খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৬

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৬
আভা ইসলাম রাত্রি

আয়ুষ্মান বাড়ির মহিলা থেকে ভৃত্যদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে নিরাপদ স্থানে। বাড়িতে চারজন সাপুড়ে ডেকে এনেছে মেহজাদ। শেহজাদ নেই, বেরিয়েছে ঘর থেকে। শহরে যাবে আজ, মন্ত্রী এসেছেন একজন। তার সঙ্গেই আলাপচারিতা চলবে। তাই বাড়িতে সব সামাল দিচ্ছেন সৌরভ, নওশাদ এবং মেহজাদ। সাপুড়ের নেতা চারপাশ দেখে ভাবুক হলেন। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘জনপূর্ন বাড়িতে বিষধর সাপের আভাস পাইতেছি, আয়ুষ্মানসাহেব। ইহা হইবার কথা না, বিষধর সাপ থাকে জঙ্গলে, ঝোঁপে। আপনাগো বাড়িতে আইলো ক্যামনে?’
মেহজাদ বরাবরই আধুনিকমনস্ক। সে সাপুড়েদের কথায় বিশ্বাসী নয়। সাপ থাকবে সেখানে, যেখানে সাপ আরাম পাবে। ময়লা আবর্জনা বাড়ির কোণে কোণে থাকলে সাপ তো ঘর বাঁধবেই। মেহজাদ আইফোন জিন্সের পকেটে পুড়ে এগিয়ে এল। সাপুড়ের দিকে চেয়ে জানাল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘সাপের পাঠ আমরা বুঝি না, তাই আমাদের বলে লাভ নেই। আপনি সাপ মারা শুরু করুন।’
সাপুড়ের নেতা জবাব দেন,
‘সাপ মারা আমাগো ধর্মে নেই। তবে আমরা সাপ একজায়গায় জড়ো কইরা ঝুড়িতে নিয়ে জঙ্গলে ফালাই দিয়ে আমু। রাজি হইল কন।’
সৌরভ কিছু বলবেন, পাশ থেকে মেহজাদ উত্তর দিয়ে ফেলল,
‘ঠিকাছে, তাই করুন তবে।’

সৌরভের খটকা লাগে যেন। তিনি মেহজাদের কথা মেনে নিতে পারলেন না। অসম্মতি জানিয়ে বললেন,
‘মেরে ফেলার কথা বলছে শেহজাদ। তুমি পাকনামি করছ কেন, মেহজাদ।’
‘অবলা সাপ মেরে কি হবে, চাচাজান? এমনিতেই ওদের ঘরের সামনে মোম ঢেলে ওদের দম বন্ধ করে অর্ধেক মেরেই ফেলেছেন। বাকি আর করার প্রয়োজন নেই। সব সাপ জঙ্গলে ছেড়ে দিলে এ বাড়ি মুখ আর হবে না। ডোন্ট ওরি।’
সৌরভ মেহজাদের বিচক্ষণতা দেখে মনেমনে প্রসন্ন হলেন বটে। তিনিও তাই অনুমতি দিলেন।

সাপুড়ে কাজ শুরু করে দিল। সাপের বিন বাজানো হল। চারজন অভিজ্ঞ সাপুড়ের একাধারে বিন বাজানোর ফলে চারপাশ মোহিত হল। এক পর্যায়ে চারপাশ থেকে অসংখ্য সাপ জড়ো হতে লাগল সাপুড়ের আশেপাশে। সাপুড়ে তবুও বিন বাজানো বন্ধ করলেন না। বিন বাজানো চলতেই থাকল। সাপেরা ক্ষণেক্ষণে ফোঁসফোঁস করে উঠছে সাপুড়ের সামনে। সাপুড়ে থেমে থাকে না তবু। সব সাপের বিষ দাঁত ভেঙে কটা ঝুড়িতে পুড়ে ফেলে তারা। তবে এক সাপ থেকে যায়। এ সাপের বিষ দাঁত ভাঙা হয়না, বরং সাপুড়ে নিজের কাজে এ সাপ ব্যবহার করবে বলে অন্য এক বিশেষ ঝুড়িতে পুড়ে রাখে। মেহজাদ তীক্ষ্ম চোখে সাপেদের লীলাখেলা দেখে। তার বুকটা কেঁপে উঠেছে সাপের প্রভাব দেখে। বিষধর সাপ সবাই ভয় পায়, বিষয়টি তাকে রোমাঞ্চকর করে তুলছে।

সাপুড়ে সব সাপ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সৌরভ উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে সাপুড়ে বিদায় করে। সাপুড়ে চলে যেতেই মেহজাদ সৌরভকে ‘একটু বেরুচ্ছি’— বলে দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

‘সাপুড়ে, দাড়াও!’
সাপুড়ে থামে। সহাস্যে পেছনে ফেরে চায়। মেহজাদ তাদের সামনে এসে হাঁটু ভেঙে দাড়ায়। হাঁপিয়ে গিয়ে শ্বাস ফেলছে ক্রমাগত। সাপুড়ে বলল,
‘আমি ভাবছিলাম, আপনি আমাগো ডেরায় যাইবেন।’
‘না, জিনিসটা এখানেই দিয়ে দিন। দুই মাইল পেরিয়ে ডেরায় আবার যাওয়ার সাহস নেই।’
সাপুড়ে বিষধর সাপের সেই বিশেষ ঝুড়ি এগিয়ে দিল মেহজাদের দিকে। মেহজাদ ঝুড়ি হাতে নেয়। কিছুটা ভয়ে আছে সে। তাই ঝুড়ি আলগোছে হাতের পিঠে আগলে রেখেছে। সাপুড়ে বলল,

‘সাপ পালার অনেক নিয়ম আছে, আয়ুষ্মানসাহেব। আমি যে পুঁথি দিসি আপনাকে, ঐটা খেয়ালে রাখবেন। দরকার হইলে আমায় স্মরণ করবেন। কারো ক্ষতি করবেন না সাপ দিয়ে, সাপের সঙ্গে অন্যায় করবেন না। মনে রাখিয়েন, সাপ পোষা এই ধরণীর ক্ষতিকারক কাজের মধ্যে এখটা।’
মেহজাদ একবার নিজের হাতের ঝুড়ির দিকে তাকায়, পরপরই সাপ পোষার আবেশে চোখ বুজে আসে তার। সে সাপুড়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘ঠিকাছে, আমি মেনে চলব। আর একটা অনুরোধ, আমাদের বাড়ির কেউ যেন এ ব্যাপারে না জানে। এটা খেয়াল রাখবেন।’
‘ঠিকাছে। আপনি সাপ পালার সব নিয়ম মাইনা চললে, আমরা কাউকে কিছু বলব না।’

‘গ্রামের নেতা এবার জেলার নেতৃত্ব চায়? বাহ রে বাহ নেতাসাহেব।’
শেহজাদ ভীষন আরামে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। যেন সে তাদের সকল তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য মন দিয়ে শুনবে। একফাঁকে ভৃত্য এসে দু কাপ চা দিয়ে যায়। শেহজাদ চায়ের কাপ হাতে তুলে। মন্ত্রী অমল ঠাকুর শেহজাদের এহেন ভাবলেশহীন আচরণে যারপরনাই বিরক্ত। তিনি রেগে বললেন,

‘গ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছি, সেই ভগবানের কাছে মাথা ঠুকো। জেলার দিকে নজর দিও না। ঐটা আমার ভাইপোর নামে। আসছে বছর আমার ভাইপো ইলেকশনে দাড়াবে।
শেহজাদ চায়ের কাপ টেবিলে শব্দ করে রাখে। অতঃপর ছোট স্বরে জানায়,
‘ভগবান নয়, আমি আল্লাহর কাছে চাইছি। আপনি শুধু ওসিলা। দিবেন কি না বলেন। গ্রামবাসী আমাকে চায় অনেক, এবার জেলাবাসির কাছে নিজেকে মহান করতে আমার বেগ পোহাতে হবে না বেশি। জানেন তো?’

অমল ঠাকুর এবার নিজের রাগ সংবরণ করতে পারেন না। শেহজাদ একদম জায়গামতো কঠুরাঘাত করেছে। শেহজাদ একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তাকে আটকানো যাবে না সহজে। একবার কোন কুক্ষণে গ্রামের নেতা বানাতে সাহায্য করেছিল। এখন এই পাতি নেতা তার শরীরের বিষ-ফোঁড়া হয়ে উঠেছে। অমল ঠাকুর নিজের দুর্বল হওয়া শেহজাদের সামনে প্রকাশ করেন না। বরং মুখ বাঁকিয়ে আওড়ান,
‘যা ইচ্ছে করো। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।’

শেহজাদ এবার হালকা হাসল। তাৎক্ষণিক সে হাসি হাওয়াই মিঠাইর ন্যায় মিলিয়েও গেল আবার। শেহজাদ গলার স্বর তীব্র করে বলে,
‘কেন রাগাচ্ছেন আমায়, ঠাকুর মশাই। আমার রেগে যাওয়া আপনার পক্ষে ক্ষতিকারক। জানেন তো?’
অমল ঠাকুরের বুক কেঁপে উঠে খানিক। তবুও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। শেহজাদের পক্ষে তার ‘না’–কে ‘হ্যাঁ’ করা সম্ভব হয়না। শেহজাদ গা ঝাঁকায়। তার কি করতে হবে সে বুঝে গেছে। শেহজাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রোদচশমা চোখে পরে কুঁচকে যাওয়া পাঞ্জাবি ঠিকঠাক করে। অমল ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলে,
‘বাঘকে ক্ষেপাতে নেই, ঠাকুর মশাই। শেষ অব্দি ধাওয়াটা নিজেকেই খেতে হয়। শেহজাদ আয়ুষ্মান এর এই কথাটা মনে রাখবেন।’

শহর থেকে ফেরার পর থেকে শেহজাদের মন মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ। সে কারো সঙ্গে কথা বলেনি। রাতেও ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করেনি। রাতের বেলায় সবসময় লাইব্রেরীতে বসে। আজ সেখানেও শেহজাদের শূন্যতা বিরাজমান। চিত্রা রেখার মুখে শুনেছে,
শেহজাদের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর ঝামেলা হয়েছে। তাই শেহজাদ আজ সারাদিন রেগে বসে আছে। এখন তার সামনে পরা মানেই জেনেবুঝে সিংহের গুহায় মরা।

চিত্রা মনেমনে ভাবে কতকিছু। এও ভাবে, একজন মাটির মত মানুষের সঙ্গে এত ঝামেলা হয় কেন মানুষের? খু/ন করতে অব্দি চায় তাকে? চিত্রার এসব প্রশ্নের জবাব মেলে না।
আতঙ্কে চিত্রার বুক কেঁপে উঠে। চিত্রার হাতে রেখা নিজের বানানো এক কাপ কড়া লিকারের চা ধরিয়ে দেন শেহজাদকে দেবার জন্যে। চিত্রা ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। যা শুনেছে, তাতেই পা কাঁপছে তার শেহজাদের ঘরে যেতে। তবুও রেখার আদেশে চিত্রা যায় শেহজাদের কাছে।
‘আ-পনার চা।’

শেহজাদ বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বুজে। চিত্রা শিয়রের পাশে এসে দাঁড়ায়। শেহজাদ চোখ না খুলে উত্তর দেয়,
‘খাব না, নিয়ে যাও।’
‘আ-ম্মাজান পা-ঠিয়েছেন।’
রেখা পাঠিয়েছে শুনে শেহজাদ মানা করতে পারে না আর। উঠে বসে। চিত্রা চায়ের কাপ টেবিলে রাখে। শেহজাদের চোখ রক্তিম হয়ে আছে। যেন যেকোনো মুহুর্তে সে সামনে থাকা চিত্রাকেই ভক্ষণ করবে। চিত্রার আত্মা ধিরিম–ধিরিম করে লাফাচ্ছে। শেহজাদ চায়ের কাপ হাতে নেয়। চিত্রা পালিয়ে যেতে চায় ঘর থেকে। তবে পেছন থেকে শেহজাদ ডাকে
‘দাঁড়াও, যাবে না।’

চিত্রা থেমে যায় তাৎক্ষণিক। সহসা পেছনে ফিরে তাকায়। শেহজাদ আঙ্গুলের ইশারা করে কাছে ডাকে চিত্রাকে। চিত্রা আগায়। ধীর পায়ে বিছানায় শেহজাদের পায়ের কাছে বসে। শেহজাদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে অপলক চেয়ে আছে চিত্রার দিকে। এমন অস্থির চাওনি চিত্রার সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতরটা কেমন ব্যাঙের মত লাফাচ্ছে। শেহজাদ যখনই এমন করে চিত্রার পানে তাকায়, চিত্রার বোধ হয় সে খু/ন হয়ে যাচ্ছে। আজ অব্দি কাউকে চিত্রা এমন তীব্র নেশাছন্ন ভাবে তাকাতে দেখেনি। এমন চাওনি শুধুমাত্র শেহজাদ আয়ুষ্মান এর পক্ষেই সম্ভব। শেহজাদ আয়ুষ্মানের মূল পরিচয়, তার ওই দুখানা চোখ। তার চোখ বলে দেয়, সে কে? কেমন তার ব্যক্তিত্ব?

শেহজাদের এমন স্থির চাওনি দেখে ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে চিত্রা। কিন্তু এমন করে তিনি চেয়ে আছেন কেন? চিত্রা যে। ভয় পাচ্ছে, তা কি তিনি জানেন না, বুঝেন না? শেহজাদ কিছুক্ষণ চিত্রাকে আপাদমস্তক পরখ করে। একসময় চোখ সরিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলে শেহজাদ,
‘তীব্র জ্বলেপুড়ে যাওয়া রাগ চেনো, সুভাষিণী? যে রাগ চারপাশ লন্ডভন্ড করে দিতে চায়, অথচ সক্ষম হয়না? চেনো তেমন রাগ?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৫

চিত্রা ফ্যালফ্যাল চোখে শেহজাদের দিকে চেয়ে। সে বুঝে না, শেহজাদের কথার অর্থ কি? চিত্রা চেয়ে আছে এখনো। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে আবারও তাকায় চিত্রার দিকে। চিত্রার বিস্মিত চাওনি, তিরতির করে কম্পিত ঠোঁট যেন কাছে ডাকছে শেহজাদকে। শেহজাদ অবলীলায় চেয়েই থাকে। একসময় কেমন নেশা জাগ্রত কণ্ঠে প্রশ্ন করে শেহজাদ,
‘তীব্র রাগ কমাতে জানো, সুভাষিণী? শুনেছি, আমার রাগ নাকি পানি মানে না। দেখি তোমায় মানে কি না? কাছে এসো, আঁকড়ে ধরো আমার রাগকে! সমূলে ধ্বংস করো তাদের। সত্যিকার অর্থে একজন স্ত্রীর দায়িত্ত্ব পালন করো এবার।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৭