খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৮

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৮
আভা ইসলাম রাত্রি

‘ভাবিজান, ভাইয়ার পেছনে চা নিয়ে ঘোরার বয়সে আমার পেছনে চায়ের কাপ নিয়ে ঘুরছেন! কি মায়া আমার প্রতি ভাবিজানের। আহা!’
চিত্রা কিছুক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেহজাদের দিকে। একটু পর শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘উর্বশী কে? তোমার প্রেমিকা?’
চিত্রার অবিচল কণ্ঠে মেহজাদ শুনে। ভাবিজান তবে সব শুনেই নিয়েছেন। তাহলে আর লুকোচুরি খেলে কিবা হবে! মেহজাদের মধ্যে কোনোরূপ ভাবাবেগ দেখা গেল না। সে নিতান্তই স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘হ্যাঁ, আমার প্রেমিকা-ই।’
চিত্রা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে থাকল মেহজাদের পানে। মেহজাদ হঠাৎ চিত্রার এমন কঠোর চাওনি দেখে গুটিয়ে গেল খানিক। তবে প্রকাশ করল না ততটা। ভাবিজান কি রেগে গেলেন? প্রেম করা কি অস্বাভাবিক কিছু? তারা নাহয় পুরোনো আমলের মত প্রেম না করে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। তার মানে কি মেহজাদের প্রেমবিহনে জীবন চলে যাবে? উহু, মেহজাদ জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপলব্ধি করতে চায়। ছোট হতে ছোট বিষয়গুলো যাচাই করে দেখতে চায়। আস্বাদন করতে চায় জীবনের প্রতিটা মোড়ের রস।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহজাদ নিজেকে সামলে ভীষন স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ভাবিজান, প্রেমই করছি, খু/ন নয়।’
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কঠিন স্বরে বলল,
‘বিয়ের আগে প্রেম হারাম, দেবরজি।’
মেহজাদ অলস ভঙ্গিতে গা ঝাঁকাল। বলল,
‘হারাম তো কতকিছুই। সব কি মানি নাকি আমরা।’
‘তাহলে প্রেম করা ছেড়ে দাও।’
মেহজাদ এবার কঠিন চোখে তাকাল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘আপনি কিন্তু—-‘
‘প্রেম ছেড়ে বিয়ে করে ফেলো দ্রুত।’

এ কথা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল চিত্রা। মেহজাদকে ভরকে দিয়ে সে দারুন আনন্দিত। মেহজাদ কেমন করে চেয়ে ছিল এতক্ষণ, ভাবলে হাসি আসছে বাঁধ ভেঙে। মেহজাদ বুঝতে পারল চিত্রা এতক্ষণ মজা করেছে তার সঙ্গে। সে বোকা বোকা চেহারায় মাথা চুলকে তাকাল চিত্রার দিকে। উদাস ভঙ্গিতে জানাল,
‘বিয়ে করাই যেত। কিন্তু ও পলাশ ভাইয়ার স্ত্রীর ন্যায়—খ্রিস্টান।’
সঙ্গেসঙ্গে চিত্রার মুখের রং বদলে গেল। দুহাতে মুখ চেপে ধরে অবাক চোখে তাকাল মেহজাদের দিকে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

‘বিধর্মী! তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ।’
মেহজাদের মধ্যে এখনো কোনো ভাবাবেগ নেই। সে সিঁড়ির উপর পা ছড়িয়ে বসে। চায়ের কাপ চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক চোখে চিত্রাকে দেখছে। চিত্রা কিছুসময় পর স্বাভাবিক হলে মেহজাদ ছন্নছাড়া কণ্ঠে বলল,
‘ভাবিজান, আমি শুদ্ধ মেয়ে মানুষকে ভালোবেসেছি, কোনো জ্বীন, লেসবিয়ান কিংবা অন্য কিছু না। এত রিয়েক্ট করবেন না তো। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’

চিত্রা ‘রিয়েক্ট’ অর্থ কিছু বুঝতে পারল না। তবে এটা বুঝতে পারল, মেহজাদের এসব পছন্দ হচ্ছে না। চিত্রা তাই চুপ থাকল। চেহারার উজ্জ্বলতা আনার চেষ্টা করে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘তোমার ভাইয়া জানেন?’
মেহজাদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানাল, ‘না, কেউই জানে না।’
‘এখন?’
মেহজাদ গা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ডোন্ট নো। দু একদিনের মধ্যে ওদের জানাব। দেখি মানেন কি না। না মানলে—-‘
‘না মানলে কি?’

চিত্রার ভয়ার্ত কন্ঠ। মেহজাদ মৃদু হাসল। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে গেল সিঁড়ি থেকে। চায়ের কাপ চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’
চিত্রা ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইল মেহজাদের চলে যাবার দিকে। মেহজাদ ইংলিশে কি বিড়বিড় করে বলে গেল চিত্রার বোধগম্য হল না কিছুই। চিত্রা তবে বুঝতে পারল, মেহজাদের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ভয়ংকর এক প্রেমরোগ। এ রোগে মেহজাদের বিনাশ নিশ্চিত। বিধর্মী বিয়ে করা ইসলাম ধর্মে অনেক বড় পাপ। মেহজাদকে কেউই এ পাপ করতে দেবেন না। মেহজাদ কি করবে তখন? সংঘর্ষ হবে তাদের মধ্যে? শঙ্কায় চিত্রা কেমন নুইয়ে পরে।

সেদিন রাতে হঠাৎ খুব করে ঝড় এলো। গাছপালা ভেঙে পরছে, মাটির মধ্যে আঁচড়ে পরছে একের পর এক বিদ্যুৎ ঝলকানি। পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ নেই কয়েক ঘণ্টা যাবৎ। আচমকা এমন ঝড় দেখে সবাই বেশ বিস্মিত। বিকেলেই ছিল ভরা রোদ, রোদের তেজ চারপাশ লন্ডভন্ড করে দিচ্ছিল যেন। অথচ এখন—ঝড়ের গুরুমগুরুম শব্দে অতি কাছের মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে না। আয়ুষ্মান বাড়ির গোয়াল ঘরের টিনে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে।

টিনের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পরার সময় যে মধুর শব্দ হয় চিত্রার কাছে তা ভীষন সমনোমুগ্ধকর শোনায়। চিত্রা জানালার কাছে বসে অপেক্ষা করছে শেহজাদের। শেহজাদ আসরের নামাজ পরে বেরিয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে। এখন এ ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে নাকি বাড়ি ফিরছে। না জানি কিভাবে, কোন বাঁধ ডিঙিয়ে বাড়ি আসছে। চিত্রার ভীষন চিন্তা হচ্ছে শেহজাদের জন্যে। চিত্রা জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকাল। বৃষ্টির ফোঁটা হাতে মেখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘কখন ফিরবেন নেতা-শাহ?’

শেহজাদ যখন ফেরে তখন প্রায় মধ্যরাত। কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। গায়ের শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি ভিজে চুবচুব। শেহজাদের কন্ঠ শুনে চিত্রা দৌঁড়ে সদর দরজার তালা খুলে দেয়। চিত্রার হাতে মোমবাতি। মোমবাতির আলোয় আবছা ছায়া পরছে শেহজাদের সুডৌল মুখে। দরজা খোলার পর শেহজাদের প্রথম কথা ছিল,
‘দেরি হয়ে গেল খুব। অপেক্ষায় ছিলে?’
কথাটা বলে শেহজাদ হাঁচি দিল পরপর কয়েকটা। চিত্রার ঠোঁটে হাসি,অথচ চোখে টলমল করছে জলে। সে শেহজাদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল,
‘খেতে আসুন।’

শেহজাদ ঘরে ঢুকল। পাঞ্জাবি বদলে ফতুয়া-লুঙ্গি পরে বের হয়ে পাকের ঘরের দিকে চলল। চিত্রা খাবার গরম করছে। শেহজাদ গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চিত্রাকে। চিবুক রাখে চিত্রার উষ্ণ ঘাড়ে। চিত্রা আচমকা শেহজাদের বরফ ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে। চুলোর আঁচ কমিয়ে শেহজাদকে বলে,
‘ব-সার ঘ-রে যান। খা-বার নিয়ে আ-সছি। ‘
‘এখানেই খাব। খাবার বাড়ো।’
কথা বলে শেহজাদ চিত্রাকে ছেড়ে দেয়। চিত্রা মাদুর পেতে দেয় পাকের ঘরেই। শেহজাদ মাদুরে বসে। চিত্রা প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। আজকে রান্না করা নতুন মাছের তরকারি দেবার সময় শেহজাদ আটকায়। আরেকবার হাঁচি দিয়ে বলে,
‘লাল মরিচ ভাজা আছে?’

চিত্রা কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু প্রশ্ন করে না। মাছের তরকারি এক পাশে রেখে উঠে যায়। খুঁজে খুঁজে বোয়াম থেকে লাল মরিচ ভাজা নিয়ে এসে গরম গরম আবারও ভেজে দেয় শেহজাদকে। দেখা যায়, শেহজাদ ভীষন তৃপ্তি নিয়ে লাল মরিচ ভাজা দিয়েই পুরো ভাত খেয়ে উঠে পরে। চিত্রা বুঝে, শেহজাদের অতিরিক্ত ঠান্ডা লেগেছে। তাই মরিচ ভাজা খেয়ে ঠান্ডা কমাতে চাইছে। শেহজাদ চলে গেলে চিত্রা পাকের ঘর গুছিয়ে ঘরে আসে।
শেহজাদ তখন আলমারির উপর থেকে কম্বল বের করছে। চিত্রা দ্রুত এগিয়ে আসে,
‘আমি বের করে দিচ্ছি, আপনি বসুন।’

শেহজাদ বসে না, নিজেই কম্বল দুইটা বের করে। দুটো কম্বল পেঁচিয়ে বিছানায় ঘুমায়। তবুও শীত মানছে না। চিত্রা মোমবাতি এক পাশে রেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। শেহজাদের কপালে হাত রাখে। ইশ কি ভীষন জ্বর। চিত্রা ব্যস্ত হয়ে পরে মুহূর্তেই। দ্রুত পায়ে তেল গরম করে এনে মালিশ করে দেয়। শেহজাদের শীত কমছে না। ঠাণ্ডায় ফর্সা নাকের ডগা লাল টকটকে। ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চিত্রার বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসছে। মানুষটার হঠাৎ এমন অসুস্থ হল কেন? চিত্রার যে সহ্য হচ্ছে না। প্রিয় মানুষদের যেন কক্ষণো অসুখ না হয়, দূর হোক, দূর হোক। চিত্রা জলপট্টি নিয়ে এসে শেহজাদের কপালে জলপট্টি দেয়। শেহজাদ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,

‘সুভাষিণী, তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, না?’
চিত্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে এবার। শেহজাদের বুকে হাত রেখে বলে,
‘না, একটুও না। আপনার সেবা করতে আমার খুব সুখ লাগছে। এমন কথা বলবেন না। আমি আপনার যোগ্য স্ত্রী হতে চাই, নেতাশাহ।’
শেহজাদ দূর্বল চোখে তাকাল চিত্রার দিকে। চিত্রার গালে অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। শেহজাদ নরম স্বরে জানাল,
‘তুমি আমার যোগ্য স্ত্রী-ই, সুভাষিণী। তো-মাকে এ ব্যাপারে চিন্তিত হতে হবে না।’

চিত্রা কাদঁছে আর জলপট্টি দিচ্ছে বারবার। একপর্যায়ে শেহজাদের অসুস্থতা চিত্রাকে অধৈর্য করে তুলে। সে ঠোঁট নামিয়ে আনে শেহজাদের কপালে। গরম কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই ঠোঁটে যেন আগুন লেগে যায় চিত্রার। তবুও চিত্রা ঠোঁট ছুঁইয়েই রাখে অনেকক্ষণ। চোখ থেকে টুপ করে জল গড়ায় চিত্রার। শেহজাদ চিত্রার স্পর্শ মন থেকে উপলব্ধি করে। সে হাত বাড়িয়ে চিত্রাকে কাছে টানে। চিত্রাকে নিজের বুকের নিচে শুইয়ে তাকায় ঠিক চিত্রার চোখের পানে। চিত্রার চোখ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুতে। শেহজাদ চিত্রার চোখ মুছে দেয় আঙ্গুলের ডগায়। চিত্রার কপালে চুমু খেয়ে গাঢ় কণ্ঠে বলে,

‘আমার খুব কাছে আসবে, সুভাষিণী। খুব কাছে! যতটা কাছে আসলে তীব্র জ্বর হার মানবে আমাদের উষ্ণতার কাছে? ঠিক ততটা কাছে আসবে, প্রিয় সুভাষিণী?’
চিত্রা চোখ বুঁজে জোরেজোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। খুব ভয় করছে চিত্রার। প্রথমবার একজন পুরুষের এতটা ঘনিষ্ট স্পর্শ উপলব্ধি করছে চিত্রা। শেহজাদ চিত্রার ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে হাতের তালুতে চুমু খায় আলতো করে। চিত্রা এবার আর নিজেকে আটকাতে পারে না। হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে শেহজাদের। মুখ গুঁজে প্রিয় মানুষটার ঘাড়ে। শেহজাদ বুঝি হাসল সামান্য।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৭

অতঃপর প্রথমবারের মত দুজনের ঘরে নেমে এলো ভালোবাসার বসন্ত। ছড়িয়ে পরল ভালোবাসার ঘ্রাণ ঘরময়। শেহজাদ জীবনের প্রথমবার তার যৌবনের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিল প্রিয়তমা স্ত্রীকে। আর শেহজাদের সুভাষিণী, সে তো মাতোয়ারা নেতাশাহের উষ্ণ স্পর্শে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৯