কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৫

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৫
লাবণ্য ইয়াসমিন

একটা পাপ থেকে অগণিত পাপের সূচনা হয়। মিথ্যা মানুষকে সত্যি ধ্বংস করে। রিজু সম্পত্তির লোভে অরিত্রীর সঙ্গে অন্যায় করেছিলো অথচ গালিবকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই ঠকে গেলো। ক্ষমতা আর সম্পত্তির লোভ ওকে ধ্বং/সের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। অরিত্রীর লা/শ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী মৃ/ত্যুর আসল কারণ সামনে আসলেও লা/শের শরীরে আগুন লাগিয়ে তথ্য গোপন এবং খু/নের সন্দেহে ওকে আইনি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

লা/শ বাংলাদেশের পথে যাত্রা করেছে। সিকদার ভিলা এখন শোকের পসরা সাজিয়ে বসেছে। সেখানে বিবাহের আলোচনা বা উৎসব একেবারেই বেমানান। তাছাড়া মাহিম নিখোঁজ। ওর খোঁজ মিলছেনা। মাহিমের ছোট ভাই দিশেহারা অবস্থা। ভাই আর বাবার এহেন পরিণতি সঙ্গে খু/নের রহস্য। সম্পত্তি হাতছাড়া হচ্ছে। কোনটা রেখে কোনটা সামলাবে বুঝতে পারছে না। এতদিন যারা পাশে ছিল তারা বিপদের দিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মাথার উপরে কেউ নেই যে ওকে সঠিক রাস্তা বলে দিবে। কহিনুর ওদের কথা ভেবে মলিন হাসলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লোকেরা পাপ করার আগে নিজের কথা ভাবেনা। অন্ততপক্ষে নিজের পরিবারের কথা ভেবে হলেও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। অরিত্রী নিজের পাপের শাস্তি মৃ\ত্যুর পরেও ভোগ করবে এটা নিশ্চিত। আত্মহ/ত্যা যে মহাপাপ। কহিনুরের বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। সামনে পূর্ণিমা হাতে সময় নেই। ওকে যেতে হবে। একবার যদি ওর মধ্যে থেকে কহিনুরের শক্তি বিলুপ্ত হয় তবে সুলতান পরিবার ধ্বং/স হয়ে যাবে। কালো জাদু সুলতান পরিবারে আবারও রাজ করবে যখন কিছুতেই আটকানো যাবেনা। সাঈদ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মাথায় নানারকম চিন্তা ঘুরছে। নির্জনতা কাটিয়ে কহিনুর বলে উঠলো,

তোমার কি মনে হয় অদৃশ্য ওই লোকটার সঙ্গে আমি পারবো? সাঈদ মাঝেমাঝে জিততে হলে হার মানতে হয় কথাটা বিশ্বাস করো?
সাঈদ লাফিয়ে উঠলো। ভ্রু কুচকে উত্তর দিলো,
মস্তিষ্ক থেকে এমন ভাবনা ঝেড়ে ফেলো নূর। আমি কিছুতেই তোমাকে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দেখতে পারবোনা। হার মানার কথা চিন্তাও করোনা। আমাকে ভাবতে দাও। তাছাড়া জনাবের তৈরী প্রাণনাশক ওষুধ সেতো আছেই।

যাকে প্রয়োজন তাকেই যদি না পাই তবে অন্যদের প্রাণ নিয়ে আমাদের কি লাভ শুনি?লোকটা ক্ষতবীক্ষত অর্ধগলিত দুর্গন্ধযুক্ত শরীর আর মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুরছে অথচ কি বুদ্ধি। ওকে পেলে আমাদের সকলের জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে। আমি টেনশন নিয়ে বাঁচতে চাইছি না। হয় ম/রবো নয়তো মা/রবো। আমি দেখতে চাই এই পূর্ণিমাতে আমার সঙ্গে কি হয়। তাছাড়া ওই লোকটার প্রাণ নিতে হলে আমাকে ওখানে যেতে হবে।

তুমি একা না আমিও যাচ্ছি। মনে রেখো কহিনুর যতক্ষণ তোমার মধ্যে আছে ততক্ষন আমি তোমার সঙ্গে আছি। সিদ্ধান্ত নেবার আগে একবার না দশবার ভেবে নিবে। তোমার হাতে অনেকের দায়িত্ব রয়েছে।
সাঈদ যতটা পারে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু মেয়েটা বুঝলে হয়। ওর মনে বারবার খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কা হচ্ছে। বিপদ কিভাবে আসবে আল্লাহ ভালো জানে। ওদের আলোচনার মধ্যে হুড়মুড় করে দরজা খুলে আলফা আর দৃষ্টি ভেতরে প্রবেশ করলো। সাঈদ লুকানোর চেষ্টা করলেও লাভ হলোনা। ওরা দেখে নিয়েছে। কহিনুর নির্বাক বসে আছে। আলফা গিয়ে ওর পাশে বসলো। মুখটা ভার করে বোনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

বিয়েটা হচ্ছে না বলে চিন্তা করোনা আমি ওর থেকেও ভালো ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিব। রিজু আঙ্কেল যেমন উনার ছেলেদুটোও তেমন।ওদের কথা ভেবে মন খারাপ করার মানে হয়না।
আলফার কথা শুনে কহিনুরের কপালে ভাজ পড়লো। বিয়েটা একটা চাল ছিল। কহিনুর নিজের কাজে সফল তাই মন খারাপের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো কি আর সেসব জানে? বিয়ে ভেঙেছে বলে বোনের মন খারাপ ভেবে ছুটে এসেছে বোনকে সান্ত্বনা দিতে। কথাগুলো ভেবে ওর বেশ ভালো লাগলো। তাই সামান্য হেসে উত্তর দিলো,

আমি পূর্ব থেকেই জানতাম বিয়ে হবে না। তাছাড়া বিয়ে হচ্ছেনা বলে আমি কষ্ট পাচ্ছি না। বিবাহিত মেয়েদের পূণরায় বিয়ে হয়না। তবে অনুষ্ঠানে থামানোর প্রয়োজন নেই বিয়ে হবে। কবে একবার অচেতন অবস্থায় বিয়ে করেছিলাম প্রায় ভুলে গেছি। এবার খুশী খুশী মনে সবাইকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করবো বুঝলে? সত্যি আমি বিবাহিত। ইমরোজ খান পাথর নামের সুদর্শন যুবক এই বাড়ির জামাই।
কহিনুর কথা শেষ করতেই দৃষ্টি ওকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা খুশীতে লাফিয়ে উঠে বলল,

আপি আমি এটা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছিলাম যে ভাইয়ার মতো ছেলেকে রেখে তুমি ওমন খারাপ একটা ছেলের সঙ্গে কেনো বিয়েতে রাজি হলে। ইমরোজ খান সত্যি লোকটা ভালো। জার্মানির মতো রাষ্ট্রে বসবাস করে অথচ নেশা জাতীয় কোনো তরলে আসক্তি নেই ভাবো একবার? লোকটা মানুষের সাহায্য করে। সুপার হিরোদের মতো। দেখতে কতটা সুন্দর অথচ মেয়েরী ঝামেলা নেই। তোমার জন্য একদম ঠিকঠাক।
কহিনুরের ওষ্ঠে চমৎকার হাসি দেখা গেলো। স্বামীর নামে গুণগান শুনতে কার না ভালো লাগে। আলফা এতোক্ষন চুপচাপ ছিল হঠাৎ সাঈদকে দেখে ওর ভ্রু কুচকে গেলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

এই ছেলেটা কি সত্যি তোমার ফ্রেন্ড? ওকে খেতে দাওনা নাকি, এমন চিকন কেনো?
সাঈদের মুখ চুপসে গেলো ওর কথা শুনে। ওতো যথেষ্ট পরিমাণে আহার গ্রহণ করে কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়না। শরীর যেমন ছিলো তেমনই থাকে। ইচ্ছে করলেই কি মোটা হওয়া যায়? তাছাড়া ওরতো ঠিকই লাগে এই মানুষগুলোই শুধু বাড়াবাড়ি করে। তাই মুখ ভার করে উত্তর দিলো,
তোমরা মানুষেরা আমার শরীর নিয়ে কেনো এমন কমেন্ট করো শুনি? আমার পরিবর্তন এভাবে হবে না। আগামী কয়েক যুগ হয়তো অপরিবর্তনীয় থাকতে হবে। তারপর যদি চেঞ্জ হয়।
কয়েক যুগের কথা শুনে দৃষ্টির চোখ গোল হয়ে গেলো।

আপনি কি সত্যি ভুত? আমিতো প্রথমে বিশ্বাস। করিনি আল্লাহ আপনি ভুত? তাইতো বলি এইটা এমন অদ্ভুত কেন।
দৃষ্টির বলার ধরণ শুনে সাঈদ উঠে গেলো। এরা দুই ভাইবোন ওকে পচাতে শুরু করেছে থামবে না। উল্টোপাল্টা বলেই যাবে। কহিনুর বোনকে শান্ত করতে বলল,
ওকে সরি বলো দৃষ্টি। ছেলেটা আমার সঙ্গে অনেক বছর থেকে আছে। আমার মনে হয় তুমি সবটা শুনেছো আমার জন্ম রহস্য আর ওর সম্পর্কে।
দৃষ্টি মাথা ঝাকালো সে সবটা জানে। সাঈদকে নিয়ে মজা করতে ওর ভালো লাগে তাই এভাবে বলেছে। ছেলেটা রাগে না তাই রাগানোর চেষ্টা করছে। সাঈদ সম্পর্কে বিস্তারিত গতকাল অধরা ওকে বিস্তারিত বলেছে। আলফা বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

বাদ দাও ওর কথা। বুদ্ধির ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই। গতকাল থেকে জ্বালিয়ে মারছে। আমার পিছু ছাড়ছে না। ওরে বিয়ে দিয়ে একটা দারোয়ান আনবো ভাবছি।
দৃষ্টি ঠোঁট ফুলিয়ে ছলছল চোখে উত্তর করলো,
তুমি একদম ভালো না ভাইয়া। ভয় লাগে বলেইতো তোমার সঙ্গে থাকি সেটা নিয়েও কথা শোনালে? আমি দারোয়ান ছেলেকে বিয়ে করবো না।
দৃষ্টির মন খারাপ করতে দেখে কহিনুর চোখ রাঙালো। আলফা হেসে উঠে বলল,

আরে মজা করছিলাম। ওর বিয়েতে আমি স্বয়ংবর সভা বসাবো। যেমন তেমন ছেলে সুলতান আলফা ফারুকীর বোনকে বিয়ে করবে এটা মানবো আমি? কখনও না। এতোটা যত্নে বড় করেছি কি দারোয়ানের জন্য শুনি? বিশ্বের সেরা ছেলেদের লাইন লাগিয়ে দিব।
দৃষ্টি খুশি হলো। বাইরে পাথর এসেছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। পর্দার নিচ থেকে ওর পা দেখা যাচ্ছে। কহিনুর কৌশলে ভাইবোনদের বিদায় করে সেদিকে এগিয়ে গেলো। লোকটা ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে নাকি সংকোচ করছে কে জানে। কহিনুর বাইরে আসতেই পাথর ওকে ডান হাতে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

জানেমান কি খবর শুনি? ভাইবোনদের নিয়ে আড্ডা বসিয়ে বরকে ভুলে গেছো? রোমাঞ্চকর কিছু দেখাই তোমাকে কাছে আসো।
কহিনুর কিছু বোঝার আগেই পাথর ওকে রেলিং এর কাছে টেনে নিয়ে নিচের দিকে ইশারা করলো। বাগানের দোলনায় জুবায়ের অধরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা চলছে কিন্তু বেশ মুডে আছে জুবায়ের। কহিনুর সেদিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে বলল,

বাবা মায়ের গুরুত্বপূর্ণ আলাপন চলছে আপনি নজর দিচ্ছেন কেনো? কাজটা ভালো হচ্ছে না। লজ্জা থাকা উচিত।
পাথর কপাল চাপড়ে বলল,
শাশুড়ি আম্মা সত্যি জাদু জানেন। শশুর সাহেব যেই লোক কথায় কথায় মানুষকে থা/প্পর দিতে উস্তাদ তাকে বশ করে নিয়েছে ভাবা যায়? কিছুতো মায়ের থেকে শিখতে পারতে নূর?তাহলে অন্ততপক্ষে আমাকে ছ্যাঁচড়ামি করে বেহায়া হতে হতোনা।
পাথর ওকে টেনে কক্ষে নিয়ে আসলো। সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে পূণরায় বলল,

চুল টেনে দাও যন্ত্রণা করছে। ইদানীং যখন তখন মাথায় যন্ত্রণা করে। আগামীকাল পূর্ণিমা মনে আছে?
কহিনুর আনমনে উত্তর দিলো,
মাহীমকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে সরানো হয়েছে। আমি যায় করবো আপনি সাপোর্ট করবেন তো? জাদুলিপি হঠাৎ পরিবর্তন হয়েছে যেটা পূর্বে কখনও হয়নি।
পাথর কথাটা শোনা মাত্র উঠে বসলো। চিন্তা হচ্ছে কিন্তু ঘাবড়ালোনা। কহিনুরের মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে টেনে নিয়ে বলল,

চিন্তা করোনা।আমি আছিনা? সব ঠিক করে দিবো।শুধু এইটুকু অনুরোধ নিজের খেয়াল রাখবে। তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত আমার কাছে মৃত্যু সমান। পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে বাবা আর তুমি ছাড়া কেউ নেই নূর। তোমাকে নিয়ে হাজার বছর না অল্প কিছুদিন হলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে চাই। তোমাকে ভালোবেসে আরও আপন করতে চাই। কতশত ইচ্ছে বাসনা আমার মধ্যে দিনরাত গুমড়ে মরে যদি একবার দেখতে পেতে তবে বুঝতে আমার বোবা অনুরক্ত হূদয়ের হাহাকার। যদি লুকিয়ে রাখার মতো হতো কবেই তোমাকে নিজের হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। ভীষণ আফসোস হয় যদি স্বাভাবিক মানুষের মতো তোমাকে কাছে টানতে পারতাম। কেনো পারিনা বলোতো?

পাথরের চোখে পানি চিকচিক করছে। কহিনুর চুপচাপ ওর কথা শুনছিলো হঠাৎ ফুপিয়ে উঠলো। রোবটের মতো জীবনযাপন করতে হচ্ছে যেখানে মায়া মমতা সব অর্থহীন। দুজনে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। নীরবতার মধ্যেও কতশত কথা আদান প্রদান চললো জানা নেই। কহিনুর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এই অভিশপ্ত জীবন থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবে। কষ্ট পেয়ে যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু ভালো।

মেঘমুক্ত নীল আকাশের কোণে পূর্ণিমা চাঁদ ঝলমল করছে। ধরণীর উপরে জোছনার আলো আছড়ে পড়েছে। দক্ষিণা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ জোয়ারের জন্য পালগামিতে মেতেছে। কহিনুর চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে। সাঈদ ওর সঙ্গে নেই। হেকিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। পাথর খান মঞ্জিলে বিয়ে নিয়ে পূণরায় আলোচনা করছে। কেউ জানেনা আজ কহিনুর কি করতে চলেছে কথাটা ভেবে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। দুহাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করতেই দূর থেকে মাংস পচা গন্ধ ওর নাকে এসে আঘাত করলো। তীব্র থেকে সেই গন্ধ আরও তীব্রতর হলো। কহিনুরের ওষ্ঠে হাসি মিলিয়ে গিয়েও মিলাতে পারলোনা। নিজের ভাগ্যের উপরে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিটা আজ বারবার ওষ্ঠ জুড়ে বিরাজ করছে।

আবহাওয়াটা দারুণ তাইনা?
পুরুষালী আওয়াজ শুনে কহিনুর ঝট করে চোখ খুঁলে পাশ ফিরে চাইলো। সেদিনের সেই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজও মুখের মাস্কটা দৃশ্যমান। কহিনুর ভ্রু কুচকে উত্তর করলো,
চমৎকার কিন্তু গন্ধটা ভীষণ বাজে। ওইযে ইদুরের গায়ে সুগন্ধি আতর নিলেও নাকি দুর্গন্ধ যায়না তেমন। সুন্দর পরিবেশ ওই গন্ধে থমকে গেলো। সৃষ্টির সুন্দরকে কিভাবে অসুন্দর আর অপবিত্র করতে হয় সেটা খুব ভালো জানে কিছু লোক।
কথার সুক্ষ খোচা শুনে ছেলেটা খানিকটা রেগে গেলো মনে হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। কহিনুরের তীক্ষ্ণ অপমানের জবাবে বলল,

সুমিষ্টি ফল খেতে সকলেই পছন্দ করে এটা নতুন কিছু না। আর খারাপ ভালো সবটাই কিন্তু সেই একজনের সৃষ্টি। যাইহোক সুন্দরী তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করোনি। গতকাল ধোকা দিয়ে আমাকে বশ করেছো সঙ্গে মোহকে আজেবাজে জিনিস দেখিয়ে বেচারিকে কষ্ট দিয়েছো। শতহোক সে তোমার মারিয়া ফুপির মেয়ে। র/ক্তের সম্পর্কের চেয়ে হৃদয়ের সম্পর্ক অনেক জটিল হয়। তোমরা মানুষেরা হৃদয় ঘটিত বিষয়ে আরও পারদর্শী। আমার আবার সুন্দরীদের কষ্ট সহ্য হয়না। আচ্ছা বাদ দাও ওসব ভেবে এই সুন্দর পরিবেশটাকে নষ্ট নাই করি। ভীষণ ইচ্ছে জেগেছে পৃথিবীর সুন্দরতম ফুলের সুবাস নিয়ে নিজেকে ধণ্য করবো।
ছেলেটা এক হাত পকেটে রেখে অন্য হাত নিজের কাধে রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছে। ওষ্ঠ জুড়ে রহস্যময় হাসি। কহিনুর সেদিকে চেয়ে বলল,

ইচ্ছে করলেই সেটা পূরণ হবে এমন না। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো কতটা যুক্তিপূর্ণ আমার জানা নেই। তবে হাত পুড়ে যাবে এইটুকু নিশ্চিত।
ছেলেটা শব্দ করে হেসে উঠলো। পায়ের গতি বাড়িয়ে কহিনুরের নিকটবর্তী হয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,
পুড়লেও আফসোস হবে না। ছোঁয়া দিয়েছি ভেবে অন্তরকে আজীবন সান্ত্বনা দিব এটাই কমকিসে? আমি অনুরোধ করিনা যেটা পছন্দ হয় ছিনিয়ে নিয়ে সুবাস নিতে পছন্দ করি। বিশ্বাস করো তোমাকে যতবার দেখেছি ততবার বুক ধড়ফড় করেছে। একবার হলেও ছোঁয়াটা ভীষণ প্রয়োজন।
লোকটা কথা বলতে বলতে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই কহিনুর নিজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলল। হাতের খঞ্জরটা তুলে ধরে বলল,

সাহস করোনা প্রাণ নিয়ে ফিরবে না।
ছেলেটা হাসলোনা এবার। কিছু একটা ভেবে দুম করে কহিনুরের দিকে ধারালো ছোট একটা খঞ্জর ছুড়ে দিলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে সবটা ঘটে গেলো। কহিনুর পিছিয়ে এসে পেটে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। ফিনকি দিয়ে উষ্ণ তরল চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। যেটা ভয় পেয়েছিলো সেই হয়ে গেলো। কহিনুর ঠোঁট চেপে পেটে হাত রেখে র/ক্ত বন্ধ করতে চাইলো। ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে পেটের কাটা জায়গা ঠেসে ধরে খঞ্জরটা তুলে ফেলে দিলো। শরীর টনটন করছে যন্ত্রণায়। মস্তিষ্ক শূণ্য শূন্য লাগছে। চন্দ্র গ্রহণ শুরু হয়েছে।

ছেলেটা শব্দ করে হেসে চন্দ্রের দিকে চেয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলো। বিন্দু বিন্দু রক্ত বালুচরে পড়ে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। কহিনুর পা দ্বারা জমাটবদ্ধ রক্ত এলোমেলো করে দিচ্ছে। এক করতে দিচ্ছে না। হঠাৎ ওর চারপাশে আলোকরশ্মি বলয় ওকে আকারে ঘিরে ধরলো। কহিনুর অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। এমন সময় পাথরের কণ্ঠে ওর কানে এসে ধাক্কা লাগলো। বলয় ভেদ করে বাইরের কিছু দেখার উপাই নেই। শুধু কাকুতি আর অনুরোধ শুনতে পেলো। পাথরের দিশেহারা অবস্থা। মেয়েটাকে কতবার নিষেধ করেছে তবুও শুনলোনা। চাপা অভিমান জন্ম নিলো কিন্তু এখন সেসব পাত্তা দিলে চলবে না। ছেলেটা মন্ত্র উচ্চারণ করেই চলেছে থামার লক্ষণ নেই। পাথর ছেলেটা কাছে যেতে পারছে না তাই চিৎকার করে বলল,

সাঈদ শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? কোথায় তুমি? ওকে থামাতে সাহায্য করো প্লিজ।
পাথরের আওয়াজ সমুদ্র পৃষ্টে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলো কিন্তু উত্তর আসলোনা। ও নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছেলেটাকে আঘাত করতে গিয়ে হাপিয়ে উঠেছে। কহিনুরের শরীরের বিন্দু পরিমাণ রক্ত অবশিষ্ট থাকলেও জেনো চলবে না আজ। হঠাৎ এমন সময় সাঈদের আগমন ঘটলো। ছেলেটা নির্বাকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে উদাসীন ভাব। পাথর ছুটে গিয়ে বলল,
কহিনুরের রক্ষক না তুমি? ওকে বাঁচাও প্লিজ।
সাঈদ রোবটের ন্যায় উচ্চারণ করলো,
ক্ষমা করবেন। আমি শুধুমাত্র পাথরের মালকিনের হুকুম মানতে বাধ্য অন্য কারোর না। পাথর যতক্ষণ নূরের ছিলো আমি ততক্ষণ ওকে সাহায্য করেছি এখন পারবো না।

সাঈদের কথা শুনে পাথর হতভম্ব হলো। এই জন্যই জ্বীন ভুতের উপরে ওর বিশ্বাস নেই এদের পাল্টিখেতে সময় লাগেনা। এতোদিনের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। পাথর দিশেহারা হয়ে পড়লো। শরীর যন্ত্রণা করছে। মাথা ভার হয়ে আসছে। তাই চোখ বন্ধ করে নিলো। রাগ হচ্ছে সকলের উপরে। মূহুর্ত্তের মধ্যে ও পরিবর্তন হতে শুরু করলো। হাতের থাবায় বড়বড় নক গজিয়ে উঠলো। শরীরের লোমকূপ দীর্ঘ হলো। সাঈদ এখনো চুপচাপ আছে। কহিনুর ইতিমধ্যে বালিমাটিতে পড়ে গেছে। জ্ঞান নেই। পাথর ঝাপিয়ে পড়লো আলোকরশ্মির দিকে। কহিনুরের শরীরটাকে তুলে নিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বড়বড় থাবা ফেলে ছুটে চললো দিগন্তের দিকে। ছেলেটা মন্ত্র উচ্চারণ বন্ধ করে সেদিকে চেয়ে ছুটে গেলো। বালিমাটিতে যে একটা চকচকে পাথর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সেদিকে দৃষ্টি পড়লোনা।

সবুজ ঘাসের উপরে কহিনুরের অচেতন শরীর পড়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। পাথর ওকে রেখে আবারও ছুটে চললো সেই পাপি জালিমের দিকে যার জন্য প্রিয়তমার এহেন অবস্থা। কিছুতেই ছাড়বে না ওই নরাধম পাপিকে। কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে হৃদয়ে সেটা শুধু ওই জানে। খানিকটা যেতেই ছেলেটার সঙ্গে ওর দেখা হলো। পাথর ঝাপিয়ে পড়ে ওর মুখোশ খুলে নিলো। মুখোশের আড়ালে পরিচিত মুখ দেখে কিছুটা থমকে গিয়েও সামলে নিয়ে দাঁতের অগ্রভাগ বসিয়ে দিলো ওর কাঁধে। মাহিম পিছিয়ে গিয়ে বলল,

সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুমি বোকামি করছো ছেলে?ওকে হাছিল করতে আমি কতগুলো যুগ অপেক্ষা করছি তোমার ধারণা আছে? প্রমিজ করছি ওকে আমার হাতে তুলে দাও আমি তোমাদের পরিবারের উপরের উপরে আজীবন আর্শীবাদ রাখবো। অমরত্ব লাভ করবে। মৃত্যুর ছোঁয়া তোমাকে স্পর্শ করবে না। আমাকে বিশ্বাস করো।
পাথর হিংস্র হয়ে উঠলো। গর্জন করে প্রতি কথার উত্তর দিলো,

তুমি কি আমার সৃষ্টিকর্তা? জন্ম মৃত্যুর সেতো আমার বিধাতা আমার ললাটে যেমন লিখেছেন তেমনি হবে তাহলে তোমার মতো অর্বাচীন শয়তানের কথা বিশ্বাস করবো কেনো? কহিনুর আমার অর্ধাঙ্গী আমার বেঁচে থাকার কারণ। প্রয়োজন নেই আমার অমরত্বের। এক সঙ্গে এক প্রহর বাঁচবো তবুও ওকে আমার বাঁচাতে হবে।
বোকামি করছো। তোমার দাদু কিন্তু তোমাকে ছাড়বে না।

পাথর অযথা সময় নষ্ট করলো না। হাতের নখে লুকিয়ে রাখা গরলখানি সুক্ষভাবে আচড়ের সাহায্যে ওর শরীরে ঢুকিয়ে দিলো। এই শয়তান গতবার আদির শরীর দখল করে ওকে বরবাদ করেছিলো এবার মাহীমের পালা। তবে এবারেই শেষবার আর কখনও এই পচা শরীর নিয়ে শয়তানটা কারো শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। পাথর ঝটপট কাজ শেষ করে আবারও পাহাড়ের উপরে ফিরে গেলো কিন্তু ততক্ষণ নতুন ঝামেলার এসে হাজির। কহিনুরের শরীরের উপরে উন্মুক্ত শাণিত তরবারি হাতে সাঈদ দাঁড়িয়ে আছে। ওর থেকে দূরে প্রহেলীকা আর ওর স্বামী ওকে নির্দেশনা দিচ্ছে। প্রহেলিকার হাতে কহিনুর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। পাথর দ্রুত নিজের রূপে ফিরে আসলো। দৌড়ে গিয়ে সাঈদের সামনে হাত জোড় করে বলল,

ওকে ছেড়ে দাও সাঈদ। প্লিজ ওকে আমার হাতে তুলে দাও আমি কথা দিচ্ছি ওকে নিয়ে তোমাদের দৃষ্টির অগোচরে লুকিয়ে যাবো। আমাদের দেখা পৃথিবীর কেউ কখনও পাবেনা। প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও। রক্তক্ষরণ হচ্ছে বন্ধ করা প্রয়োজন। তুমি না নূরকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে তবে এখন কেনো এমন করছো? আমি মরে যাব ওকে ছাড়া প্লিজ রহম করো। আল্লাহর দোহায়। উনি দেখছেন সবটা। প্লিজ সাঈদ।

পাথর কাকুতি মিনতি করতে শুরু করলো। অজানা অশঙ্কাতে শরীর থরথর করে কাঁপছে। কিভাবে মেয়েটাকে বাঁচাবে মাথায় আসছে না। এই সাঈদকে হাতে একবার পেলে উচিৎ জবাব দিতে ও ছাড়বে না। শুধুমাত্র একবার সুযোগ আসুক। পাথর মনে মনে ফুলে উঠলো কিন্তু মুখে অন্যটা বলছে। পাথরের কথায় সাঈদ তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে উত্তর দিলো,
আমি কহিনুরের গোলাম কোনো সাধারণ মানুবির না। কহিনুর যতক্ষণ ওর ছিল আমি ততক্ষণ ওকে রক্ষা করেছি। প্রহেলিকা আমার মালকিন আমি ওর কথা শুনতে বাধ্য। আর আল্লাহ জানেন আমি ওয়াদাবদ্ধ। কথা দিয়ে কথার খেলাপ করিনা।

প্রাণ নিয়ে তুমি নিজের ওয়াদা পূরণ করছো ছেলে? শয়তান আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কোথায় শুনি? জালিম শয়তান আল্লাহ তোমাকে কখনও ক্ষমা করবেন না। প্লিজ আমার অনুরোধটুকু রাখো। প্রয়োজনে আমাকে মেরে ফেলো তবুও ওকে বাঁচতে দাও। ওকে ছাড়া আমি এমনিতেও মরে যাব সাঈদ। আমাদের ভালোবাসা আশা আকাঙ্ক্ষার কিছুই পূর্ণতা পাইনি।এই অপূর্ণতা নিয়ে যুগযুগ বেঁচে থাকার অভিশাপ থেকে অন্তত মুক্তি দাও। ওকে ছেড়ে দাও।

কি ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বলেছেন? এসবে কাজ হবে না। চন্দ্রের দিকে চেয়ে দেখুন এখনো গ্রহণ চলছে। এর মধ্যে যদি প্রহেলীকাকে হত্যা করতে পারেন তবেই আমি আপনার কথা শুনবো। প্রমিজ নূর সুস্থ হয়ে উঠবে সামান্য পরিমাণ ক্ষতিও হবে না কিন্তু যদি না পারেন তবে আফসোস এই জমিনেই কহিনুরের অন্তিম সময় উপস্থিত হবে।
সাঈদ নিজের কথায় অবিচল রইল। পাথরের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। প্রহেলিকা কহিনুর পেয়ে আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। সাঈদের সঙ্গে পাথরের আলোচনার বিন্দু পরিমাণ ওর কর্ণগোচর হলোনা।

খুব তাড়াতাড়ি পাহাড়ের উপর থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হাতের তালুতে পাথরখানার রশ্মি আশেপাশের এলাকা পযর্ন্ত আলোকিত করে তুলছে। কহিনুর নিজের রক্তের সঙ্গে কিভাবে মিশিয়ে নিবেন এই সম্পর্কে ওর ধারণা নেই। এটা নিয়ে ভাবতে হবে তাই এখান থেকে যাওয়ার এতোটা তাড়া। পাথর সেদিন চেয়ে পূণরায় কহিনুরের দিকে তাঁকারো। বুকের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৪

জাদুলিপিতে ওতো কহিনুরের প্রাণ চেয়ে নিয়েছিলো তবে কেনো এমন হলো? কহিনুরের বিনিময়ে নিজেদের অস্তিত্বের বলিদান পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলো। বলেছিলো নিজের স্ত্রীর প্রাণ চেয়ে বিনিময়ে সন্তান সুখ থেকে আমি বঞ্চিত হতেও রাজি। জাদুলিপির শয়তান তবে কি ওর সঙ্গে বেইমানি করলো? পাথর ভাবতে পারছে না। যেভাবেই হোক প্রহেলিকাকে হত্যা করা অবশ্যক। হাতে সময় তিন মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড। পাথর কি পারবে প্রহেলিকাকে হত্যা করতে?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৬