কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব ( ১ম অংশ ) 

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব ( ১ম অংশ ) 
লাবণ্য ইয়াসমিন

হঠাৎ আক্রমণে ভয় পেয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপছে অধরা। শরীরে শক্তির লেশমাত্র নেই। কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে হয়তো অচেতন হওয়ার লক্ষণ। এমন বিড়ম্বনার সম্মুখে পড়তে হবে আগে জানলে জীবনেও কফি তৈরী করতে আসতো না। জুবায়েরের উপরে রাগ হচ্ছে। লোকটা সারাক্ষণ বউ বউ করে বাড়ি মাথায় করে অথচ বউ কফি তৈরী করতে গিয়ে হাওয়া হয়েছে সে খোঁজ রাখেনি । খচ্চর লোক, অধরা বিড়বিড় করে বকা দিলো। চিৎকার করবে সে উপাই নেই। পেছনের অগন্তুক ওর মুখটা বেশ শক্ত করে ধরেছে। ওরা এখন রান্না ঘরের দরজায় পাশে অবস্থান করছে। হঠাৎ ফিসফিস আওয়াজ শুনে অধরা নিজেকে ধাতস্থ করলো। বুঝলো পেছনে মোহ আছে। মেয়েটা ওর মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

মামিমা চপচপ থাকুন ওরা কেউ জীবিত না। ভয় পাবেন না। চুপচাপ গিয়ে চুলা জ্বালুন। পারলে মোমবাতি থাকলে ওটাও জ্বালিয়ে ফেলুন বাকীটা আমি দেখছি। কিচেন থেকে বের হবেন না যতক্ষণ না আমি আসছি।
অধরা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এতোটা ভিতু ও কখনও ছিল না তবে আজ কিসের ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে কে জানে। চোখের সামনে কতকিছু দেখা কথাগুলো ভেবে হয়তো কিছুটা শক্তি ফিরে পেলো। তাই খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে গলা নামিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওরা কারা তোমার ধারণা আছে? বাড়ির লোকদের ক্ষতি করবে নাতো ? তোমার মামা যদি নেমে আসে অসুবিধা হবে দ্রুত ওদের বিদায় করো প্লিজ।
মোহ উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে উত্তর দিলো,

চিন্তা করবেন না আমি দেখছি। যা বললাম দ্রুত করুন সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
অধরা কথা বাড়ালোনা তাড়াতাড়ি গিয়ে লাইটার খুঁজে চুলা জ্বালিয়ে ফেললো। তাকে ছয়টা মোমবাতি ছিল সেগুলোও জ্বালিয়ে দিলো। কিচেনের সুইচ বাইরের ওয়ালে তাই এই বিড়ম্বনা। তাছাড়া এখন আগুনের প্রয়োজন। ইতিমধ্যে মোহ বাইরে চলে গেছে দরজা বন্ধ করে যদিও কাচের দরজা ভেদ করে বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ছে কিন্তু আবছা অন্ধকারের জন্য তেমন পরিস্কার না। মোহ দরজার বাইরে গিয়ে কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মুখ খুঁললো,

কি চাই তোমাদের? ভয় দেখিয়ে মজা করতে ভালো লাগছে বুঝি? শরীর নেই তাই বোতল বন্ধি করতে কিন্তু সময় লাগবে না।
মোহ বেশ ধমক দিয়ে কথা বলছে যদিও কাজ হবে কি জানা নেই। এই সব পিশাচের দল প্রচুর ছ্যাঁচড়া হয় কথা শুনতে নারাজ। তবুও কিছু করতে হবে। মোহ পূণরায় বলল,

কথা বলবে নাকি কহিনুর আসবে তোমাদের ব্যবস্থা করতে কোনটা? ও আসলে কিন্তু এতো আদর করে বোঝাবে না। উড়ন্ত বিষাক্ত খঞ্জর চালিয়ে এসব তামাশা বন্ধ করবে।
মোহের হুমকিতে হয়তো কাজ হলো। ঘর কাপিয়ে হাসির আওয়াজ হলো। ঝুলন্ত মহিলা হুট করেই মোহের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ রাঙিয়ে উত্তর দিলো,

সবটা ওর জন্যই হয়েছে। ওই মেয়েটার জন্য আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। এইযে আমি ঝুলছি সেটা শুধুমাত্র ওর জন্য। আমি কতকাল এভাবে ঝুলে আছি কষ্ট হয়না আমার? যাওয়ার জায়গা নেই না আছে থাকার জায়গা। আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি। সবাইকে পরিণতি বুঝিয়ে তবে ফিরবো।
মেয়েটার জরাজীর্ণ পোশাক আর শরীর থেকে কেমন জানি ইদুর পচা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। মোহ শৌখিন টাইপের মেয়ে এসব দেখে বমি পেয়ে যাচ্ছে। তাই কিছুটা পিছিয়ে এসে বলল,

কাছে আসবে না দূর থেকে বলো শুনছি। আর একদম কহিনুরকে দোষারোপ করবে না। তোমার এই অবস্থার জন্য ও না বরং তুমি দোষী। কি প্রয়োজন ছিল বাবা মাকে ফেলে অচেনা এক যুবকের সঙ্গে বাসা থেকে চলে আসার? চন্দ্র মোহর দিয়ে তোমাকে খরিদ করেছিলো এমনি এমনি না। তুমি জেনে বুঝে নিজেকে বিক্রি করে এখন তাকে দোষারোপ করছো? কর্মফলের শাস্তি পেয়েছো তাই ভালোই ভালো বলছি বিদায় হও। না হলে সত্যি কহিনুর আসবে আর তোমাকে মুক্তির পথ বাতলে দিয়ে ফিরবে। পিশাচ শয়তানকে শায়েস্তা করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না।

মোহ সমানে ধমক দিয়ে চলেছে। এদেরকে দমিয়ে রাখতে পারবে কি সন্দেহ আছে। ফ্লরে পড়ে থাকা মহিলার শরীর ইতিমধ্যে জুড়ে গেছে। তবে অসংখ্য দাগ আর ঘাতে বাজে অবস্থা। মাং/স পচে খসে পড়ছে। মোহ মুখটা কুচকে রেখেছে। দম বন্ধ করা পরিবেশ। হঠাৎ সিঁড়িতে খটখট শব্দ শুনে সকলে সেদিকে তাঁকিয়ে থমকে গেলো। আবছা অন্ধকারে একটা মেয়ের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মোহ বাঁকা হাসলো। এমনটাই আশা করেছিল। নির্জনতা কাটিয়ে রিনরিনে সুরেলা কণ্ঠে কহিনুর বলে উঠলো,

কার কি অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে শুনি?
মেয়ে দুজন তেড়ে গিয়ে কহিনুর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে আটকে পড়লো। অদৃশ্য দেয়ালে ওদেরকে বাঁধা দিচ্ছে। তাই একজন ঝঙ্কার দিয়ে বলল,

তোমাকে মেরে কহিনুর ছিনিয়ে নিতে এসেছি। তোমার পরিবারের চিহ্ন পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিয়ে তবে আমাদের শান্তি। শুধুমাত্র তোমাকে পেতে চন্দ্র আমাদের ব্যবহার করেছে।
কহিনুর মলিন হাসলো। সোজাসুজি সোফায় গিয়ে বসতে বসতে উত্তর দিলো,

ভুল কেনো বলছেন শুনি? আমার জানামতে চন্দ্র নিজের শরীর পচন হতে রক্ষা করতে মেয়েদের ব্যবহার করেছিল। ওদের শরীরের রক্ত নিয়েছে তবে সেটা জোরপূর্বক না। অর্থের বিনিময়ে কিনেছিলো। এখন নিজ ইচ্ছেতে আপনি যদি নিজেকে অন্যের কাছে বিক্রি করেন এর দায়ভার অন্যরা কেন নিবে? কর্মফল সবাইকে পেতে হয়।

আমাদের দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছে চন্দ্র। ও জানতো জীবন থেকে কতটা কষ্ট আমরা পেয়েছি। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল তখন হিতাহিত জ্ঞান ভুলে রাজি হয়েছি কিন্তু মৃত্যুর সময় ভুল বুঝতে পেরেছি কিন্তু আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়েছি সেই বাড়িতে আজ অবধি পৌঁছনোর সৌভাগ্য হয়নি। লোকটা আমাকে ফাঁকি দিয়ে গণিকা পাড়াতে বিক্রি করেছিল সেদিন রাতেই আমি পালিয়ে আসি আর চন্দ্রের খপ্পরে পড়ি। এতে আমার কি দোষ?
কহিনুর গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো,

কর্ম করার আগে ভাবতে হয়। কখনও কখনও জীবন মানুষকে দুবার সুযোগ দেয়না। আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই। তবে আপনি কি জানেন আপনি চন্দ্রের জন্য এভাবে কষ্ট পাচ্ছেন না বরং নিজের কর্মফলে সাজা পাচ্ছেন?চন্দ্র নিজ হাতে আপনাকে হত্যা করেনি বরং আপনি নিজেই চন্দ্রের থেকে পালাতে সুইসাইড করেছেন। আচ্ছা বলুন চন্দ্রের জন্য অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে তারা সকলেই কি ফিরে এসেছে? দেখুন শুধুমাত্র আপনারা কয়েকজন এসেছেন কিন্তু কেনো?নিজের কর্মফল চন্দ্র আর সুলতান পরিবারের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন। হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে ঘর ছেড়েছেন সঙ্গে গণিকা পাড়ায় একটা রাত ছিলেন সেখানে কি হয়েছিল ওটা আপনি ভালো জানেন। তারপর সুইসাইড করলেন। পাপ ছাড়েনা বাপকে কথাটা জানেন তো? যাইহোক আপনাদের বুঝিয়ে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। ভাবছি একবারে প্রতিকার করে ফেলবো। সুলতান ভিলার দিকে কখনও যেন নজর ফেলতে না পারেন তাই করবো।কেমন হবে?
কহিনুর মাথা ঠান্ডা করে হুমকি দিলো। বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ উদ্ধার হলে অযথা ঝামেলা করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। পাশ থেকে আরেকজন ফোড়ন কাটলো,

মানছি ওর দোষ ছিল কিন্তু আমার এমন পরিণতি কেনো হলো? আমার অপরাধ কি ছিল? চন্দ্রের জন্য উনার স্বামী নিজের হাতে আমাকে হত্যা করেছেন এটা কি পাপ না?
কহিনুর উনার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো তারপর উত্তর করলো,

নিশ্চয়ই সে পাপ করেছে সেই শাস্তি আল্লাহ উনাকে দিচ্ছেন বা দিবেন জানিনা আমি। কিন্তু আপনি যে পাপটা শরীরে বহন করে মৃত্যু বরণ করেছিলেন সেটাও নেহায়েত কম ছিল না। আপনি অপবিত্র ছিলেন। যেখানে আমাদের ধর্মে এহেন অপরাধের শাস্তি পাথর নিক্ষেপকরণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করার কথা উল্লেখ করেছে সেখানে আপনি সামান্য ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন জানিনা আপনার পাপের পরিসীমা কতটা তবে দয়াকরে আর ওসব ঘেটে আর নিজেকে ছোট করবেন না। বুঝতে পারছেন আপনাদের নিজেদের কর্মফলের জন্য এখানে আটকে আছেন হয়তো কেয়ামত পযর্ন্ত থাকবেন। অযথা কাউকে দোষারোপ করে এসব প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলাতে নামবেন না। পিশাচ প্রেতাত্মা জ্বীন এসব থেকে আমাদের মুক্তির রাস্তা আল্লাহ দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি কি তেলোওয়াত করবো নাকি ওষুধ ব্যবহার করবো? তেলোওয়াত করলে জ্বলেপুড়ে মরবেন আর ওষুধ ব্যবহার করলে বন্ধি হবেন এই যা। এসবের জন্য আপনাদের সাহায্য করছে কে এটাকি বলা যাবে?

কহিনুর থামতেই আবারও চারদিকে নির্জনতা ঘিরে ধরলো। মেয়েদুটো কিছু হয়তো ভাবছে। কহিনুর হাসলো। সামনে মোহ দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা বেশ অবাক হচ্ছে কপালে ভাজ পড়েছে। আবছা অন্ধকারেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। কহিনুর ওর দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,

ধন্যবাদ তোমাকে আমার আম্মাকে সাহায্য করার জন্য। এখানে বসতে পারো বাকীটা আমি দেখবো। ওরা নিজেদের বশে নেই। খান সাহেব যত্ন নিয়ে মগজ ধোলাই করেছেন সেটা কাটতে সময় লাগবে। এরা বুদ্ধিহীন অসহায়। আবেগপূর্ণ হয়ে পাপ করে এখন পরিণতি বুঝতে পারছে। পৃথিবীতে ঝুলে আছে অপমৃত্যুর দোষে। খান সাহেব নিজের শক্তি খাটিয়ে এদের এক করেছেন।

আমিও নিজের মায়ের প্রিয়জনদের উপরে রেগে কতকিছু করে ফেলেছি তাই চাইছিনা নতুন করে এই বাড়ির কোনো ক্ষতি হোক। তোমাদের সবাইকে এক সঙ্গে দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। জানি আমার সঙ্গে এই পরিবারের রক্তের সম্পর্ক নেই তবুও কেমন আপনার লাগে। আমি অন্ধ ছিলাম আলোতে এসেছি পূনরায় আর নিজেকে অন্ধকারে নিয়ে চাইনা।
কহিনুর হাসলো মানুষ যখন ভুল পথ থেকে সঠিক রাস্তায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে তখন তাকে সাহায্য করতে হয়। তাছাড়া আল্লাহ সৃষ্টি কখনও খারাপ হয়না। পরিবেশ তাকে বাধ্য করে খারাপ হতে। কহিনুরের ভাবনার অবসান ঘটলো জুবায়ের আওয়াজ শুনে। সকলেই চমকে উঠেছে। অধরার দেরি দেখে বেচারা নেমে এসেছে। জুবায়ের সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল,

এখানে কি হচ্ছে? তোমরা কে? অধরা কোথায়? অধরা তুমি কি এখানে আছো?
লোকটার গলা কাঁপছে অজানা বিপদের আশঙ্কা করে। কহিনুর উঠে আসলো। মৃদু কণ্ঠে বলল,
মা কিচেনে আছে ভয়ের কিছু নেই।
জুবায়ের বিশ্বাস করতে পারলোনা। ওর চোখদুটো অচেনা মহিলাদের দিকেই বারবার যাচ্ছে। আবছা অন্ধকার তাই লাইট অন করতে যেতেই কহিনুর পূণরায় বলল,

এখানে দুজন অগন্তুক আছে আলোতে উনাদের সমস্যা হবে। মোহ তোমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিবে চিন্তা করোনা।
কহিনুর ইশারা করলো মোহ অপেক্ষা করলোনা। সোজা জুবায়েরের হাত ধরে টানতে টানতে কিচেনে নিয়ে গেলো। দরজা আবারও বন্ধ করে ফিরে আসলো। কহিনুর মহিলাদের সামনে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,
সময় অপচয় করতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। এসব পিশাচদের বিশ্বাস করা উচিত না। সাঈদ তুমি কি এখানেই আছো? দ্রুত এদের ব্যবস্থা করো প্লিজ।

সাঈদ অদৃশ্য হতে সামনে আসলো। বাতাসে গুড়া ওষুধ ছিটিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে তেলোওয়াত করতে থাকলো। গগনবিদারী চিৎকারে ড্রয়িং রুম ভারি হয়ে উঠলো। কয়েকট মিনিট পরে আবারও নির্জনতা ছেয়ে গেলো।দমকা বাতাস রকেটের গতিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে দুজনের মহিলাকে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কহিনুর হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সাঈদ কহিনুরের দিকে ছুটে এসে বলল,

এই দুজনের সঙ্গে বাকিদের বশ কেটে গেছে ওর আর এখানে আসবে না। কিন্তু খান সাহেবের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
কহিনুর ওর কথা এড়িয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
উনি কোথায় জানো কিছু?
জানিনা হয়তো নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। রেগে আছেন আমার উপরে। যতই চেষ্টা করি ততই আমি উনার থেকে দূরে চলে যায়।
কহিনুর মাথা নাড়িয়ে বলল,

চিন্তা করোনা আমি সামলে নিব। তুমি বরং বাড়িতে থাকো আমি বাইরে যাচ্ছি।
কথাটা বলে কহিনুর অপেক্ষা করলোনা। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। হাতে সময় কম। শত্রুর শেষ এবার নিশ্চিত করে তবে শান্ত হবে।

আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। কহিনুর খান মেনশনের বাইরে গাড়িতে বসে আছে। এই যে বড় অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে আছে কতশত শয়তানের বসবাস। মানুষ যখন শয়তানের পূজারী হয়ে উঠে তখন তাকে হত্যা করাই উচিত। শয়তান সব সময় মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে অথচ কেউ সেটা উপলব্ধি করতে পারেনা। কালো জাদু করে মানুষ যা পেয়েছে তার দ্বিগুণ হারিয়েছে।

অনেকেই মনে করে পৃথিবীতে যত রকম অনাচার হয়েছে তার প্রধান হিসেবে মেয়েদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এখানেও তেমনি হয়েছে। খান পরিবারের পূর্ব পুরুষের কাহিনী কারো অজানা নেই কিন্তু এখানে সেই মেয়েটার কোনো দোষ ছিল না। সে চেয়েছিল নিজের সম্মান রক্ষা করে বাঁচতে ফলাফল তেমন কিছু হয়নি। অভিশপ্ত হয়েছে খান পরিবার। কথাগুলো ভেবে কহিনুর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

এই পরিবারের ধ্বংস কোনো মেয়ের হাতেই হবে তাইতো বহুকাল এরা এই বাড়িতে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল কিন্তু পরবর্তীকালে যখন কাল ঘুম থেকে সকলে জেগে উঠেছিলো তখন খান সাহেব ভেবেছিলেন সেই অভিশাপ বুঝি আর ওদেরকে কাবু করতে পারবে না। কথাটা আদো সত্যি কিনা সেটাই কহিনুর আজ পরিক্ষা করবে। আজ কাজের মেয়ের না বরং শহরের নামকরা একজন ব্যবসায়ীর কন্যার ছদ্মবেশে নিয়ে এখানে প্রবেশ করবে ভেবে ও গাড়ি ছাড়লো। গাড়িটা জাষ্ট দেখানোর জন্য নয়তো এসব ওর তেমন লাগে না।

কথাগুলো ভেবে ও সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ডান পা বাড়িয়ে নেমে পড়লো। সাদা গাউনের সঙ্গে লাল লিপস্টিক নিয়েছে আশাকরা যায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। প্রতিজ্ঞা করেছে আজ এখানে ধামাকা লাগিয়ে দিয়ে যাবে। কথাগুলো ভেবে ও খটখট আওয়াজ করে ভেতরে প্রবেশ করলো। খবর আছে আজ এই বাড়িতে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। কি উপলক্ষে সেটা জানা নেই। ভেতরে প্রবেশ করে কহিনুর কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।

বউয়ের সাজে এলেক্স লয়েডের কন্যা বসে আছে সোফায় তাকে ঘিরে আছে বেশ কিছু মহিলা। এক পাশে পার্টি চলছে। মিউজিক চলছে সেই তালে কয়েকটা ছেলে মেয়ে উদ্দাম নেচে চলেছে। কহিনুর যা বোঝার বুঝে গেলো। মলিন হেসে হাতের গিফটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। খান সাহেব অথিতিদের আপ্যয়ন করছে। সিঁড়ির পাশে আঁধার দাঁড়িয়ে ওয়াইন গিলছে। ছেলেটা এতোটা ফাজিল বলার বাইরে। যখন যা ইচ্ছা হয় করে ফেলে। কাউকে পরোয়া করে না। কহিনুরের ইচ্ছে করে এই বেয়াদবটাকে থাপ্পড় দিতে কিন্তু ওকে স্পর্শ করার মতো মন ওর নেই। এই ছেলের পশমে পশমে পাপ কিলবিল করে। কহিনুর সবটা দেখে নিয়ে পাশের একজনকে জিঞ্জাসা করলো,

অনুষ্ঠান কি শেষ?
না না এখনো বিয়ে হয়নি। উকিল আসেনি তাছাড়া মিস্টার খান দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
কহিনুর মাথা নাড়িয়ে একপা দুপা করে বারের দিকে এগিয়ে গেলো। বাড়িতে বার এটা এই বাড়িতেই সম্ভব। কহিনুর ওয়াইনের বোতলগুলোর দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করলো। হাতের মুঠোয় থাকা বিষাক্ত ওষুধ একে একে সবগুলো বোতলে চালান করে জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,

বিনা যুদ্ধে যদি শত্রু ধ্বংস হয় তবে যুদ্ধের কি প্রয়োজন? আজ অবধি কহিনুর নিয়ে কোনো যুদ্ধ হয়নি যা হয়েছে মস্তিষ্কের খেল। আজও হবে না। ওয়েটার আজ এই লগ্নে এখানে উপস্থিত সকলকে আমার তরফ থেকে এক গ্লাস করে ওয়াইন সাপ্লাই করে আসুন বিনিময়ে পাবেন অদ্ভুত এক হিরক খণ্ড যার মূল্য আপনি কখনও কল্পনাও করতে পারবেন না।
কহিনুরের পাশের ছেলেটার চোখ চকচক করে উঠলো লোভে। ওষ্ঠ কামড়ে বলল,

কাজের মধ্যে ওয়াইন দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।
টেনশন করবেন না। আমি দেখছি।
কহিনুর পূণরায় চোখ বন্ধ করলো। দূরে ঝিলমিল পোশাকে সুইটি দাঁড়িয়ে আছে। বহুদিন পরে দুজনের দেখা তবে চোখে চোখে কথা হলো। সুইটি পূর্বে নাচের তালিম নিয়েছিল সেটাই প্রদর্শন করতে শুরু করলো। ওর সঙ্গ দিচ্ছে আরও কয়েকজন মেয়ে। কহিনুর ওদের সামনে গিয়ে দাড়ালো।

উদ্দাম নৃত্যের সঙ্গে পুরোদস্তুর ওয়াইন সাপ্লাই চলতে থাকলো। কেউ খাচ্ছে কেউবা নৃত্যের নেশায় বুদ হয়ে আছে। এভাবে সবাইকে এক সঙ্গে খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই রেখে দিচ্ছে। হঠাৎ গান শেষ হয়ে গেলো। যারা খেয়েছিলো সকলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো একে একে। কহিনুর সেদিকে চেয়ে দ্রুত সুইটিকে ইশারা করলো লুকিয়ে পড়তে। আঁধার হাতের ওয়াইন ফেলে দিয়ে ছুটে এসে কহিনুরের চোখ থেকে মাস্ক খুঁলে নিলো। কহিনুর জানতো এমন হবে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারেনি। খান সাহেব এগিয়ে আসলেন। হয়তো এটা ফাঁদ ছিল কহিনুর সেটা বুঝতে পারেনি। আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

তুমি আবারও আমাদের ক্ষতি করতে এসেছো সুন্দরী? তবে আমি কিছু মনে করিনি। একবার আমার হয়ে যাও বাকিটা আমি দেখে নিব। শুধু একবার প্লিজ।
আঁধার আরও কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারলোনা। খান সাহেব কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে হুঙ্কার ছাড়লো,

নিজেকে সামলে রাখো নয়তো বিপদে পড়বে। আর কহিনুর আমার এই বিশাল অট্টালিকাতে তোমাকে স্বাগতম। নাতির স্ত্রী হিসেবে এই বাড়ির উপরে তোমার অধিকার আছে। এবার ভদ্র মেয়ের মতো দায়িত্ব পালন করো। নিজেতো আমার নাতির যোগ্য না তাই উপযুক্ত মেয়ের সঙ্গে স্বামীর বাগদান সম্পূর্ণ করে কহিনুর ওদের হাতে তুলে দাও।এতেই তোমার মঙ্গল। আমি জানি তুমি ভীষণ রকম বাধ্য আর প্রিয়জনের জন্য সব পারবে।
খান সাহেবের কথা শুনে কহিনুর হাসলো। ওষ্ঠ কামড়ে বলল,

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৬

ডাকুন তাকে দেখি কেমন প্রস্তুতিপর্ব শেষ হলো। বরের সাজে কখনও দেখিনি তাই দেখতে ইচ্ছা করছে। আপনি চিন্তা করবেন না এই তিথিতে বিয়ে বাসর হানিমুন সব হবে শুধু সময়ের অপেক্ষা দাদাজান।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব ( শেষ  অংশ )