শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৬

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৬
তানিয়া মাহি

দুটো পুরোনো মানুষ আজ সামনাসামনি, পুরোনো দু’জোড়া চোখ সামনে দাঁড়ানো একে অপরকে দেখছে। ফাউজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ দুটো আজ তার ছলছল করছে, হৃৎস্পন্দন বেড়েছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে, ” স্যার!”
সাহিল ফাউজিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,” আসুন আমার সাথে।”

” কোথায় যাবেন?”
” ভরসা করতে পারেন। নাকি আমাকে ভরসা করতেও ভুলে গেছেন?”
ফাউজিয়া কিছু বলে না। সাহিল হাটা শুরু করলে ফাউজিয়াও তার পিছু নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে তারা দুজনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাহিল আর ফাউজিয়া মুখোমুখি বসে আছে। সাহিলের মা একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। পানির গ্লাসটা ফাউজিয়ার দিকে বারিয়ে দিলে ফাউজিয়া সেটা নেয়।
সাহিলের মা সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোরা কথা বল আমি আসছি।”
ফাউজিয়া মাথানিচু করে চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ফাউজিয়াকে চুপ থাকতে দেখে সাহিল দ্বিধা কাটিয়ে বলে, ” আপনি হঠাৎ এখানে?”

” আসলে এখানেই সামনের পার্কটায় কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে এসেছিল।”
” ওহ আচ্ছা।”
” নামলেন যে?”
” আপনাকে দেখে। ভুল করলাম?”
” আপনার হাজবেন্ড?”

ফাউজিয়া অসহায় চোখে উল্টো প্রশ্ন করে বসে, ” বিয়ে করেছেন?”
সাহিল সোজাসাপটা জবাব দেয়, ” একজন ফিরিয়ে দেওয়ার পর আর কাউকে ভালো লাগে নি। কারও কাছে নিজেকে সমর্পন করতে ইচ্ছেও করে নি। ”
হাফ ছেড়ে বাঁচে ফাউজিয়া। বুকের ওপর থেকে যেন ভারী একটা পাথর নেমে যায়। ফাউজিয়ার এই বিষয়টাও সাহিলের নজর এড়ায় না। ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়ায় সে। সাহিলকে দাঁড়াতে দেখে ফাউজিয়া উৎসুক চোখে তাকায়।

” কোথাও যাচ্ছেন?”
” হ্যাঁ আমার এখন বের হতে হবে।”
” কোথায়?”
” তখন রাস্তার পাশের বাড়িটায় ভিড় দেখেন নি? ওটা আমার চাচার বাসা। আমার চাচাতো বোন মারা গিয়েছে। আমার ওখানে থাকা খুব প্রয়োজন। আপনি মা’র কাছে থাকুন। বাসায় যাবেন কখন? আমার কি এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে?”
” আপনি বাসায় ফিরলে কথা বলব।”
সাহিল আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। ফাউজিয়া কোন একটা আশার আলো দেখতে পায়।

মাহতিম তন্ময় তার মা এবং মেয়েসহ বাসার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য লোক রাখা হলেও বাসায় সব ঠিকঠাক করার জন্য মহিলা প্রয়োজন। মাহতিমের যেহেতু এদিকে তেমনকিছু পরিচিত নেই তাই তিনি অফিসের একজনকে বলেছেন ব্যবস্থা করে দিতে কিন্তু তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি।

তাই অফিসের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরাই মাহতিমের বাসা গুছিয়ে দেবে যেহেতু উনার মায়েরও বয়স হয়েছে। মাহতিম নিজেই আপাতত একটা রুম ঠিক করছিল যেন এখানে অন্তত বিশ্রামটা নেওয়া যায়। কলিংবেলের আওয়াজ হতেই মাহতিমের মা মোহনা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দেন। রাইমা, স্নিগ্ধাসহ অফিসের আরও দুজন বাঁধন আর মেহেদি এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। মোহনা বেগমের সাথে পরিচয় নেই বিধায় তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে রাইমা বলে ওঠে, ” আমরা স্যারের অফিস থেকে এসেছি। আমরা একই সাথে আছি ওখানে। স্যারের জন্য বাসা গোছানোর মানুষ পেলাম না তাই ভাবলাম আমরা নিজেরাই হাতে হাতে সাহায্য করি।”

মোহনা বেগম সবাইকে ভেতরে আসতে বললেন। তারা ভেতরে ঢুকতেই মাহতিম এগিয়ে আসে তাদের দিকে। বাহিরে অফিসের সবাইকে দেখে সামনে রাখা সোফাতেই বসতে বলে। বাঁধন বলে ওঠে, ” স্যার আমরা অলরেডি লেট। আজকে আমরা সবাই মিলে আপনাকে যতটুকু সাহায্য করতে পারি, করব। বাকিটা আগামীকালের মধ্যেই শেষ করব।”
মাহতিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” তোমরা সাহায্য করবে মানে? আমি তো মানুষ ঠিক করে দিতে বলেছিলাম। ”

” স্যার কাউকে পাওয়া যায় নি তাই আমরাই চলে এসেছি। ”
মাহতিম কিছু বলতে যাবে তখনই রাইমা বলে ওঠে, ” স্যার আর কোন কথা না। আপনি আমাদের সাথে থেকে বুঝিয়ে দেন কোনটা কোন রুমে যাবে। আমরা সবাই মিলে করে নিতে পারব। ”

মাহতিমের সাথে সবাই কথা বলছে কিন্তু মোহনা বেগম খেয়াল করেন সেখানে শুধু স্নিগ্ধা চুপচাপ আছে আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে ঘরের দিকে তাকিয়ে। তিনি স্নিগ্ধার চোখ অনুসরণ করে ঘরের দিকে তাকাতেই দেখেন সেখানে মাহতিমের মেয়ে আয়রা কিছুক্ষণ পরপর উঁকি দিচ্ছে। মোহনা বেগম আয়রা ডাকতেই সে ছুটে এসে উনার পাশে দাঁড়ায়। আয়রাকে কোলে নিয়ে স্নিগ্ধা আর রাইমাকে দেখিয়ে বলে, ” তুমি উনাদের চেনো? ওরা তোমার আন্টি হয়।”
আয়রা মোহনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আন্টি হয়? আমার সাথে খেলবে?”
মোহনা বেগম হেসে বলে, ” তুমি খেলবে আন্টিদের সাথে? ”

আয়রা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। স্নিগ্ধা হাত বাড়িয়ে আয়রাকে ডাকলে আয়রা মোহনা বেগমের কোলে থেকে নেমে স্নিগ্ধার দিকে আসে। মোহনা বেগম বেশ অবাক হন আয়রাকে দেখে কারণ আয়রা খুব একটা মিশুক না।
সবাই কাজে হাত লাগিয়েছে। আয়রা ঘুমিয়ে গেলে স্নিগ্ধা আয়রাকে মোহনা বেগমের কাছে দিয়ে নিজেও কাজে লেগে পড়ে। রাইমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাইমা বলে, ” আয়রা খুব কিউট একটা বাচ্চা তাই না। তোর সাথে কী সুন্দর করে গল্প করছিল। স্যার তো মাঝে মাঝেই তোকে দেখছিল। আমার মনে হয় স্যার তোকে পছন্দ করে।”

স্নিগ্ধা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, ” রাইমা এসব কথা তোর মুখে যদি আর শুনেছি! ”
রাইমা ভেঙচি কেটে বলে, ” তোর কি মনে হয় আমি তোকে বুঝি না? নিজে তো ডুবে ডুবে ঠিকই জল খাচ্ছিস। তুই চাস না স্যার ও তোকে পছন্দ করুক? বাচ্চা আছে তো কী হয়েছে, বউ তো আর নেই। ”
” উল্টাপাল্টা কথা বলবি না, কাজ কর।”
” দেখা যাবে কতদিন আর এভাবে থাকতে পারো।”
স্নিগ্ধা আর কিছু বলে না। রাইমা স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দেয়।

বাহির থেকে আসার পর নিহানকে বেশ এলোমেলো দেখাচ্ছে। বেলকনিতে গিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করছে। শুভ্রতা ফ্রেশ হয়ে নিজেও বেলকনিতে আসে। নিহান তখনও ইমতিয়াজের বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। শুভ্রতা গিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। নিহান শুভ্রতাকে দেখে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে। শুভ্রতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ” মন ভালো হয়েছে আজ ঘুরে?”

” তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
শুভ্রতার পাল্টা প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে যায় নিহান। কিছু কথা যে বুকে চেপে আছে সেটা শুভ্রতা বুঝল কি করে? কিন্তু কথাগুলো শুভ্রতাকে জানানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না নিহান। সবটা জানার পর শুভ্রতা তাকে ভুল বুঝবে না তো!
নিহান বেশ মলিনমুখে শুভতার দিকে তাকায়, ” আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি শুভ্রা? বুকের ভেতরটা কেমন যেন লাগছে।”

” জড়িয়ে ধরলে ভালো লাগবে?”
” হয়তো একটু শান্তি মিলবে। ”
শুভ্রতা মুচকি হেসে নিহানের বুকে মাথা রাখে। দুই হাত দিয়ে বেশ শক্তা করে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় তাকে। হঠাৎ নিহানের ফোন বেজে উঠতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে সে। অচেনা নম্বর দেখে খটকা লাগে ইমতিয়াজ কল করেনি তো! নিহান কল রিসিভ করছে না দেখে শুভ্রতা ছো মেরে নিহানের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজেই রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মোটা ভারী গলায় ইমতিয়াজ বলে ওঠে, ” কী ব্যাপার নিহান ভাই, বউ নিয়ে ব্যস্ত নাকি? আমার টাকার কথা কি ভুলে গেলেন নাকি? টাকা না পাঠালে সংসার যে ভেঙে যাবে তখন কাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন?”

শুভ্রতা কল কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে আবার নিহানের পকেটে রেখে দেয়। নিহান শুভ্রতার কর্মকান্ডে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে, ” কী হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
” ক কে কল করেছিল? আমার ফোন তুই এভাবে কেড়ে নিলি কেন?”
” কারণ তোমার সাহস নেই ওই লোকের সাথে আমার সামনে কথা বলার?”

শুভ্রতার কথায় আরেকবার চমকে যায় নিহান। শুভ্রতা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, ” তোমার কি মনে হয় আমি ধোঁয়াশার মধ্যে থেকেই তোমাকে বিয়ে করেছি? এত বোকা আমি নই। একবার সংসার ভাঙার পর মেয়েরা আর বোকা থাকে না তাদের চতুর হতে হয়। যাকে বিয়ে করব তার ব্যাপারে সবটা না জেনে কীভাবে বিয়ে করি বলো? ”

” সবটা জানিস মানে? ”
” সবটা মানে সবটা। বাবা আমাকে সব বলেছে। তুমি কি না ওই কাপুরুষটাকে ভয় পাচ্ছিলে? ”
” আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শুভ্রা। ক্লিয়ারলি বলবি?”
” তুমি যখন ইমতিয়াজের সাথে কথা বলছিলে তার আগে আমি তোমাকে কল দিয়েছিলাম ভুলে গেছ? রাস্তায় ওঠার সময় আমাকে ফোন হোল্ড করতে বলে নিজেই ভুলে গেলে। আমি তোমার আর ইমতিয়াজের সব কথা শুনেছি। তুমি তাকে টাকা দিয়েছিলে।”

নিহান এবার শুভ্রতার দুই হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলে, ” বিশ্বাস কর শুভ্রা আমি তোর আগের সংসার ভাঙতে টাকা দেই নি। তোর বাবা আর আমি টাকা জমিয়ে বিশ লাখ টাকা ওকে দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। শুধু তুই যেন ভালো থাকিস, ভালোবাসার মানুষকে যে সবসময় স্বার্থপরের মতো নিজের কাছেই রাখতে হবে এমন কোন ব্যাপার না। ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেখাই তো ভালোবাসা। ”

” আমি সব জানি, ছয় বছর আগেই এসব জেনেছি আমি। ”
” আমাকে বলিস নি তো?”
” নিজের পছন্দকে আর ছোট করতে ইচ্ছে হয় নি আমার। ”

” যখন তুই নিজে জব করছিলি সামান্য টাকায় তখন ইমতিয়াজ একদিন তোর বাবাকে কল করে টাকা চায়। বলে সে নাকি নতুন ব্যবসা করবে। অনেক কথা বলে সে কাকাকে। কাকার হাতে তখন এত টাকা ছিল না। আর তুই তো জানিস কাকা আমার সাথে অনেক আগে থেকেই সব কথা শেয়ার করত। ইমতিয়াজের কথাও তিনি আমার সাথে শেয়ার করেন। আমি নিজে পনেরো লাখ আর কাকা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ইমতিয়াজকে সাহায্য করি৷ তুই জানলে নিজেকে ছোট মনে করবি, টাকা নিবি না তাই এই কথা তোকে জানাতে নিষেধ করি। প্রিয় মানুষের কষ্ট সহ্য করা যায় না আমিও সহ্য করতে পারি নি।”

” তারপর সেই টাকা দিয়ে সে বিভিন্নভাবে উড়াতে থাকে। সেই টাকার মাধ্যমেই সৎমায়ের ভাইয়ের মেয়েকে প্রেমিকা বানিয়ে নেয়৷ বিয়ের কথাও হয়, যখন সবাই জানতে পারে ইমতিয়াজের টাকা শেষ তখনই বিয়েটা ভেঙে যায়। ”
শুভ্রতা কিছুক্ষণ থেমে নিহানকে বলে, ” ফোন বের করো, দেখ হয়তো তোমাকে কল করেই যাচ্ছে। ফোন রিসিভ করে বলো কাল তুমি তার সাথে দেখা করে টাকা দিবে। কাল শেষবারের মতো আমি তার সাথে দেখা করব। ”
” আমি তোদের দুজনকে সামনাসামনি সহ্য করতে পারব না।”
শুভ্রতা নিহানের গালে হাত দিয়ে বলে, ” আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটাই যথেষ্ট নয় কি আমাকে বিশ্বাস করতে?”
নিহান কিছু বলতে পারে না। শুভ্রতা আবার বলে, ” আমি আমার সংসারে আর কোন আঘাত আসতে দেব না। কিছুতেই দেব না।”
নিহান নির্জীব চোখে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমার কিছুতেই এই সময়টা বিশ্বাস হচ্ছে না শুভ্রা।”
” জীবনে খারাপ সময় আসবে। প্লিজ চেষ্টা করবে সবটা আমাকে জানাতে। আমাদের মাঝে কোন অন্ধকার রাখবে না। কোন কথা অন্যকারো থেকে শুনতে খুব খারাপ লাগে। আমি জানি আমার মানুষটা কেমন। এই মানুষটাকে অবিশ্বাস করা যায় না। ”
” শুভ্রা!”
শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে, ” আপনার কি মনে হয় আমি অন্য কাউকে বিশ্বাস করে আপনাকে অবিশ্বাস করব? মোটেও না সাহেব। আপনার সব খারাপ সময়ে আপনি আমাকে পাশে পাবেন, পাবেনই৷ ”
” কখনো আমাকে ভুল বুঝবি না কথা দে?”
” আমি সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারি, তাই কথা দিতে পারছি না। অন্যা*য় না করলে সবসময় আমি পাশে আছি।”
” এটুকুই যথেষ্ট। শুধু ভালো করে যাচাই না করে ভুল না বুঝলেই হলো।”

শুভ্রতা নিজেই এবার নিহানকে জড়িয়ে ধরে। কেমন একটা প্রশান্তি কাজ করছে নিহানের মাঝে। মনের অশান্তি প্রিয় মানুষগুলোই শেষ করে দিতে পারে।
নেহা এসে দরজায় নক করতেই তাড়াতাড়ি করে নিহানকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় শুভ্রতা। নিহান পাশে থেকে বলে, ” বারান্দায় আছি, এখানে আয়।”
নেহা দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে হেটে সোজা বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ায়। দুজনকে পাশাপাশি দেখে বলে, ” তোমরা দুজন কি প্রেম করছিলে?”

নিহান ধমকের সুরে বলে, ” বোন হোস তুই আমার।”
নেহা মুখ বেজার করে বলে, ” আমি কখন বললাম তুমি আমার ভাই হও না? কখনো বলতে শুনেছ?”
নিহান কিছু বলতে যাবে তখনই শুভ্রতা দুজনকে থামিয়ে দেয়। নেহাকে বলে, ” কী হয়েছে? ডাকছিস কেন সেটা বল।”
” আম্মু তোমাকে ডাকছিল।”
শুভ্রতা নিহানের দিকে ফিরে বলে, ” তুমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি যাই দেখি বড়আম্মু কী বলে!”
” আচ্ছা।”

শুভ্রতা নেহার সাথে বারান্দা থেকে বেরিয়ে যায়। নিহানও তাদের পিছন পিছন রুমে আসে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে, ” সাবধানে নিয়ে যাস আমার বউকে।”
নেহা পিছনে নিহানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” হ্যাঁ তোমার বউ তো আমার কিছু হয় না। ”

সাহিলের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। নয়টা পনেরোতে অরুকে কবরস্থ করা হয়। সাহিলের মা ফাউজিয়াকে বাড়িতে নিয়েই কিছুক্ষণের জন্য অরুকে দেখতে গিয়েছিলেন। অরুকে নিয়ে যাওয়ার পর তারা দুজন বাসায় ফিরে আসে। বিছানায় বসে দুজন কথা বলার সময় সাহিল রুমে প্রবেশ করেই ফাউজিয়াকে বলে, আপনি তৈরি হন, বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
সাহিলের কথা শুনে সোজা হয়ে বসে সাহিলের মা। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” এতরাতে কেন ওকে রাখতে যেতে হবে? কাল সকালে পৌঁছে দিয়ে আসলেই হবে। এতরাতে মেয়েটাকে নিয়ে বের হতে হবে না, আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলেছি। ”

সাহিল পাঞ্জাবির হাতা গোছাতে গোছাতে বলে, ” উনার নিশ্চয়ই এখানে থাকতে ভালো লাগবে না। আমার বাইকটা নিয়ে বের হই, ঘণ্টাখানেকের মাঝে বাসায় পৌঁছে দেওয়া যাবে। এখন রাস্তা অনেকটা ফাঁ…।”
” আমি এখন যাব না।” বলে ফাউজিয়া।
” কেন? আপনার এখানে ভালো লাগছে?”
” হ্যাঁ লাগছে।”
সাহিল মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা নিজের রুমে চলে যায় সে। পাঞ্জাবি পাল্টে গোসলটাও শেষ করে। রুমে এসেই শুনতে পায় দরজা নক করার শব্দ। মাথা মুছতে মুছতে বলে,” মা আমি খাব না, ক্ষিধে নেই। তোমরা খেয়ে নাও, আমি ঘুমোবো।”

দরজার ওপাশ থেকে তবুও দরজা নক করে যাচ্ছে। সাহিল তোয়ালেটা রেখে একটা টিশার্ট পরে নেয়। দরজা খুলতেই দেখে খাবারে প্লেট হাতে নিয়ে ফাউজিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সাহিল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে বলে, ” আপনাকে খাবার আনতে বলেছে কে? নিজের রুমে যান অনেক রাত হয়েছে।”
” সরুন, খাবারটা রাখতে দিন।”
সাহিল সরে দাঁড়ালে ফাউজিয়া খাবারের প্লেট রেখে বলে, ” খেয়ে নিন।”

” আপনি নিজের রুমে যান, আমি খেয়ে নেব।”
” আপনি বলেছিলেন ফিরে এসে আমার সাথে কথা বলবেন।”
” ফিরে এসে রাতেই কথা বলব এটা বলিনি। আর কিই বা কথা বলব? আমাদের কী আর কোন কথা আছে?”
” থাকতে পারে না?”
” বোধ হয় না।”
” কোনভাবে আপনিও অরুকে…”
” কী?”
” না, কিছু না। ”
” কথা শেষ করুন।”
” কিছু না।”

” ঠিক আছে রুমে যান। মা ঘুমিয়েছে?”
” হ্যাঁ, উনি তো ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন।”
” তাহলে এবার রুম থেকে যান। এটা শহর না, গ্রামে এতরাতে একটা রুমে থাকা খারাপ দেখায়।”
” ঠিক আছে।”

ফাউজিয়া রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় সাহিল বলে ওঠে, ” মনের মতো কাউকে পান নি, যাকে বিয়ে করা যায়?”
ফাউজিয়া পিছনে না ফিরেই বলে ওঠে, ” আমারও আপনার মতোই অবস্থা, আপনার পর আর কাউকে ভালো লাগে নি। নিজের জন্য আর কাউকে সঠিক মনে হয় নি।”
” ভালোবাসলে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়?”
” ওই যে কথায় আছে না, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে? আমারও হয়েছে এমন। আপনি ছেড়ে আসার পরই আপনার প্রতি আমার…”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৫

ফাউজিয়া কথা শেষ না করেই থেমে যায়। সাহিল পুরো কথাটা শুনতে আনমনেই বলে ওঠে, ” কী?”
ফাউজিয়া এবার সাহিলের দিকে ফিরে তাকায়। চোখ দুটো টলমল করছে। নিম্নস্বরে বলে, ” ভালোবাসি আপনাকে।”
সাহিলের মুখে হাসি দেখে অজানা ভয় হয় ফাউজিয়ার। তবে কি তার এই ভালোবাসা শেষ সময় সর্ব*নাশ ডেকে আনবে। সাহিল ফাউজিয়ার কাছে এগিয়ে এসে বলে, ” এবার যদি আমি প্রতিশোধ-পরায়ন হয়ে আপনাকে ফিরিয়ে দিই?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা শেষ পর্ব