শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১
তানিয়া মাহি

“ডিভোর্স হওয়ার তিনমাস, সাড়ে তিন মাসেই চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম শুরু করে দিয়েছে। এসব মেয়েদের কি স্বামী ছাড়ার কষ্ট আছে নাকি? এদের তো কিছু বলাও যাবে না, বড়লোক মানুষ, যার সাথে প্রেম সে আবার মেজর হয়েছে শুনলাম। কিছু বললে তো জেলে দিয়ে দিবে তবুও এসব দেখে কি সহ্য করে থাকা যায়?”

শুভ্রতা তার পরিবারের সাথে বাবার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে এসেছে। এখানে এসে এমন একটা কথা শুনতে হবে এটা সে কল্পনাও করতে পারে নি।
সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসার ঘরে বসে আছে। শুভ্রতার ফোন আসায় সে একটু বাহিরের দিকে এসেছিল কথা বলতে। বাহিরে এসেই দেখে তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মহিলা তাকে নিয়ে কথা বলছে। তাদের মধ্যে দুজনই তার প্রতিবেশী, কয়েক বাড়ি পরেই বাড়ি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শুভ্রতাকে দেখেই আরেকজন বলে ওঠে, ” এখনকার মেয়েরা কি সংসারী হয়? চুনের থেকে নুন খসলেই ছাড়াছাড়ি। তাদের কাছে সংসারের কোন দামই নেই।”
” যা বলেছ, বাহিরে ধেঈ ধেঈ করে ঘুরলে কি আর সংসার টিকবে?”
শুভ্রতা এবার তাদের দিকে এগিয়ে যায়। তিনজনের বেশ কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়।
একজনের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে, ” আমার প্রাক্তন স্বামী নতুন বিয়ে করছে, সেদিন বিয়ের কেনাকাটা করল। এসব খবর রাখেন না? বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছেন?”

শুভ্রতার কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মহিলাগুলো। তাদের মধ্যে একজন বলে, ” ঘরের বউয়ের বাহিরের দিকে টান থাকলে বর তো আরেকটা বিয়ে করবেই। ছেলে মানুষ বউ ছাড়া থাকবে নাকি?”
শুভ্রতা বলে, ” ছেলে মানুষের বউ লাগলে মেয়ে মানুষের কেন বর লাগবে না? তাদের চাহিদা নাই? আর কি যেন বললেন আমার বাহিরের দিকে টান? আপনার মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে কেন? আপনার মেয়ের তো আপনার মতোই ভালো হওয়ার কথা। আমার মতো খারাপ কেন হলো? ”

” একদম মুখ সামলে কথা বলবে। আমার মেয়ের সাথে নিজের তুলনা করছো, সাহস কত তোমার!”
” কেন আন্টি? আপনার মেয়েও ডিভোর্সি আর আমিও ডিভোর্সি। নিজের মেয়েকে নিয়ে কিছু শুনতে পারবেন না, অন্যের মেয়েকে নিয়ে জলঘোলা ঠিকই করবেন। আপনার মেয়ে- মেয়ে আর অন্যকারো মেয়ে-মেয়ে না? ডিভোর্সের ক্ষেত্রে নিজের মেয়ে ধোয়া তুলসি পাতা আর অন্যের মেয়ে কি নিম পাতা? তেতো বলে গা গুলোয়? আপনাদের মতো কিছু মানুষের জন্য ডিভোর্সি মেয়েরা একটু শান্তি পায় না। ঘর থেকে বের হয় না এই ভয়ে যে সে বের হলেই আপনারা তাকে এভাবে মানসিক নির্যাতন করবেন। ডিভোর্স হলে শুধু মেয়েদের দোষ কেন দেখেন নিজেরা মেয়ে হয়েও?”

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর একজন বলে ওঠে, ” আমরা শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সংসার করেছি। উঠতে বসতে কথা শুনিয়েছে গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে তবুও ঘর ছাড়ি নি। আর এখনকার মেয়েরা কথায় কথায় সংসার ভাঙে।”

শুভ্রতার বেশ রাগ হচ্ছিল, নিজেকে অসহায়ও লাগছিল। মানুষের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেয়ে সবকিছু তাদের মানসিকতার ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো।
শুভ্রতা দুই চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলে, ” আপনাদের কারো স্বামী পরকিয়া করেছে? আপনারা কেউ স্বামীকে চাকরি করে খাইয়েছেন? সংসার চালিয়েছেন? এতকিছুর পরও স্বামী খারাপ ব্যবহার করলে কেমন লেগেছে আপনাদের? ”

কেউ কোন কথা বলছে না। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।
শুভ্রতা আবার বলে, ” অন্য মেয়েদেরও একটু নিজের মেয়ের মতো দেখতে শিখুন আন্টি, সবসময় শাশুড়ি শাশুড়ি ভাবটা নিয়ে থাকবেন না। আমরা মেয়েরা কোন কিছু নিয়ে ভয় না পেলেও আপনাদের মতো কিছু প্রতিবেশীদের ভীষণ ভয় পাই। সব সংসার ভাঙায় যেমন নিজের মেয়ের দোষ থাকে না ঠিক তেমন অন্যের মেয়েরও দোষ না-ও থাকতে পারে।”
শুভ্রতা কথাগুলো বলেই সেখান থেকে ভেতরের দিকে চলে যায়। শুভ্রতা ভেতরে গিয়ে দেখে তার মা বাবা এবং স্নিগ্ধা একটা জায়গায় বসে আছে। শুভ্রতা এগিয়ে যেতেই একজন এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সামনে এসে পথ আটকানোর ফলে শুভ্রতাও থেমে যায়।

” জি কিছু বলবেন?”
” তুমি শাহাদাত আঙ্কেলের বড়মেয়ে না?”
” জি।”
” চলো এনা তোমাকে ডাকছে।”
” এনা কে?”
” এনাকে চেনো না? ”
“আসলে আমি কাউকেই তেমন চিনি না।”
” যার বিয়ে হচ্ছে।”
” ওহ আচ্ছা আমি তো ইশায়া নামে চিনি, স্যরি।”
” ঠিক আছে, এসো আমার সাথে।”

মেয়েটা শুভ্রতাকে ডাকতেই মেয়েটার পিছে পিছে চলে যায়।
সবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ খানিকটা রাত হয়ে যায়। শুভ্রতা সারাদিন বাহিরে বাহিরে খুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে পড়েছে। খুটিতে ঘুনে ধরলে ঘরটা নড়বড়ে থাকে আর সেখানে যদি প্রচন্ড ভারী কিছু সেখানে নিক্ষেপ করলে ঘরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কেন মানুষ ভাঙার জন্য নড়বড়ে ঘরগুলোই বেছে নেয়? কেন তারা ভঙ্গুর মনটাকে আরও ভেঙে দেয়! জোরা না লাগতেই কেমন দাগ বসিয়ে দেয়! মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী।

শুভ্রতা বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছে। নিজেকে সামলে নিলেও মানুষগুলো বারবার একই ক্ষ*ততে আঘা*ত করে৷ এত জোরালোভাবে আঘাত করে যে ব্যথা যেতেই চায় না।
দরজা নক করার শব্দ পেতেই শুভ্রতা চোখের পানি মুছে নেয়। যত দুঃখ, কান্না সব ঘরেতেই মানায় বাহিরে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ঘরে দম বন্ধ করে কান্না করলেও হাসিমুখেই দরজা খুলতে হয়। বাহিরের মানুষগুলো যে অত্যন্ত ভয়াবহ।

শুভ্রতা স্বাভাবিক হয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দেখে নিহান দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটাকে দেখলেই কেন যে দুঃখগুলো আজকাল সায় পেয়ে যায়। ভেতর থেকে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে আসতে চায়। কত কষ্টে যে চেপে রাখতে হয়!
নিহানকে রুমের ভেতরে আসতে বললে নিহান ভেতরে আসে। শুভ্রতাও ভেতরে যাওয়ার আগে মাকে দেখে সে জানতে চায় কি হয়েছে কিন্তু তার মা উত্তর দিতে পারে না কারণ তিনি নিজেও জানেন না। শুভ্রতা রুমে যাওয়ার সময় এক কাপ চা ফ্লাস্ক থেকে নিয়ে যায়।

নিহানের চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিতেই নিহান সেটা নিয়ে টেবিলে রেখে বলে, ” বোসো কথা আছে।”
শুভ্রতা চেয়ার টেনে বসলেই নিহান বলে, ” আগামীকাল নয়টার মধ্যে তৈরি হয়ে থেকো। কোর্টে যেতে হবে।”
” ঠিক আছে।”
” আচ্ছা তাহলে উঠি। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে যাও।”
” ঠিক আছে।”
নিহান উঠে চলে যেতে লাগলে শুভ্রতা বলে, ” চা খেয়ে গেলেই পারতেন।”

” না এখন আর চা খাব না।”
” আপনার কি মন খারাপ?”
শুভ্রতার কথায় নিহান এবার থেমে যায়। শুভ্রতা কি করে বুঝলো তার মন খারাপের ব্যাপারে! আসলেই তো বিকেলে অফিস থেকে কল আসার পর থেকে তার মন খারাপ। নিহানকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্রতা আবার বলে, ” আপনার কি হয়েছে, মন খারাপ কেন?”

” মন খারাপ কেন থাকবে? ”
” দেখে মনে হচ্ছে।”
” না।”
” আপনি আমার মন খারাপ দেখতে পারেন না আর নিজের কথা বলতে চাইছেন না?”
নিহান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ” আমার কল এসেছিল, সামনে সপ্তাহে চলে যেতে হবে। ”
” সময় হয়ে গিয়েছে এত তাড়াতাড়ি! ”

” হ্যাঁ। আমি চলে গেলে নিজেকে রক্ষা করতে পারবি তো? মানুষের কথায় কষ্ট পাবি না তো?”
নিহানের কথায় শুভ্রতার মন আরও খারাপ হয়ে যায়। মানুষ যে তাকে কথায় কথায় মে*রে ফেলার সুযোগে আছে।
নিহান আবার বলে, ” কেউ কিছু বললে চুপ করে সহ্য করবি না। যারা সহ্য করে তাদের দুঃখ বেশি।”
শুভ্রতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, ” আমি পারব, আমাকে যে পারতেই হবে। আমি সহ্য করি না নিহান ভাই।”
” তোরও কোন কারণে মন খারাপ আজ তাই না? আমি আসার আগে কান্না করছিলি!”

শুভ্রতা নিহানের কথায় বেশ অবাক হয়। দরজা খোলার সময় তো সে বেশ স্বাভাবিক হয়েই দরজা খুলেছিল তাহলে নিহান বুঝল কি করে?
নিহান আবার বলে, ” লুকোনোর দরকার নেই। তোর চোখে লালচে রঙ বলে দিয়েছে যে তুই কান্না করেছিস। কি হয়েছে?”
শুভ্রতার দুপুরের ঘটনা আর লুকোতে ইচ্ছে করছিল না। শুভ্রতা প্রথম থেকে সবটা বলে। কথা শেষ করতে গিয়ে শুভ্রতার গলা ভারী হয়ে ওঠে। নিহানের মুখের ভাবটা পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের অপমান হয়তো কেউই সহ্য করতে পারে না। নিহান বলে ওঠে, ” আমাকে কল দিতে পারলি না? আমি বুঝিয়ে দিতাম দোষ কাকে বলে।”

” নিজের সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হবে। আমি নিজেই পারব, আপনি দেখে যান।”
” আমি বিশ্বাস করি তুই পারবি। শুধু নিজের সমস্যার সমাধান না অন্যকেউ বিপদে পড়লেও তাকে সাহায্য করতে হবে। বড় কিছু ঘটলে আমাকে একবার ইনফর্ম করে রাখবি।”
” হুম।”
” আচ্ছা আমি এখন বাসায় যাই, মাথাটা খুব ব্যথা করছে।”
” একটা ওষুধ খেয়ে নিবেন।”
” ঠিক আছে।”
” আপনি সারাজীবন আমার জন্য এমন থাকবেন তো?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০

ভালোবাসার মানুষ যখন সারাজীবন থেকে যাওয়ার কথা বলে সেই অনুভূতি কোনকিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। শুভ্রতার কথা অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করে নিহানের। শুভ্রতা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। নিহান মুচকি হেসে মাথা উপরনিচ নাড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রতার মুখেও হাসি ফুটে যায়।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২