শুভ্ররাঙা ভালোবাসা শেষ পর্ব 

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা শেষ পর্ব 
তানিয়া মাহি

ইমতিয়াজের গালে সজোরে চড় দিয়ে বসে শুভ্রতা। নিহান সাথে সাথে শুভ্রতাকে টেনে পিছিয়ে নিয়ে আসে। শুভ্রতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, নিহানকে বারবার বলছে, ” ছাড়ুন আমাকে, আমি ওকে আজ শেষ করে ফেলব। জানোয়া**রের সাহস কি করে হয় আমার সংসারের দিকে চোখ তুলে তাকানোর? টাকা উপার্জন করার মুরদ নেই, আগে বউয়ের টাকায় চলত এখন টাকা ব্ল্যাক**মেইল করে আদায় করার ধান্দা। ”

নিহান শুভ্রতাকে গাড়ির সামনে টেনে নিয়ে এসে বলে, ” তুমি যাও গাড়িতে বোসো আমি দেখছি বিষয়টা।”
শুভ্রতা নিজের ব্যাগ থেকে কিছু টাকা ইমতিয়াজের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে, ” কিছু খেতে পারছিস না জন্য এগুলো তোকে ভিক্ষা দিলাম। ভিক্ষা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবি। আবার যদি আমার জীবনে আসার চেষ্টা করিস, আমার স্বামীকে হেনস্তা করার চেষ্টা করিস তাহলে একদম খু*ন করে ফেলব তোকে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিহান শুভ্রতাকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দেয়। শুভ্রতাকে গাড়িতে রেখে সে নিজেই গিয়ে ইমতিয়াজের সামনে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” আপনি এটা একদম ভালো করলেন না। এর ফল খুব খারাপ হবে।”

নিহান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” খারাপ হবে অবশ্যই কিন্তু আমার সাথে না তোমার সাথে। এতদিন নিজের অবস্থানের সামান্য দাপট ও দেখাই নি। আমি চাইলে কী কী হতে পারে সেটা আজ দেখতে পাবে। পাঁচ ছয় বছর জেল খেটেছ, এবার দেখি আজীবনে কীভাবে বের হও। আজীবন আটকে না রাখতে পারলেও আবার পাঁচ ছয় বছর ওখানে থেকে এসো তারপর ভেবে দেখব পনেরো লাখ দেব নাকি বিশ লাখ দেব। ভালো থাকতে একটু খারাপ হতেই হচ্ছে আমাকে৷ স্যরি বাট নট স্যরি। ”

” আমাকে কি জেলে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন? ”
” ভয় দেখাচ্ছি না ডান দিকে তাকিয়ে দেখো একবার। এখান থেকে একা ফেরা আর সম্ভব হবে না।”
ইমতিয়াজ ডান দিকে তাকাতেই রাস্তার ওপাশে পুলিশের গাড়ি দেখতে পায়। নিহান ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” অন্যকারো সংসার ভাঙা তো দূরের কথা নিজেকে পারলে বাঁচিয়ে দেখান ইমতিয়াজ সাহেব।”

ইমতিয়াজকে ওখানেই রেখে নিহান গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ইমতিয়াজ ওখানেই দাঁড়িয়ে ভাবছে কী করবে। নিহান গাড়ির জানালা থেকে মাথা বের করে বলে, ” আমি সবাইকে একটা করে চান্স দেই। পুলিশকে গু*লি চালাতে নিষেধ করেছি। নিজেকে বাঁচাতে চাইলে বাঁচাতে পারো, তবে নেক্সট টাইম আমার সংসারের দিকে নজর দিলে চোখ তুলে নেব।”
নিহান সাথে সাথে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়৷ আর একটা বারের জন্যও নিহান বা শুভ্রতা পিছন ফিরে ইমতিয়াজকে দেখার চেষ্টা করেনি। বিপদকে ঘুরে না দেখাই উত্তম।

কিছুদূর যেতেই শুভ্রতা বলে ওঠে, ” তুমি আমাকে থামালে কেন? ওকে স্যান্ডেলপি*টা করা উচিৎ ছিল। রাগে আমার শরীর শিরশির করছে। ওকে বাঁচতে দেওয়ার সুযোগ কেন দিলে তুমি? জানো*য়ার একটা।”
নিহান শুভ্রতাকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের বুকে শুভ্রতার মাথা ঠেকিয়ে নেয়। শুভ্রতা ধীরেধীরে শান্ত হয়৷ নিহান শুভ্রতাকে বুকে রেখেই বাম হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, ” এখন ভালো লাগছে?”

শুভ্রতা শান্তস্বরেই বলে, ” হুম আলহামদুলিল্লাহ। ”
শুভ্রতার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে চোখ রেখেই বলে, ” সব সময় আমার ওপর এভাবেই বিশ্বাস রাখবি।”
শুভ্রতা নিহানের বুকে মাথা রেখেই মুখ উঁচু করে বলে, ” ভালোবাসি আপনাকে মশাই।”
নিহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ” অনেক ভালোবাসি শুভ্রা।”

ইদানীং স্নিগ্ধার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। অফিসে বসে, বাহিরের কাজেও একজনকে নিয়েই সারাক্ষণ ভেবে চলেছে। নিজের অনুভূতিকে সায় দিতেও পারছে না আবার দমিয়ে রাখতেও পারছে না। সারাক্ষণ কানে যেন আয়রার ডাক বাজছে। ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মাহতিমকে কল করার কথা ভাবে স্নিগ্ধা। কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাহতিমকে কল করেই বসে সে। ফোনের স্পিকার লাউডে দিয়ে রিং হওয়ার শব্দ শুনছে সে।

বুকের ভেতর যে দ্রুম দ্রুম শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন বুকের ভেতরটায় হাতুড়ি পিটা করছে। কল কেটে যাবে, রিং হওয়ার শেষ পর্যায়ে মাহতিম কল রিসিভ করে৷ স্নিগ্ধা সাথে সাথে ফোনের স্পিকার কমিয়ে কানে ধরে। গলাটা ভীষণ কাঁপছে তার। ওপাশ থেকে মাহতিম হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। স্নিগ্ধা গলা ঠিক করার শব্দ হতেই মাহতিম বলে ওঠে, ” ফোন করেছেন, ফোনের কাছেই আছেন তাহলে কথা বলছেন না কেন?”

” স স্যরি স্যার।”
” কিছু বলবেন?”
” না মানে আয়রা কেমন আছে?”
” হ্যাঁ ভালো আছে। আবার সময় করে আসবেন একদিন।”
” ঠিক আছে। ”
” আচ্ছা রাখছি তবে। ”
” না স্যার। ”
” আবার কী হলো?”

” আপনার সাথে দেখা করতে চাই, কিছু বলার আছে।”
” কাল অফিসে এসে দেখা করো। এখন রাখছি আয়রাকে খাওয়াতে হবে।”
” স্যার পারসোনালি কোথাও দেখা করা যায় না?”
” পারসোনালি কেন?”

আর কোন উত্তর দিতে পারে না স্নিগ্ধা। প্রশ্নের জবাবে ‘ একটু দরকার আছে’ ছাড়া আর কিই বা বলার থাকতে পারে! প্রয়োজনের কথাও না বলে একটা জায়গার নাম জানিয়ে বলে, ” স্যার সন্ধ্যায় ফ্রি থাকলে চলে আসবেন।” কল কেটে দেয় স্নিগ্ধা। কল কেটে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নেয়। মাহতিম কি আদৌ আসবে দেখা করতে! যদি আসেও কী বলবে সে!

ফাউজিয়া বাড়ি ফিরেছে সপ্তাহ দুয়েক। বাড়ি ফেরার পর সাহিলের ফোনের অপেক্ষাতেই তার দিন কাটছে। এতগুলো দিন কেটে গিয়েছে তবুও একটাবারের জন্যও সাহিলের ফোন থেকে কল আসে নি তার কাছে। যেদিন সাহিল নিজে ফাউজিয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার বলার পর সাহিল বাড়ির ভেতরে এসেছিল। ফাউজিয়ার মায়ের সাথে সেদিন সাধারণভাবেই কথাবার্তা বলেছিল সে। সাহিল চলে যাওয়ার পর ফাউজিয়া কতবার যে সাহিলকে কল করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।

ফাউজিয়া বসে বসে পরিক্ষার খাতা দেখছিল। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। বাসায় সচরাচর তেমন কেউই আসে না। এই সময় মায়ের ঘুমোনোর কথা ভেবে ফাউজিয়া নিজেই দরজা খুলে দিতে রুম থেকে বের হতেই দেখে তার মা দরজার সিটকিনি খুলছে। ফাউজিয়া নিজের ওরনা ঠিক রুমের দিকে পা বাড়াবে ঠিক তখনই চেনা কণ্ঠ শুনে আবার ফিরে তাকায়। সাহিলের মা এসে ফাউজিয়ার মাকে জড়িয়ে ধরেছে।

ফাউজিয়া ওখানেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি হাতে সাহিলও প্রবেশ করে। ফাউজিয়া দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসে। টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে শুভ্রতাকে কল করে৷ ফোনে রিং হওয়ার সাথে সাথে ফাউজিয়ার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ফোন রিসিভ হতেই বলে ওঠে, ” সাহিল স্যার এসেছে শুভ্রতা। সাহিল স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছে উনার মাকে নিয়ে। আমার হয়তো অপেক্ষা শেষ হলো।”

” সত্যি! আগে বলে নি আসার কথা?”
” না, আমাকে সেদিন রেখে যাওয়ার পর তো একটাবারের জন্যও কল দেয় নি। ভেবেছিলাম হয়তো আর কিছু সম্ভব হবে না।”
” দোস্ত।”
” হুম বল।”

” যদি আজকেই বিয়ে হয়ে যায়, আমাকে কিন্তু ভিডিয়ো কলে রাখবি। আমি তো যেতে পারব না।”
” আমি তো জানিই না কেন এসেছে আর তুই বিয়ে পর্যন্ত চলে গেলি।”
” তো যাব না? ভাবতে দোষ কীসের?”

দুজনের মাঝে আরও কিছুক্ষণ কথা চলে। পাশের রুম থেকে ফাউজিয়ার মা ডেকে চা দিতে বলে। ফাউজিয়া শুভ্রতার সাথে কথা শেষ করে রান্নাঘরে চলে চা করতে। সাহিলের মা এবং ফাউজিয়ার মা দুজন বসে গল্প করছিল। ফাউজিয়া চা নিয়ে সেখানে গিয়ে দুজনকে দু’কাপ চা দেয়। সাহিলের মায়ের সাথে কথা বলে আরেক কাপ চা সেখানেই রাখতে চাইলে ফাউজিয়ার মা বলেন, ” সাহিল বারান্দায় আছে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে,চা দিয়ে এসো।”

” ঠিক আছে।”
ফাউজিয়া চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। সাহিল কিছুক্ষণ আগেই ফোন রেখেছে। ফাউজিয়া গলার আওয়াজ করতেই সাহিল পিছনে ঘুরে তাকায়। ফাউজিয়া চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে, ” চা-টা নিন।”
” শুধু চা নেব?”

ফাউজিয়া মাথা চুলকে বলে, ” বিস্কুট লাগবে?”
” না আপনাকে চায়ের সাথে ভিজিয়ে খাব, হবে না? চায়ের সাথে আর কী খায় মানুষ? জামাই আদরটাও ঠিকমতো করতে পারেন না।”
সাহিলের কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় ফাউজিয়া। সাহিলের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” আপনি এ বাড়ির জামাইও না, জামাই আদর পাবেনও না।”
সাহিল চায়ের কাপটা চেয়ারের ওপর রাখে। ফাউজিয়ার দিকে এগিয়ে এসে দুই হাত নিজের দুই হাতে ধরে বলে, ” জামাই হলে কী কী পাব?”

ফাউজিয়া বাক্যহারা হয়ে যায়। সাহিল তাকে কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তাকে? সে যা ভাবছে তাই! তার ভাগ্য কী এতটা ভালো হবে!
দুজন দুজনের চোখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ফাউজিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সাহিল আরও শক্ত করে ফাউজিয়ার হাত দুটি ধরে।

সাহিল ফাউজিয়ার চোখের দিকেই তাকিয়ে বলে, ” আমাদের শেষ দেখায় আমি বলেছিলাম আমাকে ফিরিয়ে দিলে আর ফিরব না। আমি আমার কথায় অটুট, আপনি আমাকে ফিরিয়ে না আনলে ইহজনমে আমি ফিরতাম না। আমি আমাকে আর আমার কথাকে সম্মান করি৷ নিজেই যদি নিজেকে সম্মান না করি অন্যকেউ কেন করবে? ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটা মোহনীয় সমাপ্তি থাকা দরকার তাই বলে সম্মান খুইয়ে না। আমি এক্ষেত্রে বিশ্বাসী যে, আমার জন্য কেউ একপা এগিয়ে আমি তার জন্য প্রয়োজনে দশ পা এগিয়ে আসব। বিষয়টা যখন ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তখন সে এক কদম আমার দিকে বাড়ালে আমি একশো কদম তার দিকে বাড়াব।”

ফাউজিয়া মাথা নিচু করে নির্জীব কণ্ঠে বলে, ” আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। ”
” আমার বিষয়ে আপনার কী ধারণা?”
ফাউজিয়া মাথা তুলে মুচকি হাসে। বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে, ” আমি একটু জড়িয়ে ধরি? আপনি তো এখন আমার মানুষ। ”

সাহিল ফাউজিয়ার হাত ছেড়ে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের বুকে দুই হাত মেলে বলল, ” খবরদার কাছে আসবে না। আমার শরীর,বুক,ঠোঁট সব আমার বউয়ের জন্য।”
ফাউজিয়া কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে লোকটা এত নির্লজ্জ কবে হলো? আমতা আমতা করে বলে, ” আমি তো আপনার শরীর, ঠোঁট চাই নি শুধু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম।”
” আজ বুক চাইছেন, কাল ঠোঁট চাইবেন আর পরশু আমার শ…..”

সাহিলকে তার কথা শেষ করতে দেয় না ফাউজিয়া। দৌঁড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে। সাহিল আর কিছু বলতে পারে না। ফাউজিয়া রাগীস্বরে বলে ওঠে, ” আপনি এত ঠোঁটকা*টা স্বভাবের হয়ে যাচ্ছেন কেন বলুন তো?”

সাহিল তার মুখে রাখা ফাউজিয়ার হাতে চুমু দিতেই ফাউজিয়া তাড়াতাড়ি করে হাত সরিয়ে নেয়। ফাউজিয়ার চিবুকে হাত রেখে বলে ” আপনি যতক্ষণ সারা দুনিয়ার মানুষের মতোই আমার কাছে সাধারণ ছিলেন ততক্ষণ আমিও আপনার সাথে সাদাসিধা ভদ্র লোক ছিলাম। নিজের মানুষের কাছে ভদ্রতা কীসের? সব পুরুষই তার নিজস্ব নারীর কাছে অস*ভ্য। ”
” আম্মা আমি বিয়ে করব না এই লোক ভারী অস*ভ্য।”

ফাউজিয়ার কথা যেন বাহিরে না যায় তাই বুকে জড়িয়ে ধরে। ফাউজিয়াও হাসতে হাসতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অবশেষে দুটি হৃদয় পুরোনো ভালোবাসায় নতুন অধ্যায় শুরু করে। দুটি পুরোনো ভঙ্গুর হৃদয় নতুন করে বাঁচতে শুরু করে।

সামনাসামনি চেয়ারে বসে আছে স্নিগ্ধা আর মাহতিম। ক্যাফেতে খুব একটা মানুষ নেই বললেই চলে। চারপাশে যে টেবিলগুলো রয়েছে সবগুলোই ফাঁকা। দূরে দূরে কয়েকটা টেবিল বুকড্। স্নিগ্ধার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কী বলা যায় সেটাই ভাবছে মাহতিম। বেশি সময় না নিয়ে সোজা হয়ে বসে মাহতিম।

” আপমার পুরোটা জীবন পরে আছে। জীবনের শুরুতেই ভালো একটা অবস্থানে আছেন। সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্য নিশ্চয়ই ভালো কাউকে রেখেছেন। হয়তো আমার মেয়ের জন্য এসব ভাবছেন কিন্তু এসব ঠিক না। ”
” আয়রার আগে আমি আপনার সাথে পরিচিত। হ্যাঁ আয়রাকে আমি একটু বেশি ভালোবাসি কিন্তু এটা না যে আয়রার জন্য আমি আপনার সাথে জড়াতে চাইছি। আপনাকে জানানোর আগে এতগুলো দিন আমি নিজেকে বুঝিয়েছি কিন্তু কোন লাভ হয় নি। এসবে যে নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।”

” আমি আমার মেয়ের চিন্তা করে আর বিয়ের কথা ভাবিনি। আমার মা ওর দেখাশোনা করে। আয়রা নিজেও আপনার কথা বলে তবে আমার মনে হয় আপনাদের দূরত্ব বাড়ানো উচিৎ। ”
” আমার সাথে জড়ানো যায় না স্যার? আমি আপনার সবটা জেনেই…”
” মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলুন স্নিগ্ধা। আমার সাথে আপনার মিলবে না। যার সাথে মিলে তার সাথেই আপনার জড়ানো উচিৎ স্নিগ্ধা। ”

স্নিগ্ধা কপালে দুই হাত ঠেকিয়ে বসে থাকে। কী হবে সেটা বুঝতে পেরেও মাহতিমকে বলা ঠিক হয়নি ভেবে আফসোস করছে মনে মনে। অন্যদিকে মাহতিম নিজেকে শক্ত করে বসে আছে। মেয়ের সাথে স্নিগ্ধার সময় কাটানো, মাহতিমের প্রতি স্নিগ্ধার অন্যরকম ব্যবহার, লাজুকতা দেখে প্রথমদিকেই সে বুঝতে পেরেছিল স্নিগ্ধা তাকে পছন্দ করে কিন্তু এখানে দুজনের এক হওয়া তো ঠিক না। মাহতিম চিন্তা করে সে নিজেই তো অবিবাহিত হলে কখনো কোন বাচ্চাসহ মহিলাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত থাকতো না। সেখানে স্নিগ্ধার একটা ভালো ভবিষ্যত বুঝতে পেরে এরকম একটা সম্পর্কে জড়ানোর কোন মানেই হয় না। সবকিছুতে শুধু ভালোবাসার দিকটা দেখলেই হয় না।

স্নিগ্ধা কপাল থেকে হাত নামিয়ে মাহতিমের হাত ধরে বসে। স্নিগ্ধার কাজে মাহতিম বেশ অবাক হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। তেজি গলায় বলে, ” স্নিগ্ধা আপনি আমার কলিগ। মাথায় রাখবেন আজকের পরও আপনাকে আমার মুখোমুখি হতে হবে।”
” আমাকে কেন ভালোবাসা যায় না স্যার?”
” কোন কারণ নেই। ”
” আমাকে না ফিরিয়ে দিলে হয় না? একটু কষ্ট করে রেখে দিন না প্লিজ।”
” স্নিগ্ধা, আমি আপনার কাছে এরকম ইমম্যাচিউর কথাবার্তা একদম আশা করছি না।”
” প্লিজ। ”

” আপনি আপনার মতো কাউকে জীবনে পান, ভালো থাকুন দোয়া করি।”
” অথচ আপনাকে পেলেই আমি ভালো থাকতাম, আপনার সাথেই ভালো থাকতাম। আমার ভালো চাইছেন কিন্তু আমাকে চাইছেন না কি আজব না!”
” না, কারণ সবকিছুতে একটু হলেও সমতা প্রয়োজন স্নিগ্ধা। অসম সবকিছুই বিপদ ডেকে আনে। আপনি এখন বুঝছেন না। যদি কোনভাবে আপনার আর আমার বিয়ে হয়, তখন আশেপাশের মানুষের কথা শুনে মন উঠে যাওয়ার থেকে এখনই মন তুলে নেওয়া বেটার।”

” সবকিছু নিজের মতো কেন ভাবছেন?”
” কারণ আমি পৃথিবীকে খুব ভালোভাবে চিনি। ”
” আমাদের এক হওয়া কি কোনভাবেই সম্ভব না?”
” হয়তো না।”

স্নিগ্ধা নিজের ব্যাগ থেকে রিজাইন লেটার বের করে টেবিলে রাখে। গ্লাসে রাখা পানি সম্পূর্ণটুকু ঢকঢক করে খেয়ে নেয় সে। টিস্যু নিয়ে চোখমুখ ভালো করে মুছে নেয়। মাহতিম তাকিয়ে স্নিগ্ধার কার্যকলাপ দেখছে। পছন্দের মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া সহজ কোন কাজ নয়। বুকে পাথর চেপে ভালো লাগার কাউকে ফিরিয়ে দিতে হয়।

স্নিগ্ধা নাক টেনে বলে, ” এখানে রিজাইন লেটার আছে। আ’ম স্যরি স্যার, আমার পক্ষে কোনভাবেই আর জবটা কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না। চেনা মানুষের অচেনা মুখ আমি সহ্য করতে পারব না। ” বলতে বলতে স্নিগ্ধা কান্না করে ফেলে। কান্না করতে করতেই বলে, ” আপনি খুব অন্যা*য় করলেন আর আমি করলাম ভুল। এই ভুলটা আমি আমার জীবনে কখনোই শুধরে নেব না, আর বাকি রইলেন আপনি৷ আমাকে গ্রহণ করেই আপনার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”

” পাগলামি কোরো না স্নিগ্ধা।”
মাহতিম চারপাশে তাকিয়ে দেখছে কেউ তাদের দেখছে কী না। স্নিগ্ধা বাচ্চাদের মতো কান্না করেই যাচ্ছে। স্নিগ্ধার এমন অবস্থা দেখে কী করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না মাহতিম। স্নিগ্ধাকে সে সবসময় ম্যাচিউরভাবেই পেয়েছে। একটা ম্যাচিউর মেয়ে যে এভাবে কাউকে না পেয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করতে পারে এই ধারণাটা তার ছিল না। মাহতিম চিন্তা করছে সমাজের কথা কি এত ভাবা উচিৎ নাকি সেকেন্ড অপশন যেটা আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে সেটা সামনে আনা উচিৎ! কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবলো মাহতিম।

স্নিগ্ধা কান্না করেই যাচ্ছে। শব্দও ধীরেধীরে বাড়ছে। মাহতিম একপ্রকার ধমক দিয়েই স্নিগ্ধাকে কান্না থামাতে বলে। ধমকে যেন কান্নার বেগ আরও বৃদ্ধি পায়। মাহতিম পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দেয়। কল রিসিভ হতেই ভেতরে আসতে বলে কল কেটে দেয় সে। কিছুক্ষণ পর আবার কলব্যাক আসতেই মাহতিম রিসিভ করে।
” কী হলো? কোথায় তোমরা? এই মেয়ে তো এখানে কান্না করেই যাচ্ছে আয়রার মতই। এ আবার আয়রার মা হবে কীভাবে? স্নিগ্ধাই আয়রাকে সামলাবে নাকি আয়রা স্নিগ্ধাকে সামলাবে?”

মাহতিমের কথা বোধগম্য হতেই স্নিগ্ধা চুপ হয়ে যায়। মাহতিমের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ মুছতে মুছতে বলে, ” কী বললেন আপনি? ”
” কীভাবে তোমাকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া যায় সেই কথা বলছিলাম।”
” আমি অন্যকিছু শুনেছি, কী বললেন সত্যি করে বলুন।”
” চোখ মুছে ফেলেন।”

” আপনি কিছুক্ষণ আগে তুমি করে বলেছেন, এখন আয়রার মা হব কীভাবে সেটা কাউকে বললেন। তার মানে…..!”
মাহতিমের রহস্যময়ী হাসি দেখে স্নিগ্ধার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকি থাকে না। সবকিছু বুঝতে পেরে হেসে ফেলে স্নিগ্ধা। মাহতিমের বাহুর ওপর একটা বারি মেরে বলে, ” আমাকে কষ্ট দিলেন কেন? মনে মনে নিজেও তো ঠিকই অবিবাহিত একটা মেয়ের ওপর দূর্বল হয়েছেন। কি হন নি বলুন? নইলে আমার কিছু হলে এত কেয়ার করতেন কেন? বেয়া*দব লোক একটা।”

মাহতিম নিজেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ” এখানে সবাই দেখছে আমাদের। বোসো প্লিজ।”
” ভালোবাসি বলে দেন আগে।”
” ভালোবাসলে তো বলব।”
” বলবেন না? আমি কিন্তু ফোনটা ভেঙে ফেলব।”
” যে মেয়ের ভাঙচুর করার অভ্যাস ওই মেয়েকে কিন্তু আমি আমার মেয়ের মা হিসেবে মেনে নিব না।”
” মেনে নেন নাকি না নেন সেটা আমি পরে দেখব আপাতত ভালোবাসি বলুন।”
” স্যার হই আমি তোমার। গলা নামিয়ে কথা বলবে।”
” হবু বউ হই আমি আপনার, উঁচু গলা বরদাস্ত করব না একদম।”

স্নিগ্ধার কথায় মাহতিম এবার শব্দ করে হেসে ফেলে। স্নিগ্ধার থেকে ফোনটা নিয়ে কানে নিয়ে বলে, ” দেখেছ মা, তোমার হবু বউমা এখন থেকেই আমার সাথে কেমন জোরজবরদস্তি শুরু করেছে। ওকে নিয়ে আসছি তুমি বকে দেবে। ”
মাহতিম কল কেটেই স্নিগ্ধাকে বলে, ” চলুন, বাহিরে গাড়িতে আপনার হবু শাশুড়ি আর হবু মেয়ে অপেক্ষা করছে। তারা আর ভেতরে আসবে না।”

স্নিগ্ধা নিজের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ” আপনি আগে থেকে সব ঠিকঠাক করে রেখে আমাকে কাঁদালেন কেন?”
মাহতিম বেশ সিরিয়াস হয়েই বলে, ” প্রথমে তোমার ভালো চেয়ে ‘না’ বলেছিলাম তারপর যখন দেখলাম আমার আগু*নে জ্ব*লতে চেয়ে কান্নাকাটি করছ তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না। ”
” খারাপ লোক একটা।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৬

গেইটের সামনে এসে মাহতিম স্নিগ্ধার হাত ধরে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নরমস্বরে বলে ওঠে, ” তুমি শুধু নিজেকে আমার জন্য ঠিক রেখ আমি বাকিটা দেখে নেব। কঠোর প্রকৃতির পুরুষমানুষ কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসতে পারে। নিজেকে তৈরি করে নাও আমার ভালোবাসা সহ্য করে নিতে। ”
স্নিগ্ধা মুচকি হেসে মাহতিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমার এই রঙবিহীন শুভ্র জীবনে আপনিই একমাত্র রঙের ছটা, আপনিই আমার একমাত্র শুভ্ররাঙা ভালোবাসা।”

সমাপ্ত