শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৮

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৮
তানিয়া মাহি

শুভ্রতাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা উঠায় নিহান। পাঁচশো টাকার দুইটা মোটা বান্ডেলের মধ্যে থেকে একটা বান্ডেল সে নিজের হাতে রেখে একটা শুভ্রতার হাতে দেয়। নিহান কী করছে সেটা বুঝতে না পেরে নিহানকে প্রশ্ন করে,

” আমাকে টাকা দিচ্ছেন কেন নিহান ভাই?”
” এই টাকা তোর গিফট। কারণ জানতে চাইবি না, গিফট দেওয়ার কোন কারণ নেই। তোর আজকে এই টাকার মাঝে যা যা কেনার ইচ্ছে কিনে নিবি।”
” এখানে তো অনেক টাকা!”
” কিছু কিনতে গেলে অনেক টাকা মনে হবে না।”
” লোভ ধরিয়ে দিচ্ছেন। পরে যখন আমার অল্পতে পোষাবে না তখন কি করবেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আমিও চাইও না যে আমার ভালোবাসার মানুষের চাওয়া সীমিত হোক। তুই চাইবি, তোর যখন যা কিনতে ইচ্ছে হয় আমাকে বলবি, দেখবি সামর্থ্য থাকলে মুহূর্তের মধ্যে হাজির করব। আমার শুধু এই মানুষটাকেই লাগবে যে কী না আবদার করবে, বাচ্চাদের মতো আচরণ করবে আবার আমি ভুল করতে গেলে আমাকে বোঝাবে আমাকে অনেক ভালোবাসবে। জীবনে ভালো থাকতে হলে অনেককিছু লাগে না শুভ্রা।”
” হয়েছে হয়েছে, কথা বলার সুযোগ দিলেই স্কুলের হেড স্যারের মতো বক্তব্য শুরু করে দেয়।”
নিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” আমি আমার অনুভূতি জানালাম তোকে, আর তুই কী না হেড স্যারের বক্তব্যের সাথে তুলনা করলি?”

” এভাবেই দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে বেশি সময় নেই আর। আমার আর দুইটা পরিক্ষা হলেই বেঁচে যাই। রোজা থেকে আর পড়তেও হবে না, পরিক্ষাও দিতে হবে না বিন্দাস লাইফ।”
নিহান তার কাছে থাকা আরেকটা বান্ডেল থেকে আরও কিছু নোট শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দেয়। সে বলে,
” এগুলোও রাখ।”
” এত টাকা কেন আবার?”

” তোর মন ভালো করতে হবে না? আমরা এখন রিকশায় করে রেস্টুরেন্টে যাব। বাইক এখানেই এক পরিচিত ভাইয়ের দোকান আছে ওখানে রেখে যাই। রিকশাওয়ালাকে গাড়ি ভাড়া এই টাকার দুই তিনটা নোট দিবি দেখবি মনের মধ্যে অনেক ভালো লাগবে। রেস্টুরেন্টে খেয়ে কিছু টাকা বেশি দিবি টিপস হিসেবে দেখবি ওয়েটার খুশি হলে তুই ও খুশি হবি। এভাবে এই টাকাগুলো কিছু মানুষের মাঝে দিবি।”
শুভ্রতা বাহিরে বাহিরে ভালো আছে, স্বাভাবিক আছে দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চুড়মার হয়ে গিয়েছে কিন্তু সে চায় না এই বিষয়গুলো তার মনে চেপে বসুক আর তার কষ্টের মাত্রা বেড়ে যাক। সে নিজেকে ভালো রাখার জন্য এক প্রকার যু*দ্ধ করে যাচ্ছে নিজের সাথে।

” চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে চল, আর বেশি সময় নেই হাতে। ”
নিহানের কথায় কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। সে বলে, ” হ্যাঁ চলুন। ”
নিহান তার বাইক তার পরিচিত একটা লোকের দোকানের সামনে রেখে দুজন হাঁটা শুরু করে। কিছুদূর যেতেই দুজন মিলে একটা রিকশা নেয়। নিহান এবং শুভ্রতা রিক্সায় উঠে বসে।
” আমরা বাসায় কখন ফিরব? ”

শুভ্রতার প্রশ্নে নিহান জবাব দেয়, ” আমার সাথেই বাহিরে আছিস চিন্তার কোন কারণ নেই। আমার সাথে বাহিরে থাকলে তোর বাবা মা কিছু বলবেও না। ”
” ফোন করে জানিয়ে দিলে ভালো হতো না? বাবা তো চিন্তা করবে। ”
” এই চিন্তা আপনার করতে হবে না আমি আসার সময় বলে এসেছি আমাদের ফিরতে লেট হবে। ”
“ সব সময় একধাপ এগিয়েই থাকেন আপনি। ”
“ ভালো না? ”
“ হ্যাঁ খুব ভালো। ”

ইফতার করার পর নিহান এবং শুভ্রতা এসে বসেছে একটা মাঠে। এখানে সাধারণত মানুষ আসে স্ট্রিট ফুড খেতে। বিশেষ করে মেয়েরা যে খাবারগুলো পছন্দ করে সেগুলোর ব্যবস্থা করা হয় এখানে।
নিহান আর শুভ্রতা বসে ফুচকা আর ঝালমুড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। নিহান বসে ফোন টিপছে আর শুভ্রতা বসে টেবিল গুতোগুতি করছে। নিহান বলে ওঠে, “কি হয়েছে, এমন করছিস কেন?”
” ছয় মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড হয়ে গেছে তবু ফুসকা দিয়ে গেল না কেন? আর কত অপেক্ষা করতে হবে ফুসকার জন্য? আমার আর অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না। ”

” আমার ঝালমুড়িও তো দেয় নি আমি কি টেবিলে গুতোগুতি করছি?”
” আমি ফোন নিয়ে আসলে আমিও ফোন টিপতাম।”
নিহান কিছু না বলে মুচকি হেসে নিজের ফোনটা প্যান্টের পকেটে রাখে। একটা ঝালমুড়ি আর দুইটার ফুসকার প্লেট দেখে নিহান জিজ্ঞেস করে, ” দুইটা ফুসকার প্লেট কেন? আমি তো খাব না।”
শুভ্রতা খুশিতে দুই হাতের তালু একে অপরের সাথে ঘষতে ঘষতে বলে, ” আপনাকে খেতে বলেছে কে? এগুলো তো আমি খাব।”

” দুই প্লেট কোন পেটে আটাবি শুনি?”
” যে পেটে আটবে ওটাতেই আটাবো আপনার চিন্তা করতে হবে না।”
নিহান কিছু বলবে তখন শুভ্রতা হাত টেবিলে শব্দ করে রেখে বলে, ” থামুন, খাওয়ার সময় কোন কথা হবে না।”
” আনহেলদি খাবার একটু কম খেলেই হয়।”
” চুপ থাকুন তো, কতদিন ফুসকা খাই না! খাওয়ার সময় বেশি জ্ঞান দিলে কিন্তু ফু দিয়ে উড়িয়ে দেব।”
নিহান শব্দ করে হেসে ফেলে, ” কি! আমাকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিবি? পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি, পঁচাত্তর কেজি ওজনের মানুষ কী না তোর ফু তে উড়ে যাবে?”

” হ্যাঁ যাবে, এখন বসে বসে মুড়ি খান।”
শুভ্রতা একটা ফুসকা হাতে নিয়ে চামচ দিয়ে টক মিশিয়ে নেয়, টক গড়িয়ে গড়িয়ে প্লেটে পড়ছে। পুরোটা একেবারে মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিহান তাকিয়ে শুভ্রতার খাওয়া দেখছে। এই খাবারগুলো এত মজা করে খাওয়া যায়!
শুভ্রতা একের পর এক ফুসকা খেয়ে যাচ্ছে, শুভ্রতার খাওয়া দেখে এবার নিহানেরও খেতে ইচ্ছে করছে। শুভ্রতা এমনভাবে খেয়েছে দেখে মনে হয়েছে পৃথিবীর সেরা খাবার ফুসকা। শুভ্রতা প্লেটের শেষপিস মুখে নিয়ে নেয়। এখনো আস্ত একটা প্লেট পড়ে আছে। শুভ্রতা খাওয়া শেষ করে বলে, ” আমি আর খেতে পারব না।”
নিহান ঢোক গিলে বলে, ” বলেছিলাম তো দুই প্লেট খেতে পারবি না। সে নাকি দুই প্লেট খাবে! দে আমাকে দে প্লেট টা।”

” আপনি খাবেন? ”
” শুধু শুধু নষ্ট করে লাভ আছে নাকি?”
” অস্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন!”
” বেশি কথা না। ”
নিহান প্লেটটা নিবে তখন শুভ্রতা প্লেটটা টেনে ধরে। সেটা দেখে নিহান বলে, ” কি হলো?”
” আমি বানিয়ে দিচ্ছি, আপনি খান।”
” আচ্ছা ঠিক আছে।”

খাওয়া শেষ করে বিল দিতে যায় শুভ্রতা। দোকানদারকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট হাতে গুজে দিয়ে চলে আসতে দোকানদার ডাক দেয়। শুভ্রতা ফিরে আসে।
” কি হয়েছে চাচা?”
” মা, আপনাদের বিল তো একশো টাকা। আপনি হয়তো দুইটা পঞ্চাশ টাকা দিতে গিয়ে একশো টাকা দিয়েছেন।”
” না চাচা, দেখেই দিয়েছি। একশো টাকা বিল আর বাকি টাকা আপনার।”
” কিন্তু মা, আমি তো সাহায্য চাই নি।”
” এটা সাহায্য না চাচা, এটা মন ভালো করার ওষুধ বলতে পারেন। ”
” বুঝলাম না মা।”

শুভ্রতা নিহানকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ” ওই যে ওই লোকটাকে দেখছেন না? উনি আমার হবু স্বামী। অসম্ভব ভালোবাসেন আমাকে। আমার মন খারাপ উনি দেখতে পারেন না। আজ আমার মন খারাপ থাকায় তিনিই আমাকে টাকা দিয়ে এই রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন যে রাস্তায় আমার মন ভালো হবে।”
” আপনাদের মতো মানুষের বড় অভাব গো মা জননী। দোয়া করি আপনে আর বাপজান সারাজীবন হাসিখুশি থাকেন।”
” দোয়া করবেন চাচা, আমি আসছি তবে এখন।”
” আচ্ছা মা, আবার আসবেন কিন্তু।”
” জি অবশ্যই। ”

নিহান এবং শুভ্রতা পাশাপাশি হাটছে। শুভ্রতার মন অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। কোন বিপদ তাকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারে না। যে ব্যক্তি খুব বেশি বিপদে পড়ে তার কাছে হয়তো ভালো থাকাটাই অস্বাভাবিক মনে হয়। তারা খুব তাড়াতাড়ি খারাপ লাগা কাটিয়ে উঠতে পারে। শুভ্রতাকে দেখে কেউ বলতেই পারবে না গতকাল সে ওরকম একটা বিপদে পড়েছিল।
” ফুসকা কেমন ছিল নিহান ভাই?”

শুভ্রতার প্রশ্নে নিরবতা ভেঙে নিহান বলে, ” হ্যাঁ ভালো ছিল। তবে তোর খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল এটার স্বাদ তোর কাছে আরও বেশি ছিল। কি মজা করে খাচ্ছিলি তুই!”
” আমার খাওয়া দেখে আপনার খেতে ইচ্ছে করছিল তাই না?”
” মোটেও না। নষ্ট হবে জন্য খেয়েছি। ”
” মিথ্যে বলবেন না নিহান ভাই। আমি জানি আমার খাওয়া দেখে আপনার খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি এটা আগে থেকেই জানতাম। ছেলেরা ফুসকা নিয়ে যতই বাজে রিভিউ দিক না কেন এটার লোভ তারা সামলাতে পারে না। আর ওই প্লেটটা আপনার কথা ভেবেই অর্ডার করেছিলাম কারণ না খেতে পারলে আমার খাওয়ায় নজর লাগতো।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৭

কথাটা বলেই শুভ্রতা জোরে শব্দ করে হেসে দেয়। শুভ্রতা হাসলে তার গালের একপাশে গর্ত হয়ে যায়। যদিও মেডিকেলের ভাষায় এটা একটা রোগ তবে সাধারণ মানুষ একে টোল বলে। আর টোল শুভ্রতার হাসির সৌন্দর্য্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। হাসলে মেয়েটার চোখ ও ছোট হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা এত রূপ দিয়েছেন তাকে! নিহান এক পলকে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে তার প্রাণখোলা হাসি উপভোগ করছে। হাসির শব্দ বারবার নিহানের কানে লাগছে। এই মেয়ে নিশ্চিত মোহময়ী, ভুবনমোহিনী।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯