শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯
তানিয়া মাহি

পোশাক কিনতে গিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে দেখতে পাবে এটা কিছুতেই ভাবতে পারে নি শুভ্রতা। ইমতিয়াজ এসেছে তার মা, বোন এবং হবু বউকে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করতে। তারা বসে বিয়ের শাড়ি দেখছিল এমন সময় একই দোকানে নিহান এবং শুভ্রতা প্রবেশ করে। শুভ্রতা আর নিহান চেয়ার টেনে বসতেই দোকানী নিহানকে সালাম দিয়ে বলে, ” আরে ক্যাপ্টেন সাহেব যে! তা কেমন আছেন মশাই?”

” দীপ্ত দা?”
” চিনলেন তাহলে!”
” কতদিন আগে দেখা হয়েছিল বলুন তো! আর তারপর কেমন চলছে সব?”
” এইতো দোকান নিয়ে বসেছি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিহান দোকানীর সাথে কথা বলতে থেক। শুভ্রতা পাশে তাকাতেই দেখে ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বসে শাড়ি দেখছে, তাকে হয়তো কেউ খেয়াল করে নি। ইমতিয়াজের পাশেই মোনালিসা বসে শাড়ি পছন্দ করছে। বিয়েতে কোন শাড়ি পরবে সেটা দেখছে। কিছুদিন আগে যে শুভ্রতা ছিল সেই শুভ্রতা থাকলে হয়তো ওদের সামনে গিয়ে ইমতিয়াজকে অনুরোধ করতো এসব না করতে, তাকে ফিরিয়ে নিতে বলতো। কিন্তু শুভ্রতা এখন বুঝতে পেরেছে ইমতিয়াজের মতো মানুষ তাকে ডিজার্ভ করে না। শুভ্রতা দেখেও না দেখার নাটক করে নিহানকে বলল, ” আপনি কি গল্পই করবেন নাকি আমরা শাড়ি দেখব?”

” তুই ওদিকে দেখ কোনগুলো পছন্দ…….”
নিহানের চোখ যায় ইমতিয়াজের ওপর। ইমতিয়াজকে দেখা মাত্র মাথা গরম হয়ে যায় তার। শুভ্রতাকে বলে, ” অন্য দোকানে চল।”
” কেন?”
” আমার এখানে ভালো লাগছে না। ”

নিহান উঠে দাঁড়ালে সবাই তার দিকে তাকায়। শুভ্রতাও নিহানের সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজের বাড়ির সবাই তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কি করবে কেউ বুঝতে পারছে না। শুভ্রতা নিহানের হাত ধরে বলে,
” বসুন, আমরা শাড়ি দেখতে আর কিনতে এসেছে মানুষ দেখতে আসি নি।”
” কিন্তু শুভ্রা…”
” উহু, বসুন আপনি। আমি থাকতে পারলে আমি কেন পারবেন না?”

শুভ্রতার কথায় নিহান বসে পড়ে। শুভ্রতাও পাশের চেয়ার টেনে বসে। ইমতিয়াজ ও তার পরিবারের কারো মুখে কোন কথা নেই। তবে ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ পরপর শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে দেখছে।
শুভ্রতা মজার ফলে নিহানকে জিজ্ঞেস করে, ” আমি যদি আজকে অনেকগুলো শাড়ি নিই আপনি কি বিল দিতে পারবেন? ”
নিহান শুভ্রতার কথায় তার দিকে তাকায়। শুভতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি তো আমাকেই দিয়ে দিয়েছি তোকে, আমার যা আছে সবই তোর। অনেকগুলো শাড়ি নিবে বলছি? অনেকগুলো কেন পুরো দোকানেও যদি নিতে চাস তাহলে সেটাও আমি দিয়ে দেব। ছয় বছর ধরে চাকরি করছি, যা পেয়েছি সব ব্যাংকে তোলা আছে। কত টাকা আছে তোর হবু বরের বুঝতে পারছিস? তুই যা চাইবি তাই পাবি। ভাবিস না নিয়ে নে।”

নিহানের কথায় শুভ্রতা চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। এই লোকটা তাকে এত ভালবাসে কেন সেটাই তো বুঝতে পারেনা। একটা মানুষকে আরেকটা মানুষকে আসলেই এতো ভালবাসতে পারে!!
শুভ্রতা বেছে বেছে একটা সাদা আর একটা বেগুনী শাড়ি নিলো। শুভ্রতার বাবা বলে শুভ্রতাকে সাদা রঙে একদম শুভ্রপরী লাগে। কোনকিছু কিনতে গেলে বাবার পছন্দকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয় শুভ্রতা। শুভ্রতা দুটো শাড়ি নিয়েই নিহানকে বলে, ” এই দুটোই আমার পছন্দ হয়েছে। এই দুটো নেব।”

” কে যেন বলল অনেকগুলো শাড়ি নেবে?”
” ওটা তো মজা করে বলেছি।”
” আচ্ছা বসো একটু। দাদা ওই যে ওই পাশের নীল আর খয়েরী রঙের দুটো শাড়ি বের করুন তো দেখি।”
দোকানীকে উদ্দেশ্যে করে নিহান কথাটা বললে দোকানের ছেলেটা শাড়ি দুটো নামিয়ে দেয়। নিহান শাড়ি দুটো নেড়েচেড়ে দেখে। শাড়ি দুটো বেশ সুন্দর।

দোকানী একই শাড়ি কালো রঙেরও বের করে। শাড়িটা নিহানের সামনে রেখে বলে, ” এ রঙে শাড়িটাও কিন্তু দারুন, আপনার স্ত্রীকে দারুণ মানাবে। ”
দোকানী কথাটা বলতেই ইমতিয়াজ চোখ বড় বড় করে নিহান আর শুভ্রতার দিকে তাকায়।
নিহান শুভ্রতাকে বলে, ” এই শাড়িগুলো কেমন?”
” সুন্দর।”
” পছন্দ হয়? কোন রঙ বেশি পছন্দ?”
শুভ্রতা কিছু বলার আগেই দোকানী বলে, ” আরও রঙ আছে বের করব?”
নিহান বলে, ” হ্যাঁ বের করুন।”

নিহান আর শুভ্রতার সামনে আরও তিনটে শাড়ি রাখা হয় সবুজ, আকাশী আর গোলাপি রঙের। সামনে ছয়টা একই শাড়ি শুধু রঙ ভিন্ন। নিহান শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করে,” কোনটা বেশি ভালো লাগছে?”
” আমার তো আর শাড়ি লাগবে না, এই দুটোই হবে। আমি তো শাড়ি পরি না। ”
নিহান শুভ্রতার দিকে মুখ এগিয়ে এনে আস্তে আস্তে বলে, ” বিয়ের পর আমরা যখন একসাথে থাকব তখন প্রতিদিন শাড়ি পরতে হবে।”

নিহানের কথায় শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে যায়। সে বলে, ” তখন প্রতিদিন শাড়ি পরলে আর শাড়িতে ভালো লাগবে না।”
” তুই যেমন কোনদিন অপছন্দের তালিকায় যাবি না ঠিক তেমন শাড়িতে তুই কখনো খারাপ লাগা সৃষ্টি করতে পারবে না। এখন বল কোনটা ভালো লাগে?”
শুভ্রতা শাড়িগুলো ভালোভাবে দেখে বলে, ” সবুজ রঙ।”

ইমতিয়াজ সবার আড়ালে মনোযোগ শুভ্রতার ওপর রেখেছিল। শুভ্রতার সবুজ রঙ পছন্দ করায় সে অবাক হয়। সবুজ রঙ ইমতিয়াজের অপছন্দের হওয়ায় শুভ্রতার একটা শাড়ি বা কোন পোশাক সবুজ রঙের ছিল না। ইমতিয়াজ বুঝতে পারে না শুভ্রতার পছন্দের রঙের লিস্টে সবুজ ও আছে কি না! শুভ্রতা সারাক্ষণ বলতো সবুজ রঙ তারও অপছন্দ।
নিহান সবগুলো শাড়িই দিয়ে দিতে বলে। শুভ্রতা জিজ্ঞেস করে, ” শাড়ি পছন্দ করতে বলার পর এখন আবার সবগুলো কেন? ”

” পছন্দ করতে বললাম আপনার নিজের জন্য, সবুজ রঙের শাড়ি আপনার আর বাকিগুলো আবিরা, নেহা,স্নিগ্ধা,ইরা আর শাকিরার জন্য। তোদের সবার একই শাড়ি, সুন্দর না?”
” হ্যাঁ সুন্দর। আচ্ছা নিন।”
নিহান সব কয়েকটা শাড়ি নিয়ে নেয়। দুজন শাড়িগুলো নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে যায়। দুজন চলে গেলে ইমতিয়াজ সেটা তাকিয়ে দেখে আবার শাড়ি দেখায় মনোযোগ দেয়।

শুভ্রতা আর নিহান হাটছে, তখন রাত আটটা বেজে গিয়েছে। শুভ্রতার হাতের শপিং ব্যাগগুলো নিহান তার হাতে থেকে নিয়ে নেয়। শুভ্রতাও আর কিছু বলে না কারণ নারীকে কোনকিছু বহন করতে না দেওয়া সুপুরুষের লক্ষণ। শুভ্রতার হঠাৎ টাকার কথা মনে পড়তেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়। শুভ্রতার দাঁড়ানো দেখে নিহানও দাঁড়িয়ে যায়।
” কি হলো দাঁড়িয়ে গেলি কেন? পা ব্যথা করছে? আমি বললাম যে রিকশা নিই। ”
” থামুন তো, শুধু বেশি কথা বলেন আপনি।”
” আমি তোর সাহস দেখে অবাক হয়ে যাই, শত শত সেনাবাহিনী আমার আন্ডারে, আমার কথা শোনে আর তুই কথায় কথায় ধমক দিস।”

” কথা বেশি বললে ধমক তো খাবেনই। ”
নিহান আর কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে থাকে।শ্যভ্রতা ব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে নিহানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। নিহান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, ” কি?”
” টাকাগুলো নিন।”
” টাকা নিব কেন?”
” আমার টাকা লাগবে না৷ টাকা দিয়ে আর কি করব?”
” রেখে দে ওগুলো।”
” নাহ লাগবে না, নিন। চলুন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”
” হুম। ”

নিহান টাকাগুলো নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়। দুজন আবার হাটা শুরু করে দেয়। নিহান হাটতে হাটতে বলে, ” আজকের পর থেকে খুব প্রয়োজন না হলে আমাদের দুজনের একান্ত সময় কাটানো হবে না। তবে সবার সামনে আগের মতোই থাকব আমরা। কখনও প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবি আমাকে।”
” ঠিক আছে। তবে আজকের দিনটার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আজকের দিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি। আজকে যেমন কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছি ঠিক তেমন আমার মুখেও হাসি ফুটেছে, এর পুরো ক্রেডিট আপনার। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৮

” তুই আমার হবি তো শুভ্রা? আমার ভাগ্য কি আসলেই এত ভালো! আমার কেন যেন তোর সেদিনের কথাগুলো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।”
” আমি ডিভোর্সি একটা মেয়ে, তবুও আমাকে যদি আপনি আগের মতো ভালোবাসতে পারেন, যত্ন নিতে পারেন, বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারেন তাহলে আমি কেন আপনার থেকে আর পালিয়ে বেড়াবো!”
” আমি তোকে…..”
নিহানকে থামিয়ে দিয়ে শুভ্রতা আস্তে করে বলে ওঠে, “আমি জানি নিহান ভাই, আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০