শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৫

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৫
তানিয়া মাহি

” কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আপনি যে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন আব্বা জানে?”
ইমতিয়াজ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল এমন সময় ফারজানার কথায় দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। মেয়েটা বেশ রগচটা, সবগুলো কথাতেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ।

” হ্যাঁ, আপনার বাবা জানেন। অনুমতিও দিয়েছেন।”
কোমর থেকে খড়িগুলো উঠোনে নামিয়ে বলতে থাকে, ” তো এখন যাবেন কোথায়? ঠিক করেছেন কিছু?”
” সেটা আপনার জানতে হবে না। ”
” জানতে হবে না মানে? আবার যে কোথাও গিয়ে ম*রতে বসবেন না সেটার কোন গ্যারান্টি আছে নাকি?”
” ম*রলে কেউ আপনাকে ধরতে আসবে না। এতদিন খাইয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আমার ব্যাপারে আর কোন আগ্রহ না দেখালেও খুশি হব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আপনার বাড়িতে কেউ আছে? আপনি কিছুই বলেন নি। এই কয়েকদিন এখানে ছিলেন… ”
ফারজানাকে থামিয়ে দিয়ে ইমতিয়াজ বলে, ” তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। আসছি..”
” আপনি চাইলে এখানে থেকে যেতে পারেন। বাবার সাথে কাজ করলে….”
ইমতিয়াজ আবারও ফারজানাকে থামিয়ে দেয়। বেশ আক্রো*শ নিয়ে বলে, ” আপনার উপার্জনের টাকায় ক’দিন খেয়েছি, তাই বলে কি এখন আপনি ঠিক করবেন আমি কী করব, কোথায় থাকব?”

ফারজানা কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কম কথা শোনায় নি তো সে ইমতিয়াজকে। কাউকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিয়ে কত কথা শুনিয়েছে সে। উপায়ও তো কিছু ছিল না৷ তবে এখন ইমতিয়াজের যাওয়ার সময় বুঝতে পারছে সে একটু অতিরিক্তই করেছে। ফারজানাকে চুপ থাকতে দেখে ইমতিয়াজ বলে, ” আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। আমি কোথায় যাব আমি নিজেও জানি না। কীভাবে থাকব, দিন চলবে সেটাও জানি না। তবে আমি কারো সাথে পাশে থাকব না। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাকে একা থাকার জন্যই পাঠিয়েছেন। তিনি যেমনটা চান তেমনটাই হবে। ”

ইমতিয়াজ ফারজানাকে পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ নিজেও জানে না সে কোথায় যাবে,কী করবে! শুধু জানে যাদের যাদের জন্য আজ তার এই দশা তাদের শান্তি নষ্ট করে, নিজের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে তারপর পরিচিত বি*ষধর মানুষের কাছে থেকে সারাজীবন দূরে থাকবে। তাকে যে খোঁজার কেউ নেই, ভালোবাসারও কেউ নেই।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ছবি উঠছিল। ইমতিয়াজ গুণে দেখলো সেখানে পাঁচজন মেয়ে আছে সাথে দুইটা বাচ্চা। তার হাতে তো কোন টাকা নেই তাদের থেকে চাইলে হয়তো কিছু টাকা পেতে পারে এই আশায় ইমতিয়াজ সেদিকেই এগুতে থাকে। হঠাৎ রাস্তার ঢাল থেকে একজনকে কিছুটা সামনেই উঠে আসতে দেখে ইমতিয়াজের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে যায়।

মেয়েগুলোকেও এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরা যে আর কেউ নয়, শুভ্রতা আর তার পরিবার। ইমতিয়াজ আশা করে এখান থেকে এবার মোটা অংকের কিছু টাকা পাওয়া যাবে। নিহান রাস্তায় উঠতেই সামনে ইমতিয়াজকে দেখে স্থীর হয়ে যায়। ইমতিয়াজের মুখে ভুবনভুলানো হাসি। নিহান একবার শুভ্রতার দিকে তাকায় সে এখনো ইমতিয়াজকে দেখেনি। সে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করে, ” কী চাই এখানে?”

ইমতিয়াজ গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, ” টাকা। অনে-ক টাকা। ”
” মানে? আমি তোমাকে টাকা কেন দিতে যাব? ভিক্ষে চাইছো সবকিছু হারিয়ে?”

” ভিক্ষে!” বলেই ইমতিয়াজ শব্দ করে হাসতে থাকে। আবার বলে, ” আপনার বর্তমান আর আমার অতীত ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার সময় খারাপ যাচ্ছে, আপনারও সময় খারাপ যাক এটা আমি চাই না। আগে যে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার শুভ্রতাকে আপনাকে দিয়েছিলাম সেই খবর চাপা রাখতে আমার এখন পনেরো লাখ টাকা লাগবে। আমাকে টাকা দিয়ে দিন আমি একেবারে আপনাদের জীবন থেকে চলে যাব৷ আমি আর এইদেশে থাকার রিস্ক-ই নেব না। শুধু পনেরো লাখ টাকা চাই।”

নিহান ইমতিয়াজের শার্টের কলার ধরে চোয়াল শক্ত করে বলে, ” ওকে একদম আমার শুভ্রতা বলবি না। ও শুধু আমার, আগেও আমার ছিল এখনও আমার আর ভবিষ্যতেও আমার। ওর দিকে নজর দিলে চোখ তুলে নেব।”
” অন্যকারো বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই৷ আমাকে টাকা দিয়ে দেন আমি চলে যাচ্ছি। সারাজীবনের জন্য আমি চলে যাব। যদি বেশি বুদ্ধিমান সাজার চেষ্টা করেন সংসার শেষ করে দেব আপনার। আমি এত ভালো মানুষ না যে নিজে খারাপ থেকে অন্যের ভালো চাইব।”

” তোমার কি মনে হয় আমি পনেরো লাখ টাকা নিয়ে বেড়াতে আসছি।”
” আমাকে আপাতত কিছু টাকা দেন কালকে সব টাকা দিলেই চলবে। আজকের টাকা হিসেব করে কেটে রেখে দিবেন। আমি ওতটাও খারাপ না। ”

নিহান রেগে চ’ উচ্চারণ করল। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে কিছু সহ্য করতে৷ ছোট খাটো একটা ব্যাপারে মানুষ খু*ন তো আর করতে পারবে না। ইমতিয়াজ নিহানের নম্বরটা নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। নিহান ইমতিয়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, নতুন কোন বিপদ আসছে না তো!

সফর শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে। দুজন শিক্ষক বাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী গুণে গুণে দেখছে সবাই ঠিকঠাকমতো বাসে উঠেছে কি না। সবাই যখন জানালো প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট বাসে উঠে বসেছে তখন সব শিক্ষক-শিক্ষিকাও নিজেদের সিটে বসেন। বাস চলতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা সবাই একসাথে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তাদের আরও পরে ফেরার কথা ছিল কিন্তু প্রিন্সিপাল একটু অসুস্থতা বোধ করলে কেউ আর দেরি করতে চায় নি। বাস চলছে, সামনের সিটে প্রিন্সিপাল একা বসেছেন। ফাউজিয়া ফোনে গান ছেড়ে হেডফোনটা লাগিয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে গানের প্রতিটা লাইন অনুভব করতে থাকে।

Lag ja gale………….
Ki fir yee………
Hasin raat……………
Ho na ho………
Shayed is janam main…….
Mulakaat ho na hoo……
Lag ja gale………….
Ki fir yee………
Hasin raat……………
Ho na ho………

হঠাৎ বাস ব্রেক কষতেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে সবাই। বাসের সামনে দিয়ে একটা বাচ্চা দৌঁড়ে আসায় ব্রেক কষতে হয়েছে। কী হয়েছে জানার জন্য সবাই আশেপাশে এবং সামনের দিকে দেখছে। বাস তখনও থেমে আছে। ফাউজিয়া সামনে থেকে চোখ সরিয়ে ডানপাশে তাকাতেই চোখের সাথে তার হৃৎস্পন্দনটাও যেন থেমে যায়। বাহিরে রাস্তার পাশে কেউ তার দিকে পূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ফাউজিয়ার মধ্যেও আড়ষ্টভাব চেপে বসে।

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বাহিরের পুরুষের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ বুঝতে পারে বাস আবার চলতে শুরু করেছে। ফাউজিয়া সাথে সাথে বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে যায়। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে সে। সিট থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে৷ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ফাউজিয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভারের সাথে সাথে বাসের সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাশে থেকে একজন বলে ওঠে, ” কী হয়েছে ম্যাম?”
ফাউজিয়া কোন জবাব দিতে পারে না। সে সোজা প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

” স্যার।”
প্রিন্সিপাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ফাউজিয়ার দিকে তাকায়, ” কী হয়েছে?”
” স্যার আমি এখানে নেমে যাব।”
” মানে? কেন?”
” স্যার এখানে আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। আমার এখানেই নামতে হবে আর এক্ষুণি।”
” আগে তো কিছু বলেন নি?”

” স্যরি স্যার আমার মনে ছিল না। ভুলে গিয়েছিলাম আমি। আমি কি নেমে যাব?”
” একা এক মহিলা মানুষকে কীভাবে রেখে যাই বলুন তো?”
” স্যার শুক্রবার আর শনিবার তো ছুটি আমি রবিবারে ঠিক কলেজে চলে আসব। ”

ফাউজিয়া বাস থেকে নেমে বাহিরে চলে আসে। শাড়ির আঁচলের নীচের অংশে দ্বিতীয় ভাজ দিয়ে কাধের ওপর তুলে নেয়। ব্যাগ হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই বাস ছেড়ে দেয়। রাস্তার ডানপাশে থাকা পুরুষটি এবার তার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৪

ফাউজিয়াও সেদিকে এগুতে থাকে। দুটো পুরোনো মানুষ আজ সামনাসামনি, পুরোনো দু’জোড়া চোখ সামনে দাঁড়ানো একে অপরকে দেখছে। ফাউজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ দুটো আজ তার ছলছল করছে, হৃৎস্পন্দন বেড়েছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি
ফেলে বলে ওঠে, ” স্যার!”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৬