খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১১

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১১
আভা ইসলাম রাত্রি

‘আম্মাজান, সময় করে সুভাষিণীকে একবার ঘরে পাঠিয়ে দিবেন। আমি অপেক্ষা করছি।’
শেহজাদ চলে গেল। রেখা বিরক্ত দৃষ্টিতে ছেলের চলে যাবার দিকে চোখ রাখেন। পাশে শিউলি রেখা অভিব্যক্তি দেখে রেখার পাশে এসে দাঁড়ান। রেখার কাঁধে হাত রেখে বলেন

‘বুবু? খাবার বাড়বেন না?’
রেখা ধাতস্থ হলেন। মুখ বাঁকিয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে হনহন করে পাকের ঘরের দিকে চললেন। চিত্রা রান্নার ফাঁকে রেখাকে এদিকে আসতে দেখে তরিগরি করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। রেখা এদিকেই আসলেন। চিত্রার দিকে না তাকিয়েই জানালেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘খোকা ডাকছে, দেখে আসো কি প্রয়োজন তার। দ্রুত চলে আসবে, খাবার বাড়তে হবে। ওদের ক্ষুধা লেগেছে।’
চিত্রার মুখের খুশি যেন ধরে না। চোখের মণি ঝলমলিয়ে উঠল যেমন। তবে রেখার সামনে ওমন বাঁধভাঙ্গা খুশি প্রকাশ করার মত বোকামি করল না চিত্রা। মাথা হালকা দুলিয়ে ফিনফিনে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে পাকের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।

শেহজাদের ঘরে এসে দেখে, সে পাঞ্জাবি খুলেছে সবে। কাঁধে গামছা ঝুলানো। গোছলে যাবে বোধহয়। মানুষটাকে কতদিনে দেখল? এক সপ্তাহকে কি চিত্রা জনমের নাম দেবে? চোখের তৃষ্ণায় কৈ মাছের নয় ছটফট করা চিত্রা আজ যেন পরিপূর্নরূপে তৃপ্ত। চিত্রা বিড়ালের ন্যায় ছোটছোট পা ফেলে এগিয়ে আসে।
‘ডা-ডেকেছিলেন?’
চিত্রার কন্ঠ শুনে শেহজাদ পেছনে ফিরে তাকায়। চিত্রা বাম হাতের কব্জি খামচে ধরে ঠাই দাড়িয়ে আছে। শেহজাদ স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘হূঁ!”
শেহজাদ হয়ত লক্ষ করেনি, চিত্রা কেমন ঝরঝর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। চিত্রার মুখটা এবার শুকিয়ে এটুকু হয়ে গেল। উদাস ভঙ্গিতে চিত্রা বলল,
‘কেন ডাকলেন?’
শেহজাদ উত্তর দিল না। বরং এগিয়ে গেল লাগেজের দিকে। লাগেজ খুঁজে একটা প্যাকেট বের করল। প্যাকেট ছিঁড়ে বের হল এক সুন্দর কারুকাজ করা বাক্স। শেহজাদ বাক্স এগিয়ে দিল চিত্রাকে। বলল,

‘এটা তোমার জন্যে।’
চিত্রা বিস্ময় নিয়ে তাকাল বাক্সের দিকে। শেহজাদ তার জন্যে উপহার এনেছে বিদেশে থেকে? চিত্রার ভাগ্যে এত সুখ কেমন ঢেউয়ের ন্যায় বয়ে হচ্ছে! অতি সুখে চিত্রার চোখ টলমল করে উঠল। চিত্রা আলগোছে বাক্স হাতে নিল। ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘কি আছে এটাতে?’
‘খুললে জানবে।’
শেহজাদের ছোট্ট উত্তর। চিত্রা কম্পিত হাতে বাক্স খুলল। সুন্দর এক সাদা পুঁথির তৈরি মালা রাখা বাক্সে। চিত্রা হাত বাড়িয়ে মালাটা ছুঁইয়ে দিল। কি সুন্দর মালাটা! চিত্রা মালা দেখে কথা বলতে যেন ভুলে গেছে। শেহজাদ তার জন্যে নিজে পছন্দ করে কিছু এনেছে? চিত্রার বিশ্বাস হচ্ছে না। চিত্রা মালা হাতে নিল। মিনমিন করে বলল,

‘এখন পরি আমি?’
‘ভালো লাগলে পরো, তোমার ইচ্ছে।’
চিত্রা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মালাখানা গলায় রেখে পরার চেষ্টা করল। সফল হল না। মালাটা কোনোমতেই গলায় পরা যাচ্ছে না। চিত্রা কষ্ট পেল। আড়চোখে তাকাল শেহজাদের দিকে। শেহজাদ গোছলে যাচ্ছে, চিত্রার দিকে মনযোগ কই তার?

তিনি কি পারেন না, মালা খানা চিত্রার গলায় যত্ন নিয়ে পরিয়ে দিতে? চিত্রা অগ্যতা মালা বাক্সে রেখে দিল। মন খারাপ করে চলে যাবে, তবে আটকে গেল গম্ভীর আদেশ শুনে,
‘দাঁড়াও।’
চিত্রা থেমে গেল। গোলগোল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শেহজাদের দিকে। শেহজাদ গামছা চেয়ারে রেখে এগিয়ে এল।
‘মালা দাও?’

হাত বাড়িয়ে চেয়ে আছে চিত্রার দিকে শেহজাদ। চিত্রার মন খুশিতে প্রজাপতির ন্যায় উড়ে যেতে চাইল। মালা বাক্স থেকে নিয়ে শেহজাদের হাতে ধরাল। লজ্জিত বদনে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। শেহজাদ মালা হাতে চিত্রার পেছনে দাঁড়াল। চিত্রার পিঠের থেকে কোমর ছড়ানো চুল সামনে ঠেলে দিল। শেহজাদের সামান্য স্পর্শে চিত্রার দেহে ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপন ছড়িয়ে গেল।

শেহজাদ আলগোছে চিত্রার গলায় মালাখানা পরিয়ে দিল। চিত্রা চোখ বুজে অনুভব করছে শেহজাদের গরম হাতের স্পর্শ! শেহজাদ সরে এল। চিত্রা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। চিত্রার চোখ ছলছল করছে। আদরের শিহরণের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে তার সর্বাঙ্গ। চিত্রাকে লজ্জায় জমে থাকতে দেখে শেহজাদ কেমন করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

নারী দেহের লাজ অদ্ভুত সুন্দর ঠেকে শেহজাদের দৃষ্টিতে। শেহজাদ কেমন মোহগ্রস্থের ন্যায় চেয়ে রয় আয়নার চিত্রার প্রতিবিম্বের দিকে। প্রথমবারের মত, শেহজাদ কিছু একটা অনুভব করে! এ কিছু একটা ভীষন অপরিচিত শেহজাদের কাছে। শেহজাদ কেমন সম্মোহনের ন্যায় চিত্রার কোমরে হাত রাখে!

শেহজাদ যেন নিজের মধ্যে নেই, ভেসে গেছে অন্য এক তোলপাড় করা দুনিয়ায়। শেহজাদের স্পর্শে চিত্রার দেহ কেমন কাঁপন ধরে। চিত্রা চোখ বুজে ফেলে শক্ত করে। শেহজাদ ধীর কদমে ঘন হয়ে দাঁড়ায়। চিত্রার কাঁধে থুতনি রাখে আলগোছে। চিত্রা এবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। শেহজাদ আঁধার রাতের ন্যায় গভীর কণ্ঠে সুধায়,

‘ইচ্ছেবতীর ন্যায় ইচ্ছে করো না, কন্যা! জ্বলে পুড়ে যাবে।’
চিত্রা চমকে তাকায় আয়নায় শেহজাদের চোখের দিকে। বোধগম্য হয় শেহজাদের ওমন কথার অর্থ! চিত্রা ধরা পরে যায়। চিত্রা যে নিজের ইচ্ছেই গলায় মালা না পরার ভান করেছিল, শেহজাদ বুঝতে পেরেছে। চিত্রা ঢোক গিলে। কেমন করে চিত্রা নিজেকে আটকাবে, প্রিয় মানুষের যত্ন করা মালা পরিয়ে দেওয়া থেকে?

চিত্রার দৃষ্টি এলোমেলো হচ্ছে। হঠাৎ শেহজাদের হুশ ফেরে যেমন। ধীরে সরে যায় চিত্রার থেকে। চিত্রা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। জোরেজোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে টলমল চোখে তাকায় শেহজাদের দিকে। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে চিত্রার দিকে। চিত্রার ওমন চাওনি সহ্য হয়না যে! দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে চিত্রা।
বুদ্ধিমান শেহজাদ বুঝতে পারে তার মধ্যকার পরিবর্তন! কিছু একটা হচ্ছে তার মধ্যে! সে বদলে যাচ্ছে, অদ্ভুত আচরণ করছে। এমনটা হবার কারণ কি? তার স্ত্রী, সুভাষিণী?

আয়ুষ্মান বাড়ির পুরুষরা খেতে বসেছেন। বাড়ির মেয়ে-বউরা খাবার বেড়ে দেবার জন্যে তৈরি। শেহজাদ গোসল করে সবে এসে বসেছে চেয়ারে। রেখা ভাত বেড়ে দিলেন সবাইকে, চিত্রা শাশুড়ির দেখাদেখি তরকারি বেড়ে দিল। সবাই খেতে বসেছে, অথচ নওশাদ আশেপাশে মেহজাদকে দেখতে পারছেন না। তাই তিনি ডাক দেন,

‘মেহজাদ, খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে।’
‘অলরেডি আমি চলে এসেছি। এভরিওয়ান, দেখো তো আমায় কেমন লাগছে?’
চিত্রা শেহজাদকে তরকারি বেড়ে দেবার এক ফাঁকে তাকাল সামনে। সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা চমকে উঠল। এ কেমন লীলাখেলা? অবিকল শেহজাদ আয়ুষ্মানের ন্যায় এক পুরুষ সামনে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রার।

শেহজাদের ন্যায় অবিকল চেহারা, শেহজাদের ন্যায় গায়ে শুভ্র রঙ্গা পাঞ্জাবি, চুলের গোছায় অবিকল শেহজাদের ছাপ। চিত্রা চমকে নিজের পাশে তাকাল। শেহজাদ খাচ্ছে পাশে বসে। কে আসল শেহজাদ? এ দুই আয়ুষ্মান কি যমজ ভাই? মেহজাদ এসে দাঁড়াল চিত্রার পাশে। শেহজাদের ন্যায় গম্ভীর স্বরে চিত্রার উদ্দেশ্যে বলল,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১০

‘আপনিই বলুন! কেমন লাগছে আমায়, সুভাষিণী ভাবিজান?’
চিত্রা স্তব্ধ! মুখে ‘রা’ কাটতে সক্ষম হচ্ছে না চিত্রা। বারবার ঘুরেফিরে এ দুই ভাইকে দেখে যাচ্ছে সে। চিত্রা আপাতত বিস্ময়ের চূড়ান্তে অবস্থান করছে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১১