শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০
তানিয়া মাহি

“বিয়ের পর বউয়ের সাথে রোমান্স করা বাদ দিয়ে বউকে ধমকে ধমকে পড়াতে হয়েছে গত তিনদিন। তুমি হলে পড়াতে? থাকতে এমন বউয়ের আশেপাশে?”
রায়হানের এমন কথায় লজ্জা পেয়ে যায় শাকিরা। শাকিরার পরিক্ষা শেষ হতে না হতেই রায়হানের বাবা-মা দুজনকে বাড়ি ফিরতে বলছে। সে কথা রায়হান শাকিরাকে জানাতেই শাকিরা বলে, ” আর দুইদিন পর গেলে হয় না? মাত্র পরিক্ষা শেষ হলো দুইদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর যাই।”

তখন রায়হান উক্ত কথা বললে শাকিরা বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। সে বলে, ” সবাই যে বলে আপনি ঠোঁটকাটা, এখন দেখছি মিথ্যা কেউ বলে না।”
” নিজের যা চাই সেটা না জানালে জানবে কি করে? পেতে হলে তো জানাতে হবে আর জানালে তবেই পাওয়া যায়।”
” আজই যেতে চাচ্ছেন?”
” গেলে ভালোই হতো। নিজের রুম ছাড়া অন্যকোথাও ঘুম হয় না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” অভ্যেস করে নিন, মাঝেমাঝেই তো এখানে আসতে হবে।”
” সে দেখা যাবে। এখন বল কবে যেতে চাইছো?”
” দুইদিন পর যাই। আপনি আগে যেমন এখানে থেকেছেন ওভাবেই থাকুন।”
” আগে তো তোমার থেকে দূরে দূরে থেকেছি এখনো কি দূরে দূরে থাকব?”
বেশ জটিল প্রশ্ন, কি উত্তর দেবে শাকিরা? শাকিরাকে চুপ থাকতে দেখে রায়হান আবার বলে, ” কি হলো দূরে থাকতে হবে?”

শাকিরা বলে, ” না, এখানেই থাকুন।”
রায়হান শাকিরাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে বলে, ” কি মেয়ে বিয়ে করেছি নিজে থেকে এসে জড়িয়েও ধরে না একটু। সারাক্ষণ দূরে দূরে থাকবে শুধু।”
রায়হান শাকিরাকে বুকে জড়িয়ে নিতেই প্রশান্তির শ্বাস ফেলে রায়হান। সবার প্রিয় মানুষের জায়গা নিজের বুকে হয় না, কারো কারো প্রিয় মানুষ অন্যের বুকেও থাকে। সুখী তো সেই ব্যক্তি যে প্রিয় মানুষকে নিজের বুকে সারাজীবনের জন্য পেয়েছে।

ফাউজিয়া রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। কার কাপে কয় চামচ চিনি দেবে সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। চা বানাতে আসার আগে শুনেও আসে নি। কি যে বোকা বোকা লাগছে নিজেকে!
এখন শুনতে গেলে লজ্জায় পড়তে হবে বিধায় তিন কাপ চা’তেই এক চামচ করে চিনি দিয়ে দেয়।
ফাউজিয়া একে একে তিনজনের হাতেই চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। সাহিল শেখ তার মাকে নিয়ে ফাউজিয়াদের বাড়িতে এসেছে। আসল কারণটা সে এখনো ধরতে পারে নি কারণ তার মা তাকে রান্নাঘরে চা বানাতে পাঠিয়েছিল।

ফাউজিয়ার মা সবাইকে চা নিতে বলে নিজেও এক কাপ চা নেন। সাহিলের মা চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ” আহ, চা তো বেশ ভালো বানাতে পারো দেখছি। এজন্যই বুঝি আপা মেয়েটাকে চা বানাতে পাঠালেন? শোনো মেয়ে চা আর রুটি কখনো ভালো বানাতে নেই, ভালো বানালেই মানুষ প্রশংসা করতে করতে কাজ বাড়িয়ে দেবে। এই যেমন তোমার মা।”
কথাটা বলেই তিনি হেসে আবার চা খেতে শুরু করেন। সাহিল শেখ চা মুখে নিতেই বুঝতে পারে চিনি দেওয়া হয়েছে। তবে খুব একটা মিষ্টি না হওয়ায় বেশ ভালোই লাগছে যদিও সে চা’তে চিনি পছন্দ করে না। সাহিলের মা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” চা কেমন হয়েছে রে?”

” ভালো, মা।”
” চিনি দিয়েছে?”
” হয়তো এক চামচ দিয়েছে, মন্দ লাগছে না।”
” আপনি চা’তে চিনি খান না স্যার?”
ফাউজিয়ার প্রশ্নে বেশ সহজভাবে উত্তর দেয় সাহিল, ” খাই না, তবে ভালোই লাগছে।”
” স্যরি স্যার আমি জানতাম না।”

” ইটস ওকে। আচ্ছা মা আমি তাহলে উঠছি, তুমি সাবধানে থেকো। আন্টি আমি আসছি তবে। রাত আটটার দিকে এসে মাকে নিয়ে যাব। মা’র শরীরটা একটু অসুস্থ না হলে আর কাজের বুয়া থাকলে বাড়িতেই রেখে যেতাম কিন্তু…..”
ফাউজিয়ার মা বলে, ” তুমি কোন চিন্তা করো না বাবা। তোমার মা আর আমি গল্পগুজব করে সময় পার করে দেব। আমার ভালোই হলো কথা বলার একটা মানুষ পাওয়া গেল। মেয়েটা সারদিন পড়াশোনা করে আমার ঘরেই বসে থাকতে হয় বা পাশের ফ্ল্যাটে যাই। তোমাদের বাড়িও তো কাছেই, ভালোই হলো মাঝেমধ্যে যাওয়া যাবে। তুমি যাও সাবধানে আবার ফিরে এসো।”

” ঠিক আছে আন্টি। মা আসছি তবে।”
সাহিল শেখ যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে ফাউজিয়ার মা ফাউজিয়াকে বলে, ” সাহিল চলে গেলে দরজাটা আটকে দিয়ে আয়। আমি আর আপা রুমে গিয়ে বসি।”
মায়ের কথায় ফাউজিয়া সাহিলের পিছে পিছে গিয়ে দরজা আটকে ভেতরে চলে আসে।
রাত সাড়ে আটটা আকাশটা মেঘলা, চারদিকে শনশন বাতাস বইছে। বৃষ্টির ফোটা পড়ছে, এখনো জোরে বৃষ্টি আসেনি। শুভ্রতা রুম থেকে বেরিয়ে স্নিগ্ধার রুমে চলে যায়। স্নিগ্ধা তখন জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল। শুভ্রতা গিয়ে স্নিগ্ধাকে টেনে ছাদে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামায়। স্নিগ্ধা কিছুই বুঝতে পারছে না কি হলো!

” কি হলো আপু? এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”
” ছাদে চল, বৃষ্টিতে ভিজব। কি সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে দেখেছিস!”
” আপু, মা কিন্তু ধরে মা*রবে।”
” কিচ্ছু হবে না আয় তো।”
” তোমার না এমনিই ঠান্ডা লেগেছে, বিকেলে আম্মুকে বললে?”
” আরে কিছু হবে না চল তো!”

স্নিগ্ধাকে নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায় শুভ্রতা। আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। বৃষ্টির ফোটা এসে গালে, চোখে পড়ে আবার ছিটকে পড়ছে। স্নিগ্ধা ছাদে বসে পড়ে, দুই পা উঁচু করে ব হাটুতে চিবুক রেখে বসে ভিজছে, তার মতে বৃষ্টি উপভোগ করার এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়।
প্রায় আধাঘণ্টা পর দুজনে নিচে নেমে জামাকাপড় পাল্টে নেয়। দুজনই শীতে কাঁপছে। স্নিগ্ধা বলে, ” ভাগ্যিস আম্মু দেখেনি, দেখলে আজ খবর খারাপ ছিল।”

রুমের বাহিরে থেকে আয়েশা বেগম বলে ওঠে, ” কে বলেছে তোদের আমি দেখিনি? দুজনের সাহস খুব বেড়ে গেছে তাই না? এতরাতে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে? খুব বৃষ্টিবিলাসী হয়ে গেছেন দুজন! আর একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে যদি কাউকে দেখেছি তাহলে সেদিনই পা ভেঙে ঘরে ফেলে রাখব।”
মায়ের কথায় স্নিগ্ধা চুপ হয়ে যায়। শুভ্রতার মুখও মলিন। আয়েশা বেগম রুমে এসে শুভ্রতার মাথা নিজের ওরনা দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলেন, ” এতরাতে কেউ বৃষ্টিতে কেউ ভিজে? জ্বর আসলে! ঠান্ডার যেন না লাগে ওষুধ খেয়ে নে একটা।”

” ঠিক আছে মা খেয়ে নেব। বৃষ্টি দেখে খুব ভিজতে ইচ্ছে করছিল তাই….”
” বুঝেছি, এরপর কখনো যেন রাতে না ভিজতে দেখি।”
“তুমি আমাদের ভিজতে দেখলে কি করে? তুমি তো তখন নামাজ পড়ছিলে। তোমাকে কি অন্যকেউ খবর দিয়েছে?”
স্নিগ্ধার কথা শুনে একটু ধমক দিয়ে স্নিগ্ধাকে চুপ করিয়ে দেন আয়েশা বেগম।
স্নিগ্ধা ঠোঁট উল্টে কান্নার ভঙ্গিতে বলে, ” তুমি বড়মেয়েকে কিছু বলো না শুধু আমাকে ধমকের ওপরে রাখো। আমি যেতে চাই নি আপুই জোর করে নিয়ে গেছে আমাকে, কি রে আপু বল মাকে।”

শুভ্রতা মাথা নিচু করে বলে, ” হ্যাঁ মা, তুমি ওকে কিছু বলো না।”
আয়েশা বেগম স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” হয়েছে হয়েছে এদিকে আয় মাথাটা মুছে দেই। চুলে গোড়ায় পানি থাকলে ঠান্ডা লাগবে তখন তো আমারই দেখতে হবে।
রাত দশটার দিকে শাহাদাত সাহেব শুভ্রতার রুমে নক করে। শুভ্রতা তখন শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করছিল আর ইরার সাথে কথা বলছিল। শাকিরার বিয়ের পরদিনই তাদের ফিরে যেতে হয়েছিল তাই সবার সাথে তেমন আনন্দ করতে পারে নি।

দরজায় নক করার শব্দ শুনে শুভ্রতা উঠে দরজা খুলে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে। শুভ্রতা বাবাকে ভেতরে আসতে বলে নিজেও এসে বিছানায় পা তুলে বসে। শাহাদাত সাহেব এসে সামনের চেয়ারটায় বসে। তার হাতে একটা দেখে শুভ্রতা বলে, ” ব্যাগে কি বাবা?”
” তোদের দুই বোনের জন্য নতুন ড্রেসের কাপড় এনেছি সাথে ড্রেসের সাথে ম্যাচ করা হিজাব আছে। সামনে সপ্তাহে আমার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। বাড়ির সবাইকে দাওয়া দিয়েছে তাই তোদের জন্য নিয়ে এলাম। কাল দর্জির কাছে গিয়ে বানাতে দিয়ে আসিস।”

” ঠিক আছে বাবা।” বলে শুভ্রতা তার বাবার হাতের ব্যাগটা নেয়। বের করে ড্রেসগুলো দেখতে থাকে। নতুন জিনিস পেলে সবার মন ভালো হয়ে যায় আর সেটা যদি বাবা দেয় তাহলে তো কথাই নেই।
শাহাদাত সাহেব বলেন, ” পছন্দ হয়েছে?”
শুভ্রতা মুখে হাসি নিয়ে বলে, ” হ্যাঁ বাবা দুটোই খুব পছন্দ হয়েছে। আমি কোনটা নেব বলো তো?”
শাহাদাত সাহেব কিছু বলবেন তার আগেই আবার সে বলে, ” কাল স্নিগ্ধাকে দেখাই, ও যেটা নেবে সেটাই ওর। আমার যেকোন একটা হলেই হবে কারণ দুটোই সুন্দর।”

” ঠিক আছে দুজন মিলমিশ করে নিস তাহলে।”
” ঠিক আছে বাবা।”
” এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যা মা। ফজরে উঠে নামাজটা আদায় করে নিস।”
” ঠিক আছে, উঠব বাবা।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯

শাহাদাত সাহেব মেয়ের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে শুভ্রতাকে ঘুমোতে বলে চলে যায়। শুভ্রতা তার বাবা আর বাড়ির মানুষগুলোকে দেখে ভাবে আল্লাহ তাকে কতটা ভাগ্যবতী করে পাঠিয়েছে। একটা ডিভোর্সি মেয়ের জীবন কতটা কঠিন তা কেউ তাকে বুঝতেই দেয় না। একজন বাবা কি এতটাই ভালো হয়! সবার বাবা কি তার বাবার মতো হয়!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১