না করে অনেক কাজ আছে নাকি
বলে আবারও টিভি দেখায় ব্যস্ত হলো। তুরা খানিক ঝিম ধরে বসে রইল। আহানের অনেকগুলো খাতা দেখা বাকি,হয়তো সেই কাজই করছে। আর সে যখন বসেছে শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবে তো নাহ।

তুরা উঠে রান্নাঘরে গেল। সন্ধ্যায় খেলে রাতে আর কিছুতেই ভাত খায়না আহান। মাস্টার টা খাওয়া নিয়ে একটু বেশিই স্ট্রিক্ট। কিন্তু রাত ও তো হয়েছে, এভাবে না খেয়ে থাকবে! তাই কফি আর স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়ে উপরে গেল তুরা।
টি-টেবিলের উপর খাতার স্তুপ জমা করে রেখেছে। আহান সোফাতে বসে এক এক করে পৃষ্ঠা উলটাচ্ছে আর সাইন দিচ্ছে মাঝে মধ্যে আন্ডারলাইন ও করছে। দরজাটা ঠেলে দিয়ে তুরা এসে বসল আহানের পাশে।

-খেয়ে নিন
খাবারের ট্রে রাখতে রাখতে বলল। আহান খাতায় মুখ গুঁজে আছে,আশেপাশে কেও আছে সে খেয়াল তার নেই। তুরা খানিক চুপ করে থেকে আবারও বলল
-খাবারটা খেয়ে নিন। অনেক রাত হয়েছে তো
-হু?
তুরা বিরক্ত হলো এবার। বিরক্তি ভরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল
-আপনি কি কানে শুনতে পাচ্ছেন না? বলছি খেয়ে নিতে, নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে?
আহান কলম থামিয়ে তাকাল তুরার দিকে। কিছুক্ষণ ওভাবে দেখে আবারও খাতা দেখা আরম্ভ করল। ব্যস্ত গলায় বলল

-আমি এখন ব্যস্ত খাওয়ার সময় নেই
-খেতে পাঁচ মিনিট ও লাগবে নাহ। আমি বানিয়েছি,খেতেই হবে
-বললাম তো ব্যস্ত আছি। খাইয়ে দিলে দাও না তো নিয়ে যাও
তুরা ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল। লোকটা খুব জাঁদরেল হচ্ছে দিনদিন। যা বলে সেটাই করতে হবে। কিন্তু পতি পরমেশ্বরকে তো খাইয়েও রাখতে পারছে নাহ, স্যান্ডউইচ টা তুলে আহানের মুখের সামনে ধরে বলল

-দেখুন খাইয়ে দিচ্ছি বলে ভাববেন না গলে গেছি,আমি এখনো রেগেই আছি
আহান উত্তর করল নাহ। মুখ ঘুরিয়ে স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ রাখল। খাওয়ার মাঝেই আহান ইচ্ছাকৃত ভাবে তুরার আঙুলে সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিতেই আর্তনাদ করে উঠল তুরা
-আল্লাহ্ গোওও আমার আঙুল খেয়ে ফেলল রাক্ষসটা। এই জন্যেই মানুষের ভালো করতে হয়না। জাঁদরেল কোথাকার
বলেই উঠে যেতে নিলে আহান তুরার হাত চেপে ধরে হাতের অবশিষ্ট টুকুও খেয়ে বলল

-স্বামীর মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নাও কেমন নিষ্ঠুর বউ তুমি। তবে আমি কিন্তু তোমায় অভুক্ত রাখব না
বলে খানিক এগিয়ে এসে তুরার গাল চেপে ঠাস করে দুটো চুমু দিয়ে আবারও বলল
-তুমি নিষ্ঠুর হলেও তো আমি নিষ্ঠুর হতে পারিনা। তুমি চাইলে আরও দেব, দেই?
তুরা ঝামটা মেরে সরে এসে প্লেট নিয়ে বেরিয়ে আসল। ঘরের বাইরে আসতে গালে হাত দিয়ে লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেলো।

-বেহায়া লোক
বলেই দৌড়ে চলে গেল।

ছুটিগুলো ফুরিয়ে গেল খুব দ্রুত। ফের ব্যস্ততায় আবিষ্ট হল জীবন। ইয়ার ফাইনালের ছুটি শেষ হয়েছে দিন দুয়েক আগেই। খাগড়াছড়িতে থাকার কারণে দুইদিন অলরেডি মিস হয়েছে। আজ থেকে আবারও একই নিয়মে শুরু হবে তুরার পড়াশোনা।
সকাল করে রেডি হয়ে বেরোলো। নাস্তা সেরে একাই বেড়িয়ে আসল। আহানের আজ ক্লাস নেই,ভার্সিটিতে গেলেও দেরিতে যাবে। কিন্তু সকাল নয়টা নাগাদই তুরার ক্লাসে আছে।

আহান তুরাকে রেখে আসতে চেয়েছিল কিন্তু কাল সারারাত ধরে বসে খাতা দেখেছে সে,একে তো ক্লান্ত শরীর তার উপর সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরে ঘুমিয়েছে বলে তুরা আর ডাকেনি। নিজেই বেরিয়ে পরলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে
আকাশটা নিত্যদিনের মতই স্বচ্ছ, রোদের তীক্ষ্ণতা থাকলেও খুব একটা গরম অনুভূত হচ্ছে নাহ। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়,শীত আসব আসব করছে। কখনো গরমে ঘাম ঝরছে আবারও কখনো শীতলতায় মগ্ন হচ্ছে পরিবেশ।
রিকশাতে বসে থাকা অবস্থায় ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। ফোন দেওয়া মানুষটার নাম্বার দেখে কপাল জড়ো হলো তুরার, এইতো বেরোনোর আগেও তো কথা হলো ফারিহার সাথে, আবারও ফোন দিল যে!

-হ্যালো?
-তুই কোথায়?
খানিক চেঁচিয়ে বলল ফারিহা। কণ্ঠস্বর বেশ উত্তেজিত শোনাচ্ছে। ভ্রু কুঞ্চন করে বলল
-রিকশাতেই, কলেজের মোড়ের কাছাকাছিই। আর পাঁচ মিনিট লাগবে হয়তো, কেনো?
-দোস্ত আজকে আসার দরকার নেই এদিকে তো..
-কি করছিস পাগল নাকি
বলেই ফোন কেড়ে নিল সাদমান। খট করে লাইনচ্যুত করল কল। ফারিহা বোকা বোকা মুখ করে বলল

-কিন্তু এদিকে যে কাহিনি ঘটে গেছে!
-তো ওকে রাস্তার মাঝে কেন বলছিস, এখন নিষেধ করলেও তো ও আসবেই। ফোনে বলে সবটা বোঝাতে পারবি তুই? বরং আরও হাইপার হবে আগে থেকে।
কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলেই রিকশা থেকে নামল তুরা, ভাড়া চুকিয়ে হাঁটা ধরল ক্লাসের দিকে। দোতালার সিড়ি বেয়ে উঠতেই অনেকের সম্মুখীন হলো যারা আড়চোখে দেখছিল তুরাকে। ওদের এহেন চাহনির অর্থ বুঝল না তুরা। মাথাভর্তি কৌতুহল নিয়েই এগিয়ে গেল ক্লাসের দিকে।

ক্লাসে ঢুকতেই কতগুলো বিদ্রুপ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভরা চাহনি দেখতে পেল যারা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকেই দেখছে। কোনো কিছুই বোধগম্য হলো না তুরার। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখল ফারিহা আর সাদমান ভীষণ চিন্তিত মুখে বসে আছে,সচরাচর ওদের এই চেহারা দেখা যায় নাহ। তুরা এগিয়ে গিয়ে ওদের পাশে বসতেই শুনতে পেল পাশ থেকে কিছু অপ্রীতিকর কথা,যা অতিমাত্রায় জঘন্য। শুনেই গা গুলিয়ে এল তুরার, সকলে যেন তার দিকেই তাক করে গল্পগুজব করছে, মুখভর্তি শ্লেষাত্মক হাসি তাদের ।

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৫

-কি হয়েছে ফারু? সকলে কি নিয়ে এমন মাতামাতি করছে?
ফারিহা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর কানে আসতে থমকে গেল তুরা, ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্ফোরিত নজরে তাকাল ছেলেটির দিকে। আজ অব্দি এ ধরনের কথা তাকে কেও বলনেই কল্পনাতেও আসেনি তুরার।
কোনো দিক না ভেবে উঠে গিয়ে ছেলেটার গালে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে থা’প্পড় দিয়ে বসে। প্রচন্ড রাগ আর অপমানে শরীর কাঁপছে তার।

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৫৭