শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৪

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৪
তানিয়া মাহি

বৃহস্পতিবারে শিক্ষাসফরের দিন করা হয়েছিল। সেই কথানুযায়ী আজ সকাল সাতটায় বাস ছাড়া হয়েছে। দুইটা বাসে করে তারা নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। ফাউজিয়া জানালার পাশে বসে বাহিরের পরিবেশ দেখছিল আর ভাবছিল ফেলে আসা সেই পুরোনো দিনের কথা। আগে সবাই মিলে কত ঘুরাঘুরি করা হত! আজ এতগুলো বছর সে নিজের শহর ছেড়ে বের হয় নি খুব বেশি প্রয়োজন না হলে। বলতে গেলে সে তার বেশিরভাগ সময়ই নিজের ঘরে কাটায়

“পানির বোতলটা একটু দেন তো ম্যাম।” কথায় ঘোড় কাটে ফাউজিয়ার। পাশে তাকাতেই কলেজের সে ম্যাম আবার বলে, ” পানি পিপাসা পেয়েছে।”
ফাউজিয়া ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দেয়। উনি ঢকঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে আবার ফাউজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ” বিয়ে করছেন কবে? বয়স তো বাড়ছে।” ফাউজিয়া জোরপূর্বক হেসে বলে, ” করব, সঠিক মানুষটা পাই। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সঠিক মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যায় ম্যাম? সঠিক বানিয়ে নিতে হয়। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে আমাদের দাওয়াত দিন। ”
ফাউজিয়া প্রত্তুত্তরে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় আবার। সেদিন সাহিলকে ফিরিয়ে দিলে হয়তো আজ তার একটা সংসার হত। সাহিলকে ফিরিয়ে দেওয়ার আফসোসে আজ অবধি আর কাউকে তার মনেই ধরেনি। মনে মনে অনেক প্রশ্নই জাগে তার সাহিল কি বিয়ে করে নিয়েছে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে নির্দিষ্ট গন্তব্যে থামে। একে একে বাসের সব মেয়েরা বেরিয়ে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। নয়টা পার হয়ে গিয়েছে, প্রায় দশটা। সবার প্রথমে নাস্তাটা সেরে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করল টিচাররা৷ পাশেই একটা বড় হলরুমের মতো জায়গায় সবাই গিয়ে বসে৷ সেখানেই সকালের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে এগারোটা বেজে যায়। খাওয়া শেষ করে তালিকা করা কিছু জায়গায় ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করে সবাই। যথারীতি বারোটার দিকে বেরিয়েও যায়। আশেপাশের দুই- তিনটা জায়গায় ঘুরে আবার সবাই ফিরেও আসে দুপুরের খাবারের জন্য। প্রায় তিনটার দিকে পনেরো জনের করে কয়েকটা দলে বিভক্ত করা হয় সবাইকে। সব কয়েকটা দলের সাথে একজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পাঠানো হয়।

সে হিসেবে ফাউজিয়াও পনেরো জনকে নিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী ঘুরতে থাকে। রোদ মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করেছে। সামনেই একটা বড় বটগাছ দেখে সবাই গিয়ে সেখানটায় গাছের শিকড়ের ওপর বসে। সবাই বসে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিল। ফাউজিয়া নিজেও মায়ের সাথে কথা বলে নেয়। হঠাৎ তার কানে আসে-

আমি আবার ক্লান্ত পথচারী
আমার কা*টার আঘা*ত লাগে ভারী।
গেছে জীবন দুদিকে দুজনারই
মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি!
ছুঁতে গিয়েও যেন হাতের নাগালে না পাই,
এভাবে হেরে যাই, যেই ঘুরে তাকাই,
কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।
আলগা থেকে তাই খসে পড়েছি প্রায়
কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।

ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে তার গিটার নিয়ে গান গাইছিল। সবাই তাকেই ঘিরে বসে গান শুনছে। একপাশেই বসে আছে ফাউজিয়া। বুকের মধ্যে লুকোনো ব্যথাগুলো যেন দম আটকে মে*রে ফেলতে চাইছে তাকে। পুরোনো মানুষটাকে খুব মনে পড়ছে আজ। মনে হচ্ছে একটাবার যদি কথা বলে সব মিটমাট করে নেওয়া যেত! কিন্তু এখন তো আসলেই দুজনের রাস্তা দুদিকে। দুই রাস্তার গন্তব্যস্থল কি আবার কখনো এক হতে পারে!

মাহতিম তন্ময় কারো সাথে কথা বলছে। স্নিগ্ধা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কোন একজনের বিষয়ে তথ্য নিতে হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ। কথা শেষ করে মাহতিম সবার কাছে এসে দাঁড়ালো। ল্যাপটপে কাজের গতি খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল, ” কাজ কতদূর?”
পাশে থেকে একজন বলে উঠল, ” ছবি পাঠানোর কথা কিন্তু এখনো কোন খবর নেই।”

মাহতিম চুল ঠিক করতে করতে বলল, ” এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আমার বাড়ি ফিরতে হবে। আমার মেয়ে অসুস্থ, এখানে নতুন বাসা নেওয়া হয়েছে। সবাইকে এখানেই নিয়ে আসব।”
স্নিগ্ধা কাজ ফেলে মাহতিমের দিকে তাকায়। পাশে থেকে রাইমা বলে ওঠে, ” স্যার আপনি বিবাহিত!”
মাহতিম চকিতে জবাব দেয়, ” গতমাসে পাঁচবছর হয়েছে। আমার একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স।”

স্নিগ্ধা একপলকে বাক্যহীন চেয়ে আছে মাহতিমের দিকে। অফিসের সবার সাথে সেও বুঝতে পারেনি মাহতিম বিবাহিত। সবাইকে দেখে মাহতিম বুঝতে পারে সবাই তাকে অবাক চোখে দেখছে। অফিসে আসার পর থেকে কারো সাথে তেমন কথা হয়নি তার। কাজের মাঝেই ডুবে ছিল সারাক্ষণ। মাহতিমের জীবন মানের শুধু কাজ আর তার পরিবার। অফিসের সবার অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কাজের আগে সঙ্গীদের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো খুব প্রয়োজন। মাহতিম একটা চেয়ার টেনে সবার মাঝেই বসে। ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ” তোমরা কি ভেবেছিলে আমি অবিবাহিত?”

একজন আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ” স্যার আমরা সবাই ভেবেছিলাম আপনি অবিবাহিত। ”
মাহতিম হেসে ওঠে। ওখানে থাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কারো মুখে আর কোন কথা নেই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাহতিম আবার বলে, ” আমার পরিবার বলতে আমার মা আর আমার মেয়ে।”
রাইমা এক মুহুর্ত দেরি না করেই বলে, ” ম্যাম? উনি আপনাদের সাথে থাকেন না?”

” না, আপনাদের ম্যাম আমাদের মেয়ে জন্মানোর সময় মা*রা গিয়েছেন।”
স্নিগ্ধা আগ্রহ দমাতে না পেরে বলে, ” তাহলে যে বললেন গতমাসে আপনাদের বিয়ের পাঁচ বছর হয়েছে?”
” হ্যাঁ, সে মা*রা গিয়েছে জন্য কী বিয়ের তারিখ ভুলে যাব? আচ্ছা তোমরা এগুতে থাকো দেখো কতদূর কী করতে পারো আমি এক্ষুনি বের হব।”
মাহতিম অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সবার মাঝে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যায় যার মূলকেন্দ্র মাহতিম।

অরু লালরঙের টকটকে শাড়ি পরে ঘাড়ের ওপর একটা হাত-খোপা করে রেখেছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিতে দিতে বলল, ” মা, আমাকে সত্যিই লালশাড়িতে মানিয়েছে? আমার কাছে কেমন যেন একটা লাগছে। আমি কি শুকিয়ে যাচ্ছি মা? লালশাড়িতেও যেন আমাকে আর ভালো লাগছে না। সাহিল ভাইয়ার ভালো লাগবে তো?”

অরুর মা বারবার নাক টানছেন। মেয়েকে সাজতে দেখলেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নাও করতে পারেন না তিনি। নিজেকে শক্ত করে রাখতে হয় মেয়েকে সঙ্গ দিতে নচেৎ মেয়েটা যে আরও ভেঙে পড়বে। অরু এখন নিজের শারীরিক অবস্থা দেখে নিজেই বুঝতে পারে তার হাতে আর খুব একটা সময় নেই।

মাকে চুপ থাকতে দেখে অরু আবার বলে, ” মা কিছু বলছ না যে?”
অরুর মা এবার নিরবতা ভেঙে বলেন, ” আমার মেয়েকে কি খারাপ লাগায় উপায় আছে? আমার মেয়েকে যেকোন রঙের পোশাকেই পরীর মতো সুন্দর লাগে।

অরু চোখে কাজল দেওয়া শেষ করে নিজেকে একবার দেখে নেয়। চোখের নিচের কালো দাগের সাথে প্রায় মিশে গিয়েছে কাজল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেই নিজেকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নেয়। মা যতই বলুক অরু জানে তাকে আর আগের মতো সুন্দর লাগে না। এই চেহারায় আর কোন পুরুষের চোখ আটকাবে না কখনো। তার অস্তিত্বই তো কয়েকদিন বা কয়েকঘন্টা অথবা হতে পারে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। অরু বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, ”

মা, তোমার মেয়েকে তো সাদা রঙের পোশাকেও দারুণ লাগবে তাই না? আমাকে সাদাকাফনে শুভ্রপরীর মতো লাগবে না বলো? মা তুমি দেখো, সমস্ত শরীর যখন শুধু শুভ্র আর শুভ্ররাঙা হবে , তখন একদম ফুটন্ত সাদা ফুল লাগবে আমায়। আমি তো তোমার রঙিন ফুল, তোমার রঙিন ফুলটাকে হয়তো শুভ্ররঙে বেশি মানাবে। ”

অরুর মা এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শব্দ করে কান্না করে ফেলে৷ সন্তানের মৃত্যু কোন মা সহ্য করতে পারে না। সেখানে অরু একটা বাচ্চা মেয়ে। অনেক সাধনার পর এই মেয়ে আল্লাহ ঘর আলো করে দিয়েছিলেন তাকে। অতি শখের আর সাধনার জিনিস যে আয়ু কম নিয়ে আসে।

অরু মায়ের কান্না দেখে বারবার চোখ মুছতে থাকে। যত্নে দেওয়া কাজল চোখের পানিতে আর অরুর ডলাডলিতে লেপ্টে গেছে। এই ছোট মেয়েটা যে আর কঠিন হয়ে থাকতে পারছে না। সব আনন্দ, ভালো থাকার অভিনয় শেষে এসে খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অরু দৌঁড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। কাঁদতে অরুর ভীষণ খারাপ লাগছে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। হাঁপিয়ে গেছে সে, মাকে জোরে জোরে ডাকছে।

অরুদের বাড়িতে ঢুকবে তখনই মা-মেয়ের কান্না শুনতে পায় সাহিল। টানাপায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সোজা অরুর ঘরে চলে যায়। অরুর মা অরুর গালে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিচ্ছেন আর অরুকে ডাকছেন। অরু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সাহিলকে দেখামাত্র অরুর চিৎকার দিয়ে বলে, ” সাহিল দেখ না অরু কেমন করছে। কথা বলছে না মেয়েটা। আমার ভালো ঠেকছে না, অরু এমন করছে কেন? ”

সাহিল এসে পাশে বসে। অরুর মাথা নিজের বুকের কাছে নিয়ে অরুকে ডাকতে থাকে। হাতের তালুতে ঘষতে থাকে।
” অরু, এই অরু কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? অরু?”
অরু কোন কথা বলছে না, সাহিল অরুর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কাকি, অবস্থা ভালো বুঝছি না। ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি বের হন। আর এক মুহুর্ত দেরি করাও বোকামি হবে। ”

সাহিল অরুকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অরু চোখ খুলছে আর বন্ধ করছে। চোখ নিস্তেজ হয়ে এসেছে। বাঁধা বাঁধা গলাতেই বলে, ” সাহিল ভাইয়া আপনার সাথে আমার লালশাড়ি পরে মেলায় যাওয়া হলো না। আপনাকে পাওয়াও হলো না। জীবন তো একটাই, এই ছোট্টো জীবনটাও কেন এত অপূর্ণতায় পূর্ণ বলেন তো? ”

অরুর কথাগুলো সাহিলের কানে পৌঁছায় কিন্তু সে তাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াতেই থাকে আর বলতে থাকে, ” তোর কিছু হবে না অরু। এই তো এখনই গাড়ি পেয়ে যাব তারপরই হাসপাতাল। তুই তাকিয়ে থাকার চেষ্টা কর অরু। চোখ বন্ধ করবি না একদম। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৩

অরু নিজের শরীরের ভর একদম ছেড়ে দেয়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সাহিল কিছু একটা বুঝতে পেরে অরুর দিকে তাকায়। অরুর মাঝে আর কোন অস্থিরতা নেই, চোখের পলকও পড়ছে না। একপলকে সাহিলের দিকেই তাকিয়ে আছে। সাহিল দাঁড়িয়ে যায়। নরমস্বরে ডাক দেয়, ” অরু!”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৫