খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৯

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৯
আভা ইসলাম রাত্রি

গত রাতের ঝড়ের তান্ডব শেষ হয় ফজরের আযানের পরে। শেহজাদের রাতের জ্বর এখন অনেকটা কমে এসেছে। তবুও একটুখানি মাথা ধরে আছে। চা খেলে কমবে বোধহয়। শেহজাদ অলসতা ভেঙে গোসল করে নামাজের জন্যে তৈরি হয়। মসজিদে যাবার আগে চিত্রাকে ডেকে দিয়ে যায় নামাজের জন্যে। চিত্রা এলোমেলো শুয়ে আছে বিছানায়। শাড়ির আঁচলের গতি ঠিক নেই। শেহজাদ আলগোছে হাত বাড়িয়ে চিত্রার শাড়ি ঠিক করে দিল। নামাজের আরো কিছু মিনিট সময় আছে। তাই শেহজাদ চিত্রার মাথার পাশে বিছানায় বসে। আলতো করে হাত বুলায় চিত্রার চুলে। ডাকে মৃদু স্বরে,

‘সুভাষিণী, নামাজ পরবে। উঠো।’
দু একবার ডাকার পর চিত্রা আড়মোড়া ভেঙে চোখ তুলে তাকায়। সারারাত না ঘুমানোর কারণে চোখ রক্তিম হয়ে আছে চিত্রার। গায়ে চিরবিরিয়ে কি ভীষন ব্যথা! চোখ খুলে সর্বপ্রথম চোখ পরে পাঞ্জাবি পরিধান করা পবিত্র এক মুখের দিকে। মুগ্ধতায় ভেসে যায় চিত্রা। ঘুম উবে যায়, চেয়ে থাকে অপলক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সব মনে পরে যায়। শেহজাদকে পাশে বসে থাকতে দেখে চিত্রা এবার লজ্জায় গুটিয়ে যায়। রাতের কথা আপনাআপনি মনে পরে একে–একে। লজ্জা যে প্রাণে সয় না এবার। চিত্রা দ্রুত কম্বল টেনে মাথা অব্দি ঢেকে বিড়বিড় করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আ-পনি যান, আ-মি উঠছি।’
শেহজাদ বুঝে, চিত্রা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। তাই সেও আর ঘাঁটায় না চিত্রাকে। মাথায় টুপি পরে মসজিদে চলে যায়। শেহজাদ যেতেই উঠে বসে চিত্রা। আনমনে চেয়ে থাকে দেয়ালে ঠাঙানো বিশাল আকারের শেহজাদ আয়ুষ্মানের ছবির দিকে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে না চিত্রা। লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
‘আমি এখন উনার সামনে যাব কি করে? চোখ মেলাব কি করে? উফ, না, না!’

শেহজাদ মেহজাদকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নামাজে নিয়ে গেছে। নামাজ পরে মেহজাদ টুপি পকেটে রাখে। শেহজাদ তখন দুজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছে। তাদের কৃষি জমিতে পানির অভাব। পনি তোলার মেশিনের অনেক দাম। তাই তারা শেহজাদের সাহায্য চাইতে এসেছে। শেহজাদ আশ্বস্ত করে তাদের মেশিন কিনে দিবে। কৃষকদের মুখখানা এ কথা শুনে ঝলমলিয়ে উঠে। তারা শেহজাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে নিশ্চিন্তে বাড়ি যায়। মেহজাদ হামি তুলতে তুলতে এসব কথা শুনে। এক পর্যায়ে সে বলে,

‘ভাইয়া, আমি বাড়ি যাই? ভীষন ঘুম পাচ্ছে।’
শেহজাদ তাকায়। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে জেলেদের মাছ তোলা দেখে বলে,
‘গ্রাম দেখব আজ আমরা। সঙ্গে থাকো।’
মেহজাদকে বিরক্ত হতে দেখা গেল। সে গ্রাম দেখে কি করবে? গ্রামের মাথা তার ভাই। ভাই গ্রাম দেখে উদ্ধার করে ফেলুক। সে কেন গ্রাম দেখতে যাবে? অগ্যতা শেহজাদের পেছনে পেছনে চলতে থাকে সে। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না তার। চোখ দুখানা ঘুমে নেতিয়ে পরছে। তবুও শেহজাদ তাকে না ঘুমাতে দিয়ে অত্যাচার করছে, পাষাণ ভাই।

সূর্য মাথার উপরে উঠেছে। তীব্র রোদে চারপাশ এখন ছারখার। দু ভাই হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। শেহজাদ সবার সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছে। কিন্তু মেহজাদ এসবের ফাঁকে বড্ড রেগে আছে। আর কোনোদিন সে ভাইয়ের সঙ্গে নামাজে যাবে না। নামাজ পড়ার কথা বলে সারা গ্রাম হাঁটাচ্ছে। মেহজাদের পা ব্যথায় ভেঙে আসছে। সে রাস্তার পাথরের উপর বসে। শেষবার শেহজাদের উদ্দেশ্যে নিজের সিদ্ধান্ত জানায়,

‘ভাইয়া, আমি আর হাঁটছি না। দ্রুত রিকশা বা কিছু নাও। নাহলে আমি তোমাকে ফেলে বাড়ি চলে যাচ্ছি।’
শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। একটুপর ভাইয়ের দুঃখ বুঝে আসে তার। তাই সে আর হাঁটে না। রিকশা নেয় একটা। দুভাই রিকশায় চড়ে বসে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে এবার। দুভাই স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় এক রিকশায় দুজনের ঠিকঠাক জায়গা হচ্ছে না। এজন্যে দুজন পরষ্পরের সঙ্গে লেগে বসতে হচ্ছে। নড়াচড়ার এক ফাঁকে মেহজাদের চোখ লাগে শেহজাদের ঘাড়ের নখের দাগে। দাগটা কার এবং কিসের জন্যে বুঝতে সময় লাগে না মেহজাদের। সঙ্গেসঙ্গে মেহজাদ ঠোঁট টিপে হেসে উঠে। মুখখানা গম্ভীর করার চেষ্টা করে শেহজাদকে বলে,

‘ভাইয়া, তোমার ঘাড়ে বিড়ালের খামচির দাগ। লাল হয়ে আছে জায়গাটা। মলম লাগিয়ে নিও।’
মেহজাদের কথার পরপরই শেহজাদ সঙ্গেসঙ্গে ঘাড়ে হাত রাখে। হাত লাগলে জায়গাটা জ্বলে উঠে। শেহজাদ বুঝতে পারে, মেহজাদের কথার অর্থ। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। ঘাড় পাঞ্জাবি টেনে ঢাকার চেষ্টা করে শান্ত স্বরে বলে,
‘বাড়ি গিয়ে লাগিয়ে নেব।’

পাকের ঘরে সকালের চা তৈরি হচ্ছে। আয়ুষ্মান পুরুষরা নামাজ পরে বাড়ি ফিরে চা খাবেন। শেহজাদ নিজের ঘরে আছে, আজ সেখানেই চা যাবে। রেখা ডিম ভাজছেন। চিত্রা এক ফাঁকে চা বানিয়ে বসার ঘরে সবাইকে চা দিয়ে শেহজাদের ঘরে যায়। শেহজাদ আয়নার সামনে বসে ঘাড়ে মলম লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হাত পিঠ পর্যন্ত যাচ্ছে না। চিত্রা দেখে এগিয়ে আসে। চায়ের কাপ ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে লজ্জায় অবনত কণ্ঠে বলে,
‘আ-মাকে দিন। আমি করে দিচ্ছি।’

শেহজাদ কিছু না বলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মলম এগিয়ে দেয় চিত্রার দিকে। চিত্রা মলম হাতে নেয়। শেহজাদ হঠাৎ করে চিত্রার সামনে গায়ের ফতুয়া খুলে ফেলে। সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা আঁতকে উঠে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। শেহজাদের খালি গা চিত্রার বুকে কম্পন ডেকে আনছে যেন। রাতে শেহজাদকে দেখেছে অন্যভাবে চিত্রা। কিন্তু এখন ভর দুপুরে এমন খালি গায়ে শেহজাদকে দেখে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে চিত্রার। শেহজাদ ফতুয়া একপাশে রেখে চায়ের কাপ হাতে নেয়। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করে,
‘যত জায়গায় গতরাতে খামচি দিয়েছ, সব জায়গায় মলম লাগে যেন।’

চিত্রা ধীরেধীরে চোখ খুলে। লজ্জায় তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। মলম সমেত শেহজাদের পিঠের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। মলম আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে পিঠের ছুঁইয়ে দেয়। শেহজাদ ব্যথায় চোখ বুঁজে নেয়। সারা পিঠে অসংখ্য খামচির দাগ। গত রাতে চিত্রা এমন বন মানুষ হয়ে গেল কেন? কি নিষ্ঠুর ভাবে মানুষটাকে এত ব্যথা দিয়েছে? ইশ! কষ্ট লাগছে চিত্রার। চিত্রার চোখে জল জমে।

আলগোছে চিত্রা একের পর এক জায়গায় মলম লাগিয়ে দেয় শেহজাদের গায়ে। শেহজাদ আর যেন ব্যথা পায় না। আয়নায় চিত্রার ঘর্মাক্ত–কান্নারত চেহারা দেখে চেয়ে শেহজাদ তৃপ্তির শ্বাস নেয়। এ নারী বড্ড মুগ্ধময়ী। যখন শেহজাদের আশেপাশে থাকে, শেহজাদ আনন্দে থাকে। টলমল করে উঠে বুকের ভেতরের প্রেমের সমুদ্র! চিত্রাকে আকস্মিক বিয়ে করলেও, এখন তাকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ ছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। এ কেমন পরিবর্তন বোধ হচ্ছে শেহজাদের? শেহজাদ যখন চিত্রার পানে তাকায়, শেহজাদ বুঝে নারী গলে যাচ্ছে শেহজাদের প্রেমে। শেহজাদ তাই বারবার, বারবার চিত্রার দিকে ওমন করে চায়। তার প্রেমে পাগল করে দিতে চায় চিত্রাকে। এতে শেহজাদ পৈশাচিক আনন্দ পায় বটে।

চিত্রা মলম লাগিয়ে শেষ করে সবে। শেহজাদ আবার গায়ে ফতুয়া জড়ায়। চিত্রা মলম ড্রয়ারে রেখে মিনমিন করে বলে,
‘আমি যাই এখন?’
শেহজাদ তাৎক্ষণিক প্রশ্ন কর— ‘গায়ে ব্যথা কেমন?’
এহেন প্রশ্ন শুনে চিত্রার বোধ হয় সে লজ্জায় বরফ হয়ে যাচ্ছে। আঁচলের কোণ আঙ্গুলের ডগায় চেপে ধরে উত্তর দেয়—- ‘নেই।’

‘ড্রয়ারে ব্যথানাশক ঔষধ আছে। পানি নিয়ে আমার সামনে গিলো।’
চিত্রা মানা করে না। গায়ে প্রচন্ড ব্যথায় একটা ওষধ খুব দরকার এই মুহূর্তে। তাই সে শেহজাদের কথামত ঔষধ এনে খায়। আবারও অনুমতি চায়, ‘এখন যাই?’
‘যাও।’

চিত্রা চলে যাবে, আবারও ডাকে শেহজাদ তাকে। চিত্রা থামে। বলতে শুনে শেহজাদকে,
‘সময় করে নখ কেটে নিবে। রোজ রাতে এমন সাংঘাতিক খামচি খাওয়া আমার পছন্দ নয়।’
চিত্রা সঙ্গেসঙ্গে নিজের নখের সামনে আনে। মনেমনে ভাবে, আজকেই কেটেকুটে নখ একদম ঝাঁঝরা করে ফেলবে সে। শেহজাদের যা অপছন্দ, আজ থেকে চিত্রার তাই তাই অপছন্দ।

আয়ুষ্মান বাড়ির পুরুষরা দুপুরে খেতে বসেছেন। চিত্রা সবাইকে তরকারি বেড়ে দিচ্ছে আর রেখা ভাত। খাবার এক ফাঁকে নওশাদ জানালেন,
‘শেহজাদ, অমল ঠাকুরের ভাইপোকে নাকি লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে পার্টি ছেড়ে দেবার। জানো এটা?’
শেহজাদকে অবাক হতে দেখা গেল না। বরং সে বড্ড শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
‘নোটিশ কবে দিয়েছে?’
সৌরভ উত্তর দিলেন,

‘এ সপ্তাহেই। তুমি যেদিন শহর থেকে ফিরলে তার পরের দিন।’
‘খুব দুঃখজনক। অমল ঠাকুরের ভাইপো মানুষ ভালো ছিল। আল্লাহ তার ভালোমানুষী সহ্য করেন নি তাই নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। আমি তাহলে একবার টেলিফোন করে স্বান্তনা জানিয়ে দেব।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৮

শেহজাদ এ কথা বলে আবার মাথা নত করে খেতে মশগুল হয়ে গেল। তার কথা বাকিরা অতটা আমলে নেন নি। অমল ঠাকুরকে শেহজাদ ভীষন ভালবাসে। তার জন্যেই তো আজ শেহজাদ এ গ্রামের নেতা। তারা মনে করেন শেহজাদের বোধহয় খারাপ লেগেছে ভীষন। কিন্তু তারা এ দেখেন নি, শেহজাদের ঠোঁটে ক্রুর হাসি দেখা গেলেও কিছু সময়ের মধ্যে সে হাসি মিলিয়ে গেল। শেহজাদের মন পড়েন নি তারা। শেহজাদের মস্তিষ্ক নড়ে উঠে যেন। ভাবে সে, ফাঁদে ঘুঘু পা দিয়েছে অবশেষে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২০