খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৩

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৩
আভা ইসলাম রাত্রি

মেহজাদ এবং তার কিছু পুরোনো বন্ধুরা গ্রামের বড় হাওরের তীরে বসেছে। কাদা মাটিতে সবার পরনের কাপড় ময়লা হচ্ছে। সেদিকে অবশ্য কারো নজর নেই। বহুদিন পর গ্রামে ফিরে এসে মেহজাদ চারপাশ ভুলে বসেছে। তন্ময় হয়ে অনুভব করছে তার প্রিয় গ্রাম। গল্প করার ফাঁকে নুমান বলল,

‘বিলেত ফেরত নেতা পুত্র, কাদা মাটিতে বসা আপনার শোভা পাইতাসে না। কাপড় নোংরা হলে কাকিমা ধইরা আমাদের ঠেঙাবে।’
মেহজাদ গা ঝাড়া দিল। মাটিতে এবার সটান শুঔয়ে পরল। ধুলো মাটি এবং কিছুটা কাদা মিলে তার শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি মাখামাখি হল। মেহজাদ মাথার নিচে দুহাত রেখে চেয়ে দেখে মাথার উপরে সুবিশাল আকাশ! আকাশের মধ্যখানে সূর্য বসে আছে। হালকা তেজ ছড়াচ্ছে চারপাশে। মেহজাদকে শুয়ে পরতে দেখে আঁতকে উঠে শুয়াইব বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এই তুই শুয়ে পরলি কেন এইখানে আবার? উঠ, কাপড় কিন্তু ময়লা হইতাসে।’
‘হোক, পাত্তা দেই না। ধুয়ে ফেললে দাগ চলে যায়।’
‘অনেকদিন পর গ্রামে আইলি, কেমন লাগতাসে?’
মেহজাদ আকাশের দিকে তাকাল। দু চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিজের নাকে টেনে নেয়। নাকের মধ্যে সুরসুর করে প্রবেশ করে গ্রামের কাদামাটির গন্ধ, গরুর গোবরের গন্ধ, ঘাসফুলের সুভাস, মাছের গন্ধ। মেহজাদ বিমোহিত হয়। চোখ খুলে টলমল চোখে আকাশের দিকে চেয়ে আওড়ায়,

‘গ্রামের গন্ধটাই আলাদা রে। এখানে এলে গরুর গোবরের গন্ধেও সুখ লাগে। আপন আপন মনে হয়।’
নুমান পাশ থেকে দায়ছাড়া ভাবে বলে,
‘বিলেত থেকে আইলে সবাই এমন বাণী ছাড়ে। বিলেতের মজা আমাগো জানা আছে। অ্যাহ, গরুর গোবরের গন্ধে আবার সুখ!’

মেহজাদ শুয়ে থেকে পাশে তাকায়। নুমানের বিলেতে না যাবার কষ্ট সে কিছুটা বুঝে। মেহজাদ আবারও আকাশের দিকে চায়। ঠোঁট টেনে হেসে বলে,
‘বিলেতে আসলেই অনেক মজা। যে যায়, সে জানে।’
শুয়াইব পাশ থেকে হঠাৎ করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘শুন, বিলেতে নাকি মেয়েরা রাস্তায় ছোট ছোট জামা পইরা হাঁটে? ঐ কি কয় তারে, বিকিলি।’

শুয়াইবকে বড্ড আগ্রহী দেখাল। সে ঝুঁকে আছে মেহজাদের দিকে। শুইয়াবের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মেহজাদের এবার পেট ফেঁটে হাসি আসে। সে হেসে হেসে বলে,
‘বিকিলি না, বিকিনি। আর হ্যাঁ হাঁটে, তবে রাস্তায় না। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়। তবে সামারে কেউ কেউ রাস্তায়ও হাঁটে।’
‘তুই দেখেছিস সামনাসামনি?’
‘অনেকবার।’

শুয়াইব এবার বিকিনি পরিধানকৃত মেয়েদের দেখতে না পেয়ে দুঃখে মরে যাবার জোগাড়। সে বিড়বিড় করে বলল,
‘সোনার ভাগ্য রে তোর, মেহজাদ।’
মেহজাদ বাঁকা হেসে আবারও তাকাল আকাশের পানে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল—- ‘সত্যি, অনেক বড় ভাগ্য।’
বেশ কিছুসময় পেরিয়ে যায়। হঠাৎ মেহজাদ উঠে দাঁড়ায়। গায়ের পাঞ্জাবির থেকে ময়লা ঝাড়ার চেষ্টা করে বলে বন্ধুদের দিকে চেয়ে,

‘আয়, শেহজাদ আয়ুষ্মান সেজে গ্রামের মানুষকে চমকে দেই।’
নুমান অবাক চোখে তাকায় মেহজাদের দিকে। ভয় পেয়ে দু কদম পিছিয়ে আওড়ায়,
‘খবরদার, আমাকে এসবে জড়াইবি না। নেতাসাহেব জানতে পারলে বিপদ হইব।’
শুয়াইবের একই উত্তর। মেহজাদ এসব কথায় যারপরনাই বিরক্ত। সে জোর করে দুজনের হাত টেনে ধরে উঠায়। দুজনের কাঁধে শক্ত করে হাত রেখে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘মার খেলে একসঙ্গে খাব, একেই বন্ধুত্ত্ব বলে শা/লা।’

‘শেহজাদ আয়ুষ্মান আইসেন, জায়গা ছাড়ো রে সবে।’
মেহজাদের পথের সামনে থেকে সমস্ত বাঁধা উপরে দিল কিছু লোক। মেহজাদ শেহজাদের ন্যায় গর্বে বুক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছনে পেছনে জড়োসড়ো ভাবে এগিয়ে আসে নুমান এবং শুয়াইব। মেহজাদ একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে। ময়রা মেহজাদকে দেখেই দৌঁড়ে এসে পা ধরে সালাম করে। মেহজাদ গম্ভীর চেহারায় সালাম গ্রহন করে। ময়রা সরে দাঁড়ায়। মাথা নত করে হাতজোড় করে জিজ্ঞেস করে,

‘আমার দোকানের কি পছন্দ হয় আফনার, নেতাসাহেব? একবার আদেশ খরেন।’
মেহজাদ পেছনে তাকায়। দোকানের হরেক রকম মিষ্টি দেখে নুমান এবং শুয়াইবের জিভে জল এসেছে। মেহজাদ চোখ ঘুরিয়ে সকল মিষ্টি দেখে নেয়। তারপর আদেশ করে,

‘রাবড়ি পায়েস, রসগোল্লা, সন্দেশ সহ আর যা যা ভালো মিষ্টি আছে নিয়ে এসো।’
ময়রা দৌঁড়ে দোকানের সবচেয়ে ভালো মিষ্টি খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে মেহজাদের সামনে। মেহজাদ কয়েকটা মিষ্টি খেল। নুমান এবং শোয়াইব পাশে দাঁড়িয়ে মুখের লালা ফেলে দেখছে মেহজাদকে। মেহজাদ গোপনে হাসে। তারপর ময়রাকে আদেশ করে,

‘ওদের বসার জায়গা করে দাও। মিষ্টি আনো তাদের জন্যেও।’
ময়রা লোক পাঠাল। সঙ্গেসঙ্গে দুটো চেয়ার এনে দিল তাদের। নুমান এবং শুয়াইব বসে চেয়ারে। মিষ্টি আনা হল তাদের জন্যেও। মিষ্টি সামনে পেয়ে ঝটপট মিষ্টি মুখে তুলতে লাগল তারা।
মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে মেহজাদ উঠে দাঁড়ায়। বড় এক ঢেঁকুর তুলে ময়রার দিকে চেয়ে বলে,
‘মিষ্টির টাকা বাড়ি এসে নিয়ে যেও।’
ময়রা লজ্জিত কণ্ঠে বলে,

‘টাকা লাগব না, নেতাসাহেব।’
মেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বললে,
‘এ গ্রামের কাউকে বিনা পয়সায় মিষ্টি দাও?’
ময়রা ভরকে উত্তর দেয়, ‘না, সাহেব।’
মেহজাদ বলে,

‘তাহলে আমি কেন বিনা পয়সায় নেব? বাড়ি এসে টাকা নিয়ে যেও।’
ময়রা মেহজাদের গম্ভীর স্বরে আদেশ শুনে থমকে গেল। হন্তদন্ত হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করল। মেহজাদ চলে গেল দোকান ছেড়ে।
গ্রামের বড় মসজিদের উঠোনে দাঁড়িয়ে মেহজাদ এতক্ষণে চেপে রাখা হাসি হেসে উঠল। সঙ্গে হাসল নুমান এবং শুয়াইব। হাসতে হাসতে মেহজাদের চোখে পানি জমল। একসময় মেহজাদ হাসি থেমে ভেঙিয়ে বলল,

‘নেতাসাহেব, টাকা লাগব না। নেতাসাহেব, হা হা হা।’
নুমান পাশ থেকে হেসে বলল,
‘আর কোথায় যাইবি? গ্রামে নতুন এক দোকান খুলেছে। খিঁচুড়ি আর মাংস বেছে। যাইবি ওখানে?’
মেহজাদ নিজের লোভ সংবরন করতে পারে না। তাদেরকে নিয়ে চলে গ্রামের পূর্ব পাশের দোকানে।
কিছুটা দূরে এসে তারা দেখে এক জায়গায় মারামারি লেগেছে। দু পক্ষের মধ্যে ছু/রি নিয়ে তুমুল হাতাহাতি চলছে। নুমান এবং শুয়াইব এসব দেখে আঁতকে উঠে। ভয়ার্ত চোখে তারা মেহজাদের দিকে চায়। মেহজাদের চেহারার রং পাল্টাচ্ছে। তারা ভয় পেয়ে মেহজাদকে টেনে আটকে বলে,

‘আর যাওয়ার দরকার নাই, মেহজাদ। তোর উপর আক্রমন হইলে আমাদের ধরে ধরে মারবে তোর বাড়ির লোকেরা। চল জাইগা।’
মেহজাদের তুখোড় দৃষ্টি সামনেই। সে কিছু একটার হিসেব কষছে যেন। নুমান আবারও মেহজাদের পাঞ্জাবির হাতা ধরে টানে,
‘মেহজাদ রে, জাইগা চল। ‘

নুমান কথাটা শেষ করতে পারেনি, মেহজাদের রক্তিম চক্ষু বাজের ন্যায় ছুঁড়ে পরে নুমানের দিকে। নুমান মেহজাদের হঠাৎ এমন চাওনি দেখে আঁতকে উঠে পাঞ্জাবি ছেড়ে দু কদম পিছিয়ে যায়। শুয়াইব এগিয়ে এসে মেহজাদকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে বলে,
‘রাগস ক্যান? প্রথম গ্রামে আইসস, এসব সামাল দেওয়া চিনস না তুই। একমাত্র নেতাসাহেব আইলেই এসব থামব, নাইলে এমনিই চলব।’

চারপাশে মানুষের আতঙ্কিত কণ্ঠ! রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। হাহাকার ভেসে আছে শিশুদের। মেহজাদ এমন সাংঘাতিক পরিস্থিতি দেখে পিছনে চলে যেতে পারল না, বিবেকে দেয় নি তার। মেহজাদ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবে। তারপর হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকায়। মেহজাদের চোখে রক্ত জমা হয়েছে দেখে বন্ধুরা আতংকে সরে দাঁড়ায়। মেহজাদ যখন অতিরিক্ত রেগে থাকে, মেহজাদের চোখে এভাবেই রক্ত জমে যায়। মেহজাদ কখনোই নিজের রাগ সংবরণ করতে পারে না। এ রাগের কারণে মেহজাদ গ্রামে কিছু বিপদ করে ফেলবে এ আশঙ্কায় শেহজাদ আয়ুষ্মান তাকে দ্রুতসম্ভব বিলেতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এবার হয়ত বিপদটা ঘটেই ফেলবে মেহজাদ। নুমান শেষবারের ন্যায় বলে,

‘ভুল করতাসোস, মেহজাদ। তুই পারবি না এসব সামাল দিতে।’
মেহজাদ এবার রাগ সংবরণ করতে না পেরে চিৎকার করে উঠে,
‘আমার ভাই পারলে আমিও পারব। আটকালে খবর আছে তোদের। সরে দাঁড়া।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১২

অতঃপর সবাইকে পরোয়া না করে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যায় মেহজাদ। সঙ্গেসঙ্গে হইচই এর তীব্র আওয়াজ ছড়িয়ে পরে চারপাশে। নুমান এবং শুয়াইব ভয়ে কপালের ঘাম মুছে দৌঁড়ে পা বাড়ায় আয়ুষ্মান বাড়ির লোকদের খবর দিতে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৪