কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব (শেষ অংশ) 

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব (শেষ অংশ) 
লাবণ্য ইয়াসমিন

কহিনুরের কথার শুনে খান সাহেব বিশেষ প্রতিক্রিয়া করলেন না। উনি জানেন কহিনুর চাটুকারিতাতে পারদর্শী ওর সঙ্গে তর্কে জড়ানো উচিৎ হবে না। তবে উনি উত্তর না দিলেও এক ভৃত্যকে ইশারা করলেন পাথরকে ডাকার জন্য। ভৃত্য গিয়ে খানিকটা পরে ফিরে এসে বলল,

জনাব ক্ষমা করবেন সাহেব দরজা বন্ধ করে আছেন ভেতর থেকে সাড়াশব্দ করছেন না।
ভৃত্যের কথা শুনে খান সাহেবের কপালে ভাজ পড়লো। বিরক্ত হলেন পাথরের উপরে। ছেলেটার মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছেন না। গতকাল রাতেও বলেছে যা ইচ্ছে করুন আমি কিছু বলবো না অথচ সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে তামাশা করছে। কক্ষের ভেতরে আছে সেটার আভাস উনি পাচ্ছেন। একবার নিজে যাবে কিনা বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ কহিনুরের কথায় উনার ধ্যান ভাঙলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কি ব্যাপার বলুন তো দাদাজান? সেকি নতুন পুরাতন দুই বউয়ের মুখ দেখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করলো? নাকি অভিমান করে দূরে আছে? সে যাইহোক আপনার আয়োজন দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ। কিন্তু বিয়ে তো দিচ্ছেন আমার জামাইকে এটা জানেন সে একান্ত আমার ব্যক্তিগত মানুষ। আমার অনুমতি ব্যতিত তাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো নারীর নেই? কি করবেন এখন কিছু ভেবেছেন এই বিষয়ে?
কহিনুর তাচ্ছিল্যপূর্ণ কটুক্তি শুনে খান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কথাটা ভেবে উনার শরীর রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা অতি চালাক। উনি দাঁতে দাঁত চেপে তেড়ে এসে উত্তর দিলেন,

বড়দের সঙ্গে বেয়াদব করছো মেয়ে? মুসলিম হয়ে এইটুকু জানোনা পুরুষ মানুষ ইচ্ছে করলে চারটা পযর্ন্ত বিয়ে করতে পারে। স্ত্রী হিসেবে নিজের স্বামীকে সুখী করতে চাইলে অনুমতি দিতে তুমি বাধ্য। তাছাড়া কহিনুর যখন তুমি ওকে দিয়ে দিবে তখন এসব অনুমতির কোনো প্রয়োজন হবে না। তোমার ক্ষমতা ধ্বংস হবে।

ধর্ম সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে দাদাজান। আমাদের ধর্মের ব্যাখ্যা আপনার মতো শয়তানের উপাসকের থেকে নাইবা শুনলাম। কহিনুর কি এতোটাই সস্তা যে কেউ ভিক্ষা চাইবে আর আমি দান করবো? আপনি এখনো বড্ড বোকা আছেন দাদাজান। আপনি বরং একটা কাজ করেন বাড়িতে যেসব কালো জাদু আর খারাপ জ্বীনদের আটক রেখে আজেবাজে কাজকর্ম করছেন সেসব মুক্ত করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। এমনিতেই জীবনে যতটা পাপ করেছেন জানিনা ক্ষমা পাবেন কিনা ।আল্লাহ ক্ষমাশীল আপনার মতো পাপিষ্ঠকে উনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করলেও করতে পারেন। আল্লাহ দয়ালু ভরসা রাখতে পারেন।

গলা নামিয়ে কথা বলো নাতবউ। বাবার মতো সুযোগ পেলে কথা বলতে ছাড়ো না দেখি। আমার বয়স আর আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তোমার বিন্দু পরিমাণ ধারণা নেই। আমি নিজের শক্তি আর কালো জাদু কাজে লাগিয়ে কতগুলো বছর পৃথিবীতে আছি জানো তুমি?
না জানার কি আছে। শয়তানকে আল্লাহ ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন সময় হলে উনি নিশ্চয়ই আপনার দাপট ভেঙে শক্তিহীন করবেন। সময় থাকতে ক্ষমা চেয়ে নিন। আপনার জন্য এই পরিবারের ছেলেগুলো অভিশাপ নিয়ে ধুকে ধুকে মরছে। কি লাভ হচ্ছে এসব করে?

কহিনুর শেষের কথাটা বেশ নরম করেই বললো। আগে বুঝিয়ে বলবে তারপর অন্য কিছু ভাববে। এতোক্ষন দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি চলছিলো আশেপাশের সকলে চুপচাপ শুনছে। খান সাহেব কথা বলার সময় সকলে চুপচাপ থাকে। এই বাড়ির নিয়মকানুন অন্যরকম। খান সাহেবকে রাগালে শাস্তি পেতে হয়। হঠাৎ আঁধার মুখ খুললো,

নূর তুমি দাদাজানের সঙ্গে তর্ক করছো কেনো? ছাড়ো এসব তুমি বরং আমার সঙ্গে চলো। সত্যি অনেক ভালোবাসি তোমাকে। আমার হৃদয়ের মাঝে তুমি ছাড়া কেউ নেই। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই বিধায় অনেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছি কিন্তু মনে শুধু তুমিই আছো। একবার আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখো পাথরের চেয়ে কোনো অংশে আমি কম না বরং ওর থেকে বেশি সুদর্শন। আমার জন্য মেয়েরা মরতেও রাজি। তুমি কেনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো বুঝি না। আসোনা সুইটি।

গুরুত্বপূর্ণ আলাপনের মধ্যে আঁধারের প্রেম নিবেদন খান সাহেবের পছন্দ হলোনা। বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিয়ে বসলেন ঠিক তখনই ঐশ্বর্য ছুটতে ছুটতে এসে আঁধারের হাত টেনে কহিনুর দিকে চেয়ে আক্রোশে ফেটে পড়লো,
চরিত্র নিয়ে খুব গর্ব না? সব পুরুষদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে স্বামীর প্রতি অবিচার করতে লজ্জা করেনা?
কহিনুর কটু কথা শুনেও হাসলো। হিজাবটা টেনে নিয়ে বললো,

আমার লজ্জা অনেক কম ঐশ্বর্য। আমার বাবা কিন্তু তোমাকে মনে করে এখনো ভীষণ কষ্ট পান। কন্যার স্নেহে পালন করেছেন তো তাই এখনো ভুলতে পারেননি। তাছাড়া মানুষের হৃদয় অনেক নরম হয়। শয়/তানের তো হৃদয় বলতে কিছু থাকে না সেই সম্পর্কে উনার ধারণা হয়নি। যাইহোক তুমি বরং এই গাধাটাকে এখানে থেকে নিয়ে যাও। তখন থেকে ভুল বকছে। আমার ধৈর্যের সময় সীমা ফুরিয়ে আসলে হাত উঠে যাবে। আমি রাগলে কি হবে সেই ধারণা তোমার আছে। এখন যাও প্লিজ।

কহিনুর কথা থামিয়ে কিছুটা পিছিয়ে আসলো। এখানে অযথা তর্কাতর্কি হচ্ছে। খান সাহেব ওকে কথার প্যাচে ফেলে সময় নষ্ট করছে। নিশ্চয়ই কোনো মতলব করছেন। কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারছে না। কহিনুর চোখ বন্ধ করে সাঈদকে স্মরণ করলো। পাথর রেগে আছে হয়তো ওকে সাহায্য করতে আসবে না। কহিনুর মনে মনে শঙ্কিত হচ্ছে। বাইরে সুইটি আছে। ওকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছিল সেটা হয়েছে কি জানতে পারলে শান্তি লাগতো।

হঠাৎ আক্রমণে কহিনুর থতমত খেয়ে গেলো। ডান দিক থেকে উড়ন্ত সিঁকল এসে ওর পা স্পর্শ করলো। আটকে ধরলো। ও কিছু করার পূর্বেই পূণরায় একাধিক সিঁকল এসে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। কহিনুর জানে এই সিঁকল গুলো সাধারণ না। সিঁকলের অন্যপ্রান্ত ধরে আছে শক্তিশালী জ্বীনেরা। বহুকাল এই সিঁকল দ্বারা পাথরের বাবাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কহিনুর চোখ বন্ধ করলো। হাত না চললে শক্তির ব্যবহার করতে পারবে না। খান সাহেব ওর এমন পরিণতি দেখে ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। তারপর তেড়ে এসে হুঙ্কার দিলেন,

খুব না মুখের বুলি ফুঁটেছিলো? বধির বোবা সামান্য কিছু শক্তি পেয়ে ধরাধামে নিজেকে শক্তির দেবী ভাবতে বসেছিলে না? এই সিঁকল ভেদ করে তোমার মুক্তি কিভাবে সম্ভব হয় এটাও আমি দেখবো। আজ চন্দ্রের দ্বিতীয় গ্রহণ লাগতে চলেছে। কহিনুর আমার হাতে আসতে বাধ্য।

খান সাহেবের কথা শুনে কহিনুর চোখ বন্ধ করলো। বুক ঢিপঢিপ করছে। হাতের আঙুল নাড়তে চাইলো কিন্তু হচ্ছে না। এই সিঁকল ওর শক্তিকে আটকে দিচ্ছে। কহিনুর এবার উপরের দিকে চাইলো। পাথর এখনো দরজা বন্ধ করে আছে। হঠাৎ সেই সময় ফাইল হাতে একজন উকিল এসে হাজির হলো। লোকটা এসে আশেপাশে না তাকিয়েই বলল,
জনাব ক্ষমা করবেন কাজে আটকে গিয়েছিলাম। আপনি ছেলে মেয়েকে ডাকুন কাগজপত্র রেডি করে রেখেছি।
খান সাহেব এগিয়ে গিয়ে উনাকে বসতে দিয়ে বললেন,

আপনি মেয়ের থেকে সাইন করিয়ে নিন ছেলে এখুনি আসবে।
খান সাহেব কথা শেষ করতে পারলোনা পাথরের কক্ষের দরজা ধুম করে খুঁলে গেলো। গটগট আওয়াজ করে পাথর নেমে আসলো উপর থেকে। কহিনুর সেদিকে চেয়ে ঢোক গিললো। সাদা শার্টের সঙ্গে কালো প্যান্ট পরেছে লোকটা। পায়ে সাদা জুতা। আহামরি বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি তবুও কহিনুর চোখ সরাতে পারলোনা। পাথর কপালের উপরে আসা চুলগুলোর মধ্যে হাত ডুবিয়ে খান সাহেবের সম্মুখে গিয়ে থামলো। আশেপাশে না তাকিয়েই বলল,

সব রেডি?
এতোক্ষন লাগলো তোমার রেডি হতে? কিন্তু আমার দেওয়া পোশাক পরিধান করোনি কেনো? মেয়েটা অপেক্ষা করছে। যাও সাইন করে নিজের স্ত্রীকে গ্রহণ করো।
পাথর এবার এক পলক কহিনুরের দিকে চাইলো। তারপর ভ্রু কুচকে বলল,
ওকে বেঁধে রেখেছেন কেনো? ছেড়ে দিন।
এহেন কথায় খান সাহেব বিরক্ত হলেন । ভ্রু কুচকে বললেন,
বেয়াদবি করছিলো তাই আটকে রেখেছি চিন্তা করোনা কহিনুর পেয়ে গেলে ওকে ছেড়ে দিবো। যাও কাজ সম্পূর্ণ করো। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না।
পাথর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। হুট করে রাগ উঠে গেলো। তবুও চেষ্টা করলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাগলে তান্ডব হবে সেটা ভালো হবে না। তাই চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো,

ওকে ছেড়ে দিন দাদাজান। আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। ভেতরের ঘুমন্ত পশুটাকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। ওর শরীরে একটা করে দাগ বসবে সেই সঙ্গে এই বিশাল অট্টালিকার একটা একটা অংশ ধুলাই লুটাবে। আমার হৃদয় ওকে দেখলে থমকে যায় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমার আমিটা ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আপনি বললে একাধিক পেপারে সাইন করে একাধিক নারীর দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত কিন্তু এই মেয়েটা ব্যতীত অন্য কোনো নারীর দিকে আমি চোখ তুলেও তাকাতে রাজি না। স্ত্রীদের সমান অধিকার দিতে না পারলে বিয়ের কোনো মানে হয়না। আমি আল্লাহর কাছে অপরাধী হয়ে যাব তাই ক্ষমা করবেন এখানে কোনো বিয়ে হবে না। আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিন।

পাথরের কথা শুনে খান সাহেব রেগে গেলেন। তারপর কিছু একটা ভেবে আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,
কথার খেলাপ করছো ঠিক আছে নিজের বাবাকে একবার দেখে নাও তবে।
কথাটা বলতে দেরী হলো কিন্তু একটা দৃশ্য ফুটে উঠতে দেরী হলোনা। পাথরের বাবাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। পাথর বাবার এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। গলা শুকিয়ে আসছে। একদিকে স্ত্রী অন্যদিকে বাবা। কি করবে বুঝতে পারছে না ঠিক তখনই কহিনুর মুখ খুললো,

দাদাজান আপনি পুরাতন ফুটেজ কেনো দেখাচ্ছেন? পারলে এখনকার অবস্থাটা একটু দেখান। আচ্ছা দেখাতে হবে না আপনি বরং নিজে দেখে নিন তাতে আপনার জানে বাতাস লাগবে।
কহিনুরের কথার মানে পাথর বুঝে ফেলল। ওষ্ঠ কামড়ে বলল,

দাদাজান কি করেছেন বলুনতো? আমার বউয়ের সঙ্গে বুদ্ধিতে তো পারলেন না। ছেড়ে দিন ও কষ্ট পাচ্ছে। বউয়ের কষ্টে চুপচাপ থাকতে পারিনা আমি। তাছাড়া আপনার হাতে সময় খুব কম আছে। আপনার অমৃতরস নাকি একটা তরল আছে যেটা আপনি নিয়ম করে সবাইকে খেতে দেন আমি ওর মধ্যে বিষাক্ত ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। আশাকরি তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া শুরু হবে।

আমি এইজন্য কক্ষে অপেক্ষা করছিলাম। ওটাই আপনাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির কারণ ছিল না? আর হ্যাঁ আমাদের হেকিম সাহেব কিন্তু চমৎকার একটা সমাধান বলেছেন। আমাদের খান পরিবারের অভিশাপ কিভাবে খণ্ডিত হবে ওটা জেনেছি আমি। আপনার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা চমৎকার একটা জীবন পেতে চলেছি। কালো জাদুর ধবংস হলে অভিশাপ এমনিতেই কেঁটে যাবে। মৃত্যুর কয়েক মূহুর্ত বাকি আছে।

এইটুকু সময়ের মধ্যে একটা ভালো কাজ করুন। ওকে ছেড়ে দিন।
পাথরের ধীরস্থির বাক্যলাপে খান মেনশনে বজ্রপাতের সৃষ্টি করলো। খান সাহেব চমকে উঠে পিছিয়ে গেলেন। এই ছেলেকে বাড়িতে রাখলে এহেন বিপদের সম্মুখে পড়তে হবে আগে জানলে কখনও রাখতেন না। কিন্তু এখন কি হবে? অতিরিক্ত টেনশনে উনি ঘামতে শুরু করলেন। মাথা ঘুরছে। আঁধার ছুটে এসে বলল,

বেইমান যখন নূর যখন তোমাকে আহত করে সমুদ্রের তীরে ফেলে গিয়েছিল তখন কে তোমাকে বাঁচিয়েছিলো? দাদুর স্নেহের এই প্রতিদান দিলে তুমি? লজ্জা করলো না? আমি তোমাকে খু*ন করবো।
পাথর সরে গেলো। কহিনুরের দিকে যেতে যেতে উত্তর দিলো,

মৃ/ত্যুর পূর্বে মানুষ অনেক পাগলামি করে সেসবে পাত্তা দিতে নেই। হ্যাপী জার্নি, আল্লাহ চাইলে ইনশাআল্লাহ ওপারে দেখা হবে। আর অনুরোধ আমার বউয়ের নিকনেম ধরে ডাকাডাকি করোনা ভালো দেখাচ্ছে না। যদি বোন হিসেবে ডাকতে তাতে আমার অসুবিধা ছিল না। আর রইলো দাদুর আমাকে বাঁচানো? আল্লাহ চেয়েছিলেন বিধায় বেঁচে আছি। আমার মৃত্যু ওভাবে ছিল না। উনি নিজের স্বার্থে আমাকে বাঁচিয়েছেন তার বেশি না। প্রতিদান হিসেবে উনার প্রতিটা কথা শুনেছি। হৃদপিণ্ডে লেখা নামটাও ভুলে থেকেছি। অনাথের মতো একাকি বড় হয়েছি আরও কি প্রতিদান দেয়ার বাকি আছে? আচ্ছা যাও আর কিছু বিনিময়ে দিচ্ছি। এই যে,পৃথিবীর মোহ মায়া থেকে মুক্তি দিলাম ভালো হলো না?। উনি মানুষের অনিষ্ট করছেন সঙ্গে নিজেরও ক্ষতি করছেন।

পাথর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে কিন্তু আঁধার চুপচাপ থাকতে পারছে না। শরীর কাঁপছে মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে। কহিনুর চুপচাপ পাথরের মুখের দিকে চেয়ে আছে। পাথর সোজাসুজি গিয়ে সিঁকল টেনে খুঁলে দিয়ে কহিনুরের ডান হাত নিজের আয়ত্তে নিয়ে বলল,

দ্রুত যেতে হবে। ওষুধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দাদুর মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের অভিশাপ কেটে যাবে। এই বাড়িতে অসংখ্য জ্বীন খারাপ আত্মার বসবাস আছে ওরাও মুক্তি পাবে। দাদুর ভেলকিবাজি যত রকমের জাদুবিদ্যা আছে সব কিছুর মূলে ওরা আছে। যেকোনো সময় এটা ধ্বংস হবে। দ্রুত চলো।

কহিনুর কিছু বললো না। পাথরের উপরে ভরসা আছে। লোকটা নিজের মুক্তির সন্ধান নিজেই করে ফেলেছে। পাথর ওর হাত শক্ত করে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো। ততক্ষণে বাড়ির বাকিরা ফ্লরে গড়াগড়ি করছে। ওরা বেলকনি থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই জোরে আওয়াজ হলো। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো খান মেনশন নামের বিখ্যাত অট্টালিকা। পাথর বুকে হাত রেখে বলল,

আজ থেকে এইসব অর্ধমানবদের ঝামেলা শেষ হলো। আমি নিজের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু নূর তুমি এখনো কহিনুর ধারণ করছো।
পাথরের কথা শুনে কহিনুর হাসলো। সাঈদ ততক্ষণে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কহিনুর ওর দিকে চেয়ে বলল,
সাঈদ তুমি আজ থেকে মুক্ত জীবন যাপন করতে পারো। অর্ধমানবেরা নেই আশাকরি আর কেউ কহিনুরের খোঁজে আসবে না। তুমি শেষবারের মতো একটা কাজ করো কহিনুর নিয়ে যতগুলা ডায়রী আর কালোজাদুর বই আছে সবগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দাও। মানুষের মন থেকে কহিনুরের স্মৃতি ভুলিয়ে দাও। আমি চাইনা কেউ মনে রাখুক কহিনুর বলতে কোনো মূল্যবান জাদু পাথর পৃথিবীতে ছিল।
কহিনুরের কথা শেষ হলো না সাঈদ প্রতিবাদ করে উঠলো। মুখটা করুন করে বলল,

আমি মুক্তি নিয়ে কি করবো নূর? প্রিয়জন নেই না আছে নিজের কোনো ঠিকানা। প্লিজ আমাকে পর করোনা। তোমাদের সঙ্গে রাখো প্লিজ। তাছাড়া কহিনুরকে তুমি বিসর্জন দিও না। পাথরটাকে লুকিয়ে নিজের কাছে রেখে দাও। ও থাকলে আমিও তোমার সঙ্গে থাকতে পারবো। ভুলক্রমে ওটা হাত বদল হলে আবারও ঝামেলা হবে।

জাদুলিপি পরিবর্তন হতে শুরু করেছিলো মনে আছে তোমার? ওটা ইঙ্গিত করছিলো সামনে ভালো কিছু হতে চলেছে। জনাব তোমাকে চেয়ে যেটার বিনিময় করেছিলো ওটার আর প্রয়োজন নেই। তোমরা চাইলে বাবা মা হতে পারো। জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
সাঈদের কথা শুনে পাথর খুশী হয়ে গেলো। কহিনুরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,

ক্ষমা করো নূর আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে ওরকম পাগলামি করেছি। আমার উচিৎ হয়নি জাদুলির কাছে কিছু চাওয়া। আল্লাহর উপরে ভরসা রাখা উচিৎ ছিল।
কহিনুর হাসলো। অবশেষে সব ঝামেলা শেষ হলো। সুলতান ভিলাতে ফিরতে হবে। সুইটি পাথরের বাবাকে উদ্ধার করে হয়তো ওখানে পৌঁছে গেছে। গালিব অন্যায় করেছিলো মায়ের কথাতে কালো জাদুর সঙ্গে জড়িয়ে যদিও লোকটা সাধারণ ছিল না তবুও উনার অন্যায় খুব একটা বেশি না। তাছাড়া ক্ষমা করার মালিক আল্লাহ ওরা কেউ না। সামনে যা হবে ইনশাআল্লাহ সব ঠিকঠাক হবে।

পরশিষ্ট
গভীর রজনী বাইরে হালকা তুষারপাত হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কহিনুর। কোমর অবধি উন্মুক্ত বাদামি কেশপল্লব বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছে। মাঝেমাঝে বাম হাতে ধরে থাকা কফির কাপে রক্তিম ওষ্ঠের ছোঁয়া দিতে ভুলছে না। দৃষ্টি খানিকটা দূরে, মন পড়ে আছে অন্যখানে। হঠাৎ কাধে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ও সিউরে উঠলো। শীত শীত ভাব প্রখর হলো। পাথর ওকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলল,

হৃদয় হরিণী শীতের মধ্যে এখানে কি? কক্ষে চলো।
কহিনুর চোখ বন্ধ করলো। পাথরের নিশ্বাস ওর কাঁধেরর উপরে আড়ছে পড়ছে। শরীর মন মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিষ্টি সুবাস প্রবাহিত হচ্ছে। কহিনুর লাজুক হেসে বলল,
ছাড়ুন আমি শীত উপভোগ করছি। দেখছেন না কফি এনেছি? এমনে আমার ভলোলাগে।
পাথর মুখ তুললোনা। কাঁধে দ্বিতীয়বার ওষ্ঠের ছোঁয়া দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,

কেমনে ভালোলাগে? তুমি ব্যতীত আমার তো কিছুই ভালোলাগেনা। চলো বরের ভালো লাগানোর দায়িত্ব নিবে। শুধু পালিয়ে বেড়ানোর ধান্দা, বুঝিনা আমি?
পালাতে আর দিচ্ছেন কোথায়?
পাথর ওকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। কহিনুরের মুখের উপরে এলোমেলো চুলগুলো কানে গুজে কপালে চুমু দিয়ে বলল,

কতশত চুম্বন এঁকেছি এই ললাটে তবুও স্বাদ মিটেনি কি করা যায় বলোতো? নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছি।
কহিনুর উত্তর করতে পারলোনা। পাথর শোনার জন্য অপেক্ষাও করলো না। বাইরে বাতাসের গতি প্রবল হতে শুরু করেছে। তুষারপাত হচ্ছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজবে দুজনেই। পাথর ওকে আলগোছে কোলে তুলে কক্ষের দিকে এলোমেলো পায়ে হেটে গেলো। অনাদরে কফির কাপটা সেখানে পড়ে থাকলো।

সুলতান ভিলাতে সুখের মূহুর্ত বিরাজ করছে। গালিব স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। দৃষ্টি আর আলফার খুনসুটি সারাদিন লেগেই থাকে। জুবায়ের আলফাকে প্রচুর বকাবকি করে কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনা। জামসেদ আর মীরা আলফার জন্য নিবেদিত প্রাণ। ছেলে বলতে পাগল। মোহ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য একটা সংস্থা পরিচালার দায়িত্ব নিয়েছে বিধান সুলতান ভিলাতে খুব একটা থাকতে পারে না।

বছরের বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হয়। কহিনুর বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে। পাথর নিজের ব্যবসা দেখাশোনা করে।যদিও শশুর বাড়িতে থাকার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু কহিনুরের জন্য বাধ্য হয়েছে। মেয়েটা কতকাল বাবা মায়ের থেকে দূরে ছিল তাই নতুন করে আর দূরে রাখতে চাইছে না। অধরা সারাজীবন এমনিই একটা হাসিখুশি সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখতো। হয়তো জীবনের শেষ সময়ে এই সুখটুকু ভাগ্যে ছিল। জুবায়ের আগের মতোই আছে। হুটহাট রেগে যাওয়া মুদ্রাদোষ কখনও আর ভালো হবে না। ডিনার শেষে অধরা আয়েশ করে বিছানায় বসতেই জুবায়ের এসে হাজির হলো। ল্যাপটপ বন্ধ করে অধরার পাশে বসতে বসতে বললো,

প্রয়োজনীয় যা কিছু আছে গুছিয়ে নাও। আমি অফিসের ঝামেলা আপাতত মিটিয়ে ফেলেছি বাকীটা ভাই দেখে নিবে। ছেলেমেয়ের কিচিরমিচির সংসারের ঝামেলা আর ল্যাপটপের খটখটানি থেকে কিছুদিন প্রশান্তি পাওয়া যাবে। কি যে শান্তি লাগছে বউ বলে বোঝানো যাবে না।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। কোথাও যাওয়ার কথা ছিল বলে ওর মনে হচ্ছে না। তাই কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,

কোথাও কি যাচ্ছি আমরা?
জুবায়ের বিরক্ত হলো এহেন প্রশ্ন শুনে। থমথমে মুখে বলল,
মানে কি তুমি সবটা ভুলে গিয়েছো? আরে বলেছিলাম না সব ঝামেলা ঠিকঠাক হলে আমরা হানিমুনে আফ্রিকা যাব?দুদিন পরে পূর্ণিমা। জঙ্গলে মাঝে পাহাড়ের উপরে কটেজ নিয়েছি। ভাবো একবার আমারতো চোখ বন্ধ করলেই কেমন সুখ সুখ লাগছে।

জুবায়েরের কথাতে কক্ষে ছোট একটা বজ্রপাতের সৃষ্টি হলো। অধরা চোখ গোলগোল করে চাইলো। মানে জামাই মেয়ে ছেলে ফেলে এখন আফ্রিকা যেতে হবে কি অদ্ভুত। লোকটার মাথা সত্যি নষ্ট হয়ে গেছে। এই পাগলের সংসার অধরা আর কিছুতেই করবে না। ধৈর্যের একটা সীমা আছে। রাগে ফুলতে ফুলতে বলল,

আপনার আক্কেল জ্ঞান জীবনেও হবে না তাইনা? আপনি জান আমি কোথাও যাচ্ছি না। লজ্জা শরম নেই। বুইড়া বয়সের ভিমরতি। আল্লাহ তুমি আমাকে এ কেমন জামাই লিখেছিলে কপালে?
অধরা আহাজারি করে উঠলো। জুবায়ের হতভম্ভ ওর এমন আচরণে। সবটা আগেই বলা ছিল তাহলে বউ এমন করে কেন? জুবায়ের গাল ফুলিয়ে বলল,

আফসোস করে লাভ নেই এখন আর জামাই পরিবর্তনের সুযোগ পাবেনা তারচেয়ে বরং যা বলছি শুনো। তালবাহানা রাখো। তোমার কথা আমি শুনছি না। আফ্রিকা যাচ্ছি মানে যাচ্ছি।পাথর ব্যবস্থা করেছে না গেলে জামাই কি ভাববে বলোতো? তাছাড়া আমাদের কি এখনো চুল পেকেছে যে তুমি এমন ভাব করছো? আমাকে দেখলে এখনো মেয়েরা কফি অফার করে। পটানোর চেষ্টা করে। কতটা সুদর্শন ভাবো?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড শেষ পর্ব ( ১ম অংশ )

অধরা ক্ষেপে গেলো। কথা বললে লোকটা থামবেনা তাই চুপচাপ কম্বলের মধ্যে ডুব দিলো। বোম মারলেও একটা শব্দ উচ্চারণ করবে না। পাগলের সঙ্গে কোনো কথা নেই। থাকুক এভাবে। জোবায়ের বসে থাকলোনা। কম্বল নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করলো। হয়তো আরও কিছুক্ষণ পরে অধরা ঠিকই রাজি হয়ে পাড়ি দিবে সূদুর আফ্রিকায়।

সমাপ্ত