খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১২

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১২
আভা ইসলাম রাত্রি

এ দুই আয়ুষ্মান কি যমজ ভাই? চিত্রার হতভম্ব দৃষ্টি মেহজাদ বোধ করি ভীষন উপভোগ করে। ধীর পায়ে দু কদম এগিয়ে মেহজাদ এসে দাঁড়াল চিত্রার পাশে। শেহজাদের ন্যায় গম্ভীর স্বরে চিত্রার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনি বলুন সুভাষিণী ভাবিজান, কেমন লাগছে আমায়?’

চিত্রা স্তব্ধ! মুখে ‘রা’ কাটতে সক্ষম হচ্ছে না চিত্রা। বারবার ঘুরেফিরে এ দুই ভাইকে দেখে যাচ্ছে সে। চিত্রা আপাতত বিস্ময়ের চূড়ান্তে অবস্থান করছে। চিত্রার বিস্মিত চাওনি সবাই বুঝতে পারল। হিয়া চিত্রার দিকে চেয়ে চামচ নাড়িয়ে হেসে উত্তর দিল,
‘অবাক হচ্ছেন ভাবিজান? বড় ভাইজান এবং ছোট ভাইজান জমজ। বড় ভাইজান পাঁচ মিনিটের বড় ছোট ভাইজান থেকে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাগুলো যখন চিত্রার বোধগম্য হয় চিত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কারো চেহারা কখন এতোটা মিলে যায় যখন তাদের দুজনকে একদম আলাদা করা যায় না? চিত্রা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে আওড়ায়,
‘সালাম! প্রথম দেখায় অবাক হই-হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি সব। খেতে বসুন, খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে।’
মেহজাদ ঠোঁট টেনে হাসল খানিক। চিত্রাকে চমকে দিতে পেরে সে আনন্দিত! বিদেশ থেকে ফেরার পথে সে সারা পথ এ চমকের অপেক্ষা করছিল। মূলত এ কারণবশত মেহজাদ এতদিন চিত্রার সঙ্গে কথা বলেনি।

‘মেহজাদ খেতে বসো। ঠাণ্ডা হচ্ছে সব।’
সৌরভের আদেশে মেহজাদ হেসে চেয়ারে গিয়ে বসে। মেহজাদের ওমন ঠোঁট টেনে হাসি লক্ষ্য করে চমকে উঠল চিত্রা। শেহজাদ হাসলেও বোধহয় এমন অস্বাভাবিক সুন্দর লাগবে? চিত্রা আড়চোখে শেহজাদের দিকে চাইল। শেহজাদ আনমনে খেতে মশগুল। চিত্রা অপলক চেয়ে থাকে এই দুই ভাইয়ের দিকে। ভাবনার বাঁধ ভেঙে যায় রেখার আদেশে। চিত্রা দ্রুত মেহজাদের পাতে ভাত-তরকারি তুলে দিল।

খাবার পর্ব শেষ করে মেহজাদ বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। শেহজাদ পথ আটকায় তবে। ডাকে,
‘ ষথামো, কোথায় যাচ্ছ?’
‘গ্রামেরই আশেপাশে ঘুরব-ফিরব, ভাইয়া।’
মেহজাদের কথা শুনে গা ঝাঁকায় শেহজাদ। ভ্রু কুঁচকে আপাদমস্তক মেহজাদকে দেখে নিয়ে আদেশ করে,

‘কাপর বদলে যাবে। এভাবে শেহজাদ সেজে সবাইকে ভরকে দেওয়া কোনো ভালো কাজ নয়।’
মেহজাদ বিরক্ত হল কিছুটা। নাছোড়বান্দার ন্যায় বায়না করে বসল,
‘একটু মজা নিলে কিছু হবে না। সবাই তুমি ভেবে আমাকে নেতার মত ট্রিট করবে, মারাত্মক লাগবে ব্যাপারটা। মানা করলেও আমি শুনছি না, ভাইয়া। বাই!’

শেহজাদ প্রচন্ড বিরক্ত হল। মেহজাদ চলে যাচ্ছে দ্রুত। পেছন থেকে শেহজাদ ডাকল অনেকবার। থামে না মেহজাদ। চিত্রা অসহায় চোখে দু ভাইয়ের কান্ড দেখে যায়। মেহজাদ পুরো ভিন্ন শেহজাদ থেকে। শুধু গঠনেই মিল, বাকি আচরণ থেকে শুরু কথা কথাবার্তা সব স্বত্রন্ত্র।
শেহজাদ থামল। কপাল দু আঙুলের ডগা দিয়ে মালিশ করে লাইব্রেরীর দিকে যেতে যেতে চিত্রার উদ্দেশ্যে বলে গেল,
‘এক কাপ চা করে দিও। আমি লাইব্রেরীতে আছি।’

চিত্রা খাবার গুছিয়ে চা বানিয়ে শেহজাদের লাইব্রেরীতে যায়।
শেহজাদ বই পড়ছে। বই পড়লে শেহজাদের আশেপাশের কোনো খবর থাকে না। ডুবে যায় বইয়ের মধ্যে। চিত্রা চাইল না শেহজাদের ধ্যান ভাঙে। চিত্রা ধীর পায়ে চায়ের কাপ টেবিলে রাখে। অথচ কাপ রাখার শব্দে শেহজাদের ধ্যান ভাঙে। শেহজাদ মাথা তুলে তাকায়। শেহজাদের চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয় ঠিক চিত্রার চোখ বরাবর। চিত্রার বুক ধ্বক করে উঠে যে। চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। শেহজাদ চায়ের কাপ হাতে নেয়। পাশের চেয়ার ইশারায় দেখিয়ে বলে,

‘বসো।’
চিত্রা কথামত বসে। শেহজাদ বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে প্রশ্ন করে,
‘শুদ্ধ ভাষা কবে শিখলে?’
চিত্রার মন এবার খুশিতে নাচে। শেহজাদ তবে লক্ষ্য করল। চিত্রার বোধ হল, ঢোল বাজিয়ে বলতে শেহজাদকে, ‘আপনার জন্যে সব করেছি, সব শিখেছি, নেতাশাহ!’

কিন্তু বলতে পারে না। লজ্জায় কন্ঠনালী দেবে যায় যেন। শেহজাদের সামনে এলে চিত্রার অন্য রূপ ফিরে আসে। লজ্জা, আতঙ্ক এবং ভয় এ তিনের সম্মেলনে এক অদ্ভুত সত্তা প্রকাশ পায় চিত্রার। শেহজাদ চিত্রার এমন রুপ ইদানিং উপভোগ করে। গঠনে গাম্ভীর্য বজায় রাখে, অথচ বুকে পুষে প্রশান্তির বীজ! চিত্রা কিছুক্ষণ পর ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
‘আপনি চই-চলে যাবার পর।’

শেহজাদ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। প্রশ্ন করে আবারও,
‘এখনও পুরোপুরি রপ্ত করতে পারো নি। কথায় জড়তা আছে। আরো চেষ্টা করতে হবে।’
চিত্রা মাথা দুলায়। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চিত্রার মাথা দুলানো শেহজাদের পছন্দ নয়। কথা হবে কণ্ঠ দিয়ে, নাকি অঙ্গভঙ্গি দিয়ে? তবে শেহজাদ কথা শুনায় না। বরং একটা সিদ্ধান্ত জানায়,
‘তোমার মেধা ভালো যথেষ্ট। পড়াশোনা করতে চাও?’

চিত্রা বিষ্ময় নিয়ে ডাগর ডাগর চোখে তাকায় শেহজাদের পানে। শেহজাদ ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে চিত্রার দিকে। চিত্রা দমে যায়। খানিক পর কম্পিত কণ্ঠে আওড়ায়,
‘এত পড়ে কি হই-হবে?’
‘শেহজাদ আয়ুষ্মানের স্ত্রী সবে অষ্টম শ্রেণী পাশ, কথাটা আমার জন্যে অসম্মানজনক।’
‘ বিয়ের পরে ইশকুলে যাব আমি?’
চিত্রার ভয়ার্ত কন্ঠ। শেহজাদ প্রশ্ন করে,

‘কেন? বিয়ের পর স্কুলে যাওয়া মানা?’
চিত্রা মাথা নাড়ায় আবারও। শেহজাদ আবারও বিরক্ত হয়। চিত্রা আশেপাশে চেয়ে হাতে হাত রেখে আওড়ায়,
‘সবাই কি ভাববেন? বাড়ির বৌ ইশকুলে যাবে? সমাজ কি বলবে?’

‘সমাজের পরোয়া আমি কখনও করিনি, করবও না। তাছাড়া বাড়ির লোকদের সঙ্গে আমি কথা বলব। নেতা বাড়ির সকল বউ শিক্ষিত,তাই তোমাকেও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষিত হতে হবে। আমি স্কুলের মহিলা মাস্টারের সঙ্গে কথা বলব। তিনি তোমাকে বাড়িতে পড়াবেন। পরীক্ষার সময় স্কুলে পরীক্ষা দেবে। সর্বোপরি, শেহজাদ আয়ুষ্মানের স্ত্রীকে শিক্ষিত হতে হবে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। এবং বারবার মাথা দুলিয়ে কথা না বলে, কন্ঠ দিয়ে কথা বলতে হবে।’
শেষের কথায় চিত্রা নিজের ভুল বুঝতে পারে। দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে মাথা নত করে বসে। শেহজাদ চায় চিত্রার পানে। চিত্রার রক্তিম–লজ্জিত বদনে নেশা ধরে তার। শেহজাদ আনমনে চেয়ে থাকে। খানিক পর কেমন মরে যাওয়া কণ্ঠে আওড়ায়,

‘তোমাকে নেতা বাড়ির যোগ্য বউ হতে হবে, সুভাষিণী। যেন আমার কখনও কিছু হয়ে গেলে কেউ তোমাকে ঠুকতে না পারে, আটকাতে হয়না কোথাও, মাথা উঁচু করে বাঁচতে লজ্জা না পেতে হয়। সবাই যেমন আমাকে সম্মান করে, আমি চাই তুমি এমন নারী হও যেন সবাই আমার মত তোমাকেও সম্মান করে নেতা বউ হিসেবে। আমি ছাড়া, তুমি যেন নিজের আমি হয়ে উঠো, এটাই আমার চাওয়া।’

শেহজাদের কথায় কিছু একটা ভয়ংকর আভাস ছিল বোধহয়। চিত্রার চোখে সঙ্গেসঙ্গে জল উপচে পরল। চিত্রা শেহজাদের সামনে বসেই কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। শেহজাদের দৃষ্টি কান্নারত এ নারীর পানে। হাসলে এক নারীকে সুন্দর লাগে, অথচ কান্নারত নারীকে দেখলে পুরুষ নেশাগ্রস্ত হয়। কান্নারত নারী হাস্যরত নারী থেকে দ্বিগুণ সুন্দর। চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে আওড়ায়,

‘আপনি দয়া কইরে এমন কথা কইবেন না, আমার বুক পুড়ে। আমি কষ্ট পাই খুব। আপনি….আপনি ক্যান …এসব কথা.. কন?
কষ্টে চিত্রার কণ্ঠ থেকে শুদ্ধ ভাষা হারিয়ে আগের ভাষা চলে এসেছে। শেহজাদ ভীষন মনযোগ দিয়ে চিত্রার কান্না দেখছে। এ নারী ভীষন অদ্ভুত, কান্নায় নারীর আসল রূপ বেরিয়ে আসে। চিত্রার কান্না থামছে না, কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাচ্ছে। শেহজাদ এবার কিছুটা নরম হল। আলগোছে চিত্রার নরম—কম্পিত দেহখানা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। চিত্রা শেহজাদের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। শেহজাদ আদর নিয়ে চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দিল। বোঝানোর ভঙ্গিতে আওড়ালো কিছু কথা,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১১

‘তোমার স্বামীর গায়ে আঘাত করা কোনো শত্রুর কাম্য নয়, সুভাষিণী। পৃথিবীতে এমন কেউ জন্মেনি যে আমার ক্ষতি করবে, আমাকে আঘাত করবে। শেহজাদ আয়ুষ্মান সম্পর্কে তোমার চিন্তা খুব নগণ্য, কন্যা। আমি যা দেখাই, আমি আসলে তা নই! আমি আসলে কে, তাহা কেউ জানেই না।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৩