মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৩৩

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৩৩
লেখিকাঃ দিশা মনি

ইভানা নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে যেন ধরা না পড়ে। শিক্ষিকা ইভানার কাছে এসে বলে,
‘তোমার খাতা দেখি!’

ইভানা ভয়ে কাপতে থাকে। এখন উনি খাতা দেখলেই তো সব টের পেয়ে যাবে। তাই ইভানা সহসা কি করবে ভেবে পায়না। ইভানাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিক্ষিকা জোরপূর্বক খাতা টেনে নেয়। ইভানা চোখ বন্ধ করে নেয় ভয়ে। তার চোখ দিয়ে দু ফোটা জল বের হয়। বুক ফে’টে কান্না পাচ্ছে এখন। কিছু ভুলের পরিণতি যে খারাপ হয়, সেটা এই মুহুর্তে ইভানাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে।
শিক্ষিকা বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। পরীক্ষায় নকল এনেছ। ভেবেছিলে খুব সহজেই নকল করবে। আমার চোখের সামনে এসব করা এত সহজ নয়। তোমাকে আমি এক্সপেল করে দিলাম।’
ইভানা কান্নাভেজা গলায় বলে,
‘প্লিজ ম্যাডাম এমন করবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে।’
‘চুপ। নকল করার আগে এসব মনে ছিল না? আমার সাথে প্রিন্সিপালের রুমে চলো। তোমার গার্ডিয়ানকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করছি।’

ইভানা অনুনয় করে বলতে থাকে,
‘এমন করবেন না। আমার এক্সপেল করুন ঠিক আছে কিন্তু প্লিজ বাড়ির লোককে জানাবেন না।’
ম্যাডাম কোন কথাই শুনলেন না। রুমে আরো একজন ডিউটিতে ছিল৷ তাকে রুমে রেখে ইভানাকে নিয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে গেলেন তিনি। প্রিন্সিপালের অফিসে গিয়ে প্রিন্সিপালকে সবকিছু বলেন ঐ শিক্ষিকা। প্রিন্সিপাল যেহেতু ইভানাকে চেনে যে সে তাঁর ভাইয়ের বন্ধু ফাহিমের স্ত্রী তাই তিনি বেশ অবাক হন। তিনি ইভানার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,

‘ফাহিম ছেলেটা তোমার জন্য কত কি করল। কত কষ্ট করে তোমার এখানে এডমিশনের ব্যবস্থা করিয়ে দিলো। আর তুমি সেটার এই দাম দিলে। সেম অন ইউ। আমি এখনই ফাহিমকে সব জানাচ্ছি।’
ইভানা প্রিন্সিপালকেও অনেক অনুরোধ করে কিন্তু কোন লাভ হয়না। প্রিন্সিপাল ফাহিমকে ফোন করে কলেজে আসতে বলে। ফাহিম কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে বলে জানায়। ইভানা অনবরত কাঁদতেই থাকে। তার কান্না দেখে প্রিন্সিপাল বলেন,
‘এজন্যই প্রবাদ আছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। এখন কেঁদে কোন লাভ নেই। নকল করার আগে এটা ভাবা উচিৎ ছিল।’

ফাহিম অফিস রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রিন্সিপালের রুমে এসে ইভানাকে দেখে বেশ অবাক হয় সে। এগিয়ে এসে ইভানাকে বলে,
‘তুমি এখানে কি করছ? তোমার না এখন পরীক্ষা চলছে। ভাইয়া আপনি আমায় কেন ডাকলেন। ইভানার কি কোন সমস্যা হয়েছে?’
প্রিন্সিপাল বললেন,

‘তোমার স্ত্রী পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক কারণ আমাদের কলেজে এভাবে কেউ নকল করে না। এর জন্য আমাদের কলেজের রেপুটেশন অনেক খারাপ হতে পারে। আমি এই ব্যাপারে কলেজের ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের সাথে কথা বলব। তারপর তারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে।’
ফাহিম ইভানার পক্ষ নিয়ে বলে,
‘আমার মনে হয়, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ভাইয়া। ইভানা এমন কিছু করতে পারে না। ইভানাকে মেবি কেউ ফাসিয়ে দিয়েছে। তাই না ইভানা?’

ফাহিম ইভানাকে এত বিশ্বাস করে দেখে ইভানার খুব খারাপ লাগে। আজ সে ফাহিমের বিশ্বাস ভরসা সব ভেঙে দিয়েছে। ইভানাকে চুপ থাকতে দেখে ইভানা আরো বেশি অস্থির হয়ে যায়। একপ্রকার চেচিয়ে বলে,
‘কি হলো চুপ করে আছ কেন? আন্সার মি। বলো যে তুমি নকল করো নি।’
‘আসলে…’

‘আসলে কি? তোমার তো নকল করার কথা না। তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে ভালো করে পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করবে। সেখানে তুমি এটা কি ভাবে করতে পারো?’
ইভানা ক্রমাগত কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেচকি উঠে যায়। সে ধরা গলায় বলে,
‘আমি নকল করতে চাইনি। কিন্তু পড়াশোনার অবস্থা বেশি ভালো ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে…’
ফাহিম অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ইভানার দিকে তাকায়। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগে তার। এদিকে প্রিন্সিপাল বলেন,
‘তুমি ইভানাকে নিয়ে যাও। আজকে রাতের মধ্যে আমি তোমাকে ডিশিসন জানিয়ে দেব যে, ইভানা এই কলেজে পড়তে পারবে কি পারবে না।’

ফাহিম ইভানার হাত শক্ত করে ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ইভানার সাথে কোন কথা বলে না। ইভানাকে নিয়ে বাইরে এসে রিক্সায় ওঠে। রাস্তায় ইভানা বারকয়েক ইভানার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু ফাহিম ইভানাকে এড়িয়ে যায়। এতে ইভানার অনুশোচনা এবং কান্না দুটোই বাড়তে থাকে।

বাড়ির সামনে পৌঁছানোর অর ফাহিম দ্রুত রিক্সা থেকে নামে। অতঃপর ভাড়া মিটিয়ে হাটা ধরে। ইভানা তার পিছু পিছু যায়। বাড়িতে ঢুকে সোজা সিঁড়ি বেয়ে রুমে চলে যায় ফাহিম। ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন ফারজানা বেগম। ফাহিমকে এভাবে হহন্তদন্ত হয়ে রুমে যেতে দেখে তিনি চমকে যান। আরো চমকে যান ইভানাকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ঢুকতে দেখে। ইভানার কাছে এসে জানতে চায়,

‘কি হইছে? তুমি এইভাবে কাঁদতাছ ক্যান?’
ইভানা ফারজানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অতঃপর তাকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে ফারজানা বেগম ইভানাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘তুমি চিন্তা কইরো না। দেখবা সব ঠিক হইয়া যাব।’

ধরনীতে এখন সন্ধ্যা নেমেছে। ইভানা ফারজানা বেগমের রুমে আসে। সে প্রায় দুই তিনবার নিজেদের রুমে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফাহিম দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। তাই ইভানা যেতে পারে নি।
ফারজানা বেগম ইভানার এমন পরিস্থিতি দেখে বলেন,

‘তুমি যা কইরছ তা অন্যায়। আমার ফাহিম তোমার লিগা কত কিছু করে। আর তুমি পরীক্ষায় নকল কইরা ওর মান সম্মান, বিশ্বাস সব নষ্ট করছ। মনে আছে তুমি খারাপ রেজাল্ট করছিলা জন্য কত অপমানিত হইছিলা? তাই তো ফাহিম চাইছিল যেন তুমি ভালো রেজাল্ট কইরা সবাইকে দেখাই দিতে পারো।’
ইভানা তীব্র অনুশোচনা নিয়ে বলে,

‘আমি জানি, আমি ভুল করেছি। এমন আর কখনো করব না। এখন থেকে মন দিয়ে পড়বো।’
‘এইসব আমায় বইলা লাভ নাই। ফাহিমরে গিয়া কও। এখানে আর বসি থাকিও না। ফাহিমের রাগ ভাঙ্গনের চেষ্টা করো।’

ফারজানা বেগমের কথা অনুযায়ী ইভানা নিজেদের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বুকভরা সাহস নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। কিছু সময় পর ফাহিম এসে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সে একটিবারের জন্যেও ইভানার দিকে তাকায় না। ইভানা ভিতরে এসে বসে কিন্তু ফাহিম তার সাথে কোন কথা বলে না। ইভানা সাহস যুগিয়ে ফাহিমকে বলে,
‘আপনি কি আমার সাথে কথা বলবেন না?’

‘কেন কথা বলবো আমি? আমি কে হই তোমার? যদি আমাকে নিজের ভাবতে, আমার সম্মানের দাম দিতে তাহলে এমন করতে পারতে না।’
ফাহিমের কানে হাত দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কানে হাত দিয়ে বলে,
‘আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো এমন করবোনা। ভালো করে পড়ব। এরপরের পরীক্ষাগুলোয় ভালো রেজাল্ট করব পরিশ্রম করেই।’

ফাহিম আর রাগ করে থাকতে পারে না। ইভানাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কেন তুমি এমন করলে ইভানা? তুমি এমন করায় আমি কত কষ্ট পেয়েছি তুমি জানো?’
‘আমি খুব লজ্জিত। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। অনুশোচনা হচ্ছে খুব।’
‘চিন্তা করো না। প্রিন্সিপাল কল করেছিল। তোমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয় নি। আরেকটা সুযোগ পাচ্ছ তুমি। এরপর আর কখনো এমন ভুল করিও না।’

‘কখনো না। এখন থেকে আমি পড়ে পরীক্ষা দিতে যাব। যতটুকু পারবো ততটুকুই লিখব কিন্তু আর কখনো এমন কাজ করব না।’
ফাহিম ইভানার কপালে চু’মু দিয়ে বলে,
‘এই তো আমার ভালো বউয়ের মতো কথা।’
ইভানার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে ওঠে। ফাহিম ইভানার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘তুমি পড়াশোনা করে সবাইকে দেখিয়ে দিও। আমি জানি তুমি এইচএসসিতে অনেক ভালো রেজাল্ট করবে।’
ইভানা বলে,

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৩২

‘আপনি আমার উপর আর রাগ করে নেই তো?’
‘রাগ একটু আছে, তবে তুমি যদি এখনই পড়তে বসো তাহলে আর থাকবে না।’
ইভানা হেসে ফেলে। অতঃপর পড়তে বসে। ফাহিম ইভানার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ভুল মানুষ মাত্রই হয়। আর সেই ভুল থেকেই সবাই শিক্ষা নেয়। আশা করি এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তুমি জীবনে এগিয়ে যাবে।’

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৩৪