খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৫

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৫
আভা ইসলাম রাত্রি

কটা দিন পেরিয়ে গেছে। চিত্রা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসছে আয়ুষ্মানদের সঙ্গে। কথা বার্তা আগের চেয়ে ঢের উন্নত হয়েছে। চিত্রার পক্ষ থেকে সম্পূর্ন চেষ্টা করছে আয়ুষ্মান বাড়ির যোগ্য বউ হওয়া। কদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, আয়ুষ্মানদের দোতলা বাড়িটার রঙে ঝং ধরেছে। সম্পূর্ন বাড়ি নতুন করে সাজানো হচ্ছে আবারো।

বাড়ির বড় ছেলে বিয়ে করেছে, বাড়ি না সাজালে চলে? সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; বাড়ির উঠোন সাফ করা হবে, বাড়ি রং করা হবে এবং শেহজাদের ঘর ভেঙে আরো বড় করা হবে। দুদিন পর নাতি–পুতি আসবে, ও ঘরে জায়গা হবে না। বাড়িতে কাজ হচ্ছে, সে কারণেই আজ শেহজাদ সকাল থেকে বাড়িতে। সাদা রঙের লুঙ্গি–ফতুয়া গায়ে শেহজাদ বড্ড ব্যস্ত আজ। বাড়ির উঠোনে মিস্ত্রিদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির উঠোনের পূর্ব পাশে তুলসী গাছের ঝোঁপটা আজকাল কারো ঠিকঠাক পছন্দ হচ্ছে না। শেহজাদ তাই মত প্রদান করল, ঝোঁপ কেটে ফেলার। নওশাদ বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘তুলশি গাছ স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। কেটে ফেলা উচিত হবে না।’
শেহজাদ কানের পেছনে পেন্সিল গুঁজে ইতি অতি চেয়ে উত্তর দেয়,
‘বাড়ির পেছনে দুটো তুলশি গাছ লাগানো হয়েছে। ওতেই চলবে। উঠোনে ঝোঁপের দরকার নেই, সৌন্দর্য্যে ভাটা পরছে।’
সৌরভ শেহজাদের ঘর ভাঙার বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন মিস্ত্রিকে। একপর্যায়ে শেহজাদ এবং নওশাদের দিকে তাকান। বাপ–ছেলে বড্ড ব্যস্ত বাড়ি সাজাতে। সৌরভ মিস্ত্রিকে সব বুঝিয়ে দিয়ে এলেন তাদের কাছে।

‘আমি বলছিলাম কি, শেহজাদের পাশের ঘরটা পলাশকে ভেঙে বড় করে দেওয়া হোক। ও আসছে কমাস পর, ও তো নতুন বিয়ে করল।’
সৌরভের কথা শুনে নওশাদের রঙ পাল্টে যেতে দেখা গেল। তিনি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলেন। পুরনো খোঁচাখানা ঝেড়ে বললেন,
‘বিদেশি খ্রিষ্টান মেয়ে বিয়ে করে এ বাড়িতে জায়গা চাই নাকি আবার? আমরা মুসলিম বংশের হয়ে ওকে এ বাড়িতে আসার অনুমতি দিতেই কুণ্ঠাবোধ করি।’

কথাগুলো সৌরভের বুকে ঘা হয়ে বিঁধে। ছেলের এ কাজে তিনি এখন অব্দি মোটেও আশকারা দেন নি। এ বাড়ির লোকেরা পলাশের উপর এ কারণে বড্ড ক্ষিপ্ত। পলাশের স্ত্রী সদ্য গর্ভবতী। অথচ কেউই একবার টেলিফোনে পলাশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সৌরভ চেয়েছিলেন একবার যোগাযোগ করতে। কিন্তু বিবেকে বাঁধা দেয় তার। মুসলমান হয়ে খ্রিস্টান মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ধর্মমতে বিয়ে বৈধ নয়। এ কথা তারা বারবার বিয়ের আগে পলাশকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

বিয়ের আগে শেহজাদ নিজে ব্রিটেন যায় পলাশকে বোঝানোর জন্যে। কিন্তু পলাশ নাছোড়বান্দা ন্যায় শেহজাদসহ সবার কথা অমান্য করে। উল্টো শেহজাদকে বাড়ি থেকে নানা কথা শুনিয়ে বিদেয় করে দেয়। এ কারণে বাড়ির লোক পলাশের ছায়া অব্দি মারাতে চান না। সৌরভের এতদিন ছেলের সঙ্গে সকল প্রকার যোগাযোগ ছিন্ন করে রাখলেও, আজকাল ভীষন মনে হচ্ছে ছেলেকে। একবার টেলিফোন করবেন ভেবেও করা হচ্ছে না। বারবার ধর্মের মত বিশেষ জায়গায় আঘাত হানছে।

কিন্তু আজ নওশাদ তাকে এমন করে না বললেও পারতেন। সৌরভ মনোকষ্টে পাশ থেকে সরে গেলেন। আবারো কাজে লেগে পূর্বের দুঃখ ভোলার চেষ্টায় রত। শেহজাদ হয়ত বুঝতে পারল সোরভের ব্যপারটা। সে নওশাদকে বলল
‘চাচাজান কষ্ট পেয়েছেন। ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। ছেলে উনার, আমি লক্ষ্য করছি উনার কিছুদিন ধরে পলাশের জন্যে মন টানছে।’
নওশাদ ছেলের কথায় হুশ ফেরে।

ভাইয়ের কষ্ট এখন উপলব্ধি করতে পেরে আত্মগ্লানিতে ডুবে যান। আসলে পলাশের উপর রাগ এখনো চূড়ান্ত সকলের। তাই যখনই বাড়িতে পলাশের কথা তোলা হয়, তাদের রাগ ছুঁড়ে পরে কণ্ঠ থেকে। নওশাদ বুঝতে পারলেন কথাটা বেশি রুঢ় হয়ে গেছে। তাই তিনি তাৎক্ষণিক সকল রাগ ঝেড়ে ফেলে দ্রুত ভাইয়ের দিকে ছুটেন।
চিত্রা এক বড় ট্রেতে করে কয়েক কাপ চা নিয়ে আসে উঠোনের দিকে। সকল মিস্ত্রি কাজে লেগেছে। বাড়ির পুরুষরা বারান্দায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন এবং কাজ দেখছেন। চিত্রা সৌরভ এবং নওশাদকে প্রথমে চা দেয়। শেহজাদের দিকে আসবে, পাশ থেকে মেহজাদ চেঁচায়,

‘ভাবিজান, আগে আমাকে দিন। কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি।’
মেহজাদের কথা শুনে সবার চক্ষু চড়কগাছ। কাজ করা দূরের কথা, মেহজাদ সবে ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকাল পেরিয়ে দুপুর করা মেহজাদের নিত্যদিনের রুটিন। চিত্রা নিঃশব্দে হেসে উঠল। শেহজাদের দিকে একপল চেয়ে মেহজাদের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মেহজাদ সবার ভ্রু কুঁচকে চাওনি দেখে চিত্রার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘দেখেছেন ভাবিজান, আমার কাজের কেউ কোনো মূল্যই দিচ্ছে না? কাল থেকে আর কাজ করব না, শুধু ঘুমাব। সিদ্ধান্ত ফাইনাল।’
চিত্রা হালকা হেসে বলল, ‘একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দেবরজি।’
মেহজাদ চিত্রার মুখে আপনি সম্বোধন শুনে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ভাবিজান, আপনি বলে ছোট মানুষকে লজ্জা দিবেন না। আপনি নিজের স্বামীকেই বলুন, আমাকে তুমি বললেই চলবে।’

বড়দের সামনে এহেন কথা চিত্রাকে লজ্জায় নাস্তানাবুদ করে ফেলল। চিত্রা আড়চোখে সবাইকে দেখে মেহজাদের দিকে চোখ রাঙানোর ভান করে সরে গেল। শেহজাদের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। শেহজাদ চিত্রার দিকে একপল চেয়ে চায়ের কাপ হাতে নেয়। চিত্রা চা দিয়েই ভেতরে চলে যায়।
শেহজাদ কথা তুলে এবার,
‘বাড়িতে বড্ড সাপের উপদ্রব বাড়ছে। সাপুড়ে ডাকানো লাগবে দ্রুত।’
সৌরভ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,

‘ডাকা হয়েছিল সেদিন। বাড়িতে সকল গর্তে মোম গলে ঢেকে দিয়েছে। আর ভয় নেই।’
‘আমার মনে হচ্ছে, সাপগুলো এত সহজে গর্তে আটকা পরেনি। ভয় তো একটা থেকেই যাচ্ছে। সাপুড়ে ডেকে সাপ মারানো লাগবে। পরবর্তীতে মোম নষ্ট হলে যেন বেরিয়ে আর কারো ক্ষতি করতে না পারে।’
‘বাড়ির কাজ শেষ হলে করা হোক। এখন একসঙ্গে দুটো কাজ করা যাবে না, ভেস্তে যাবে সব।’
‘চাইলেই করা যাবে। মেহজাদকে দায়িত্ত্ব দেওয়া হোক। ওর আপাতত কোনো কাজ নেই। সারাদিন পরে পরে না ঘুমিয়ে সাপের দিকটা ও দেখুক।’

মেহজাদ সেলফোনে বার্তা পাঠাচ্ছিল কাউকে। শেহজাদের কথা শুনে সে সেলফোন রেখে চমকে বলল,
‘আমি পারব না এসব সাপ টাপ নিয়ে কাজ করতে। কামওন! আ’ম অ্যান ইঞ্জিনিয়ার, সাপুড়ে নই।’
শেহজাদ চায়ের কাপ রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফতুয়া টেনেটুনে ঠিক করে যেতে যেতে মেহজাদের উদ্দেশ্যে বলে গেল,
‘বাড়াবাড়ি না করে কাজে লাগো দ্রুত। সন্ধ্যার মধ্যেই কাজ শেষ হওয়া চাই।’
শেহজাদ বলে গিয়েছে মানে কাজটা সময়মত হওয়া চাই। কি করবে আর? মেহজাদ বিরক্ত হয়ে উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে সাপুড়ে ডাকতে।

শেহজাদ ঘরে এসে সোজা গোসলে প্রবেশ করে। চিত্রা আগে থেকে কল থেকে পানি ঢেলে বালতি ভরে রেখেছে। শেহজাদ গোসল করে বেরিয়ে এসেছে। বিছানায় শেহজাদের পাঞ্জাবি–পাজামা রাখা। চিত্রার দায়িত্বশীলতা দেখে শেহজাদ খুশি হয়ে ঠোঁট বাঁকায়। গা ঝাঁকিয়ে বিছানার দিকে এগুয়। ধীরে ধীরে তার জীবনের নারী সংসদ শিখে যাচ্ছে!

শেহজাদ পাঞ্জাবি পরেছে সবে, তখন চিত্রা ঘরে ঢুকে। চিত্রাকে দেখে শেহজাদ বোতাম লাগানোর জন্যে বাড়ানো হাত ছেড়ে দেয়। ইশারায় চিত্রাকে কাছে ডাকে। চিত্রা স্বলজ্জ শেহজাদের কাছে আসে। এতদিনে অভ্যাস হয়েছে শেহজাদের ইশারায় একের পর এক কাজ শিখতে। শেহজাদ যখন চিত্রাকে পাঞ্জাবির বোতাম লাগানোর জন্যে ডাকে, চিত্রা লজ্জায় থেমে থাকে, এগুয় না। কিন্তু মনেমনে শেহজাদের বুকে লুটিয়ে পরে। চিত্রা নিজের লজ্জাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। আজকাল চিত্রার কাছে তার লজ্জাকে শত্রু মনে হয়। মনে হয়, লজ্জা না থাকলে চিত্রা শেহজাদের বুকে কত আরামে লুটোপুটি খেতে পারত। আর ওই….একখান চুম্বন…ইশ! ভাবতে ভাবতেই চিত্রা লজ্জায় জমে যাচ্ছে। ভাবনাটাও আজকাল লাগাম ছেড়েছে। কিসব ভেবে যায় সারাদিন, লজ্জায় মরণ না হয় একদিন চিত্রার।

‘ভাবছ কি এত? আসো এইদিকে।’
শেহজাদ গম্ভীর স্বরে আবারও ডাকে। চিত্রার এবার ধ্যান ভাঙে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় শেহজাদের দিকে। বোতামে হাত ছুঁতেই কেঁপে উঠে সর্বাঙ্গ। চিত্রা আবেশে যেন ঢলে পরতে চায়। তবে শেহজাদ চিত্রার কোমরে হাত রেখে আগলে রাখে যত্নে। চিত্রা একের পর এক বোতাম লাগায়। শেহজাদ বারবার চিত্রাকে এমনভাবেই নাস্তানাবুদ করতে থাকে।

শেহজাদ উপভোগ করে, যখন লজ্জা এবং অস্বস্তিতে চিত্রার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপে, রক্তিম হওয়া মুখের দশা বড্ড আবেদনময়ী ঠেকে শেহজাদের দৃষ্টিতে। মুহূর্তে শেহজাদের চোখের দৃষ্টির আপনা আপনি বদলে যায়। বরং ঘোলাটে দু চোখে জন্মায় কেমন মোহ! দু চোখে যেন নেশায় সমুদ্রে উপচে পরেছে। চিত্রা এখনো লক্ষ্য করেনি শেহজাদের বদলে যাওয়া দৃষ্টি। বরং শেহজাদের গলা অব্দি নাগাল না পাওয়ায় বারবার পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হবার চেষ্টা করছে। তা দেখে শেহজাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে কিছুটা নিচু হয়ে দাঁড়ায়, নচেৎ হাঁটু সমান চিত্রা নাগাল পায় না শেহজাদের।

বোতাম লাগানো শেষ হলে চিত্রা সরে যাবে। অথচ সরে যেতে পারে না। বরং সম্মোহনে আটকে থাকা শেহজাদ তার বাহু আটকে ধরে। চিত্রা থমকে যায়। শেহজাদ ঠাই চেয়ে থাকে চিত্রার চোখের দিকে। চিত্রা লজ্জায় নত হয় কিছু। শেহজাদ যখনই এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চিত্রাকে ছুঁয়ে দেয়, চিত্রা বেসামাল হয়ে পরে আবারো। এই তো; এখনো বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে।
‘কি দেখেন এত?’—কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে চিত্রা।

চিত্রার কথায় ধ্যান ভেঙে শেহজাদের একবার চোখের পলক ফেলে। চিত্রার বাহুতে থাকা হাতের বাঁধন আরো একটু শক্ত করলেই ব্যথায় চোখ বুজে চিত্রা। শেহজাদ ফিচেল গলায় আওড়ায় একটা কথা;
‘আজকাল বড্ড জালাচ্ছ, সুভাষিণী! জ্বালানো বন্ধ করতে অতিশীঘ্রই খু/ন করা হবে তোমার মধ্যের আপন এক অনুভূতিকে। তৈরি থেকো! মনে রেখো, এ পুরুষ কিন্তু মোটেও জনদরদী নয়।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৪

কথা শেষ করার পরপরই শেহজাদ চিত্রার হাত ছেড়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। চিত্রা থমকে তাকিয়ে থাকে শেহজাদের যাবার পানে। এমন সাংঘাতিক বুলির মর্মদ্ধার করা সম্ভব হয় না চিত্রার পক্ষে। চিত্রার চোখ টলমল করে উঠে মুহূর্তেই। আবেগে কেমন নুইয়ে পরে দেহখানা।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৬