খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৪

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৪
আভা ইসলাম রাত্রি

আকষ্মিক অদূর হতে ধারালো ছু/রি ছুঁড়ে ফেলা হল মেহজাদের দিকে। মেহজাদের কান ছুঁয়ে ছু/রি ছুঁড়ে একটি গাছ ছেদ করল। মেহজাদ সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে দু কদম পেছালো। রক্তিম চোখে তাকাল সম্মুখে। মুখোশ পরিধান করা এক তরুণ পুরুষকে লক্ষ্য করতেই মেহজাদ গাছ থেকে ছু/রি টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলল তার দিকে। লক্ষ ভ্রষ্ট হলনা, বরং ছুরিটি সোজা পুরুষের পায়ে বিঁধে গেল।

সঙ্গেসঙ্গে মুখোশধারী সে লোক পায়ে হাত চেপে পালানোর চেষ্টা করল। তবে সক্ষম হল না। গ্রামবাসী তাকে আটকে ধরল। ততক্ষণে শেহজাদ গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে মা/রামা/রির স্থানে। মেহজাদ রাগে তখন থরথর করে কাঁপছে। শেহজাদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তেড়ে গেল মেহজাদের দিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ করে গ্রামবাসী দুজন একই অবয়বে মানুষ দেখে ভরকে গিয়েছে। কে শেহজাদ এবং কে মেহজাদ বিষয়টা তাদের কাছে আপাতত ধোঁয়াশা। তারা নীরব থেকে দুই ভাইয়ের আগাম কর্ম দেখতে যাচ্ছে। শেহজাদ দু কদনেই মেহজাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাইকে দেখে মেহজাদের রাগ কিছুটা গলেছে। বরং এখন মনে ভর করেছে ভয়! শেহজাদ আশপাশ আড়চোখে দেখে। গ্রামবাসী উৎসুক চোখে চেয়ে আছে তাদের দিকে। শেহজাদ তা দেখে রাগ কিছুটা দমিয়ে রাখে। দাঁতে দাঁত চেপে মেহজাদের কানের কাছে মুখ এনে বলে,

‘তোমার সঙ্গে যা করার বাড়িতেই করব। দফা হও এক্ষুনি এখান থেকে।’
মেহজাদ আগ বাড়িয়ে নিজের কথাগুলো ব্যাখ্যা করতে চাইল শেহজাদের কাছে। অথচ শেহজাদ যেন চক্ষু থেকে আগুন ছুঁড়ে দিল মেহজাদের দিকে। মেহজাদ আঁতকে উঠে দ্রুত বেরিয়ে গেল ভিড় ছেড়ে। শেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকাল আশপাশে। মুখোশধারী লোককে দুজন মানুষ চেপে রেখেছে। শেহজাদ তার দিকে এগিয়ে গেল।

ধীর পায়ে হাঁটু বটে বসল তার পাশে। লোকটার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে। পায়ে এখনো ছু/রি বিঁধে, রক্ত গড়াচ্ছে ঝরঝর করে। শেহজাদ লোকটার পা থেকে ছুরি একটানে বের করে নিল। লোকটা ব্যথায় চিৎকার করে। শেহজাদ ছু/রি এক হাতে নিয়ে ওপর হাতে লোকটার মুখোশ খোলার জন্যে হাত বাড়ায়। লোকটার চোখ থেকে এবার ব্য/থার আবেশ সরে যায়। বরং চোখে জন্মায় আতঙ্ক। শেহজাদ মুখোশ সরিয়ে নেয় একটানে। সঙ্গেসঙ্গে শেহজাদ চমকে উঠে,
‘মহি? তুমি?’

মহি ভয়ার্ত চোখে তাকায় শেহজাদের দিকে। শেহজাদ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার একজন আপন মানুষ মেহজাদকে শেহজাদ ভেবে খু/ন করতে এসেছে। শেহজাদ নিজের রাগকে সংবরণ করে চাপা স্বরে মহির গেঞ্জি চেপে ধরে। মহি নড়েচড়ে উঠে। শেহজাদ গলার স্বর ভয়ংকর ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
‘কে পাঠিয়েছে তোমাকে? নাকি তুমি নিজে শত্রুতাবশত আমাকে খুন করতে এসেছ?’

মহির চোখ পরিবর্তন হচ্ছে। চেহারায় কঠোরতা জন্মাচ্ছে। আস্তে আস্তে মহি নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। শেহজাদের দিকে কিছুক্ষণ ঠাই চেয়ে থেকে আচমকা তার হাত থেকে জোরপূর্বক ছু/রি নিজের হাতে নিয়ে পেটে ঢুকিয়ে ফেলে। শেহজাদ চমকে উঠে আকষ্মিক এমন আচরণে। লোকটা পেট থেকে গলগল করে র/ক্ত পরছে। শেহজাদ সঙ্গেসঙ্গে ছু/রি পেট থেকে বের করে ফেলে। মহি মাটিতে লুটিয়ে পরে। দুর্বল হাতে শেহজাদের হাত নিজের দিকে টেনে ধরে। শেহজাদ ঝুঁকে। মহি ধীর গলায় শেহজাদের কানে কাছে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘আ-মি আ-ল্লাহর কা–ছে বিছার দিমু আ-ফনার নামে, নে-তা-সা-হে-ব।’
মহি কথাটা বলেই ঢলে পরে শেহজাদের কোলে। শেহজাদ হতভম্ব হয়ে পরে মহির কথা শুনে। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে মহির মরদেহের পানে। মৃত্যুর আগে মহির শেষ কথাটা শেহজাদের জন্যে অ/ভিশা/প ছিল, শেহজাদ বিশ্বাস করতে চায় না।
‘মহির লাশ দাফনের ব্যবস্থা করুন। আর খবর নিন তার পুরনো দিনের সকল কার্যক্রমের। কোথায় যায়, কি করেছিল, কার সঙ্গে মিশে, সব খবর নিন। আমাদের আপন মানুষ আমাদের শত্রু হয়ে যাচ্ছে, ব্যপারটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর।’
পাশ থেকে মর্তুজা মাথা নাড়ায়। শেহজাদ আলগোছে চোখের কোণার জল মুছে গাড়িতে চেপে বসে।

‘মেহজাদ কোথায়? ডাকুন তাকে।’
মর্তুজাকে আদেশ করে শেহজাদ। মর্তুজা বুঝতে পারে আজ দু ভাইয়ের মধ্যে বড়সড় দন্ধ লাগবে। মর্তুজা এগিয়ে যায়। বোঝানোর চেষ্টা করে শেহজাদকে,
‘ছোট মানুষ ছেলেমানুষি করেছে। ক্ষমা করে দিন।’
শেহজাদ গম্ভীর স্বরে জানায়,
‘নিজের জীবন বাজি রাখাকে ছেলেমানুষিঐ বলে না, মূর্তজা সাহেব। ও সজ্ঞানে আজ এতবড় কান্ড ঘটিয়েছে। আমার ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ডাকুন তাকে।’

মর্তুজা আরেকবার বোঝানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয় শেহজাফের রক্তিম চোখখানা দেখে। মর্তুজা মাথা নত করে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে মেহজাদ সমেত। মেহজাদ ততক্ষণে কাপড় পাল্টে জিন্স—শার্ট পরে নিয়েছে। মেহজাদের পিছু পিছু রেখাও আসেন। মূলত মেহজাদ রেখাকে পাকের ঘর থেকে টেনে এনেছে নিজের সঙ্গে। শেহজাদ রাগ বরাবরই চূড়ান্ত। কিন্তু আজ যা করেছে, যেকোনো সময় মেহজাদের গায়ে হাত তুলে ফেলতে তার দ্বিধা হবে না। শেহজাদ রেখাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,

‘আম্মাজান, আপনি ভেতরে যান, ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।’
রেখা শুনেন না। বরং আরাম করে সোফায় বসেন। শেহজাদের দিকে চেয়ে বলেন,
‘আমার ছেলের পা/প আমি দেখব, তুমি না। তুমি ভাই হয়ে যেটুকু বলার আমার সামনে বলতে পারো।’
শেহজাদের রাগ বাড়ছে। তবুও সে যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করে মেহজাদের কা/টা কানের দিকে চেয়ে বলে,
‘তোমার কানে ব্যান্ডেজ কেন আম্মাজানকে বলেছ?’

মেহজাদ চট করে ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে বলে,
‘গাছের কাটার সঙ্গে লেগে ছিলে গেছে।’
‘গাছের সঙ্গে লেগে? নাকি ছুরি লেগে? সত্যি বলো। মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ।’

রেখা ভ্রু কুঁচকে মেহজাদের দিকে চেয়ে। কান কা/টার বিষয়ে মেহজাদ তাকেও একই উত্তর দিয়েছে। অথচ ছুরি দিয়ে কান কেটেছে সে? ভয়ে আঁতকে উঠলেন রেখা। ছোট ছেলে গ্রামে আসতে না আসতে শ/ত্রুপক্ষের নজরে পরে গেছে? রেখা রাগান্বিত দৃষ্টি এবার মেহজাদের দিকে। মেহজাদ বুঝতে পারে বিষয়টা তার বিপক্ষে যাচ্ছে। তাই সে শেহজাদকে উত্তর দেয়,
‘আমি বুঝতে পারিনি তোমার মত মানুষের গ্রামে এত শত্রু থাকতে পারে। আমি তো শুধুমাত্র মজা করতে চাইছিলাম। কিন্তু মজা হয়ে গেল সাজা। সরি, আর তুমি সাজব না কখনো, প্রমিজ।’

শেহজাদ কিছু বলবে, পাশ থেকে রেখা উত্তর দেন,
‘নেতা মানুষের শ/ত্রু থাকবেই, চাই সে ফেরেশতা নেতা হোক কিংবা শয়/তান নেতা হোক। তোমার বোঝা উচিত ছিল তা। তুমি কিন্তু এখনো ছোট নও। শেহজাদ যেখানে তোমার বয়সে একটা গ্রাম সামলাচ্ছে, সেখানে তুমি এই বয়সে এখনো ছেলেমানুষি// করে বেড়াচ্ছ। নিজেকে শুধরে নাও সময় থাকতে। আমাদের যেন তোমার জন্যে আর মুশকিলে পরতে না হয়।’

মেহজাদ মাথা নত করে আছে। শেহজাদ বুঝতে পারে মেহজাদ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। শেহজাদ এগিয়ে আসে। মেহজাদের কাঁধে দুহাত রেখে‌ আদর কণ্ঠে বলে,
‘তুমি নেতাবংশের প্রাণ, মেহজাদ। তোমাকে কেউ কখনো জোড় করবে না যে তুমি দায়িত্ত্ব কাঁধে নাও।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৩

তুমি এভাবেই উড়তে থাকো আকাশে, পুরো আকাশ আমরা তোমার নামে করে দিয়েছি। কিন্তু দিনশেষে বেশি উড়লে লাগাম টানার দায়িত্ত্ব আমাদের। আমরা শুধুমাত্র আমাদের দায়িত্ত্ব পালন করছি। গ্রামে এসেছ বহু বছর পর, কিছু জানো না গ্রাম নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে তোমার জ্ঞান এখনো শূন্য। জানো, বুঝো, তারপর শেহজাদ নয়, মেহজাদ সেজে সবাইকে ভরসা দেবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায়।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৫