খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১০

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১০
আভা ইসলাম রাত্রি

চিত্রা মাটির চুলোয় চা বসিয়েছে। পাশে লাকড়ি এগিয়ে দিচ্ছে একজন ভৃত্য মহিলা। চিত্রার শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে আছে নোংরা মাটিতে। ভৃত্য আঁচল তুলে দিল। বলল,
‘সাবধান ভাবিজান, আঁচল পুইড়া যাইব।’
চিত্রা ভৃত্যের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। কিছুক্ষণ চুলোয় লাকড়ি নেড়েচেড়ে বলল,
‘হালিমা বুবু? এ বাড়ির মানুষ সম্পর্কে তুমি কি জানো? আমাকে একটু বলো তো।’

ভৃত্য চিত্রার মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে চমকে উঠল যেমন। চোখ কোটরাগত হবার উপক্রম। যে নারীকে শুদ্ধ ভাষায় শেখানোর জন্যে এ বাড়ির সবাই মরিয়া হয়ে আছে, সে নারী আজ ঝরঝর করে শুদ্ধ ভাষা বলতে দেখে ভৃত্য হতভম্ব। ভৃত্য বিস্ময় নিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ভাবিজান শহরের ভাষা শিইখা ফেলছেন? এ আমি কি শুনতেছি বাপ?’
চিত্রা ভৃত্যের এমন হইচই শুনে হেসে উঠল শব্দ করে। খাট টেনে ভৃত্যের দিকে মুখ করে বসল। একহাতের তালু থুতনিতে ঠেসে বলল,
‘আমি কি পুরো শহরের ভাষায় কথা কই-বলছি, হালিমা বুবু?’
হালিমা বিস্ময় নিয়ে মাথায় হাত রেখে বলল,
‘আল্লাহর কসম ভাবিজান, আমি সইত্য কইতাছি আফনার মুখে শহরের ভাষা শুইনা আমার নিজের কানরেই বিশ্বাস হইতেসে না!’

চিত্রা হেসে উঠল। দিনরাত তার কষ্ট করে শুদ্ধ ভাষা চর্চা স্বার্থক তবে। চিত্রা আবার চা বানানোতে মন দিল। হালিমা কিছুটা স্বাভাবিক হল। চিত্রার দিকে পাতার ঝুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ভাইজানের লাইগাই শিখেছেন শহরের ভাষা, তাইনা ভাবিজান?’
চিত্রা কিছুটা অন্যমনস্ক হল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘তিনি কখন আই-আসবেন, বুবু? সপ্তাহ তো পেরিয়েই গেল।’

হালিমা হয়ত শুনল চিত্রার মনে মনে বলা কথাটুকু। হালিমা পাশ থেকে হেসে বলল,
‘ভাইজানের অনেক ভাগ্য ভাবিজান, তিনি আফনার মত বউ পাইসেন।’
চিত্রা গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি যেন মনের অগোচরে মনের সঙ্গে হিসেব কষছে। চিত্রা আগের ন্যায় অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিল,
‘উনার না, আমার ভাগ্য উনাকে স্বামী হিসেবে পাই-পেয়ে!’
হালিমা পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ,

‘চা উপচাইয়া পরতাসে গো, ভাবিজান।’
মুহূর্তেই চিত্রা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল। দ্রুত চা কাপে ঢেলে নিল। একহাতে কাপ নিয়ে, অপর হাতে মাথায় আঁচল তুলে চলল নওশাদ আয়ুষ্মানের ঘরে।

নওশাদ আয়ুষ্মান আপাতত কদিন বিছানা থেকে উঠবেন না। কদিন আগে গাঁয়ের এক মারামারির কারণে কেউ তার পায়ে ব/টির কো/প দিয়েছে। পায়ের ওই জায়গায় সদরের ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। আপাতত তিনি বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। পায়ের সাপে কাটার ক্ষত ঠিক হতে না হতেই আরেক বিপদ ঢেকে এনেছেন পায়ে। শেহজাদ জানেন না, জানলে তুলকালাম ঘটবে এ বাড়ি। সবাই তাই অপেক্ষা করছে শেহজাদের বাড়ি ফেরার।

অবশ্য যে এ কাজ করেছে, তাকে তাৎক্ষণিক সৌরভ আয়ুষ্মান পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং কড়া নজরদারি রাখছেন যেন সে সাজার সর্বোচ্চ স্তরের সঙ্গে পরিচিত হয়। কানাঘুষার শোনা গেছে,গ্রামের এ ঝগড়া শুধুমাত্র এক অজুহাত! একদল মানুষের ষড়যন্ত্র ছিল, ঝগড়ার সময়কালে শেহজাদ এলে তাকে খু/ন করেই পালাবে তারা। অথচ শেহজাদ এল না, এলেন নওশাদ এবং সৌরভ। তাই সুযোগ বুঝে তারা নওশাদের উপরেই আক্রমন চালায়। খুন করার ইচ্ছে থাকলেও, সৌরভ আয়ুষ্মানের কারণে কোনরকম পায়ে আঘাত করেই পালিয়ে যায় তারা। শেষঅব্দি পালিয়ে থাকতে সক্ষম হয় না তারা! পুলিশের ধাওয়ায় আটকা পরে।

বিকেল হলে নওশাদের চা প্রয়োজন। তাই চিত্রা চা নিয়ে গেছে তার ঘরে। নওশাদের ঘরে প্রবেশ করলে, চিত্রা দেখে নওশাদ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। চিত্রা তা দেখে দৌঁড়ে এগিয়ে গেল। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে আলগোছে নওশাদের হাতে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করল। নওশাদ চিত্রাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘আমি একাই পারব। কারোর সাহায্যের দরকার নেই।’
চিত্রা শুনে ভয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুটা মিনমিন করে বলল,
‘আব্বাজান, পায়ের ক্ষত সাই-সেরে গেলে আপনি একাই হাঁটতে পারবেন। কিন্তু এখন আপনার সাহায্যের দরকার। দয়া করে আমাকে সাহায্য কই-করতে অনুমতি দিন।’
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন চিত্রার দিকে। মেয়ে কি ঝরঝর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে! কোথা থেকে শিখল? শেহজাদ শিখিয়েছে? নওশাদের এমন চাওনি দেখে চিত্রা ভয়ে গুটিয়ে গেল। দু কদম পিছিয়ে মাথা নত করে বলল,

‘আমি…..’
‘ধরো আমাকে। আমি বারান্দায় যাব।’
নওশাদের অনুমতি শুনে চিত্রার মুখ ঝলমল করে উঠল। আলগোছে নওশাদের হাতে ধরে তাকে বারান্দার চেয়ারে নিয়ে বসাল। চায়ের কাপ বারান্দার ছোট টেবিলে রেখে দিল। চিত্রা এখনো নওশাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যদি কিছু প্রয়োজন হয়। নওশাদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বারান্দা দিয়ে উঠোনে থাকা হরেক রকমের গাছের দিকে চেয়ে রইলেন। একটু পর চিত্রার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে জানালেন,

‘তোমার কাজ শেষ, যেতে পারো তুমি।’
চিত্রা একপ্রকার শ্বাস আটকে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এতক্ষণ প্রাণ যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে দাড়িয়ে ছিল নওশাদের পাশে। ইশ! আজ কতগুলো কথা কিভাবে বলে ফেলল চিত্রা। এখন বুকের কাঁপুনি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি ভয়ে জ্ঞান হারাল চিত্রা।

দুই আয়ুষ্মান ভাই বাড়ি আসছেন! গ্রাম জুড়ে সাজ সাজ রব লেগে গেল। আয়ুষ্মান বাড়িতে বিরাট আয়োজন করা হচ্ছে। ঘরদোর পরিষ্কার করা হচ্ছে, হরেক রকমের খাবার রান্না করা হচ্ছে। চিত্রা রান্না করার ফাঁকে বারবার সদর দরজার তাকাচ্ছে। তিনি এখনো আসছেন না কেন? হঠাৎ উঠোন থেকে খবর এল,
‘ছোট ভাইজান, বড় ভাইজান আইসেন রে।’

চিত্রার বুক কেঁপে উঠল যেমন। দৌঁড়ে এগিয়ে যাবে, তবে আটকে গেল হঠাৎ। রেখা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখছেন চিত্রাকে। চিত্রা সঙ্গেসঙ্গে রান্নায় হাত দিল আবার। রেখা ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ছেড়ে ছোট দেবরের স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন সদর দরজার দিকে। হুইল চেয়ার করে নওশাদকে বসার ঘরে নিয়ে এলেন সৌরভ।
‘সালাম, আম্মাজান! আব্বাজান, সালাম। কেমন আছেন?’

মেহজাদ এগিয়ে গিয়ে পা ধরে সালাম করল সবাইকে। রেখা ছেলের দিকে অভিমান নিয়ে তাকালেন। মেহজাদ পা ধরে সালাম করতে গেলে রেখা পা সরিয়ে ফেলেন। মেহজাদ মায়ের দিকে মাথা তুলে তাকায়। রেখা মুখ অন্যদিকে ফিরে বললেন,
‘আমার একটাই ছেলে, শেহজাদ। আর কেউ আমার ছেলে নয়।’
মেহজাদ মৃদু হাসল। বসা থেকে উঠে রেখার কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘আপনাদের কথায় ভাইয়া আমার মাথায় গু/লি ঠেকিয়ে দেশে নিয়ে এসেছেন। আর এখন বলছেন আপনাদের কোনো ছেলে নেই, একটাই ছেলে?’
রেখা সরে গেলেন মেহজাদের থেকে। মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

‘দেশে আসার জন্যে, মা বাবাকে দেখার জন্যে যার মাথায় গু/লি ঠেকাতে হয়, সে আবার কিসের ছেলে? দূর হ।’
মেহজাদ কানে ধরে বলল, ‘সরি, আর হবে না। এবারের মত মাফ করুন, প্লিজ?’
রেখা এবার টলমল চোখে মেহজাদের দিকে চাইলেন। মেহজাদ হেসে জড়িয়ে ধরে রেখাকে। রেখার মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
‘আপনাকে অনেক মিস করেছি, আম্মাজান! কাঁদবেন না।’

শেহজাদ নিজেও পা ধরে সালাম করল সবাইকে। নওশাদকে সালাম করার সময় পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে শেহজাদের ভ্রু কুঁচকে যায়। জিজ্ঞেস করে,
‘আব্বাজান, পায়ে কি হয়েছে আপনার?’
নওশাদ এ কথার উত্তর দেবার আগে পাশ থেকে সৌরভ বলেন,
‘ এখন এসব বিষয়ে কথা তোলার দরকার নেই, শেহজাদ। খাবারের পর আমরা নাহয় সব কথা বলব।’
শেহজাদকে শান্ত হতে দেখা গেল না। বরং সে তখনো সন্দেহের দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে নওশাদের পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে চেয়ে।

সবার কথাবার্তা শেষ হলে সৌরভ বললেন,
‘দুজন ঘরে যাও এখন। হাতমুখ ধুয়ে, খেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। বিমানের প্রভাব কাটলে, আরো গল্প করা যাবে।’
মেহজাদ তাকাল শেহজাদের দিকে। বলল,
‘সবাইকে দেখলাম, ভাবিজান কই আমার? ডাকো, তাকেও দেখি।’
শেহজাদ চিত্রাকে ডেকে দিতে চাইলে, পাশ থেকে রেখা বললেন,

‘খাবার টেবিলে এলেই তাকে দেখতে পারবে। এখন যাও, হাতমুখ ধুয়ে আসো। আমি খাবার বাড়ছি।’
মেহজাদ আর কথা বাড়াল না। আপাতত সে প্রচন্ড ক্লান্ত! বিমানে বসে থাকতে থাকতে শরীর ব্যথায় ভেঙে আসছে। তাই সে লাগেজ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৯

শেহজাদ কথা বলার ফাঁকে রান্নাঘরের নজর যায় তার। চিত্রা ঘুরেফিরে বারবার এদিকেই তাকাচ্ছে। ও নিশ্চয়ই শেহজাদের পাশে আসতে চাচ্ছে। শেহজাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিজের ঘরে যাবার জন্যে পা বাড়ানোর আগে রেখার উদ্দেশ্যে বলে গেল,
‘আম্মাজান, সময় করে সুভাষিণীকে একবার ঘরে পাঠিয়ে দিবেন। আমি অপেক্ষা করছি।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১১