খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৭

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৭
আভা ইসলাম রাত্রি

‘তীব্র রাগ কমাতে জানো, সুভাষিণী? শুনেছি, আমার রাগ নাকি পানি মানে না। দেখি তোমায় মানে কি না? কাছে এসো, আঁকড়ে ধরো আমার রাগকে! সমূলে ধ্বংস করো তাদের। সত্যিকার অর্থে একজন স্ত্রীর দায়িত্ত্ব পালন করো এবার।’
শেহজাদ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চিত্রার স্তম্ভিত চোখের দিকে। চিত্রার বুক হাপরের মত উঠানামা করছে। হৃদয়খানা আজকাল কথা শুনছে না। সর্বদা দলছুটে পালিয়ে যেতে তৎপর! শেহজাদ ভীষন উপভোগ করে চিত্রার কম্পিত হওয়া মুখ। তাই সে আবারও আদেশ করে,

‘ভয় পেলে চলবে না। কাছে এসো!’
চিত্রা নিজের অনুভূতি সামলাতে পারে না। একহাতে বিছানায় চাদর খামচে ধরে এলোমেলো করে ফেলে চাদর। শেহজাদের ঘোলাটে দৃষ্টি সেদিকেই। শেহজাদ আবারও বলবে কিছু কথা, চিত্রা সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে এসে মুখ চেপে ধরে তার। শেহজাদ বিস্মিত হয় যেন। চিত্রা কাঁপছে থরথর করে। যেন এই মুহূর্তে শেহজাদের গায়ের উমেই তার মরণ। এই যে এত কাছে সে শেহজাদের, চিত্রা মনেমনে এখনই হাজারবার মরে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মানুষটা কেমন অদ্ভুত! তার চোখে যেন নেশা পুষে। ও নেশা একবার যার বুকে বিঁধে, বুকটা যেন ঝাঁজরা হয়ে যায়। চিত্রার এলোমেলো চোখ পরে শেহজাদের চোখে। সঙ্গেসঙ্গে ওই চোখে তলিয়ে যায় চিত্রা। আলগোছে হাত সরিয়ে নেয় শেহজাদের ঠোঁটের উপর থেকে। একহাতে শেহজাদের কোমরের কাছের পাঞ্জাবি খামচে ধরে চেয়েই থাকে। নয়নে নয়ন মেলে। শেহজাদের বুকটাও কাঁপছে, অনুভব করতে পারছে চিত্রা। শেহজাদ আবার বলে,

‘আমার রাগ ক…’
চিত্রা বাকি কথা বলতে দেয় না। চুপচাপ বুকের অস্বাভাবিকতা অগ্রাহ্য করে মাথা নামিয়ে আনে শেহজাদের কপালে। গাঢ় চুমু এঁটে দেয় কপালের মধ্যখানে। শেহজাদের চোখ বুঁজে আসে আবেশে। চিত্রা সরে আসে। মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে,
‘কমেছে?’

শেহজাদ টলমল চোখ তুলে তাকায় চিত্রার চোখে। মাথা নাড়িয়ে ‘না’–বোধক সম্মতি দেয়। চিত্রা এক ঢোক গিলে। শেহজাদের দু গালে হাত রেখে মাথা উঁচু করে তুলে। চুমু খায় ডান গালে। শেহজাদ চোখ বুঁজে। চিত্রা সরে এসে আবারও বাম গালে চুমু এঁটে দেয়। শেহজাদের এডম’স অ্যাপল কেঁপে উঠে তীব্রভাবে। একহাতে চিত্রার কোমর টেনে ধরে নিজের দিকে। চিত্রা মিশে যায় শেহজাদের বুকের সঙ্গে। চিত্রা আর পারছে না।

বুকের ভেতরটা নড়ে উঠছে। এই বুঝি অজ্ঞান হবে সে। চিত্রা শেহজাদের ঘাড়ে মাথা রেখে তীব্রভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। শেহজাদ চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে চিত্রাকে। এ নারী ভীষন নাজুক! সামান্য স্পর্শে দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে চায়। শেহজাদ চিত্রার চুলে ঠোঁট রেখে তৃপ্তি নিয়ে বলে,
‘জাদুকরীর একটু ছোঁয়ায় আমার রাগ পালিয়ে যেতে বাধ্য। তোমার একটুখানি এগিয়ে আসা আমার কাছে তাক লাগানোর ন্যায় ছিল, সুভাষিণী!’

সন্ধ্যার দিকে আয়ুষ্মান বাড়ির সবে নতুন করে তৈরি করা বাড়িতে চা–নাস্তা খেতে বসেছে। পুরুষরা কথা বলছেন, পাকের ঘরে মহিলারা রান্না করছেন এটা সেটা! শোনা যাচ্ছে তীব্র হাসাহাসির শব্দ। আয়ুষ্মান বাড়ি যেন জেগে উঠেছে আবার। শিউলি চিত্রার হাতে কিছু ফল-ফাক্কর কেটে ধরিয়ে দিলেন পুরুষদের দেবার জন্যে। চিত্রা প্লেট নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। শেহজাদ নওশাদের সঙ্গে জেলার ইলেকশনের ঝামেলার কথা বলছে। চিত্রা ঘরে প্রবেশ করলে তাদের এসব কথা বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত যেকোনো ঝামেলা বা অশান্তির কথা থেকে এ বাড়ির পুরুষরা মহিলাদের দূরে রাখেন।

মহিলারা বাইরের খবর জেনে কি করবে? তারা নাহয় ঘর সামলাক! চিত্রা সবাইকে যার যার ফলের প্লেট তুলে দেয়। শেহজাদের কাছে ফলের প্লেট এগিয়ে দিতে শেহজাদ প্লেট নেবার বাহানায় চিত্রার আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। চিত্রা কেঁপে উঠে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। মাথায় আঁচল আরো ভালো করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। শেহজাদের এমন ব্যবহার আর কারো নজরে না পড়ুক, মেহজাদের নজরে ঠিকই পরেছে। মেহজাদ এসব দেখে শুধু হাসছে। শেহজাদ একবার মেহজাদকে চোখ রাঙালে, মেহজাদের হাসি এবার যেন বাঁধ ভাঙে। শব্দ করেই হেসে উঠে সে।

হঠাৎ মেহজাদের মোবাইলে কল আসে। কলের মানুষটা দেখে মেহজাদের চোখের রং বদলে যায়। সে সবাইকে ‘একটু আসছি’– বলে বেরিয়ে যায় বসার ঘর থেকে। সবাইকে লুকিয়ে বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ায়। কল ধরে কানে লাগায় মোবাইল।
‘হ্যালো–’
‘তুম কাহাপে হো, মেহজাদ? ইউএসএতে তো নেহি হো।’
‘আমি বাংলাদেশে।’

সঙ্গেসঙ্গে ওপাশের সুরেলা কণ্ঠ থেমে যায়। মেহজাদ বুঝতে পারে ওপাশের নারী অবাক হয়েছে। মেহজাদ তৎপর হয়,
‘সরি ফর দ্যাট। ইটস অল অ্যাবাউট ম্যাই ফ্যামিলি। ওরা ফোর্স করেছিল। তাই হুট করে দেশে এসেছি।’.
‘কাব ইউএসএ আয়োগে?’
নারীর কণ্ঠের তেজ বদলে গেছে। বরং কণ্ঠে জন্ম নিয়েছে অসম্ভব অভিমান। মেহজাদ অদূরে দৃষ্টি রেখে বিষণ্ণ মনে বলল,
‘ডোন্ট নো। তবে এবার আমি ওদেরকে তোমার কথা বলে দেব।’
‘তুম ইয়ে বহুত বার বোল চুকে হো। পার কাবি সাচ মে নেহি বোলা আপনে ফ্যামিলি মেম্বার কো। কাব বলো গে মেহজাদ?’
‘এইবার সত্যি বলব, ট্রাস্ট মি।’

‘ও লোগ নেহি মানেনগে।’
‘না মানলে সেটা পরে দেখা যাবে। আগে বলে তো দেখি।’
‘হু।’
কিছুক্ষণ থেমে নারী কন্ঠ বলে উঠে বড্ড আবেগে,
‘আই লাভ ইউ মোর দেন এনিথিং, মেহজাদ। তুম মুজে কাবি ছুরোগে নেহি, না?’
‘কাবি নেহি। ট্রাস্ট অন মি, উর্বশী।’

মেহজাদের কথা শুনে বড্ড আশ্বস্ত হয় উর্বশী। বাকি কিছুক্ষণ কথা হয় তাদের মধ্যে। আধা ঘন্টা পর মেহজাদ ফোন কেটে পকেটে রেখে দেয়। উর্বশীকে তো বলল, পরিবারকে তাদের কথা বলে দিবে। কিন্তু কিভাবে বলবে? ওই বাঁধা…বাঁধা উপেক্ষা করবে কিভাবে মেহজদ?
মেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস টানে। কদিন যাক, তারপর বলবে। মূলত পলাশের এ অবস্থা দেখার পর মেহজাদের ভয় হচ্ছে ভীষন। এ বাড়ি ছাড়া মেহজাদের এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না। সে তার পরিবারকে সবার আগে ভালোবাসে। কিন্তু এ পরিবার যদি উর্বশীকে ছেড়ে দিতে বলে? কি করবে মেহজাদ তখন? মেহজাদ এলোমেলো হয়ে যায় এ চিন্তায়।

যা হবার হবে! সময় এলে সব দেখা যাবে। মেহজাদ মাথা ঝাঁকায়। পেছনে ফিরে ঘরে যাবে, সঙ্গেসঙ্গে থমকে যায় তার স্নায়ু। মেহজাদের সামনে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। হাতে চায়ের কাপ। মেহজাদের অবচেতন মস্তিষ্ক আন্দাজ করে, ভাবিজান কি সব শুনে নিয়েছেন? মেহজাদ মুখ হাসিহাসি করার চেষ্টা করে। জিন্সের পকেটে হাত পুরে এগিয়ে যায় চিত্রার দিকে। চিত্রার হাত থেকে চায়ের কাপ নিজের হাতে নিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৬

‘ভাবিজান, ভাইয়ার পেছনে চা নিয়ে ঘোরার বয়সে আমার পেছনে চায়ের কাপ নিয়ে ঘুরছেন! কি মায়া আমার প্রতি ভাবিজানের। আহা!’
চিত্রা কিছুক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেহজাদের দিকে। একটু পর শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘উর্বশী কে? তোমার প্রেমিকা?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৮